যে কারণে যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে

পিবিআইর ৪৮ দিনের তদন্তের বিবরণ

সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা যখন ওই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে শ্লীলতাহানির মামলায় জেলে যায়, তখন তার অনুসারীদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছিল- অধ্যক্ষ সিরাজ জেলে থাকলে মাদ্রাসায় আয়ের যে অর্থ তারা ভাগভাটোয়ারা করে সুবিধা নিত, তা বন্ধ হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি নুসরাতের আগে বিভিন্ন সময় যেসব ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করা হয়েছে, তা ফাঁস হয়ে যাবে। কারণ নুসরাতকে যৌন হয়রানির পর এসব ঘটনা বন্ধে মাদ্রাসায় প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল নুসরাত। তার এ প্রতিবাদের সঙ্গে মাদ্রাসায় যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রীরা একত্র হওয়ার চেষ্টা করছিল। অধ্যক্ষ সিরাজের ভয় ছিল, বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্য তৈরি হবে। আর এ কারণেই নুসরাতকে কেরেসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার জন্য সরাসরি নির্দেশ দেয় অধ্যক্ষ সিরাজ। আর তার ওই নির্দেশনা মাদ্রাসা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিন, সদস্য ও পৌর কাউন্সিলর মাকসদু আলমসহ অনুসারী মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের একটি গ্রুপ বাস্তবায়নে ছক আঁকে। ওই ছক অনুযায়ী ৪ গ্রুপে ভাগ হয়ে নুসরাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে আগুনে পোড়ানো হয়। পরিকল্পনামতো নুসরাত নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলেও প্রচার করা হয়। নুসরাত হত্যা মামলায় দীর্ঘ ৪৮ দিন তদন্ত করে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, চ্যাঞ্চল্যকর ওই মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে মাদ্রাসায় কী ধরনের অপকর্ম হতো, এর সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, কোন ব্যক্তিদের লাভ ছিল, কোন ব্যক্তিদের ক্ষতি হয়েছে- এর আদ্যপান্তই বের করেছে পিবিআই। তদন্তে কার কী ভূমিকা ছিল, এর সবকিছুই উল্লেখ করা হয়েছে। শুরুতে আসামিরা বলেছিল, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করায় আলেম সমাজকে হেয় করা এবং প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নুসরাতকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। মূলত নুসরাতকে হত্যা করা হয়েছে ওই মাদ্রাসায় বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, অধ্যক্ষ সিরাজ জেলে থাকলে মাদ্রাসার আয়ের টাকা লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে- এসব ভেবে। নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে ওঠায় তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কারণ তার ঘটনা বেশি আলোচনায় এলে আগে বিভিন্ন ছাত্রীকে যৌন হয়রানির বিষয়টিও বের হয়ে আসতে পারে। আর এসব বের হলে অধ্যক্ষ সিরাজ ফাঁসবে। সে ফাঁসলে তার অনুসারীরাও ফাঁসবে। তাই ঠান্ডা মাথায় নুসরাতকে হত্যা করা হয়।

যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে

পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে নিয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ শ্লীলতাহানি করে। এ ঘটনায় নুসরাতের মা বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করলে গ্রেফতার হয়ে জেলে যায় অধ্যক্ষ সিরাজ। সে জেলে যাওয়ার পরদিন ২৮ মার্চ তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করে পৌর কাউন্সিলর ও ম্যানেজিং কমিটি সদস্য মাকসুদ আলমের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ। অন্যদিকে মাদ্রাসাছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় অধ্যক্ষের শাস্তি দাবি করে পাল্টা মানববন্ধন করে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের আরেকটি গ্রুপ। এসব ঘটনায় নুরউদ্দিনকে আহ্বায়ক এবং ওই মাদ্রাসার ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীমকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদ গঠন করে মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি ও সোনাগাজী থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি (বহিষ্কৃত) রুহুল আমিন। রুহুল আমিন শিক্ষক আবসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তির জন্য গঠিত কমিটির নেতা নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ হেসেনসহ কয়েকজনের মাধ্যমে রুহুল আমিন প্রচার করেছিল- সব ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসা অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে আসবে এবং যারা মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মানববন্ধন বা অন্য কোন কর্মসূচিতে যোগ দেবে, ওই ছাত্রছাত্রীদের আইসিটি মার্ক দেয়া হবে না। তাদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হবে। এ পরিস্থিতিতে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে করা মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য নানাভাবে নুসরাত ও তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেয়া হয়েছিল।

অধ্যক্ষ সিরাজ মাদ্রাসায় বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করত। মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করা হতো। মাদ্রাসার ভর্তি, বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়, মাদ্রাসার মার্কেট ভাড়া দেয়া, মাদ্রাসায় দান-অনুদানের অর্থ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সে একটি গ্রুপ তৈরি করে। ওই গ্রুপের মূল নিয়ন্ত্রণ করত রুহুল আমিন ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম। মাদ্রাসায় ছাত্রদের হুমকি-ধমকি, অধ্যক্ষের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের শারীরিক লাঞ্ছনা করত নুর উদ্দিন, জাবেদ, শামীমসহ একটি গ্রুপ।

গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় তার মা যে মামলা করেছিলেন, তা তুলে নেয়ার জন্য বার বার বলার পরও কিছুতেই কাজ না হওয়ায় জেলখানায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষের সঙ্গে নুর উদ্দিন, শামীম ও জাবেদ দেখা করতে গেলে সে তাদের বলে, নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে ভয় দেখাতে হবে। এতে কাজ না হলে মেরে ফেলতে হবে। কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে হত্যার পর এটিতে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে হবে। অধ্যক্ষ সিরাজের কাছ থেকে এমন নির্দেশনা পাওয়ার হত্যার ছক আঁকে নুর উদ্দিন, শামীম, জাবেদ, কামরুন নাহার মণি, হাফেজ আবদুল কাদের, রুহুল আমিন ও মাকসুদসহ আসামিরা। তাদের মধ্যে ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনামতো ঘটনার দিন মাদ্রাসার টিনশেড ছাত্রাবাসে মিটিং করে নুর উদ্দিন, শামীম, জাবেদ, কাদের, মণিসহ কয়েকজন। সেখানে মণিকে বোরখা কেনার জন্য টাকা দেয় শামীম। মণি তার এক পরিচিত বোরখার দোকান থেকে শামীম, জাবেদ ও নুর উদ্দিনের জন্য ৩টি বোরখা কেনে। ওই বোরখা আগের দিন ঘটনাস্থলের এক জায়গায় রাখা হয়। জাবেদ কেরোসিন কিনে ঘটনার দিন পলিথিনে করে নিয়ে আসে। পরিকল্পনামতো নুসরাতকে মণি মিথ্যা কথা বলে ছাদে পাঠায়। ছাদে যাওয়ার পর নুসরাতের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিতে যায় এ বলে সে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ মিথ্যা উল্লেখ করে মামলা প্রত্যহার করার আবেদন করবে। কিন্তু এতে রাজি না হওয়ায় মণি ও উম্মে সুলতানা পপি তাকে ছাদে ফেলে চেপে ধরে। নুসরাতের গায়ে থাকা ওড়না শামীম দু’ভাগ করে তার হাত পা বেঁধে ফেলে এবং মুখ চেপে ধরে। জাবেদ দিয়াশলাই দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর মণি, পপি ও জাবেদ নিচে নেমে এসে পরীক্ষা হলে চলে যায়। জুবায়ের পেছন দিয়ে আর শামীম বোরখা পরে সামনে দিয়েই বের হয়ে যায়। প্রকাশ্যে মেয়ে সেজে শামীম মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে মাদ্রাসার মার্কেটে কৃষি ব্যাংকে সিঁড়িতে গিয়ে খুলে তা পলিথিনে নেয়। আর জোবায়ের মাদ্রাসার পেছন দিয়ে বের হয়ে তার বোরখা খালে ফেলে। জাবেদের বোরখা মাদ্রাসার পুকুরে ফেলে দেয়। এরপর মাদ্রাসার সহ-সভাপতিকে ঘটনা জানানো হয়। সে ঘটনার আশপাশে কাউকে না থাকার জন্য বলে এবং আত্মহত্যা প্রচার চালিয়ে থানার পুলিশকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব দেয়। নুসরাতের শরীরে যখন আগুন ধরে যায়, তখন তার জামাকাপড় পুড়ে যায়। শরীরে কোন পোশাক ছিল না। ওই অবস্থায় সে বাঁচার জন্য দৌড়ে নিচে এলে পুলিশ দ্রুত এগিয়ে যায় এবং হত্যায় অংশ নেয়া শাকিল, নুর উদ্দিনসহ কয়েকজন নুসরাতের শরীরে আগুন নেভাতে চলে আসে। তারা তখন নুসরাতকে হাসপাতালে নেয়ারও ব্যবস্থা করে। তাকে ঢাকায় আনার পর শাকিল চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মণি ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু সে বোরখা কেনা পরিকল্পাসহ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত। নুসরাতকে যখন ছাদে ডেকে নিয়ে কেরোসিন দেয়া হয়, তখন কেরোসিন ঢালতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে একটি গ্লাস নেয়া হয়েছে। ওই গ্লাসে করে কেরোসিন নুরসাতের গলার নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢালা হয়। কেরোসিন ঢালার পর নুসরাতের হাতে গ্লাস চেপে ধরা হয়Ñ যাতে প্রমাণ করা যায়, নুসরাত নিজের গায়ে নিজে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়েছে। নুসরাতের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী চম্পা। তাই মণি পরিকল্পনামতো তাকে চম্পা বলে ডাকতে বলে অন্যদের। ওই অনুযায়ী নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার পর মণিকে চম্পা বলে ডাক দেয় পপি।

বুধবার, ২৯ মে ২০১৯ , ১৫ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ২৩ রমজান ১৪৪০

যে কারণে যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে

পিবিআইর ৪৮ দিনের তদন্তের বিবরণ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

গ্রেফতারের পর অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা -ফাইল ফটো

সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা যখন ওই মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে শ্লীলতাহানির মামলায় জেলে যায়, তখন তার অনুসারীদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছিল- অধ্যক্ষ সিরাজ জেলে থাকলে মাদ্রাসায় আয়ের যে অর্থ তারা ভাগভাটোয়ারা করে সুবিধা নিত, তা বন্ধ হয়ে যাবে। এর পাশাপাশি নুসরাতের আগে বিভিন্ন সময় যেসব ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করা হয়েছে, তা ফাঁস হয়ে যাবে। কারণ নুসরাতকে যৌন হয়রানির পর এসব ঘটনা বন্ধে মাদ্রাসায় প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল নুসরাত। তার এ প্রতিবাদের সঙ্গে মাদ্রাসায় যৌন হয়রানির শিকার ছাত্রীরা একত্র হওয়ার চেষ্টা করছিল। অধ্যক্ষ সিরাজের ভয় ছিল, বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্য তৈরি হবে। আর এ কারণেই নুসরাতকে কেরেসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার জন্য সরাসরি নির্দেশ দেয় অধ্যক্ষ সিরাজ। আর তার ওই নির্দেশনা মাদ্রাসা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিন, সদস্য ও পৌর কাউন্সিলর মাকসদু আলমসহ অনুসারী মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের একটি গ্রুপ বাস্তবায়নে ছক আঁকে। ওই ছক অনুযায়ী ৪ গ্রুপে ভাগ হয়ে নুসরাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে আগুনে পোড়ানো হয়। পরিকল্পনামতো নুসরাত নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলেও প্রচার করা হয়। নুসরাত হত্যা মামলায় দীর্ঘ ৪৮ দিন তদন্ত করে এসব তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, চ্যাঞ্চল্যকর ওই মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে মাদ্রাসায় কী ধরনের অপকর্ম হতো, এর সঙ্গে কারা জড়িত ছিল, কোন ব্যক্তিদের লাভ ছিল, কোন ব্যক্তিদের ক্ষতি হয়েছে- এর আদ্যপান্তই বের করেছে পিবিআই। তদন্তে কার কী ভূমিকা ছিল, এর সবকিছুই উল্লেখ করা হয়েছে। শুরুতে আসামিরা বলেছিল, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করায় আলেম সমাজকে হেয় করা এবং প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নুসরাতকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। মূলত নুসরাতকে হত্যা করা হয়েছে ওই মাদ্রাসায় বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের যৌন হয়রানি, অধ্যক্ষ সিরাজ জেলে থাকলে মাদ্রাসার আয়ের টাকা লুটপাট বন্ধ হয়ে যাবে- এসব ভেবে। নুসরাত প্রতিবাদী হয়ে ওঠায় তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কারণ তার ঘটনা বেশি আলোচনায় এলে আগে বিভিন্ন ছাত্রীকে যৌন হয়রানির বিষয়টিও বের হয়ে আসতে পারে। আর এসব বের হলে অধ্যক্ষ সিরাজ ফাঁসবে। সে ফাঁসলে তার অনুসারীরাও ফাঁসবে। তাই ঠান্ডা মাথায় নুসরাতকে হত্যা করা হয়।

যেভাবে হত্যা করা হয় নুসরাতকে

পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফিকে ডেকে নিয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ শ্লীলতাহানি করে। এ ঘটনায় নুসরাতের মা বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করলে গ্রেফতার হয়ে জেলে যায় অধ্যক্ষ সিরাজ। সে জেলে যাওয়ার পরদিন ২৮ মার্চ তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করে পৌর কাউন্সিলর ও ম্যানেজিং কমিটি সদস্য মাকসুদ আলমের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ। অন্যদিকে মাদ্রাসাছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় অধ্যক্ষের শাস্তি দাবি করে পাল্টা মানববন্ধন করে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের আরেকটি গ্রুপ। এসব ঘটনায় নুরউদ্দিনকে আহ্বায়ক এবং ওই মাদ্রাসার ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীমকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে অধ্যক্ষ সিরাজ মুক্তি পরিষদ গঠন করে মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি ও সোনাগাজী থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি (বহিষ্কৃত) রুহুল আমিন। রুহুল আমিন শিক্ষক আবসার উদ্দিন, মাদ্রাসার ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজের মুক্তির জন্য গঠিত কমিটির নেতা নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ হেসেনসহ কয়েকজনের মাধ্যমে রুহুল আমিন প্রচার করেছিল- সব ছাত্রছাত্রী মাদ্রাসা অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে আসবে এবং যারা মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মানববন্ধন বা অন্য কোন কর্মসূচিতে যোগ দেবে, ওই ছাত্রছাত্রীদের আইসিটি মার্ক দেয়া হবে না। তাদের পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়া হবে। এ পরিস্থিতিতে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে করা মামলাটি প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য নানাভাবে নুসরাত ও তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেয়া হয়েছিল।

অধ্যক্ষ সিরাজ মাদ্রাসায় বিভিন্ন সময় ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করত। মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে ছাত্রীদের ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানি করা হতো। মাদ্রাসার ভর্তি, বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষায় অতিরিক্ত অর্থ আদায়, মাদ্রাসার মার্কেট ভাড়া দেয়া, মাদ্রাসায় দান-অনুদানের অর্থ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সে একটি গ্রুপ তৈরি করে। ওই গ্রুপের মূল নিয়ন্ত্রণ করত রুহুল আমিন ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম। মাদ্রাসায় ছাত্রদের হুমকি-ধমকি, অধ্যক্ষের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদের শারীরিক লাঞ্ছনা করত নুর উদ্দিন, জাবেদ, শামীমসহ একটি গ্রুপ।

গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় তার মা যে মামলা করেছিলেন, তা তুলে নেয়ার জন্য বার বার বলার পরও কিছুতেই কাজ না হওয়ায় জেলখানায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষের সঙ্গে নুর উদ্দিন, শামীম ও জাবেদ দেখা করতে গেলে সে তাদের বলে, নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে ভয় দেখাতে হবে। এতে কাজ না হলে মেরে ফেলতে হবে। কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে হত্যার পর এটিতে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে হবে। অধ্যক্ষ সিরাজের কাছ থেকে এমন নির্দেশনা পাওয়ার হত্যার ছক আঁকে নুর উদ্দিন, শামীম, জাবেদ, কামরুন নাহার মণি, হাফেজ আবদুল কাদের, রুহুল আমিন ও মাকসুদসহ আসামিরা। তাদের মধ্যে ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনামতো ঘটনার দিন মাদ্রাসার টিনশেড ছাত্রাবাসে মিটিং করে নুর উদ্দিন, শামীম, জাবেদ, কাদের, মণিসহ কয়েকজন। সেখানে মণিকে বোরখা কেনার জন্য টাকা দেয় শামীম। মণি তার এক পরিচিত বোরখার দোকান থেকে শামীম, জাবেদ ও নুর উদ্দিনের জন্য ৩টি বোরখা কেনে। ওই বোরখা আগের দিন ঘটনাস্থলের এক জায়গায় রাখা হয়। জাবেদ কেরোসিন কিনে ঘটনার দিন পলিথিনে করে নিয়ে আসে। পরিকল্পনামতো নুসরাতকে মণি মিথ্যা কথা বলে ছাদে পাঠায়। ছাদে যাওয়ার পর নুসরাতের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিতে যায় এ বলে সে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ মিথ্যা উল্লেখ করে মামলা প্রত্যহার করার আবেদন করবে। কিন্তু এতে রাজি না হওয়ায় মণি ও উম্মে সুলতানা পপি তাকে ছাদে ফেলে চেপে ধরে। নুসরাতের গায়ে থাকা ওড়না শামীম দু’ভাগ করে তার হাত পা বেঁধে ফেলে এবং মুখ চেপে ধরে। জাবেদ দিয়াশলাই দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর মণি, পপি ও জাবেদ নিচে নেমে এসে পরীক্ষা হলে চলে যায়। জুবায়ের পেছন দিয়ে আর শামীম বোরখা পরে সামনে দিয়েই বের হয়ে যায়। প্রকাশ্যে মেয়ে সেজে শামীম মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে মাদ্রাসার মার্কেটে কৃষি ব্যাংকে সিঁড়িতে গিয়ে খুলে তা পলিথিনে নেয়। আর জোবায়ের মাদ্রাসার পেছন দিয়ে বের হয়ে তার বোরখা খালে ফেলে। জাবেদের বোরখা মাদ্রাসার পুকুরে ফেলে দেয়। এরপর মাদ্রাসার সহ-সভাপতিকে ঘটনা জানানো হয়। সে ঘটনার আশপাশে কাউকে না থাকার জন্য বলে এবং আত্মহত্যা প্রচার চালিয়ে থানার পুলিশকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব দেয়। নুসরাতের শরীরে যখন আগুন ধরে যায়, তখন তার জামাকাপড় পুড়ে যায়। শরীরে কোন পোশাক ছিল না। ওই অবস্থায় সে বাঁচার জন্য দৌড়ে নিচে এলে পুলিশ দ্রুত এগিয়ে যায় এবং হত্যায় অংশ নেয়া শাকিল, নুর উদ্দিনসহ কয়েকজন নুসরাতের শরীরে আগুন নেভাতে চলে আসে। তারা তখন নুসরাতকে হাসপাতালে নেয়ারও ব্যবস্থা করে। তাকে ঢাকায় আনার পর শাকিল চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মণি ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু সে বোরখা কেনা পরিকল্পাসহ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত। নুসরাতকে যখন ছাদে ডেকে নিয়ে কেরোসিন দেয়া হয়, তখন কেরোসিন ঢালতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে একটি গ্লাস নেয়া হয়েছে। ওই গ্লাসে করে কেরোসিন নুরসাতের গলার নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢালা হয়। কেরোসিন ঢালার পর নুসরাতের হাতে গ্লাস চেপে ধরা হয়Ñ যাতে প্রমাণ করা যায়, নুসরাত নিজের গায়ে নিজে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়েছে। নুসরাতের এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী চম্পা। তাই মণি পরিকল্পনামতো তাকে চম্পা বলে ডাকতে বলে অন্যদের। ওই অনুযায়ী নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার পর মণিকে চম্পা বলে ডাক দেয় পপি।