কান্নাভরা ঈদ নুসরাতের পরিবারের

গত বছরের রোজা ও ঈদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার শিকার সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। তবে এ বছর তিনি নেই। নিজের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হত্যাকারীদের আগুনে ঝলসে প্রাণ দিয়েছেন তিনি। তাকে হারিয়ে ভালো নেই তার পরিবারের সদস্যরা। একমাত্র আদরের মেয়েকে ছাড়া ঈদ করতে গিয়ে শোকে বিহ্বল নুসরাতের মা শিরিন আক্তার ও বাবা এ কে এম মুসা। নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানও বোন হারানোর বেদনায় কাতর। গত বুধবার ঈদের দিন নুসরাত জাহান রাফির মা শিরিন আক্তার জানান, নুসরাতের শোকে তার দুই ছেলে ও বাবা সারারাত ঘুমাননি। মেয়ে ও বোনের জন্য শোকে তারা কাতর। বাবা কোরআন তেলাওয়াত করেছেন। কিছুক্ষণ পর পর মা-মা, নুসরাত-নুসরাত বলে ডাকছেন। শিরিন আক্তারের নিজের কণ্ঠও ভারী। কে কাকে দেবেন সান্তনা। শিরিন আক্তারের কথা ছাপিয়ে আসছিল কান্নার শব্দ। ঈদের নামাজ পড়ে নুসরাতের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কবরস্থাানে অঝোরে কেঁদেছেন দুই ভাই ও নুসরাতের বাবা। তাদের কান্নায় আশপাশের লোকজনও অশ্রু দমিয়ে রাখতে পারেননি। কবর জিয়ারত শেষে বাড়িতে গেলে নুসরাতের পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে।

কথায় কথায় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। জানালেন, প্রতিবছর রমজানে ইফতার তৈরি থেকে শুরু করে সবাই মিলে ইফতার করার স্মৃতি কোনভাবে আমরা ভুলতে পারছি না। তিনি বলেন, প্রতি ঈদে নুসরাতকে নিয়ে ১০ রমজানের মধ্যে নতুন জামা কিনতে মার্কেটে যেতাম মায়ের সঙ্গে। তার পছন্দের কাপড় প্রথম কিনে তারপর আমাদের জন্য ঈদ বাজার শুরু করতাম। প্রতিবছর নুসরাত আমার ও মা এবং বাবার জন্য জামা পছন্দ করে কিনতো। বাবা ও মা সাধ্যমতো নুসরাত ও রায়হানের আবদার মেটানোর চেষ্টা করতেন। ‘যে বোন ছিল আমাদের আশার বাতি, ভয়াবহ নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেই বোনকে মৃত্যুবরণ করতে হলো।’ নুসরাতের বাবা মুসা বলেন, আমাদের এবারের ঈদে কোন আনন্দ নেই। সব আনন্দ শোকে পরিণত হয়েছে। নুসরাতের শূন্যতা আমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছে। জানি না সামনের দিনগুলোতে কিভাবে এই শোক কাটিয়ে উঠব। তিনি আরও বলেন, ‘নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে মানুষ করব। কিন্তু আর হলো না। সবাই পরিজন নিয়ে ঈদ করছে। আর আমি একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে কাঁদছি।’

পাড়ায় আনন্দ আমাদের

ঘরে শুধুই কান্নার শব্দ

ঈদের দিন নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ফেসবুকে বোনকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে রায়হান লিখেছেন, ‘আবার এসেছে ঈদ, পাড়া প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে দেখছি আনন্দের বন্যা। আর আমাদের ছোট্টঘরে শুধু কান্নার শব্দ। অথচ গত বছরের এই সময় আমাদের এই সংসারে কতই না আনন্দ ছিল। আজ আপুমনিকে হারিয়ে সব আনন্দ অশ্রুজলে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ঘাতকের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল আমাদের সোনালী সংসার। বারবার মনে পড়ছে বিগত বছরগুলোতে আপুর সঙ্গে কাটানো ঈদের দিনের সেসব ভুলতে না পারা স্মৃতিগুলো! যা আজ নিভে গিয়ে এক মুঠো ছাইয়ে রূপান্তরিত হয়েছে...।

একবুক চাপা কষ্ট, বেদনায় আমার ছোট্ট হৃদয়টি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে আপুর কথা। বারবার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে আপুর বলে যাওয়া শেষ কথাটিও রাখতে পারছি না... আপু বলেছিল রায়হান আব্বু আম্মুর দিকে খেয়াল রাখিস, কিন্তু কোনভাবে পারছি না আম্মুকে স্থির করতে। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে দিন-রাত কাঁদতে কাঁদতে দু-চোখের অশ্রুজলও শুকিয়ে গেছে...! বারবার শুধু মা মা করে চিৎকার করতেছে কিভাবে মাকে সান্ত¡না দিব নিজেকে নিজেই স্থির রাখতে পারছি না...।

যারা আমার শান্তিপূর্ণ ফ্যামিলিতে অশান্তি সৃষ্টি করে চিরদিনের জন্য আমার বুক থেকে আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন আমার কলিজার টুকরা একটি মাত্র বোনকে কেড়ে নিয়েছে আল্লাহ যেন তাদের ইহকাল ও পরকালে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন এই কামনা করি।

পরিবারের পাশে ফেনীর

পুলিশ সুপার

এদিকে নুসরাতের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়ান ফেনীর পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান। ঈদুল ফিতরের পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে সোনাগাজী থানায় নুসরাতের বাবা ও দুই ভাই পুলিশের এ আয়োজনে অংশ নেয়। এর আগে নুসরাত জাহান রাফির পরিবারের সদস্যদের জন্য ঈদ উপহার পাঠিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। নুসরাত জাহান রাফিকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখনও বাকরুদ্ধ। তাদের পরিবারে বইছে বেদনা। সে শোকাহত পরিবারকে সান্তনা দেয়ার জন্য সোনাগাজী থানায় আয়োজন করা হয় প্রীতিভোজ। এতে অংশ নেয় নুসরাতের বাবা মাওলানা একেএম মুসা, নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ও ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান। ফেনীর পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) কাজী মনিরুজ্জামান তাদের সার্বিক খোঁজ খবর নেন এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তিনি জানান, শুধু ঈদে নয়; সব সময় নুসরাত পরিবারের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক থাকবে। নুসরাতের পরিবার পুলিশ প্রশাসনের পরিবার। এ সময় নুসরাতের বাবা মাওলানা একেএম মুসা জানান, আমাদের জন্য ঈদ আসেনি। আমার কলিজার টুকরা মুক্তা (নুসরাত জাহান রাফি) কবরে ঘুমাচ্ছে, আমাদের কিসের ঈদ? তবুও বেদনার এই মুহূর্তে পুলিশের এই আয়োজনে আমাদের পুরো পরিবার কিছুটা শান্তনা পেয়েছি। পুলিশ প্রশাসন আমাদের সব ধরনের খোঁজ-খবর রাখছেন।

শনিবার, ০৮ জুন ২০১৯ , ২৫ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ৪ শাওয়াল ১৪৪০

কান্নাভরা ঈদ নুসরাতের পরিবারের

প্রতিনিধি, ফেনী

গত বছরের রোজা ও ঈদের আনন্দ পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার শিকার সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। তবে এ বছর তিনি নেই। নিজের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হত্যাকারীদের আগুনে ঝলসে প্রাণ দিয়েছেন তিনি। তাকে হারিয়ে ভালো নেই তার পরিবারের সদস্যরা। একমাত্র আদরের মেয়েকে ছাড়া ঈদ করতে গিয়ে শোকে বিহ্বল নুসরাতের মা শিরিন আক্তার ও বাবা এ কে এম মুসা। নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান, ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হানও বোন হারানোর বেদনায় কাতর। গত বুধবার ঈদের দিন নুসরাত জাহান রাফির মা শিরিন আক্তার জানান, নুসরাতের শোকে তার দুই ছেলে ও বাবা সারারাত ঘুমাননি। মেয়ে ও বোনের জন্য শোকে তারা কাতর। বাবা কোরআন তেলাওয়াত করেছেন। কিছুক্ষণ পর পর মা-মা, নুসরাত-নুসরাত বলে ডাকছেন। শিরিন আক্তারের নিজের কণ্ঠও ভারী। কে কাকে দেবেন সান্তনা। শিরিন আক্তারের কথা ছাপিয়ে আসছিল কান্নার শব্দ। ঈদের নামাজ পড়ে নুসরাতের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কবরস্থাানে অঝোরে কেঁদেছেন দুই ভাই ও নুসরাতের বাবা। তাদের কান্নায় আশপাশের লোকজনও অশ্রু দমিয়ে রাখতে পারেননি। কবর জিয়ারত শেষে বাড়িতে গেলে নুসরাতের পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে।

কথায় কথায় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। জানালেন, প্রতিবছর রমজানে ইফতার তৈরি থেকে শুরু করে সবাই মিলে ইফতার করার স্মৃতি কোনভাবে আমরা ভুলতে পারছি না। তিনি বলেন, প্রতি ঈদে নুসরাতকে নিয়ে ১০ রমজানের মধ্যে নতুন জামা কিনতে মার্কেটে যেতাম মায়ের সঙ্গে। তার পছন্দের কাপড় প্রথম কিনে তারপর আমাদের জন্য ঈদ বাজার শুরু করতাম। প্রতিবছর নুসরাত আমার ও মা এবং বাবার জন্য জামা পছন্দ করে কিনতো। বাবা ও মা সাধ্যমতো নুসরাত ও রায়হানের আবদার মেটানোর চেষ্টা করতেন। ‘যে বোন ছিল আমাদের আশার বাতি, ভয়াবহ নির্যাতনের বিচার চাইতে গিয়ে ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেই বোনকে মৃত্যুবরণ করতে হলো।’ নুসরাতের বাবা মুসা বলেন, আমাদের এবারের ঈদে কোন আনন্দ নেই। সব আনন্দ শোকে পরিণত হয়েছে। নুসরাতের শূন্যতা আমাদের অনেক কষ্ট দিচ্ছে। জানি না সামনের দিনগুলোতে কিভাবে এই শোক কাটিয়ে উঠব। তিনি আরও বলেন, ‘নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। খুব ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে মানুষ করব। কিন্তু আর হলো না। সবাই পরিজন নিয়ে ঈদ করছে। আর আমি একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে কাঁদছি।’

পাড়ায় আনন্দ আমাদের

ঘরে শুধুই কান্নার শব্দ

ঈদের দিন নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ফেসবুকে বোনকে নিয়ে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে রায়হান লিখেছেন, ‘আবার এসেছে ঈদ, পাড়া প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে দেখছি আনন্দের বন্যা। আর আমাদের ছোট্টঘরে শুধু কান্নার শব্দ। অথচ গত বছরের এই সময় আমাদের এই সংসারে কতই না আনন্দ ছিল। আজ আপুমনিকে হারিয়ে সব আনন্দ অশ্রুজলে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ঘাতকের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল আমাদের সোনালী সংসার। বারবার মনে পড়ছে বিগত বছরগুলোতে আপুর সঙ্গে কাটানো ঈদের দিনের সেসব ভুলতে না পারা স্মৃতিগুলো! যা আজ নিভে গিয়ে এক মুঠো ছাইয়ে রূপান্তরিত হয়েছে...।

একবুক চাপা কষ্ট, বেদনায় আমার ছোট্ট হৃদয়টি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে আপুর কথা। বারবার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে আপুর বলে যাওয়া শেষ কথাটিও রাখতে পারছি না... আপু বলেছিল রায়হান আব্বু আম্মুর দিকে খেয়াল রাখিস, কিন্তু কোনভাবে পারছি না আম্মুকে স্থির করতে। একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে দিন-রাত কাঁদতে কাঁদতে দু-চোখের অশ্রুজলও শুকিয়ে গেছে...! বারবার শুধু মা মা করে চিৎকার করতেছে কিভাবে মাকে সান্ত¡না দিব নিজেকে নিজেই স্থির রাখতে পারছি না...।

যারা আমার শান্তিপূর্ণ ফ্যামিলিতে অশান্তি সৃষ্টি করে চিরদিনের জন্য আমার বুক থেকে আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন আমার কলিজার টুকরা একটি মাত্র বোনকে কেড়ে নিয়েছে আল্লাহ যেন তাদের ইহকাল ও পরকালে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন এই কামনা করি।

পরিবারের পাশে ফেনীর

পুলিশ সুপার

এদিকে নুসরাতের পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়ান ফেনীর পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান। ঈদুল ফিতরের পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে সোনাগাজী থানায় নুসরাতের বাবা ও দুই ভাই পুলিশের এ আয়োজনে অংশ নেয়। এর আগে নুসরাত জাহান রাফির পরিবারের সদস্যদের জন্য ঈদ উপহার পাঠিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। নুসরাত জাহান রাফিকে হারিয়ে পুরো পরিবার এখনও বাকরুদ্ধ। তাদের পরিবারে বইছে বেদনা। সে শোকাহত পরিবারকে সান্তনা দেয়ার জন্য সোনাগাজী থানায় আয়োজন করা হয় প্রীতিভোজ। এতে অংশ নেয় নুসরাতের বাবা মাওলানা একেএম মুসা, নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ও ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান। ফেনীর পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) কাজী মনিরুজ্জামান তাদের সার্বিক খোঁজ খবর নেন এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তিনি জানান, শুধু ঈদে নয়; সব সময় নুসরাত পরিবারের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক থাকবে। নুসরাতের পরিবার পুলিশ প্রশাসনের পরিবার। এ সময় নুসরাতের বাবা মাওলানা একেএম মুসা জানান, আমাদের জন্য ঈদ আসেনি। আমার কলিজার টুকরা মুক্তা (নুসরাত জাহান রাফি) কবরে ঘুমাচ্ছে, আমাদের কিসের ঈদ? তবুও বেদনার এই মুহূর্তে পুলিশের এই আয়োজনে আমাদের পুরো পরিবার কিছুটা শান্তনা পেয়েছি। পুলিশ প্রশাসন আমাদের সব ধরনের খোঁজ-খবর রাখছেন।