ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের ‘এক্সিট’-এর ব্যবস্থা করবেন অর্থমন্ত্রী

ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের এ থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি করতে চান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ জন্য বাজেটে একটি প্রস্তাবনাও দিয়েছেন তিনি। প্রস্তাবনা অনুসারে আগামী অর্থবছরই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের জন্য একটি ‘এক্সিট’-এর ব্যবস্থা করা হবে। দেশে বিদ্যমান দেউলিয়া আইনের পথ ধরে এই ব্যবস্থা করা হবে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ২০১৯-২০ বাজেট প্রস্তাবে তার বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কোন প্রকার সংস্কার আমরা দেখিনি। ব্যাংক থেকে কোন ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে এ জন্য কোন প্রকার এক্সিটের ব্যবস্থা ছিল না। আমরা এবার এ কার্যক্রমটি আইনি প্রক্রিয়ায় সুরাহার জন্য একটি কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও ব্যাংকরাপসি আইনের (দেউলিয়া আইন) হাত ধরে ঋণগ্রহীতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এক্সিটের ব্যবস্থা ছাড়াও আর্থিক খাত সংস্কারে বাজেটে আরও ৮টি কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ব্যাংকিং কমিশন অন্যতম। তবে এ বিষয়ে কোন প্রস্তাব তিনি বাজেট বক্তব্যে দেননি। শুধু সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিষয়ে বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তব্যে তিনি এ বিষয়ে বলেন, দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের উপরে দেখতে চাই না। এ জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, যেসব ঋণগ্রহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন বা ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। হোল্ডিং কোম্পানি ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয় এবং যুগোপযোগী করার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করার প্রস্তাব এসেছে বাজেট বক্তব্যে। তবে ব্যাংক খাতের সংস্কারের প্রথম কাজটি হবে মূলধন বাড়ানো। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে আমরা ব্যাংকের মূলধনের (অনুমোদিত ও পরিশোধিত) পরিমাণ বাড়াব।

ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অঙ্গগুলো যথা- ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর সংক্রান্ত আইনসহ অন্যান্য আইনের সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোন কিছু সাংঘর্ষিক না থাকে, এ জন্য আইনটির (ব্যাংক কোম্পানি আইন) সংস্কার আনা হবে।

বাজেটে বলা হয়, আর্থিক খাতে আগে বিশেষ কোন উপকর ছিল না। তাই ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণে বাধ্য হতো। এতে ব্যাংকিং খাতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এটি কখনও কখনও সংকট সৃষ্টি করে থাকে। এ জাতীয় ভারসাম্যহীনতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। একটি গতিশীল বন্ড মার্কেট তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের বন্ড ছাড়াকে উৎসাহিত করা হবে।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের বিষয়ে এতদিন ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা শুনে আসছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীকালে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।

জানা গেছে, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি এ দেশে নতুন নয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর ফেরত না দেয়ার ঘটনা অহরহ। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকার বিভিন্ন আইনও প্রণয়ন করেছে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না, এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকের অর্থ উদ্ধারে ১৯৯৭ সালে সরকার দেউলিয়া আইন প্রণয়ন করে। ২০০০ সালে এ আইনের অধীন একটি মাত্র কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর এ আইনে কোন বিচার হয়নি।

দেউলিয়া আইন অনুযায়ী দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান ঋণ পায় না। এর সম্পদ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কর্তৃপক্ষ সম্পদ বিক্রি করে দায় মেটাতে পারে। দেউলিয়া ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হওয়াসহ নাগরিক অধিকারও হারায়। কিন্তু সারাদেশে স্থাপিত দেউলিয়া আদালতে ব্যাংকগুলো কয়েক হাজার মামলা করলেও এর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কাউকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হচ্ছে না। ফলে আইনের কার্যকারিতা বা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

দেশে প্রতিবছরই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেউলিয়া আইনের প্রয়োগ চাইছে। সম্প্রতি দেউলিয়া আইন যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে দেউলিয়া আইন ১৯৯৭ কার্যকর রয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায় ও খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ কার্যকর রয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা থাকলেও দেউলিয়া আইনের কার্যকারিতা নেই।

দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ে দেউলিয়া আইনের সংস্কার ও কার্যকর প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

শনিবার, ১৫ জুন ২০১৯ , ১ আষাঢ় ১৪২৫, ১১ শাওয়াল ১৪৪০

ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের ‘এক্সিট’-এর ব্যবস্থা করবেন অর্থমন্ত্রী

রোকন মাহমুদ

ব্যাংক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের এ থেকে বের হওয়ার পথ তৈরি করতে চান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ জন্য বাজেটে একটি প্রস্তাবনাও দিয়েছেন তিনি। প্রস্তাবনা অনুসারে আগামী অর্থবছরই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের জন্য একটি ‘এক্সিট’-এর ব্যবস্থা করা হবে। দেশে বিদ্যমান দেউলিয়া আইনের পথ ধরে এই ব্যবস্থা করা হবে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ২০১৯-২০ বাজেট প্রস্তাবে তার বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কোন প্রকার সংস্কার আমরা দেখিনি। ব্যাংক থেকে কোন ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে এ জন্য কোন প্রকার এক্সিটের ব্যবস্থা ছিল না। আমরা এবার এ কার্যক্রমটি আইনি প্রক্রিয়ায় সুরাহার জন্য একটি কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও ব্যাংকরাপসি আইনের (দেউলিয়া আইন) হাত ধরে ঋণগ্রহীতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এক্সিটের ব্যবস্থা ছাড়াও আর্থিক খাত সংস্কারে বাজেটে আরও ৮টি কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ব্যাংকিং কমিশন অন্যতম। তবে এ বিষয়ে কোন প্রস্তাব তিনি বাজেট বক্তব্যে দেননি। শুধু সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিষয়ে বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তব্যে তিনি এ বিষয়ে বলেন, দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের উপরে দেখতে চাই না। এ জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি।

ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, যেসব ঋণগ্রহীতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন বা ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। হোল্ডিং কোম্পানি ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয় এবং যুগোপযোগী করার জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করার প্রস্তাব এসেছে বাজেট বক্তব্যে। তবে ব্যাংক খাতের সংস্কারের প্রথম কাজটি হবে মূলধন বাড়ানো। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে আমরা ব্যাংকের মূলধনের (অনুমোদিত ও পরিশোধিত) পরিমাণ বাড়াব।

ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অঙ্গগুলো যথা- ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর সংক্রান্ত আইনসহ অন্যান্য আইনের সঙ্গে ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোন কিছু সাংঘর্ষিক না থাকে, এ জন্য আইনটির (ব্যাংক কোম্পানি আইন) সংস্কার আনা হবে।

বাজেটে বলা হয়, আর্থিক খাতে আগে বিশেষ কোন উপকর ছিল না। তাই ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণে বাধ্য হতো। এতে ব্যাংকিং খাতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এটি কখনও কখনও সংকট সৃষ্টি করে থাকে। এ জাতীয় ভারসাম্যহীনতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। একটি গতিশীল বন্ড মার্কেট তৈরি করতে বিভিন্ন ধরনের বন্ড ছাড়াকে উৎসাহিত করা হবে।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের বিষয়ে এতদিন ব্যাংক কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা শুনে আসছি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে পরবর্তীকালে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।

জানা গেছে, ঋণখেলাপি সংস্কৃতি এ দেশে নতুন নয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর ফেরত না দেয়ার ঘটনা অহরহ। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকার বিভিন্ন আইনও প্রণয়ন করেছে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না বা দিতে পারছে না, এমন প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকের অর্থ উদ্ধারে ১৯৯৭ সালে সরকার দেউলিয়া আইন প্রণয়ন করে। ২০০০ সালে এ আইনের অধীন একটি মাত্র কোম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর এ আইনে কোন বিচার হয়নি।

দেউলিয়া আইন অনুযায়ী দেউলিয়া প্রতিষ্ঠান ঋণ পায় না। এর সম্পদ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কর্তৃপক্ষ সম্পদ বিক্রি করে দায় মেটাতে পারে। দেউলিয়া ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হওয়াসহ নাগরিক অধিকারও হারায়। কিন্তু সারাদেশে স্থাপিত দেউলিয়া আদালতে ব্যাংকগুলো কয়েক হাজার মামলা করলেও এর নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কাউকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হচ্ছে না। ফলে আইনের কার্যকারিতা বা সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

দেশে প্রতিবছরই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেউলিয়া আইনের প্রয়োগ চাইছে। সম্প্রতি দেউলিয়া আইন যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে দেউলিয়া আইন ১৯৯৭ কার্যকর রয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায় ও খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ কার্যকর রয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে অর্থঋণ আদালত আইনের প্রয়োগ ও কার্যকারিতা থাকলেও দেউলিয়া আইনের কার্যকারিতা নেই।

দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ে দেউলিয়া আইনের সংস্কার ও কার্যকর প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।