জঙ্গিবাদ দমনে ৭ দফা প্রস্তাবনা নির্মূল কমিটির

সরকার ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে

জঙ্গি দমনের পাশাপাশি জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মূল করার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের জন্য ৭ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সংগঠনটি জানায়, জঙ্গিবাদ আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করতে হলে সরকার ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘বাংলাদেশে আইএসের নতুন হুমকি ও কার্যক্রম : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন সংগঠনের সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।

সংবাদ সম্মেলনে নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি ও শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি মাহবুবুর রশীদ, শহীদ জায়া সালমা হক, সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, জঙ্গি সমস্যা শুধুু বাংলাদেশের নয়। জঙ্গি ও মৌলবাদ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেসব দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তারা এটিকে মাফিয়াদের মতো নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা মনে করছে। তা শক্তি প্রয়োগ করে নির্মূল করা সম্ভব। তিনি বলেন, জঙ্গিদের আদর্শ নির্মূল না করে শুধু মাঠপর্যায়ে কিছু খুচরো জঙ্গি হত্যা বা গ্রেফতার কিংবা তাদের আস্তানা ধ্বংস করে নিশ্চিন্ত বোধ করলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে যাবে। আর এ পর্যন্ত ৫৭ ধারায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা লেখক বা ব্লগার। কোনো মোল্লা বা ওয়াজকারী একজনও এ ধারায় গ্রেফতার হয়নি।

শাহরিয়ার কবির বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আইএস’ ও ‘আল কায়েদা’, ইরাক এবং সিরিয়ায় জিহাদ করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ২০১৭ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের পরবর্তী তৎপরতার কেন্দ্র হবে আরব মানচিত্রের হিন্দুস্থানÑ বর্তমানে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। ২০১৬ সাল থেকে তারা হাদিসের কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, কেয়ামতের আগে শেষ জিহাদ হবে হিন্দুস্থানের জমিনে। এটি তাদের ভাষায় ‘গাজওয়ায়ে হিন্দ’। এর প্রস্তুতি কীভাবে নিতে ও প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে হবে, এর উল্লেখ আইএস এবং আল কায়েদার প্রকাশনা ও তাদের নেতারাসহ এ দেশীয় সহযোগীদের বিভিন্ন ওয়াজ-জলসার বক্তব্যে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে খেয়াল করছি। তিনি বলেন, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য প্রদর্শন করেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত কয়েক বছরে জঙ্গিদের বহু আস্তানা ধ্বংস করেছে। তাদের বহু হামলার চক্রান্ত ও উদ্যোগ নস্যাৎ করা হয়েছে। অনেক জঙ্গি ক্রসফায়ারে নিহত ও গ্রেফতার হয়েছে। জঙ্গি ও মৌলবাদী সন্ত্রাসের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র ঘোষণা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। তবে এ কথা আমরা বার বার বলছি- জঙ্গি দমনই যথেষ্ট নয়, জঙ্গিদের আদর্শ ও রাজনীতি তথা ‘মওদুদীবাদ’ ও ‘ওয়াহাবিবাদ’-এর রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে নির্মূলের কোন সমন্বিত কার্যক্রম কোথাও দেখছি না।

বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে জঙ্গি ও মৌলবাদ সন্ত্রাসের অন্যতম উৎস হতে পারে বলে মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী জনবিচ্ছিন্ন এবং কোণঠাসা হয়ে তাদের বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভেতরে জিহাদি জজবা সৃষ্টির জন্য বহুমাত্রিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। ২০০৫ সালে জামায়াত-বিএনপির জামানায় আমরা বাংলাদেশের ১২৫টি জঙ্গি মৌলবাদ সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা প্রস্তুত করেছিলাম। এর ভেতর ১৭টি ছিল রোহিঙ্গাদের। ২০১৭ সাল থেকে বিপুল পরিমাণে রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন ঘটার পর আমরা তদন্ত করে রোহিঙ্গা শিবিরে এ পর্যন্ত ৩৯টি জঙ্গি রোহিঙ্গা সংগঠনের সন্ধান পেয়েছি। সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে যেহেতু শক্তিশালী কোন বিরোধী দল নেই। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং সরকার ও গণপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন কার্যক্রমের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন উদ্যোগকে আরও সক্রিয়ভাবে পালন করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, যারা ধর্মীয় বক্তব্যের আড়ালে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধি ও ৫৭ ধারায় বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, তাদের এখনও শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এসব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে হাইকোর্টের রুল জারি করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে যদি কেউ নিযুক্ত থাকেন, তার বিরুদ্ধে প্রত্যন্ত গ্রামে কেউ একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লিখলে- তাহলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও এমন অনেক কিছুই আছেÑ যা সরানো প্রয়োজন এবং তাদের বলা উচিত কী ধরনের পোস্ট গ্রহণ করা হবে না। তিনি বলেন, আমেরিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যদি পদ্মা সেতু হয়, তাহবে ফেসবুক-ইউটিউবকে বার বার বলা সত্ত্বেও কেন এগুলো বন্ধ হচ্ছে না? সরকারের সময় এসেছে পদক্ষেপ নেয়ার। এ বিষয়ে আমাদের দুই মন্ত্রী আছেন। তারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেটিও আমাদের জানা দরকার। কেননা পরিস্থিতি যা এসেছে, এতে মনে হয় না খুব দ্রুত মৌলবাদ থেকে আমরা বের হতে পারব।

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ওয়াজ মাহফিল, ইউটিউবে একশ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী মেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন কটূক্তি করে। সমাজে এসবের কারণে মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এসব দমন না করলে এ দেশের মেয়েরা স্বাধীনচেতা হিসেবে বেড়ে উঠতে পারবে না।

মাহবুবুর রশীদ বলেন, আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কত ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। নাসিরনগরের রসরাজ দাসকে মিথ্যা মামলা নিয়ে তিন বছর লড়াই করতে হচ্ছে। রামুতে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

নির্মূল কমিটির প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রযেছে সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী ধর্মের নামে রাজনীতি অবিলম্বে নিষিদ্ধ করা; ওয়াজ ও খুৎবার নামে যারা শান্তি এবং সহমর্মিতার ধর্ম ইসলামকে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের সমার্থক বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত, সেসব ব্যক্তিকে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার এবং শাস্তির আওতায় আনা; ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে অবিলম্বে সব ঘৃণা-বিদ্বেষ ও উন্মাদনা সৃষ্টিকারী প্রচারণা বন্ধ করা এবং প্রচারকদের শাস্তির আওতায় আনা। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের নেতাদের প্রতি আহ্বান- জঙ্গি, মৌলবাদী ও সন্ত্রাসীদের সব কার্যক্রমের ওপর নজরদারি রাখুন এবং মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা; মওদুদীবাদী মোল্লাদের আপত্তির কারণে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সময়সূচি নিয়ন্ত্রণ কিংবা চিরায়ত গ্রামীণ মেলার শান্তিপূর্ণ আয়োজনের ওপর বিধি-নিষেধ জারি কোনোভাবে কাম্য নয়। প্রশাসনের এ ধরনের কার্যক্রম সমাজে অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও উগ্রতা সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক। তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে মানবিক ও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি সব শিক্ষা মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করাসহ মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত গাওয়া বাধ্যতামূলক করা।

সোমবার, ২৭ মে ২০১৯ , ১৩ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ২১ রমজান ১৪৪০

জঙ্গিবাদ দমনে ৭ দফা প্রস্তাবনা নির্মূল কমিটির

সরকার ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

জঙ্গি দমনের পাশাপাশি জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্মূল করার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজের জন্য ৭ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সংগঠনটি জানায়, জঙ্গিবাদ আদর্শিকভাবে মোকাবিলা করতে হলে সরকার ও নাগরিক সমাজকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে ‘বাংলাদেশে আইএসের নতুন হুমকি ও কার্যক্রম : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন সংগঠনের সভাপতি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির।

সংবাদ সম্মেলনে নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি ও শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি মাহবুবুর রশীদ, শহীদ জায়া সালমা হক, সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, জঙ্গি সমস্যা শুধুু বাংলাদেশের নয়। জঙ্গি ও মৌলবাদ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যেসব দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, তারা এটিকে মাফিয়াদের মতো নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা মনে করছে। তা শক্তি প্রয়োগ করে নির্মূল করা সম্ভব। তিনি বলেন, জঙ্গিদের আদর্শ নির্মূল না করে শুধু মাঠপর্যায়ে কিছু খুচরো জঙ্গি হত্যা বা গ্রেফতার কিংবা তাদের আস্তানা ধ্বংস করে নিশ্চিন্ত বোধ করলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে যাবে। আর এ পর্যন্ত ৫৭ ধারায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারা লেখক বা ব্লগার। কোনো মোল্লা বা ওয়াজকারী একজনও এ ধারায় গ্রেফতার হয়নি।

শাহরিয়ার কবির বলেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত সন্ত্রাসী সংগঠন ‘আইএস’ ও ‘আল কায়েদা’, ইরাক এবং সিরিয়ায় জিহাদ করতে গিয়ে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ২০১৭ সালেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের পরবর্তী তৎপরতার কেন্দ্র হবে আরব মানচিত্রের হিন্দুস্থানÑ বর্তমানে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। ২০১৬ সাল থেকে তারা হাদিসের কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, কেয়ামতের আগে শেষ জিহাদ হবে হিন্দুস্থানের জমিনে। এটি তাদের ভাষায় ‘গাজওয়ায়ে হিন্দ’। এর প্রস্তুতি কীভাবে নিতে ও প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে হবে, এর উল্লেখ আইএস এবং আল কায়েদার প্রকাশনা ও তাদের নেতারাসহ এ দেশীয় সহযোগীদের বিভিন্ন ওয়াজ-জলসার বক্তব্যে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে খেয়াল করছি। তিনি বলেন, ২০১৬ সালের জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংসভাবে হত্যাকান্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য প্রদর্শন করেছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত কয়েক বছরে জঙ্গিদের বহু আস্তানা ধ্বংস করেছে। তাদের বহু হামলার চক্রান্ত ও উদ্যোগ নস্যাৎ করা হয়েছে। অনেক জঙ্গি ক্রসফায়ারে নিহত ও গ্রেফতার হয়েছে। জঙ্গি ও মৌলবাদী সন্ত্রাসের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র ঘোষণা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়েছে। তবে এ কথা আমরা বার বার বলছি- জঙ্গি দমনই যথেষ্ট নয়, জঙ্গিদের আদর্শ ও রাজনীতি তথা ‘মওদুদীবাদ’ ও ‘ওয়াহাবিবাদ’-এর রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে নির্মূলের কোন সমন্বিত কার্যক্রম কোথাও দেখছি না।

বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে জঙ্গি ও মৌলবাদ সন্ত্রাসের অন্যতম উৎস হতে পারে বলে মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী জনবিচ্ছিন্ন এবং কোণঠাসা হয়ে তাদের বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভেতরে জিহাদি জজবা সৃষ্টির জন্য বহুমাত্রিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। ২০০৫ সালে জামায়াত-বিএনপির জামানায় আমরা বাংলাদেশের ১২৫টি জঙ্গি মৌলবাদ সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা প্রস্তুত করেছিলাম। এর ভেতর ১৭টি ছিল রোহিঙ্গাদের। ২০১৭ সাল থেকে বিপুল পরিমাণে রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন ঘটার পর আমরা তদন্ত করে রোহিঙ্গা শিবিরে এ পর্যন্ত ৩৯টি জঙ্গি রোহিঙ্গা সংগঠনের সন্ধান পেয়েছি। সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে যেহেতু শক্তিশালী কোন বিরোধী দল নেই। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এবং সরকার ও গণপ্রতিনিধিদের বিভিন্ন কার্যক্রমের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন উদ্যোগকে আরও সক্রিয়ভাবে পালন করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, যারা ধর্মীয় বক্তব্যের আড়ালে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধি ও ৫৭ ধারায় বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, তাদের এখনও শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এসব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে হাইকোর্টের রুল জারি করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে যদি কেউ নিযুক্ত থাকেন, তার বিরুদ্ধে প্রত্যন্ত গ্রামে কেউ একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লিখলে- তাহলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও এমন অনেক কিছুই আছেÑ যা সরানো প্রয়োজন এবং তাদের বলা উচিত কী ধরনের পোস্ট গ্রহণ করা হবে না। তিনি বলেন, আমেরিকাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যদি পদ্মা সেতু হয়, তাহবে ফেসবুক-ইউটিউবকে বার বার বলা সত্ত্বেও কেন এগুলো বন্ধ হচ্ছে না? সরকারের সময় এসেছে পদক্ষেপ নেয়ার। এ বিষয়ে আমাদের দুই মন্ত্রী আছেন। তারা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেটিও আমাদের জানা দরকার। কেননা পরিস্থিতি যা এসেছে, এতে মনে হয় না খুব দ্রুত মৌলবাদ থেকে আমরা বের হতে পারব।

শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, ওয়াজ মাহফিল, ইউটিউবে একশ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ী মেয়েদের নিয়ে বিভিন্ন কটূক্তি করে। সমাজে এসবের কারণে মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েই চলেছে। এসব দমন না করলে এ দেশের মেয়েরা স্বাধীনচেতা হিসেবে বেড়ে উঠতে পারবে না।

মাহবুবুর রশীদ বলেন, আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কত ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। নাসিরনগরের রসরাজ দাসকে মিথ্যা মামলা নিয়ে তিন বছর লড়াই করতে হচ্ছে। রামুতে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

নির্মূল কমিটির প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রযেছে সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী ধর্মের নামে রাজনীতি অবিলম্বে নিষিদ্ধ করা; ওয়াজ ও খুৎবার নামে যারা শান্তি এবং সহমর্মিতার ধর্ম ইসলামকে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের সমার্থক বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত, সেসব ব্যক্তিকে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার এবং শাস্তির আওতায় আনা; ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে অবিলম্বে সব ঘৃণা-বিদ্বেষ ও উন্মাদনা সৃষ্টিকারী প্রচারণা বন্ধ করা এবং প্রচারকদের শাস্তির আওতায় আনা। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন, গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের নেতাদের প্রতি আহ্বান- জঙ্গি, মৌলবাদী ও সন্ত্রাসীদের সব কার্যক্রমের ওপর নজরদারি রাখুন এবং মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা; মওদুদীবাদী মোল্লাদের আপত্তির কারণে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সময়সূচি নিয়ন্ত্রণ কিংবা চিরায়ত গ্রামীণ মেলার শান্তিপূর্ণ আয়োজনের ওপর বিধি-নিষেধ জারি কোনোভাবে কাম্য নয়। প্রশাসনের এ ধরনের কার্যক্রম সমাজে অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও উগ্রতা সৃষ্টির পক্ষে সহায়ক। তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে মানবিক ও যুগোপযোগী করার পাশাপাশি সব শিক্ষা মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করাসহ মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত গাওয়া বাধ্যতামূলক করা।