বাজেটে ভর্তুকি বাড়ছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা

  • সবচেয়ে বেশি বাড়ছে এলএনজিতে
  • মোট ভর্তুকি ৪৫ হাজার কোটি টাকা

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এসব খাতে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বরাদ্দ আছে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ বরাদ্দ ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এ অর্থ দিয়ে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, কৃষি, সরকারি কলকারখানা, রপ্তানি উন্নয়ন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন সরবরাহসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেয়া হবে। তবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্কে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়লেও বাজেটের অংশ হিসেবে ভর্তুকি কমবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

জনগণকে সহনীয় মূল্যে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করার জন্য সরকার বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখে। জনগণের কাছ থেকে কম নেয়া দাম ভর্তুকির মাধ্যমে সরকার পূরণ করে থাকে। কৃষিসহ বিভিন্ন খাতের সুবিধার্থে সরকার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে ডিজেল বিক্রি করে থাকে। আবার সার, চিনির মতো কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দারিদ্র্যবান্ধব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ভর্তুকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে ভর্তুকির অর্থের অপচয় নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সমালোচনা করে থাকেন।

সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হবে মোট ব্যয়ের সাড়ে ৮ শতাংশের সামান্য বেশি। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তা বাজেটের সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি। ভর্তুকির সবচেয়ে বেশি যাবে বিদ্যুৎ খাতে।

জানা গেছে, আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও সমান পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ যে বরাদ্দ রাখা হয়, অনেক সময় ছাড় হয় এর কম। সেচ, সার ও সুদসহ বিভিন্ন উপায়ে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়। কৃষি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ খাতে ভর্তুকি কমানো ঠিক হবে না। দেশ বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এর পেছনে ভর্তুকির অবদান রয়েছে। আবার মৎস্য, গবাদিপশুসহ অন্যান্য খাতে যে সম্প্রসারণ হচ্ছে, তা টেকসই হওয়ার জন্য ভর্তুকি প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় অঙ্কের হলেও আসন্ন বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সামান্য কমবে বলে জানা গেছে। এ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, অপচয় হ্রাস ও দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভর্তুকি কমাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী বাজেটে ১০০ কোটি টাকা কমে বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

রপ্তানি খাতে সহায়তা বাবদ বরাদ্দ বাড়বে বলে জানা গেছে। আগামী বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। রপ্তানিতে ভর্তুকি বাড়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নতুন বাজারে প্রবেশ অন্যতম। আর সরকারি পাটকলের লোকসান বা মূলধন বাবদ ভর্তুকির জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী থাকায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য কোনো ভর্তুকির দরকার হবে না। আর ব্যাংকগুলোর মূলধন সরবরাহের জন্য চলতি অর্থবছরের মতো দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

সাধারণত ভর্তুকি বেশি হলে আর্থিক চাপ বাড়ে সরকারের। এ জন্য বাজেট প্রণয়নের সময় অনেকটা অস্বস্তিতে থাকে সরকার। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ভর্তুকি হচ্ছে এক ধরনের অনুৎপাদনশীল খাত। অর্থনীতির অদক্ষতার কারণেই ভর্তুকি দিতে হয়। এটি যত বেশি হবে, তত আর্থিক চাপ বাড়বে সরকারের ওপর। এ জন্য ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তারা।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই ভর্তুকি দেয় সরকার। ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্যের দাম আরও বাড়বে। এছাড়া বাড়বে বিদ্যুতের দাম এবং ব্যাহত হবে রপ্তানি। এতে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, প্রকৃত দামের চেয়ে কম দামে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিক্রি করতে হবে বলে নতুন বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। এলএনজি খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বেড়ছে ৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জ্বালানির এই নতুন উৎসে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এই বরাদ্দ তিনগুণের বেশি বেড়ে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হবে বলে জানা গেছে। এলএনজি আমদানি করে সরকার স্থানীয় শিল্পে গ্যাস সরবরাহ করছে।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বাজেট বরাদ্দ গত ৫ বছর খুব বেশি বাড়েনি বা কমেনি। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় এক প্রকার স্বস্তিতে ছিলেন অর্থমন্ত্রীও। বাজেট প্রণয়নের সময় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে এ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে আনার প্রবণতা দেখা গেছে। যেমনÑ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমিয়ে করা হয়েছিল ২৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছর থেকে ভর্তুকিতে এলএনজি যুক্ত হওয়ায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়ে গেছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

ভর্তুকি কম দিতে হলে সরকারের জন্য ভালো। কারণ এ টাকা সরাসরি জনগণের দেয়া করের। ভর্তুকি না দিতে হলে এ টাকা সরকার অন্য কাজে ব্যয় করতে পারে। এতদিন ভর্তুকি দেয়া হচ্ছিল প্রধানত বিদ্যুৎ, কৃষি, রপ্তানি, খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি খাতে। এবার নতুন করে দেয়া হচ্ছে এলএনজিতে। কেননা সরকার হিসাব করে দেখেছে, যে দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, ওই দামে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে বিক্রি করলে তাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। তাই গ্যাস ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার এখানে ভর্তুকি দিতে যাচ্ছে বলে জানায় অর্থ বিভাগ।

খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। খাদ্যেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ কমছে। এছাড়া অন্যান্য খাতের জন্য ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রণোদনার টাকার অঙ্কে কোনো হেরফের হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের মতো আগামীতেও ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। কৃষি খাতের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনাও রাখা হচ্ছে ৪ হাজার কোটি। পাটের জন্য রাখা হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকা।

নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর খেলাপি ঋণের ভারে নুয়ে পড়া ব্যাংক খাত বাঁচাতে আবারও দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ অর্থ মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে ব্যয় করা হবে।

ভর্তুকি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকেও এক ধরনের সমালোচনা রয়েছে। সেটি হচ্ছে, অর্থনীতিতে ভর্তুকি বেশি দিতে হলে সরকারের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ে। অর্থ বিভাগের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভর্তুকির পক্ষেও যুক্তি রয়েছে। যেমনÑ ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্য ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে। আর প্রতিযোগী দেশগুলো রপ্তানিতে প্রণোদনা দেয়। বাংলাদেশ না দিলে রপ্তানি কমে যাবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রি করে সরকার। এ কারণেও ভর্তুকি রাখতে হয়।

বুধবার, ২৯ মে ২০১৯ , ১৫ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ২৩ রমজান ১৪৪০

বাজেটে ভর্তুকি বাড়ছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা

রোকন মাহমুদ

  • সবচেয়ে বেশি বাড়ছে এলএনজিতে
  • মোট ভর্তুকি ৪৫ হাজার কোটি টাকা

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে। এসব খাতে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বরাদ্দ আছে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ বরাদ্দ ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেড়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এ অর্থ দিয়ে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, কৃষি, সরকারি কলকারখানা, রপ্তানি উন্নয়ন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধন সরবরাহসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেয়া হবে। তবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় টাকার অঙ্কে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়লেও বাজেটের অংশ হিসেবে ভর্তুকি কমবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

জনগণকে সহনীয় মূল্যে পণ্য ও সেবা সরবরাহ করার জন্য সরকার বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখে। জনগণের কাছ থেকে কম নেয়া দাম ভর্তুকির মাধ্যমে সরকার পূরণ করে থাকে। কৃষিসহ বিভিন্ন খাতের সুবিধার্থে সরকার আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে ডিজেল বিক্রি করে থাকে। আবার সার, চিনির মতো কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দারিদ্র্যবান্ধব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ভর্তুকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে ভর্তুকির অর্থের অপচয় নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সমালোচনা করে থাকেন।

সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হবে মোট ব্যয়ের সাড়ে ৮ শতাংশের সামান্য বেশি। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। তা বাজেটের সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি। ভর্তুকির সবচেয়ে বেশি যাবে বিদ্যুৎ খাতে।

জানা গেছে, আগামী বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকতে পারে। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও সমান পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ যে বরাদ্দ রাখা হয়, অনেক সময় ছাড় হয় এর কম। সেচ, সার ও সুদসহ বিভিন্ন উপায়ে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়। কৃষি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ খাতে ভর্তুকি কমানো ঠিক হবে না। দেশ বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এর পেছনে ভর্তুকির অবদান রয়েছে। আবার মৎস্য, গবাদিপশুসহ অন্যান্য খাতে যে সম্প্রসারণ হচ্ছে, তা টেকসই হওয়ার জন্য ভর্তুকি প্রয়োজন।

সবচেয়ে বড় অঙ্কের হলেও আসন্ন বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সামান্য কমবে বলে জানা গেছে। এ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, অপচয় হ্রাস ও দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভর্তুকি কমাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী বাজেটে ১০০ কোটি টাকা কমে বরাদ্দ দাঁড়াচ্ছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

রপ্তানি খাতে সহায়তা বাবদ বরাদ্দ বাড়বে বলে জানা গেছে। আগামী বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। রপ্তানিতে ভর্তুকি বাড়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নতুন বাজারে প্রবেশ অন্যতম। আর সরকারি পাটকলের লোকসান বা মূলধন বাবদ ভর্তুকির জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী থাকায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জন্য কোনো ভর্তুকির দরকার হবে না। আর ব্যাংকগুলোর মূলধন সরবরাহের জন্য চলতি অর্থবছরের মতো দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।

সাধারণত ভর্তুকি বেশি হলে আর্থিক চাপ বাড়ে সরকারের। এ জন্য বাজেট প্রণয়নের সময় অনেকটা অস্বস্তিতে থাকে সরকার। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ভর্তুকি হচ্ছে এক ধরনের অনুৎপাদনশীল খাত। অর্থনীতির অদক্ষতার কারণেই ভর্তুকি দিতে হয়। এটি যত বেশি হবে, তত আর্থিক চাপ বাড়বে সরকারের ওপর। এ জন্য ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তারা।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করেই ভর্তুকি দেয় সরকার। ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্যের দাম আরও বাড়বে। এছাড়া বাড়বে বিদ্যুতের দাম এবং ব্যাহত হবে রপ্তানি। এতে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, প্রকৃত দামের চেয়ে কম দামে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) বিক্রি করতে হবে বলে নতুন বাজেটে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। এলএনজি খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বেড়ছে ৬ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জ্বালানির এই নতুন উৎসে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। আগামী অর্থবছরে এই বরাদ্দ তিনগুণের বেশি বেড়ে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা হবে বলে জানা গেছে। এলএনজি আমদানি করে সরকার স্থানীয় শিল্পে গ্যাস সরবরাহ করছে।

অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ খাতে বাজেট বরাদ্দ গত ৫ বছর খুব বেশি বাড়েনি বা কমেনি। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় এক প্রকার স্বস্তিতে ছিলেন অর্থমন্ত্রীও। বাজেট প্রণয়নের সময় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে এ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে আনার প্রবণতা দেখা গেছে। যেমনÑ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমিয়ে করা হয়েছিল ২৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বরাদ্দ ছিল ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তবে চলতি অর্থবছর থেকে ভর্তুকিতে এলএনজি যুক্ত হওয়ায় এ খাতে বরাদ্দ বেড়ে গেছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

ভর্তুকি কম দিতে হলে সরকারের জন্য ভালো। কারণ এ টাকা সরাসরি জনগণের দেয়া করের। ভর্তুকি না দিতে হলে এ টাকা সরকার অন্য কাজে ব্যয় করতে পারে। এতদিন ভর্তুকি দেয়া হচ্ছিল প্রধানত বিদ্যুৎ, কৃষি, রপ্তানি, খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য ইত্যাদি খাতে। এবার নতুন করে দেয়া হচ্ছে এলএনজিতে। কেননা সরকার হিসাব করে দেখেছে, যে দামে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, ওই দামে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে বিক্রি করলে তাদের পণ্য উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে। তাই গ্যাস ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই সরকার এখানে ভর্তুকি দিতে যাচ্ছে বলে জানায় অর্থ বিভাগ।

খাদ্যে ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। খাদ্যেও চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ কমছে। এছাড়া অন্যান্য খাতের জন্য ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে প্রণোদনার টাকার অঙ্কে কোনো হেরফের হচ্ছে না। চলতি অর্থবছরের মতো আগামীতেও ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। কৃষি খাতের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হচ্ছে। রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনাও রাখা হচ্ছে ৪ হাজার কোটি। পাটের জন্য রাখা হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকা।

নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর খেলাপি ঋণের ভারে নুয়ে পড়া ব্যাংক খাত বাঁচাতে আবারও দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এ অর্থ মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে ব্যয় করা হবে।

ভর্তুকি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকেও এক ধরনের সমালোচনা রয়েছে। সেটি হচ্ছে, অর্থনীতিতে ভর্তুকি বেশি দিতে হলে সরকারের ওপর আর্থিক চাপ বাড়ে। অর্থ বিভাগের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভর্তুকির পক্ষেও যুক্তি রয়েছে। যেমনÑ ভর্তুকি না দিলে কৃষিপণ্য ও বিদ্যুতের দাম বাড়বে। আর প্রতিযোগী দেশগুলো রপ্তানিতে প্রণোদনা দেয়। বাংলাদেশ না দিলে রপ্তানি কমে যাবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রি করে সরকার। এ কারণেও ভর্তুকি রাখতে হয়।