ঈদের বিক্রি নিয়ে খুশি নন ব্যবসায়ীরা

  • কমে গেছে ৩০ শতাংশ বিক্রি দাবি ব্যবসায়ীদের
  • দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ধানের দামের প্রভাব

ঈদের বাকি আর মাত্র ৭-৮ দিন। প্রতি বছর এ সময় পাইকারি ও খুচরা মার্কেটগুলোয় ঈদ বেচাবিক্রির ধুম থাকলেও এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। রাজধানীর পাইকারি ও খুচরাÑ কোন মার্কেটেই আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না। বিক্রেতারা বলছেন, গত বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বিক্রে কম এবার। কিছু ক্ষেত্রে বেচাবিক্রি অন্যান্য বছরের তুলনায় অর্ধেক বলেও জানান তারা। বিশেষ করে পোশাক ও আনুষঙ্গিক পণ্য বিক্রি বেশ কম হচ্ছে বলে বলছেন তারা। এমনকি আশানুরূপ বিক্রি হয়নি জাকাতের কাপড়ও। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথম ঈদ হচ্ছে বলে জাকাতের কাপড় ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করেছিলেন এবার ভালো বিক্রি হবে। কিন্তু শেষ সময় এসে হতাশায় দিন কাটছে তাদের।

ব্যবসায়িক মন্দার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতেই হিমসিম খাচ্ছে। ফলে তাদের ঈদ কেনাকাটা সীমিত হয়ে পড়েছে। এর উপর এবার গ্রামে কৃষক ধানের দাম না পাওয়ায় কেনাকাটায় তেমন উৎসাহ নেই। আর শহরে বিভিন্ন এলাকায় মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য সড়ক কাটাকুটি করে রাখার কারণে নগরবাসীর বাজারে যাওয়ার আগ্রহ কম। বিশ্লেষকরা বলছেন, জিনিসপত্রের দাম রোজার আগেই বেশ বেড়ে যাওয়ায় আগের মাসের বেতন চলে গেছে রোজার বাড়তি খরচ মেটাতে। আর চলতি মাসের বেতন দিয়ে ঈদের খরচ এবং ঈদের পর পরবর্তী বেতন পাওয়ার আগের দিনগুলোর সংসার খরচ চালাতে হবে। এসব সমীকরণ মিলিয়ে চাকরিজীবীরা রয়েছেন অর্থনৈতিক চাপে। এছাড়া যারা ব্যবসায়ী, তাদের অবস্থাও যে খুব ভালোÑ তা নয়। প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত ঈদের খরচ হাতে পায়নি। তবে অনেকে বলছেন, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি প্রক্রিয়াও একটা কারণ হতে পারে। কেননা মধ্যবিত্তদের একটা অংশের আয় চলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের ভর্তি ও ভর্তি-পরবর্তী আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে। এছাড়া চলমান দাবদাহও কিছু মানুষকে কেনাকাটায় নিরুৎসাহিত করছে। ফলে ঈদবাজারের যেটুকু না করলেই নয়, মানুষ শুধু সেটুকুই করছে। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে এমন চিত্রই ওঠে এসেছে।

দেশের বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার ইসলামপুর। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে বাড়ছে এ বাজারের পাইকারি দোকানের বেচাবিক্রিও। তবে শেষ মুহূর্তের বিক্রিতে খুশি নন এখানকার ব্যবসায়ীরা। গতকাল বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের কণ্ঠে পাওয়া গেল হতাশার সুর। এর পেছনে এই মৌসুমে কৃষকের ধানের কম দামপ্রাপ্তিকেই দায়ী করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকায় মূলত থানকাপড়ের পাইকারি বিক্রির জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে শাড়ি, থ্রি-পিস, লুঙ্গি, প্যান্ট, শার্ট ও পাঞ্জাবির কাপড়ের পাইকারি বিক্রি চলে সারা বছর। তবে খুচরাও বিক্রি হয় কোনো কোনো দোকানে। বেশ কয়েকটি দেশীয় বস্ত্র কারখানার উৎপাদিত কাপড়ের শোরুমও রয়েছে এখানে। এর পাশাপাশি থাইল্যান্ড, চীন, পাকিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কাপড়ের সমাহার রয়েছে এ মার্কেটে। দেশি থানকাপড়ের ৬০ শতাংশ ও বিদেশি থানকাপড়ের ৪০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় ইসলামপুরের এ কাপড়ের বাজারের মাধ্যমে। ঈদ মৌসুমে সেটি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এর মধ্যে রোজার ঈদে তাদের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। ঈদ মৌসুমে বিক্রি হয় মূলত তিন ভাগে। প্রথম ভাগে বিক্রি চলে রমজানের আগে, শবেবরাতের আগে-পরের সময়ে। প্রথম ধাপের বিক্রি শেষে বা পণ্যের স্টক শেষের দিকে এলে দ্বিতীয় ধাপের মূল বিক্রি শুরু হয় রোজার শুরুতে। শেষ ধাপে মূল বিক্রি চলে ১০ থেকে ১৫ রমজানের মধ্যে। এ সময় খুচরা ব্যবসায়ীরা মূলত কিছু ‘স্পেসিফিক’ পণ্যের খোঁজে এখানে আসেন। তবে এবার প্রথম ধাপ বাদ দিলে অন্য দুই ধাপের বিক্রিতে প্রত্যাশা মেটেনি পাইকারি ব্যবসায়ীদের। বরং অন্যান্য ঈদের তুলনায় এবার তা বেশ নাজুক বলেই জানান তারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ইসলামপুর থেকে ৯০ শতাংশ পাইকারি কাপড় যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সেসব এলাকার মানুষের মূল আয়ের উৎস কৃষিকাজ বা কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এবারের বোরো আবাদের পর ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় সেসব এলাকায় বিক্রি খুব একটা জমছে না। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের বিক্রি ভালো না হলে স্বাভাবিকভাবেই পাইকারি বাজারেও এর বড় প্রভাব পড়ে।

ইসলামপুরের খাদিজা ফ্যাব্রিকসের কর্নধার মো. শাহীন বলেন, ঈদ সামনে রেখে আমরা নিজেরা বিভিন্ন ডিজাইনের থ্রি-পিস তৈরি করি। এবার ৭০টি নতুন ডিজাইন দোকানে উঠিয়েছিলাম। শবেবরাতের পর বেচাকিনি শুরু হলেও পরে এর ধারাবাহিকতা ছিল না। স্বাভাবিকভাবে প্রতি বছর বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতারা শবেবরাত থেকে ২০ রোজা পর্যন্ত কয়েকবার মাল নিয়ে যায়। এবার তারা শবেবরাতের আগে একবার মাল নিয়ে গেছেন। এরপর আর তাদের মার্কেটে দেখা যায়নি। একই কথা জানান এখানকার এইচআর ট্রেডিংরে মালিক মঈন আহমেদ বাবু। তার দোকানে পাকিস্তানি সালোয়ার-কামিজ বিক্রি হয়। তিনি সংবাদকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কম।

ইসলামপুরের চায়না মার্কেটে নিপ্পন টেক্সটাইলের মালিক মো. ওসমান বলেন, আমাদের মতো পাইকারি দোকানগুলোয় বেচাকেনা হয় শবেবরাত থেকে ২০ রোজা পর্যন্ত। কিন্তু এবার ২ রোজাতেই বেচাকেনা কমে গেছে।

রাজধানীতে জাকাতের পোশাক যে কয়টি মার্কেটে পাইকারি বিক্রি হয়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পীর ইয়ামেনী মার্কেট। এ মার্কেটটির নিচতলায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়।

এ বিষয়ে কাজী শাড়ি হাউসের মো. জাহিদ বলেন, নির্বাচনের বছর হওয়ায় গত বছর জাকাতের কাপড় বেশ ভালো বিক্রি হয়েছিল। আমাদের ধারণা ছিল, এবারও বেশ ভালো বিক্রি হবে। বিক্রি পরিস্থিতি মোটামুটি হলেও আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই জাকাতের কাপড় বিক্রিতে এক ধরনের মন্দা ছিল। গত বছর নির্বাচন কেন্দ্র করে বেশ ভালো বিক্রি হয়। এবার এখন পর্যন্ত যা বিক্রি হয়েছে, তা গত বছরের অর্ধেকের সমান হবে না। ঈদের আগে আর যে কয়দিন বাকি আছে, এতে বিক্রি খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না।

গতকাল নয়াপল্টনের পলওয়েল মার্কেটে ঘুরে দেখা গেছে, কেনাবেচা চলছে ঢিমেতালে। নেই ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। অনেক দোকানদার বসে বসে ঝিমুতে দেখা যায়। এসবিএন গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী কবিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেচাকেনা অনেক কম। তারা যতটা আসা করেছিলেন, ওই তুলনায় বিক্রিবাট্টা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, গতবার প্রতিদিন দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকার কেনাবেচা হতো। কিন্তু এবার এক লাখ টাকাও হচ্ছে না। এমন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এতে মানুষ ঈদের কেনাকাটা করবে, নাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে। তবে আশা করছি কাল-পরশু থেকে বিক্রি কিছুটা বাড়তে পারে।

ওই মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা ইকবাল হোসেন বলেন, গতবার এ সময় মার্কেটে ঢোকায় যেত না। কিন্তু এবার অনেক ফাঁকা। দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যবিত্তদের মৌলিক চাহিদা মেটানোই দায় হয়ে পড়েছে। সেখানে ঈদের কেনাকাটা কীভাবে করবে। করলেও গতবারের চেয়ে অনেক কম করছে। আমিও গতবার পরিবারের জন্য প্রায় ১০ হাজার টাকার পণ্য কিনেছিলাম। এবার ৫ হাজার টাকার করতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছি।

জানা গেছে, চলতি বছর বোরো চাষ করে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ধানের উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম ধান বিক্রি করতে হচ্ছে বলে হতাশায় রয়েছেন তারা। ঈদের আনন্দ তাদের মধ্যে নেই। ধানের উৎপাদন খরচ বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকায়। প্রবাসের আয়ের ওপর নির্ভরশীলরা বলছেন, ঈদ খরচের টাকা এখনও অনেকে পাঠাননি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি মে মাসের ১৭ দিনে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১০০ কোটি ডলার। গত বছর মে মাসে মোট রেমিটেন্স এসেছিল ১৫০ কোটি ডলার। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাকি ১৪ দিনে গত বছরের চেয়ে বেশি রেমিটেন্স দেশে আসবে। তবুও তা দেশের মূল্যস্ফীতি ও মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির তুলনায় খুব বেশি হবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। কেননা আগের মাস এপ্রিলে রেমিটেন্স এসেছিল ১৪৩ কোটি ডলার। এর আগের মাসে ছিল আরেকটু বেশিÑ ১৪৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ বর্তমানে দেড়শ’ কোটি ডলার রেমিটেন্সের প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই থাকে।

এদিকে অর্থবছর প্রায় শেষ হওয়ায় উন্নয়ন কাজের তোড়জোড় লেগেছে সবখানে। এতে প্রতি বছরের মতো এবারও রাস্তাঘাট কেটে একাকার করে ফেলেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে রাজধানীতে এই অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। এর উপর মেট্রোরেলের কাজ চলায় তা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমই বের হচ্ছে বলে নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

একাদশ শ্রেণীতে ১২ মে থেকে শুরু হয়েছে ভর্তি প্রক্রিয়া। প্রাথমিকভাবে ২৩ মে ভর্তি শেষ হয়। ৩০ জুনের মধ্যে ভর্তির যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করে ক্লাস শুরু হবে। অনেকে মনে করছেন, ছেলেমেয়েদের ভালো কলেজে ভর্তি করতে মা-বাবার অনেক খরচ হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষার পর পরই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে কোচিং করার জন্য অনেক টাকা খরচ করে। এছাড়া ভর্তি-পরবর্তী আনুষঙ্গিক খরচও রয়েছে। সব মিলিয়ে ঈদ কেনাকাটায় তারা তেমন উৎসাহ পাচ্ছেন না।

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত মার্কেট মৌচাক। গতকাল এ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা কম। ফলে এক ধরনের অলস সময় কাটাচ্ছেন তারা। তাদের অনেকেই বলছেন, ক্রেতারা ইন্ডিয়ামুখী হওয়ায় বিক্রি কমেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, অনলাইন শপের কারণে মার্কেটগুলোয় এখন আগের মতো বিক্রির চাপ নেই।

ওই মার্কেটের দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর বিক্রয় কর্মীরা জানান, এ বছর ফুটপাথে দোকান না থাকালেও এই অঞ্চলে দেশীয় ব্র্যান্ডের শোরুম বা আউটলেটে ঈদের বিক্রির চাপ তেমন নেই।

সোমবার, ২৭ মে ২০১৯ , ১৩ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ২১ রমজান ১৪৪০

ঈদের বিক্রি নিয়ে খুশি নন ব্যবসায়ীরা

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

  • কমে গেছে ৩০ শতাংশ বিক্রি দাবি ব্যবসায়ীদের
  • দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও ধানের দামের প্রভাব

ঈদের বাকি আর মাত্র ৭-৮ দিন। প্রতি বছর এ সময় পাইকারি ও খুচরা মার্কেটগুলোয় ঈদ বেচাবিক্রির ধুম থাকলেও এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। রাজধানীর পাইকারি ও খুচরাÑ কোন মার্কেটেই আশানুরূপ বিক্রি হচ্ছে না। বিক্রেতারা বলছেন, গত বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বিক্রে কম এবার। কিছু ক্ষেত্রে বেচাবিক্রি অন্যান্য বছরের তুলনায় অর্ধেক বলেও জানান তারা। বিশেষ করে পোশাক ও আনুষঙ্গিক পণ্য বিক্রি বেশ কম হচ্ছে বলে বলছেন তারা। এমনকি আশানুরূপ বিক্রি হয়নি জাকাতের কাপড়ও। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথম ঈদ হচ্ছে বলে জাকাতের কাপড় ব্যবসায়ীরা প্রত্যাশা করেছিলেন এবার ভালো বিক্রি হবে। কিন্তু শেষ সময় এসে হতাশায় দিন কাটছে তাদের।

ব্যবসায়িক মন্দার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতেই হিমসিম খাচ্ছে। ফলে তাদের ঈদ কেনাকাটা সীমিত হয়ে পড়েছে। এর উপর এবার গ্রামে কৃষক ধানের দাম না পাওয়ায় কেনাকাটায় তেমন উৎসাহ নেই। আর শহরে বিভিন্ন এলাকায় মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য সড়ক কাটাকুটি করে রাখার কারণে নগরবাসীর বাজারে যাওয়ার আগ্রহ কম। বিশ্লেষকরা বলছেন, জিনিসপত্রের দাম রোজার আগেই বেশ বেড়ে যাওয়ায় আগের মাসের বেতন চলে গেছে রোজার বাড়তি খরচ মেটাতে। আর চলতি মাসের বেতন দিয়ে ঈদের খরচ এবং ঈদের পর পরবর্তী বেতন পাওয়ার আগের দিনগুলোর সংসার খরচ চালাতে হবে। এসব সমীকরণ মিলিয়ে চাকরিজীবীরা রয়েছেন অর্থনৈতিক চাপে। এছাড়া যারা ব্যবসায়ী, তাদের অবস্থাও যে খুব ভালোÑ তা নয়। প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত ঈদের খরচ হাতে পায়নি। তবে অনেকে বলছেন, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি প্রক্রিয়াও একটা কারণ হতে পারে। কেননা মধ্যবিত্তদের একটা অংশের আয় চলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের ভর্তি ও ভর্তি-পরবর্তী আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে। এছাড়া চলমান দাবদাহও কিছু মানুষকে কেনাকাটায় নিরুৎসাহিত করছে। ফলে ঈদবাজারের যেটুকু না করলেই নয়, মানুষ শুধু সেটুকুই করছে। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে এমন চিত্রই ওঠে এসেছে।

দেশের বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার ইসলামপুর। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে বাড়ছে এ বাজারের পাইকারি দোকানের বেচাবিক্রিও। তবে শেষ মুহূর্তের বিক্রিতে খুশি নন এখানকার ব্যবসায়ীরা। গতকাল বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের কণ্ঠে পাওয়া গেল হতাশার সুর। এর পেছনে এই মৌসুমে কৃষকের ধানের কম দামপ্রাপ্তিকেই দায়ী করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই এলাকায় মূলত থানকাপড়ের পাইকারি বিক্রির জন্য বিখ্যাত হলেও এখানে শাড়ি, থ্রি-পিস, লুঙ্গি, প্যান্ট, শার্ট ও পাঞ্জাবির কাপড়ের পাইকারি বিক্রি চলে সারা বছর। তবে খুচরাও বিক্রি হয় কোনো কোনো দোকানে। বেশ কয়েকটি দেশীয় বস্ত্র কারখানার উৎপাদিত কাপড়ের শোরুমও রয়েছে এখানে। এর পাশাপাশি থাইল্যান্ড, চীন, পাকিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কাপড়ের সমাহার রয়েছে এ মার্কেটে। দেশি থানকাপড়ের ৬০ শতাংশ ও বিদেশি থানকাপড়ের ৪০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় ইসলামপুরের এ কাপড়ের বাজারের মাধ্যমে। ঈদ মৌসুমে সেটি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এর মধ্যে রোজার ঈদে তাদের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। ঈদ মৌসুমে বিক্রি হয় মূলত তিন ভাগে। প্রথম ভাগে বিক্রি চলে রমজানের আগে, শবেবরাতের আগে-পরের সময়ে। প্রথম ধাপের বিক্রি শেষে বা পণ্যের স্টক শেষের দিকে এলে দ্বিতীয় ধাপের মূল বিক্রি শুরু হয় রোজার শুরুতে। শেষ ধাপে মূল বিক্রি চলে ১০ থেকে ১৫ রমজানের মধ্যে। এ সময় খুচরা ব্যবসায়ীরা মূলত কিছু ‘স্পেসিফিক’ পণ্যের খোঁজে এখানে আসেন। তবে এবার প্রথম ধাপ বাদ দিলে অন্য দুই ধাপের বিক্রিতে প্রত্যাশা মেটেনি পাইকারি ব্যবসায়ীদের। বরং অন্যান্য ঈদের তুলনায় এবার তা বেশ নাজুক বলেই জানান তারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ইসলামপুর থেকে ৯০ শতাংশ পাইকারি কাপড় যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সেসব এলাকার মানুষের মূল আয়ের উৎস কৃষিকাজ বা কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ততা। এবারের বোরো আবাদের পর ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় সেসব এলাকায় বিক্রি খুব একটা জমছে না। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের বিক্রি ভালো না হলে স্বাভাবিকভাবেই পাইকারি বাজারেও এর বড় প্রভাব পড়ে।

ইসলামপুরের খাদিজা ফ্যাব্রিকসের কর্নধার মো. শাহীন বলেন, ঈদ সামনে রেখে আমরা নিজেরা বিভিন্ন ডিজাইনের থ্রি-পিস তৈরি করি। এবার ৭০টি নতুন ডিজাইন দোকানে উঠিয়েছিলাম। শবেবরাতের পর বেচাকিনি শুরু হলেও পরে এর ধারাবাহিকতা ছিল না। স্বাভাবিকভাবে প্রতি বছর বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতারা শবেবরাত থেকে ২০ রোজা পর্যন্ত কয়েকবার মাল নিয়ে যায়। এবার তারা শবেবরাতের আগে একবার মাল নিয়ে গেছেন। এরপর আর তাদের মার্কেটে দেখা যায়নি। একই কথা জানান এখানকার এইচআর ট্রেডিংরে মালিক মঈন আহমেদ বাবু। তার দোকানে পাকিস্তানি সালোয়ার-কামিজ বিক্রি হয়। তিনি সংবাদকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কম।

ইসলামপুরের চায়না মার্কেটে নিপ্পন টেক্সটাইলের মালিক মো. ওসমান বলেন, আমাদের মতো পাইকারি দোকানগুলোয় বেচাকেনা হয় শবেবরাত থেকে ২০ রোজা পর্যন্ত। কিন্তু এবার ২ রোজাতেই বেচাকেনা কমে গেছে।

রাজধানীতে জাকাতের পোশাক যে কয়টি মার্কেটে পাইকারি বিক্রি হয়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পীর ইয়ামেনী মার্কেট। এ মার্কেটটির নিচতলায় শতাধিক প্রতিষ্ঠানে জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করা হয়।

এ বিষয়ে কাজী শাড়ি হাউসের মো. জাহিদ বলেন, নির্বাচনের বছর হওয়ায় গত বছর জাকাতের কাপড় বেশ ভালো বিক্রি হয়েছিল। আমাদের ধারণা ছিল, এবারও বেশ ভালো বিক্রি হবে। বিক্রি পরিস্থিতি মোটামুটি হলেও আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই জাকাতের কাপড় বিক্রিতে এক ধরনের মন্দা ছিল। গত বছর নির্বাচন কেন্দ্র করে বেশ ভালো বিক্রি হয়। এবার এখন পর্যন্ত যা বিক্রি হয়েছে, তা গত বছরের অর্ধেকের সমান হবে না। ঈদের আগে আর যে কয়দিন বাকি আছে, এতে বিক্রি খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না।

গতকাল নয়াপল্টনের পলওয়েল মার্কেটে ঘুরে দেখা গেছে, কেনাবেচা চলছে ঢিমেতালে। নেই ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়। অনেক দোকানদার বসে বসে ঝিমুতে দেখা যায়। এসবিএন গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী কবিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেচাকেনা অনেক কম। তারা যতটা আসা করেছিলেন, ওই তুলনায় বিক্রিবাট্টা নেই বললেই চলে। তিনি বলেন, গতবার প্রতিদিন দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকার কেনাবেচা হতো। কিন্তু এবার এক লাখ টাকাও হচ্ছে না। এমন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এতে মানুষ ঈদের কেনাকাটা করবে, নাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবে। তবে আশা করছি কাল-পরশু থেকে বিক্রি কিছুটা বাড়তে পারে।

ওই মার্কেটে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা ইকবাল হোসেন বলেন, গতবার এ সময় মার্কেটে ঢোকায় যেত না। কিন্তু এবার অনেক ফাঁকা। দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যবিত্তদের মৌলিক চাহিদা মেটানোই দায় হয়ে পড়েছে। সেখানে ঈদের কেনাকাটা কীভাবে করবে। করলেও গতবারের চেয়ে অনেক কম করছে। আমিও গতবার পরিবারের জন্য প্রায় ১০ হাজার টাকার পণ্য কিনেছিলাম। এবার ৫ হাজার টাকার করতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছি।

জানা গেছে, চলতি বছর বোরো চাষ করে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ধানের উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম ধান বিক্রি করতে হচ্ছে বলে হতাশায় রয়েছেন তারা। ঈদের আনন্দ তাদের মধ্যে নেই। ধানের উৎপাদন খরচ বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে ৮ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকায়। প্রবাসের আয়ের ওপর নির্ভরশীলরা বলছেন, ঈদ খরচের টাকা এখনও অনেকে পাঠাননি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি মে মাসের ১৭ দিনে দেশে রেমিটেন্স এসেছে ১০০ কোটি ডলার। গত বছর মে মাসে মোট রেমিটেন্স এসেছিল ১৫০ কোটি ডলার। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাকি ১৪ দিনে গত বছরের চেয়ে বেশি রেমিটেন্স দেশে আসবে। তবুও তা দেশের মূল্যস্ফীতি ও মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির তুলনায় খুব বেশি হবে না বলেই মনে করছেন অনেকে। কেননা আগের মাস এপ্রিলে রেমিটেন্স এসেছিল ১৪৩ কোটি ডলার। এর আগের মাসে ছিল আরেকটু বেশিÑ ১৪৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ বর্তমানে দেড়শ’ কোটি ডলার রেমিটেন্সের প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই থাকে।

এদিকে অর্থবছর প্রায় শেষ হওয়ায় উন্নয়ন কাজের তোড়জোড় লেগেছে সবখানে। এতে প্রতি বছরের মতো এবারও রাস্তাঘাট কেটে একাকার করে ফেলেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে রাজধানীতে এই অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। এর উপর মেট্রোরেলের কাজ চলায় তা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমই বের হচ্ছে বলে নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

একাদশ শ্রেণীতে ১২ মে থেকে শুরু হয়েছে ভর্তি প্রক্রিয়া। প্রাথমিকভাবে ২৩ মে ভর্তি শেষ হয়। ৩০ জুনের মধ্যে ভর্তির যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করে ক্লাস শুরু হবে। অনেকে মনে করছেন, ছেলেমেয়েদের ভালো কলেজে ভর্তি করতে মা-বাবার অনেক খরচ হয়ে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষার পর পরই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে কোচিং করার জন্য অনেক টাকা খরচ করে। এছাড়া ভর্তি-পরবর্তী আনুষঙ্গিক খরচও রয়েছে। সব মিলিয়ে ঈদ কেনাকাটায় তারা তেমন উৎসাহ পাচ্ছেন না।

রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত মার্কেট মৌচাক। গতকাল এ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার ক্রেতা কম। ফলে এক ধরনের অলস সময় কাটাচ্ছেন তারা। তাদের অনেকেই বলছেন, ক্রেতারা ইন্ডিয়ামুখী হওয়ায় বিক্রি কমেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, অনলাইন শপের কারণে মার্কেটগুলোয় এখন আগের মতো বিক্রির চাপ নেই।

ওই মার্কেটের দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর বিক্রয় কর্মীরা জানান, এ বছর ফুটপাথে দোকান না থাকালেও এই অঞ্চলে দেশীয় ব্র্যান্ডের শোরুম বা আউটলেটে ঈদের বিক্রির চাপ তেমন নেই।