বাজেট বাস্তবায়নে ‘ভ্যাট আয়নির্ভর’ সরকার

আয়করে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য রেকর্ড পরিমাণ বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। বিশাল এই বাজেট বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় অর্থের বড় অংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আয় থেকে আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কেননা আগামী অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে সরকার পাঁচটি হার রেখে ভ্যাটের নতুন আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তবে এ বছর বাজেট প্রস্তাবের অধিকাংশই ছিল ভ্যাটে ছাড় বিষয়ে। সে হিসেবে ভ্যাটের ওপর নির্ভর বাজেট কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের। যদিও আয়কর হওয়া উচিত রাজস্ব আদায়ের প্রথম খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্যাট সর্বস্তরের মানুষ দিয়ে থাকে। এর মধ্যে দরিদ্র মানুষও রয়েছে। সুতরাং ভ্যাটের ওপর চাপ বাড়ানো মানে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ানো। পক্ষান্তরে আয়করে ছাড় দেয়া মানে ধনীদের ছাড় দেয়া। সুতরাং সরকারের উচিত আয়করের দিকে মনোযোগ দেয়া। সরকার বলছে, আয়করদাতার সংখ্যাও বাড়ানো হবে। এজন্য আগামী অর্থবছর আয়করদাতার সংখ্যা ১ কোটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থবিভাগ সূত্র জানায়, আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে জন্য সম্ভাব্য বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বিশাল এই বাজেট বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে। এনবিআরের এ লক্ষ্য চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে ১৭ শতাংশ বা প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছিল। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্য কমিয়ে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে আহরণ হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯০ কোটি টাকা। ফলে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অর্থবছরের শেষ দুই মাসে (মে ও জুন) ১ লাখ ৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে সংস্থাটিকে। যা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর পরও বিশাল বাজেট বাস্তবায়নের আশা করছে সরকার। আর এজন্য ভ্যাটের ওপরই নির্ভর করা হচ্ছে।

নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। তাই ভ্যাট খাতেই আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ভ্যাট বাবদ ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। ভ্যাট খাতে চলতি অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারিত আছে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার।

আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে আয়কর খাতে। আয়কর খাতে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা আদায় করতে হবে এনবিআরকে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। এবার আয়করের সংশোধিত লক্ষ্য হলো ৯৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে শুল্ক খাতে লক্ষ্য বাড়ছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে শুল্ক খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৯২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে শুল্ক খাতে সংশোধিত লক্ষ্য হলো ৭৯ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।

এদিকে গত পাঁচ বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হয়েছে। অথচ এই পাঁচ বছরে রাজস্ব খাতে তেমন বড় কোন সংস্কার আনা হয়নি। নতুন ভ্যাট আইন ২০১৭ সালের জুলাই থেকে চালু হওয়ার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা দুই বছর পিছিয়ে দেয়া হয়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল দেড় লাখ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব আদায়ের এ লক্ষ্য বেড়ে আগামী অর্থবছরে সোয়া ৩ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হচ্ছে। কিন্তু সেই পুরোনো ‘ঢাল-তলোয়ার’ দিয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হচ্ছে।

এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, এনবিআরকে প্রতিবছর যে লক্ষ্য দেয়া হয়, তা কখনোই আদায় হয় না। এ কারণে পরে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ করতেও কষ্ট করতে হয় এনবিআরকে। তাই মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে করের পরিমাণ কমছে। এনবিআরে রাজস্ব আদায় বাড়াতে তাই রাজস্ব খাতে সংস্কারের ওপর জোর দেন সেলিম রায়হান।

সোমবার, ১০ জুন ২০১৯ , ২৭ জৈষ্ঠ্য ১৪২৫, ৬ শাওয়াল ১৪৪০

বাজেট বাস্তবায়নে ‘ভ্যাট আয়নির্ভর’ সরকার

আয়করে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ

রোকন মাহমুদ

image

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য রেকর্ড পরিমাণ বাজেট দিতে যাচ্ছে সরকার। বিশাল এই বাজেট বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় অর্থের বড় অংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আয় থেকে আদায়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কেননা আগামী অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে সরকার পাঁচটি হার রেখে ভ্যাটের নতুন আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। তবে এ বছর বাজেট প্রস্তাবের অধিকাংশই ছিল ভ্যাটে ছাড় বিষয়ে। সে হিসেবে ভ্যাটের ওপর নির্ভর বাজেট কতটুকু বাস্তবায়ন করা যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের। যদিও আয়কর হওয়া উচিত রাজস্ব আদায়ের প্রথম খাত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভ্যাট সর্বস্তরের মানুষ দিয়ে থাকে। এর মধ্যে দরিদ্র মানুষও রয়েছে। সুতরাং ভ্যাটের ওপর চাপ বাড়ানো মানে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ানো। পক্ষান্তরে আয়করে ছাড় দেয়া মানে ধনীদের ছাড় দেয়া। সুতরাং সরকারের উচিত আয়করের দিকে মনোযোগ দেয়া। সরকার বলছে, আয়করদাতার সংখ্যাও বাড়ানো হবে। এজন্য আগামী অর্থবছর আয়করদাতার সংখ্যা ১ কোটি নির্ধারণ করা হয়েছে।

অর্থবিভাগ সূত্র জানায়, আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে জন্য সম্ভাব্য বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বিশাল এই বাজেট বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে। এনবিআরের এ লক্ষ্য চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে ১৭ শতাংশ বা প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছিল। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্য কমিয়ে ২ লাখ ৮০ হাজার ৬৩ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে আহরণ হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭৩ হাজার ৯০ কোটি টাকা। ফলে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অর্থবছরের শেষ দুই মাসে (মে ও জুন) ১ লাখ ৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে সংস্থাটিকে। যা সম্ভব নয় বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর পরও বিশাল বাজেট বাস্তবায়নের আশা করছে সরকার। আর এজন্য ভ্যাটের ওপরই নির্ভর করা হচ্ছে।

নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। তাই ভ্যাট খাতেই আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ভ্যাট বাবদ ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। ভ্যাট খাতে চলতি অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারিত আছে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার।

আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে আয়কর খাতে। আয়কর খাতে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা আদায় করতে হবে এনবিআরকে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। এবার আয়করের সংশোধিত লক্ষ্য হলো ৯৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা।

অন্যদিকে শুল্ক খাতে লক্ষ্য বাড়ছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে শুল্ক খাতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য হচ্ছে ৯২ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে শুল্ক খাতে সংশোধিত লক্ষ্য হলো ৭৯ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।

এদিকে গত পাঁচ বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ানো হয়েছে। অথচ এই পাঁচ বছরে রাজস্ব খাতে তেমন বড় কোন সংস্কার আনা হয়নি। নতুন ভ্যাট আইন ২০১৭ সালের জুলাই থেকে চালু হওয়ার কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা দুই বছর পিছিয়ে দেয়া হয়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল দেড় লাখ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব আদায়ের এ লক্ষ্য বেড়ে আগামী অর্থবছরে সোয়া ৩ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হচ্ছে। কিন্তু সেই পুরোনো ‘ঢাল-তলোয়ার’ দিয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ হচ্ছে।

এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, এনবিআরকে প্রতিবছর যে লক্ষ্য দেয়া হয়, তা কখনোই আদায় হয় না। এ কারণে পরে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্য পূরণ করতেও কষ্ট করতে হয় এনবিআরকে। তাই মোট দেশজ উৎপাদনের অনুপাতে করের পরিমাণ কমছে। এনবিআরে রাজস্ব আদায় বাড়াতে তাই রাজস্ব খাতে সংস্কারের ওপর জোর দেন সেলিম রায়হান।