রাজনীতির মাঠ চাঙ্গা করতে প্রস্তুতি আ’লীগ-বিএনপির

  • অক্টোবরে জাতীয় সম্মেলন আ’লীগের
  • ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বিএনপির

পবিত্র রমজানজুড়ে ইফতার মাহফিলে সীমাবদ্ধতার পর রাজনীতি চাঙ্গা করতে এখন নতুন উদ্যোমে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ক্ষমাতসীন আওয়ামী লীগ অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করবে। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি মাঠে নামবে জনমত সৃষ্টি ও দলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য অনুপ্রবেশ দমন ও সব কোন্দল মীমাংসা করে একটি সফল জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করা, নতুন নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী (মুজিববর্ষ) উদযাপন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জমকালো আয়োজনে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন। ক্ষমতাসীন দলটির বিভিন্ন স্তরে অনুপ্রবেশ নিয়ে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। আর বেশিরভাগ জেলা-উপজেলায় শীর্ষ নেতাদের গ্রুপিংয়ের কারণে কোন্দল দলের সাংগঠনিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সব স্তরের নেতাকর্মী জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনার নতুন চমক দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন।

বিএনপির লক্ষ্য ব্যাপক জনমত সৃষ্টি ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির কর্মসূচি নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট। এদিকে জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি ও দলীয়প্রধানের মুক্তিতে ব্যর্থতা দলের মহাসচিবের ওপর চাপিয়ে পদ দখলের সুযোগ খুঁজছেন জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা। খালেদা-তারেকের অনুপস্থিতিতে দল চালানো মহাসচিবের কাছে সব ব্যর্থতার জবাব চান দলের শীর্ষ নেতারা। মির্জা ফখরুলের সংসদে না যাওয়া, পরে বগুড়ায় মনোনয়ন না হওয়া আবার সংরক্ষিত নারী আসনে প্রার্থী দিয়ে রুমিন ফারহানাকে এমপি করাÑ এসব ঘটনা মহাসচিবের ওপর খালেদা-তারেকের অনাস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিএনপিতে চলছে নেতৃত্বে পরিবর্তনের গুঞ্জন।

গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নিরঙ্কুশ জয় এবং বিএনপি ও এর দুই জোট ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলের ভারাডুবি রাজনীতিতে স্থবিরতা তৈরি করে। তবে মহাজোটের শরিকদের একপাশে রেখে এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন ও তরুণ নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে চমক দেখানোর পাশপাশি রাজনীতিতে আলোচনার খোড়াক জোগান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ করার পর ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শপথ না নেয়া রাজনীতিতে রহস্য তৈরি করে। আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল থেকে জোটের বহুদিনের মিত্র ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সরে আসাও ২০ দল ভাঙনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। মির্জা ফখরুলকে বগুড়ায় মনোনয়ন না দেয়ায় বিএনপির নেতৃত্বে পরিবর্তনের গুঞ্জন ওঠে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক সূত্র জানায়, পবিত্র ঈদুল ফিতর-পরবর্তী কর্মসূচি হচ্ছে জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আট বিভাগে একযোগে চলবে সাংগঠনিক সফর। এর পাশাপাশি জেলা-উপজেলায় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হবে। সাংগঠনিক সফর ও সব মহানগর-জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন শেষে অক্টোবরে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

ৎআওয়ামী লীগের ২০তম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর। ওই হিসাবে বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে এই বছরের ২৩ অক্টোবর।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আগামী অক্টোবরনাগাদ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের গত বৈঠকে হয়েছে। ওই বৈঠকে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের জন্য আটটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে আটটি কমিটি নিজ নিজ বিভাগে কাজও শুরু করেছে। তবে পবিত্র রমজানের কারণে সাময়িকভাবে তা স্থগিত ছিল। ঈদ শেষ। এখন কাজ পুরোদমে চলবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মহানগর, জেলা-উপজেলায় সম্মেলন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যথাসময়ে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলাগুলোর কাউন্সিল শেষ করার তাগিদসহ বেশকিছু নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৬৪টির কমিটির মেয়াদ নেই। অধিকাংশ জেলায় সম্মেলন হয়েছে ৫ থেকে ৬ বছর আগে। ওই হিসাব অনুযায়ী এসব জেলায় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলা চলে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, জাতীয় সম্মেলন সম্পন্নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রধান কাজ হলো কাউন্সিলর তালিকা প্রণয়ন করা ও তালিকা ঠিক করা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন যেখানে সম্ভব হয়, সেখানে করা হবে। আর যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর সম্মেলন করা হবে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব জেলা ও উপজেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলোর একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। গত ১১ মে খুলনা বিভাগ থেকে এই সফর শুরু হয়। কিন্তু রমজান মাসের কারণে পরে সম্মেলন স্থগিত করা হয়। তবে ইতোমধ্যে নীলফামারী ও রংপুর জেলার ৫টি উপজেলার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঈদের পর পরই ওইসব উপজেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

কেন্দ্রীয় সূত্র মতে, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সাংগঠনিক সফরে সদস্য সংগ্রহ অভিযান সম্পন্ন করা ও দলীয় কোন্দল নিরসনের জন্য নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, ঈদের পরই সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার পূর্বপরিকল্পনা ছিল। কারণ আগস্টজুড়ে শোকের কর্মসূচি থাকায় ওই মাসে কোন সম্মেলন হবে না। ফলে এর আগে জুলাইয়ের মধ্যেই বেশিরভাগ জেলা সম্মেলন শেষ করা হবে। যেসব জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন হয়নি, কোন্দল বিদ্যমান, সংগঠন দুর্বল, পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, নেতারা বয়স্ক ও অসুস্থÑ সেসব জেলা-উপজেলায় সম্মেলন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া যেসব এলাকায় সংগঠনে বিএনপি-জামায়াত বা অন্য সংগঠন থেকে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাদেরসহ যারা বিতর্কিত কাজের কারণে সমালোচিতÑ তাদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। দলের শুদ্ধি অভিযানে বিতর্কিতদের বাদ দেয়া হবে বলেও জানা গেছে। যোগ্য ও অযোগ্য নেতাদের তালিকাও করা হচ্ছে। সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর একাধিক সদস্য বলেন, এবার জাতীয় সম্মেলনের পর নতুন নেতৃত্বের কাছে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দায়িত্ব দেয়া হবে। এ দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জাতির পিতার মহান আত্মত্যাগ ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের বার্তা পোঁছে দেয়া হবে।

অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে ভারাডুবি এবং সম্প্রতি ২০ দলীয় জোট থেকে বিজেপিসহ কয়েকটি দলের বের হয়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছে বিএনপি। রাজনীতিতে টিকে থাকতে একের পর এক কৌশল পরিবর্তন করছে দলটি। ক্ষেত্র বিশেষে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তও পরিবর্তন আসছে। নিজেদের মৌলিক সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারছেন না তারা। ভোট ডাকাতির একাদশ সংসদ নির্বাচন মেনে না নিলেও শেষ পর্যন্ত বিজয়ী ৬ সদস্যকে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার নির্দেশ দেন বিএনপির শীর্ষ নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রায় ১৫ মাস কারাগারে। বিএনপির সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন মোটেও ভালো না। এ অবস্থায় সংসদে যাওয়া নিয়ে বিএনপি যদি আগের অবস্থানেই থাকেÑ তাহলে সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন, প্যারোল বা মুক্তির বিষয়ে কঠোর অবস্থানেই থাকবে। আবার আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা আপাতত দেখছে না বিএনপি। ফলে বিএনপি অনড় অবস্থানে থেকে খালেদা জিয়ার ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে চায় না। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাইলেও দলটির জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতার মধ্যে বিরোধ দৃশ্যমান। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দলের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী নেতাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।

শনিবার, ০৮ জুন ২০১৯ , ২৫ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ৪ শাওয়াল ১৪৪০

রাজনীতির মাঠ চাঙ্গা করতে প্রস্তুতি আ’লীগ-বিএনপির

ফয়েজ আহমেদ তুষার

  • অক্টোবরে জাতীয় সম্মেলন আ’লীগের
  • ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বিএনপির

পবিত্র রমজানজুড়ে ইফতার মাহফিলে সীমাবদ্ধতার পর রাজনীতি চাঙ্গা করতে এখন নতুন উদ্যোমে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ক্ষমাতসীন আওয়ামী লীগ অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করবে। তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি মাঠে নামবে জনমত সৃষ্টি ও দলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্রুত খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য অনুপ্রবেশ দমন ও সব কোন্দল মীমাংসা করে একটি সফল জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করা, নতুন নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ-বিদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী (মুজিববর্ষ) উদযাপন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়া, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে জমকালো আয়োজনে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন। ক্ষমতাসীন দলটির বিভিন্ন স্তরে অনুপ্রবেশ নিয়ে রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ। আর বেশিরভাগ জেলা-উপজেলায় শীর্ষ নেতাদের গ্রুপিংয়ের কারণে কোন্দল দলের সাংগঠনিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাই কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সব স্তরের নেতাকর্মী জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনার নতুন চমক দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন।

বিএনপির লক্ষ্য ব্যাপক জনমত সৃষ্টি ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির কর্মসূচি নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট। এদিকে জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি ও দলীয়প্রধানের মুক্তিতে ব্যর্থতা দলের মহাসচিবের ওপর চাপিয়ে পদ দখলের সুযোগ খুঁজছেন জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতা। খালেদা-তারেকের অনুপস্থিতিতে দল চালানো মহাসচিবের কাছে সব ব্যর্থতার জবাব চান দলের শীর্ষ নেতারা। মির্জা ফখরুলের সংসদে না যাওয়া, পরে বগুড়ায় মনোনয়ন না হওয়া আবার সংরক্ষিত নারী আসনে প্রার্থী দিয়ে রুমিন ফারহানাকে এমপি করাÑ এসব ঘটনা মহাসচিবের ওপর খালেদা-তারেকের অনাস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিএনপিতে চলছে নেতৃত্বে পরিবর্তনের গুঞ্জন।

গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নিরঙ্কুশ জয় এবং বিএনপি ও এর দুই জোট ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলের ভারাডুবি রাজনীতিতে স্থবিরতা তৈরি করে। তবে মহাজোটের শরিকদের একপাশে রেখে এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন ও তরুণ নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে চমক দেখানোর পাশপাশি রাজনীতিতে আলোচনার খোড়াক জোগান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ করার পর ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শপথ না নেয়া রাজনীতিতে রহস্য তৈরি করে। আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল থেকে জোটের বহুদিনের মিত্র ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) সরে আসাও ২০ দল ভাঙনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। মির্জা ফখরুলকে বগুড়ায় মনোনয়ন না দেয়ায় বিএনপির নেতৃত্বে পরিবর্তনের গুঞ্জন ওঠে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক সূত্র জানায়, পবিত্র ঈদুল ফিতর-পরবর্তী কর্মসূচি হচ্ছে জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আট বিভাগে একযোগে চলবে সাংগঠনিক সফর। এর পাশাপাশি জেলা-উপজেলায় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হবে। সাংগঠনিক সফর ও সব মহানগর-জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলন শেষে অক্টোবরে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

ৎআওয়ামী লীগের ২০তম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর। ওই হিসাবে বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে এই বছরের ২৩ অক্টোবর।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, আগামী অক্টোবরনাগাদ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত দলের কার্যনির্বাহী সংসদের গত বৈঠকে হয়েছে। ওই বৈঠকে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফরের জন্য আটটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে আটটি কমিটি নিজ নিজ বিভাগে কাজও শুরু করেছে। তবে পবিত্র রমজানের কারণে সাময়িকভাবে তা স্থগিত ছিল। ঈদ শেষ। এখন কাজ পুরোদমে চলবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে মহানগর, জেলা-উপজেলায় সম্মেলন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যথাসময়ে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলাগুলোর কাউন্সিল শেষ করার তাগিদসহ বেশকিছু নির্দেশনা দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৬৪টির কমিটির মেয়াদ নেই। অধিকাংশ জেলায় সম্মেলন হয়েছে ৫ থেকে ৬ বছর আগে। ওই হিসাব অনুযায়ী এসব জেলায় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলা চলে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, জাতীয় সম্মেলন সম্পন্নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রধান কাজ হলো কাউন্সিলর তালিকা প্রণয়ন করা ও তালিকা ঠিক করা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন যেখানে সম্ভব হয়, সেখানে করা হবে। আর যেখানে সম্ভব নয়, সেখানে কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর সম্মেলন করা হবে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সূত্রে জানা গেছে, যেসব জেলা ও উপজেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলোর একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। গত ১১ মে খুলনা বিভাগ থেকে এই সফর শুরু হয়। কিন্তু রমজান মাসের কারণে পরে সম্মেলন স্থগিত করা হয়। তবে ইতোমধ্যে নীলফামারী ও রংপুর জেলার ৫টি উপজেলার সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঈদের পর পরই ওইসব উপজেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।

কেন্দ্রীয় সূত্র মতে, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সাংগঠনিক সফরে সদস্য সংগ্রহ অভিযান সম্পন্ন করা ও দলীয় কোন্দল নিরসনের জন্য নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, ঈদের পরই সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার পূর্বপরিকল্পনা ছিল। কারণ আগস্টজুড়ে শোকের কর্মসূচি থাকায় ওই মাসে কোন সম্মেলন হবে না। ফলে এর আগে জুলাইয়ের মধ্যেই বেশিরভাগ জেলা সম্মেলন শেষ করা হবে। যেসব জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন হয়নি, কোন্দল বিদ্যমান, সংগঠন দুর্বল, পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, নেতারা বয়স্ক ও অসুস্থÑ সেসব জেলা-উপজেলায় সম্মেলন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া যেসব এলাকায় সংগঠনে বিএনপি-জামায়াত বা অন্য সংগঠন থেকে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তাদেরসহ যারা বিতর্কিত কাজের কারণে সমালোচিতÑ তাদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। দলের শুদ্ধি অভিযানে বিতর্কিতদের বাদ দেয়া হবে বলেও জানা গেছে। যোগ্য ও অযোগ্য নেতাদের তালিকাও করা হচ্ছে। সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর একাধিক সদস্য বলেন, এবার জাতীয় সম্মেলনের পর নতুন নেতৃত্বের কাছে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দায়িত্ব দেয়া হবে। এ দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে সারা বিশ্বকে জাতির পিতার মহান আত্মত্যাগ ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের বার্তা পোঁছে দেয়া হবে।

অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে ভারাডুবি এবং সম্প্রতি ২০ দলীয় জোট থেকে বিজেপিসহ কয়েকটি দলের বের হয়ে যাওয়ায় চাপে পড়েছে বিএনপি। রাজনীতিতে টিকে থাকতে একের পর এক কৌশল পরিবর্তন করছে দলটি। ক্ষেত্র বিশেষে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তও পরিবর্তন আসছে। নিজেদের মৌলিক সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারছেন না তারা। ভোট ডাকাতির একাদশ সংসদ নির্বাচন মেনে না নিলেও শেষ পর্যন্ত বিজয়ী ৬ সদস্যকে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়ার নির্দেশ দেন বিএনপির শীর্ষ নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রায় ১৫ মাস কারাগারে। বিএনপির সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন মোটেও ভালো না। এ অবস্থায় সংসদে যাওয়া নিয়ে বিএনপি যদি আগের অবস্থানেই থাকেÑ তাহলে সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন, প্যারোল বা মুক্তির বিষয়ে কঠোর অবস্থানেই থাকবে। আবার আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা আপাতত দেখছে না বিএনপি। ফলে বিএনপি অনড় অবস্থানে থেকে খালেদা জিয়ার ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে চায় না। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে চাইলেও দলটির জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতার মধ্যে বিরোধ দৃশ্যমান। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দলের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী নেতাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।