আজ চার্জশিট পেশ ১৬ জন অভিযুক্ত

সবার মৃত্যুদন্ডের আবেদন পিবিআইর

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ আদালতে চার্জশিট জমা দিচ্ছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অন্য যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলো- নুসরাত হত্যায় অংশ নেয়া মাদ্রাসাছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামিম, পৌর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আল কাউন্সিলর, সাইফুর রহমান, মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে শাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মেল সুলতানা পপি ওরফে তুহিন ওরফে সম্পা ওরফে চম্পা, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামিম, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভপাতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন, মহিউদ্দিন শাকিল। চার্জশিটে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়ার আবেদন করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা। ৭২২ পৃষ্ঠার এ চার্জশিটে আসামিদের কার কী ভূমিকা ছিল, কিভাবে হত্যা করা হয়, কেন হত্যা করা হয়েছে, সবকিছু বিস্তারিত উল্লেখ করেছে পিবিঅআই। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে, এ মামলার আসামিরা কেউ ছাড় পাবে না। বিচার চলাকালে আদালতে সব আসামি উপস্থিত থেকে নিজ চোখে তাদের বিচার দেখবে। আমরা পেরেছি। ঘটনায় অভিযুক্ত প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা উল্লেখ করে মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। মাদ্রাসার অর্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং যৌন হয়রানির মতো নানা অপকর্মের সঙ্গে ১৬ জনের একে অপরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। এই অপকর্মের বিরুদ্ধে নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাই ১৬ জনের প্রত্যেকে সুচিন্তিতভাবে সুস্থ মস্তিষ্কে এ হত্যাকান্ড ঘটায়। ঠান্ডা মাথায় এই হত্যায় চারটি শ্রেণী পেশার মানুষকে অংশ নিতে দেখা যায়। শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং শিক্ষার্থী। খুনের পর ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষাও যে দেয়া সম্ভব তা ভাবনাতীত। আসামিরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ডিআইজি বলেন, ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী ও পরীক্ষার্থী নুসরাত রাফিকে ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষা চলাকালে সাইক্লোন সেল্টারে ডেকে নিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ১০ এপ্রিল মামলার তদন্তে দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নুসরাতকে হত্যায় ১৬ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তদন্তে। হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ৯২ জনের সাক্ষী নিয়েছে পিবিআই। এর মধ্যে ইতোমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিসহ সাক্ষ্য দিয়েছে ৭ জন। হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া ১৬ জনের মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১২ জন আদালতে হত্যার দ্বায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।

ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে মাদ্রাসায় কী ধরনের অপকর্ম হতো, এর সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, কাদের লাভ ছিল, কাদের ক্ষতি হয়েছে এর আদ্যোপান্ত সবই বের করেছে পিবিআই। আজ চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। চার্জশিটে আসামিদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেয়ার জন্য আদালতে তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। আমরা আসামিদের প্রত্যেকের অপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। মামলার বিচারকার্যে আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য যে ধরনের আলামত ও সাক্ষ-প্রমাণ প্রয়োজন সবই সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছি। আশা করি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড রায় দিবে আদালত।

নুসরাত হত্যায় অভিযুক্ত

১৬ জনের কার কী ভূমিকা ছিল

এসএম সিরাজ উদ দৌলা : হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও এর চেয়ে বেশি করেছেন। তার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাতে কাজ না হলে নুসরাতকে ভয়-ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা দেন তিনি। কিভাবে হত্যা করতে হবে তারও নির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনাও দেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার পরামর্শও দেন তিনি।

নুর উদ্দিন : হত্যাকান্ডের আগে যে কক্ষে বোরখা রাখা ছিল, সেটি পরিদর্শন করে আসেন তিনি। ঘটনার সময় ভবনের নিচের পরিস্থিতিটা খুব চতুরতার সঙ্গে সামলে নেন। পুরোটা সময় নাটকের মতো চিত্রায়ন করতে সহায়তা করেন।

শাহাদাত হোসেন শামীম : হত্যাকান্ডের আগে পরিকল্পনার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শামীম। কিভাবে কে কী করবে তার পুরো পরিকল্পনা সাজান শামীম। তিনি কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেন। যে টাকা দিয়ে বোরখা ও কেরোসিন কেনা হয়। তার জবানবন্দি অনুযায়ী পরে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাস উদ্ধার করা হয়।

মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর : ২৮ মার্চ সিরাজের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন তিনি। শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে না থাকলে আইসিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেয়ার হুমকি দিতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন। হত্যাকান্ডের জন্য তিনি ১০ হাজার টাকা দেন। ঘটনার সবকিছু জানলেও ঘটনার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ফেনীতে অবস্থান করছিলেন তিনি।

সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের : তিনি ঘটনাস্থলে নুসরাতকে শোয়ানোর পর পা বেঁধে দেন। নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢালার পর শামীমের নির্দেশে নিজের সঙ্গে থাকা ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন : তিনি নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালেন। নুসরাতকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে খুবই ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে চলে যান। পরে চিৎকার শুনে ছুটে এসে নুসরাতকে দেখতে যান, এমন ভাব করেন যেন কিছু জানেন না।

হাফেজ আবদুল কাদের : তিনি নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু। ঘটনার সময় মেইন গেটের বাইরে পাহারায় ছিলেন। নুসরাত পরীক্ষার হলে ঠিকমতো পৌঁছেছে কি-না, ভাই নোমান দেখতে চাইলে কাদের তাকে বাধা দেন। কাদেরের কাছে নুসরাতের বিষয় জানতে চাইলে কাদের জানান, ২ মিনিট পর জানাচ্ছি। পরে তিনি জানান, নুসরাত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

আবছার উদ্দিন : ঘটনার সময় তিনি গেট পাহারার দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও মামলার বাদীকে ফোন করে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন।

কামরুন নাহার মনি : শামীম তাকে ২ হাজার টাকা দিয়ে বোরখা ম্যানেজ করতে বলেন। এ টাকায় ২টি বোরখা ও হাতমোজা কেনেন। কেনা ২টি বোরখাসহ তার নিজের কাছ থেকে একটি মিলিয়ে মোট তিনটি বোরখা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় রেখে আসেন। ছাদে ওঠানোর পর নুসরাতকে শুইয়ে ফেলতে সহায়তা করেন এবং বুকের উপর চাপ দিয়ে ধরে রাখেন। ঘটনার পর ঠান্ডা মাথায় এসে তিনিও পরীক্ষায় অংশ নেন।

উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা : নুসরাতকে ছাদে ওঠানোর পর মামলা তুলে নিতে প্রথমে চাপ দেন তিনি। রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ের ওড়নাটি বের করেন পপি। এরপর ওড়নাটি ২ ভাগ করে দেন, যা দিয়ে নুসরাতে হাত ও পা বাঁধা হয়। নুসরাতের হাত পেছন দিকে বাঁধার পর কেরোসিন ঢালার গ্লাসটি নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দেয়। যাতে বোঝা যায় নুসরাত আত্মহত্যা করেছে।

আবদুর রহিম শরীফ : তিনি বাইরের গেটে পাহারায় ছিলেন। নুসরাতের ভাই ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেন তিনি।

ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন ও মহিউদ্দিন শাকিল : তারা গেটে পাহারায় ছিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক বুঝাতে যা যা করণীয় তা করছিলেন তারা।

মোহাম্মদ শামীম : তিনি প্রথমে পপির সঙ্গে ভবনটির গেটে পাহারায় ছিলেন। যাতে কেউ সে সময় ভবনে উঠতে না পারে এবং এর ফলে অন্য কাউকে খুন করতে না হয় সেজন্য সতর্ক ছিলেন তিনি।

রুহুল আমিন : ঘটনার পর মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে পুলিশ-প্রশাসন সবকিছু ম্যানেজ করার আশ্বাস দেন তিনি। হত্যাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করেন। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে দুই দফা ফোনে কথা বলে সবকিছু নিশ্চিত হন।

বুধবার, ২৯ মে ২০১৯ , ১৫ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ২৩ রমজান ১৪৪০

আজ চার্জশিট পেশ ১৬ জন অভিযুক্ত

সবার মৃত্যুদন্ডের আবেদন পিবিআইর

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট চূড়ান্ত করা হয়েছে। আজ আদালতে চার্জশিট জমা দিচ্ছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অন্য যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলো- নুসরাত হত্যায় অংশ নেয়া মাদ্রাসাছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামিম, পৌর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আল কাউন্সিলর, সাইফুর রহমান, মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে শাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মেল সুলতানা পপি ওরফে তুহিন ওরফে সম্পা ওরফে চম্পা, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামিম, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভপাতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন, মহিউদ্দিন শাকিল। চার্জশিটে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়ার আবেদন করেছে তদন্তকারী কর্মকর্তা। ৭২২ পৃষ্ঠার এ চার্জশিটে আসামিদের কার কী ভূমিকা ছিল, কিভাবে হত্যা করা হয়, কেন হত্যা করা হয়েছে, সবকিছু বিস্তারিত উল্লেখ করেছে পিবিঅআই। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যে, এ মামলার আসামিরা কেউ ছাড় পাবে না। বিচার চলাকালে আদালতে সব আসামি উপস্থিত থেকে নিজ চোখে তাদের বিচার দেখবে। আমরা পেরেছি। ঘটনায় অভিযুক্ত প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা উল্লেখ করে মামলার চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে। মাদ্রাসার অর্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় এবং যৌন হয়রানির মতো নানা অপকর্মের সঙ্গে ১৬ জনের একে অপরের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। এই অপকর্মের বিরুদ্ধে নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাই ১৬ জনের প্রত্যেকে সুচিন্তিতভাবে সুস্থ মস্তিষ্কে এ হত্যাকান্ড ঘটায়। ঠান্ডা মাথায় এই হত্যায় চারটি শ্রেণী পেশার মানুষকে অংশ নিতে দেখা যায়। শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং শিক্ষার্থী। খুনের পর ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষাও যে দেয়া সম্ভব তা ভাবনাতীত। আসামিরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ডিআইজি বলেন, ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী ও পরীক্ষার্থী নুসরাত রাফিকে ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষা চলাকালে সাইক্লোন সেল্টারে ডেকে নিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ১০ এপ্রিল মামলার তদন্তে দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নুসরাতকে হত্যায় ১৬ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে তদন্তে। হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ৯২ জনের সাক্ষী নিয়েছে পিবিআই। এর মধ্যে ইতোমধ্যে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিসহ সাক্ষ্য দিয়েছে ৭ জন। হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া ১৬ জনের মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজসহ ১২ জন আদালতে হত্যার দ্বায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।

ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে মাদ্রাসায় কী ধরনের অপকর্ম হতো, এর সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, কাদের লাভ ছিল, কাদের ক্ষতি হয়েছে এর আদ্যোপান্ত সবই বের করেছে পিবিআই। আজ চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। চার্জশিটে আসামিদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেয়ার জন্য আদালতে তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। আমরা আসামিদের প্রত্যেকের অপরাধ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। মামলার বিচারকার্যে আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য যে ধরনের আলামত ও সাক্ষ-প্রমাণ প্রয়োজন সবই সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছি। আশা করি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড রায় দিবে আদালত।

নুসরাত হত্যায় অভিযুক্ত

১৬ জনের কার কী ভূমিকা ছিল

এসএম সিরাজ উদ দৌলা : হত্যাকান্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও এর চেয়ে বেশি করেছেন। তার বিরুদ্ধে নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। তাতে কাজ না হলে নুসরাতকে ভয়-ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে নুসরাতকে হত্যার নির্দেশনা দেন তিনি। কিভাবে হত্যা করতে হবে তারও নির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনাও দেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার পরামর্শও দেন তিনি।

নুর উদ্দিন : হত্যাকান্ডের আগে যে কক্ষে বোরখা রাখা ছিল, সেটি পরিদর্শন করে আসেন তিনি। ঘটনার সময় ভবনের নিচের পরিস্থিতিটা খুব চতুরতার সঙ্গে সামলে নেন। পুরোটা সময় নাটকের মতো চিত্রায়ন করতে সহায়তা করেন।

শাহাদাত হোসেন শামীম : হত্যাকান্ডের আগে পরিকল্পনার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শামীম। কিভাবে কে কী করবে তার পুরো পরিকল্পনা সাজান শামীম। তিনি কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেন। যে টাকা দিয়ে বোরখা ও কেরোসিন কেনা হয়। তার জবানবন্দি অনুযায়ী পরে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাস উদ্ধার করা হয়।

মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর : ২৮ মার্চ সিরাজের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন তিনি। শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে না থাকলে আইসিটি পরীক্ষায় নম্বর কম দেয়ার হুমকি দিতে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দেন। হত্যাকান্ডের জন্য তিনি ১০ হাজার টাকা দেন। ঘটনার সবকিছু জানলেও ঘটনার সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ফেনীতে অবস্থান করছিলেন তিনি।

সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের : তিনি ঘটনাস্থলে নুসরাতকে শোয়ানোর পর পা বেঁধে দেন। নুসরাতের শরীরে কেরোসিন ঢালার পর শামীমের নির্দেশে নিজের সঙ্গে থাকা ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন।

জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন : তিনি নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢালেন। নুসরাতকে আগুন ধরিয়ে দিয়ে খুবই ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে চলে যান। পরে চিৎকার শুনে ছুটে এসে নুসরাতকে দেখতে যান, এমন ভাব করেন যেন কিছু জানেন না।

হাফেজ আবদুল কাদের : তিনি নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু। ঘটনার সময় মেইন গেটের বাইরে পাহারায় ছিলেন। নুসরাত পরীক্ষার হলে ঠিকমতো পৌঁছেছে কি-না, ভাই নোমান দেখতে চাইলে কাদের তাকে বাধা দেন। কাদেরের কাছে নুসরাতের বিষয় জানতে চাইলে কাদের জানান, ২ মিনিট পর জানাচ্ছি। পরে তিনি জানান, নুসরাত গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

আবছার উদ্দিন : ঘটনার সময় তিনি গেট পাহারার দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনার কিছুক্ষণ আগেও মামলার বাদীকে ফোন করে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন।

কামরুন নাহার মনি : শামীম তাকে ২ হাজার টাকা দিয়ে বোরখা ম্যানেজ করতে বলেন। এ টাকায় ২টি বোরখা ও হাতমোজা কেনেন। কেনা ২টি বোরখাসহ তার নিজের কাছ থেকে একটি মিলিয়ে মোট তিনটি বোরখা ওই ভবনের তৃতীয় তলায় রেখে আসেন। ছাদে ওঠানোর পর নুসরাতকে শুইয়ে ফেলতে সহায়তা করেন এবং বুকের উপর চাপ দিয়ে ধরে রাখেন। ঘটনার পর ঠান্ডা মাথায় এসে তিনিও পরীক্ষায় অংশ নেন।

উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা : নুসরাতকে ছাদে ওঠানোর পর মামলা তুলে নিতে প্রথমে চাপ দেন তিনি। রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ের ওড়নাটি বের করেন পপি। এরপর ওড়নাটি ২ ভাগ করে দেন, যা দিয়ে নুসরাতে হাত ও পা বাঁধা হয়। নুসরাতের হাত পেছন দিকে বাঁধার পর কেরোসিন ঢালার গ্লাসটি নুসরাতের হাতে ধরিয়ে দেয়। যাতে বোঝা যায় নুসরাত আত্মহত্যা করেছে।

আবদুর রহিম শরীফ : তিনি বাইরের গেটে পাহারায় ছিলেন। নুসরাতের ভাই ভেতরে ঢুকতে চাইলে বাধা দেন তিনি।

ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন ও মহিউদ্দিন শাকিল : তারা গেটে পাহারায় ছিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক বুঝাতে যা যা করণীয় তা করছিলেন তারা।

মোহাম্মদ শামীম : তিনি প্রথমে পপির সঙ্গে ভবনটির গেটে পাহারায় ছিলেন। যাতে কেউ সে সময় ভবনে উঠতে না পারে এবং এর ফলে অন্য কাউকে খুন করতে না হয় সেজন্য সতর্ক ছিলেন তিনি।

রুহুল আমিন : ঘটনার পর মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে পুলিশ-প্রশাসন সবকিছু ম্যানেজ করার আশ্বাস দেন তিনি। হত্যাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করেন। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে দুই দফা ফোনে কথা বলে সবকিছু নিশ্চিত হন।