পরোয়ানার ২০ দিন পর

ওসি মোয়াজ্জেম গ্রেফতার

ঢাকায় খালার বাসায় লুকিয়ে ছিল

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ২০ দিন পর হাইকোর্টে গোপনে জামিন নিতে এসে গ্রেফতার হয়েছেন সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। গতকাল বেলা ৩টার দিকে হাইকোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় গেটের কাছ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের টিম তাকে গ্রেফতার করে। এরপর তাকে শাহবাগ থানা পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। তিনি রাজধানীর কল্যাণপুরে খালার বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন বলে জানা গেছে। খোদ রাজধানীতেই এতদিন আত্মগোপনে থাকার পরও গত ২০ দিন ধরে খুঁজে না পাওয়া; কিভাবে জামিন নিতে এসেছিলেন; তিনি কোথায় আত্মগোপনে ছিলেনÑ এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন মামলায় আসামিদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়, সেখানে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও কেন বরখাস্ত হওয়া পুলিশের একজন ওসিকে গ্রেফতার করতে ২০ দিন সময় লাগলো- তা নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

গ্রেফতার হওয়ার খবরে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ওসি মোয়াজ্জেমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে নুসরাতের পরিবার।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সর্দার জানান, আমাদের কাছে গোপন তথ্য ছিল বরখাস্ত হওয়া ওসি মোয়াজ্জেম এখানে (হাইকোর্ট এলাকা) থাকতে পারেন। তাই পুলিশের গোয়েন্দা টিমসহ একাধিক টিম তাকে গ্রেফতারের জন্য হাইকোর্ট এলাকার আশপাশে অবস্থান নেয় এবং তাকে গ্রেফতার করে। ডিসি মারুফ জানান, সোনাগাজী থানায় তার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে। গ্রেফতারের পরই আমরা সোনাগাজী থানায় যোগাযোগ করেছি। সেই থানার প্রতিনিধি আসলে তাদের কাছে মোয়াজ্জেমকে হস্তান্তর করা হবে। যতক্ষণ হস্তান্তর না করা হবে ততক্ষণ শাহবাগ থানায় রাখা হবে তাকে।

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলায় করায় গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা চলাকালীন মাদ্রাসার কেন্দ্রে নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তার অনুসারীরা। পরিকল্পিতভাবে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে ওই ঘটনাকে আত্মহত্যার চেষ্টা ছিল বলে প্রচার করেন ওসি মোয়াজ্জেম। চিকিৎসাধীন থাকা অগ্নিদ্বগ্ধ রাফি জবানবন্দি দিলে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে মামলা করার উদ্যোগ নেন। ওসি মূল আসামিদের বাঁচাতে মনগড়া এজাহার লিখে নুসরাতের ভাইয়ের কাছ থেকে সাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করেন। পরে ওসির বিরুদ্ধে আসামিদের পক্ষ নেয়া এবং আসামিদের গ্রেফতার না করে তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ উঠলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত। এর আগে ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা কর্তৃক নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় মামলা করতে গেলে ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে অশ্লীল প্রশ্ন করে নাজেহাল করে। ওই জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ১৫ এপ্রিল ওই ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে ওসি মোয়াজ্জেমকে আসামি করে ঢাকায় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামছ জগলুল হোসেন ওই অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন পিবিআইকে। এর ধারাবাহিকতায় পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে ওসি মোয়াজ্জেমের নিজের মোবাইল ফোনে জবানবন্দি রেকর্ড করা এবং তা ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামছ জগলুল হোসেন গত ২৭ মে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। হাসপাতালে নুসরাতের মৃত্যুর পর ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রথমে সোনাগাজী থানা থেকে প্রত্যাহার করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ও রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করতে রংপুর রেঞ্জ ও ফেনী পুলিশের মধ্যে ঠেলাঠেলির মধ্যে ওসি মোয়াজ্জেম আত্মগোপন করে। এর মধ্যে নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় পিবিআই। সব আসামিকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে পিবিআই। হত্যার কয়েকদিনের মধ্যে আসামিরা গ্রেফতার হওয়া ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও ওসি মোয়াজ্জেম ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। ফলে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতারে পুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে বলেন ওসি মোয়াজ্জেম পলাতক থাকায় তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। এরপর বলেন তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ওসি মোয়াজ্জেম পালিয়ে যেতে পারেন এমন আশঙ্কায় সীমান্ত, বিমানবন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়।

যেভাবে গ্রেফতার হলেন মোয়াজ্জেম : তথ্য প্রযুক্তি আইনে করা মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও আদালতের আদেশের কপি হাতে না পৌঁছানোর অজুহাত দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয়নি ওসি মোয়াজ্জেমকে। এর ফাঁকে তিনি গোপনে জামিন নিতে হাইকোর্টে আইনজীবীর মাধ্যমে নথিপত্র জমা দেন। বিষয়টি প্রকাশ হলে জামিনের শুনানি বন্ধ করে রাখে আদালত। এরপর ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার না করা নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর মোয়াজ্জেম আত্মগোপনে যান। পুলিশ তাকে গ্রেফতারে তৎপর হয়। ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো হয় তার গ্রামের বাড়ি যশোরে। এতো তৎপরতার মধ্যেও গতকাল তিনি হাইকোর্ট এলাকায় আসেন জামিন নেয়ার চেষ্টায়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যে করেই হোক আদালত থেকে জামিন নেয়ার চেষ্টা ছিল তার। এজন্য দাড়ি-গোঁফ বড় করে চেহারা পাল্টানোর চেষ্টাও করেন। শনিবার রাতে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। গোপনে জামিন নিতে কৌশলে আদালত চত্বরে প্রবেশ করেন। একজন আইনজীবীর মাধ্যমে মামলায় জামিনের আবেদনও করেন। তবে আগে থেকেই মোয়াজ্জেম হোসেনকে নজরদারিতে রেখেছিল শাহবাগ থানা পুলিশ। আদালত চত্বর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহবাগ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি।

হাইকোর্টে ডিউটিরত ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, ওসি মোয়াজ্জেমের দাড়ি-গোঁফ বড় ছিল। তাই প্রথমে তাকে চিনতে পারেনি ডিবি পুলিশের টিম। কয়েকবারের চেষ্টায় তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। সোনাগাজী থানার সাবেক এই ওসির সঙ্গে থাকা তার সাবেক গাড়িচালক মোহাম্মদ জাফর জানান, সকাল ১০টায় তারা অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের চেম্বারে যান। সেখান থেকে আদালতে গিয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলাটির শুনানির জন্য আবেদন করেন। দুপুর ১টার দিকে আবেদনটিতে নম্বর পড়ে। নম্বর : ৪২৭৭০। এ সময় তাদের জানানো হয় সোমবার সকাল ১০টায় মামলাটির শুনানি হবে। দুপুরের পর তিনি খাবার খেতে রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে ডিবির একটি দল তাকে অনুসরণ করে। ডিবি পিছু নিয়েছে টের পেয়ে সেখান থেকে কৌশলে বের হয়ে আসেন মোয়াজ্জেম। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

খালার বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন মোয়াজ্জেম : পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর ধারণা, গত ২০ দিন তিনি ঢাকায় পরিচয় লুকিয়ে বিভিন্ন বন্ধু-স্বজনের কাছে আত্মগোপনে ছিলেন। তার ধারণা ছিল, ১৬ জুন উচ্চ আদালত খুলবে। এদিন হয়তো তিনি আগাম জামিন পাবেন। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা না দেখে আবারও আত্মগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। পুলিশের ধারণা ছিল, উচ্চ আদালত খোলার দিন মোয়াজ্জেম জামিনের জন্য চেষ্টা করতে পারেন। সেজন্য হাইকোর্ট এলাকায়ও নজরদারি বাড়ানো হয়। এছাড়া মোবাইল ফোনে তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন কিনাÑসেজন্য শুরু থেকেই তার স্বজনদের মোবাইল নম্বরও ট্র্যাকিং করা হচ্ছিল।

শাহবাগ থানার পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওসি মোয়াজ্জেম গত ২৭ এপ্রিল থেকে ১০ জুন পর্যন্ত রাজধানীর কল্যাণপুরে এক খালার বাসায় ছিলেন। গোয়েন্দারা তাকে খুঁজছেন, বিষয়টি টের পেয়ে সেখান থেকে সটকে পড়েন। চলে যান কুমিল্লা। সেখানে তার নিজের বাড়ি রয়েছে। কিন্তু তিনি ওই বাড়িতে না উঠে আত্মগোপন করেন চান্দিনায়। সেখানে তার খালাতো ভাই আসাদুজ্জামান রয়েছেন। আসাদুজ্জামান চান্দিনা থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসেবে রয়েছেন। কিন্তু ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে ধরতে গত কয়েকদিন কুমিল্লায় অবস্থান করছিল। গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গত ১৪ জুন রাতে ওই বাসা থেকেও সটকে পড়েন। সেখান থেকে তিনি আবার ঢাকায় এসে খালার বাসায় না উঠে অন্য এক বন্ধুর বাসায় ওঠেন। সেখান থেকেই গতকাল উচ্চ আদালতে যান আগাম জামিনের আশায়। তিনি কোন মোবাইল নম্বরে কথা বলতেন না। বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে কথা বলতেন।

যে অপকর্ম করেছিলেন : ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করে। নুসরাতের মা থানায় মামলা করতে গেলে ওসি নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডাকেন। সেখানে একজন সাংবাদিককে সামনে রেখে নুসরাতকে অশ্লীল প্রশ্ন করেন। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে বলে চাপ প্রয়োগ করেন। ওসির অশ্লীল প্রশ্নে নুসরাত কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওইসব দৃশ্য ভিডিও করেন ওসি মোয়াজ্জেম। নুসরাতের বিরুদ্ধে নানা রকম কুৎসা রটিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেয়ার দাবিতে ‘সিরাজ মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে পেছন থেকে ভূমিকা রাখেন ওসি মোয়াজ্জেম। নুসরাতের জীবন হুমকির মুখে জেনেও তার নিরাপত্তায় কোন ভূমিকা নেননি ওসি মোয়াজ্জেম। ওইদিন নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার পর পরই ঘটনা তদন্ত না করে উল্টো আলামত নষ্ট করেন। ঘটনা তদন্ত না করেই মন্তব্য করেন- নুসরাত আত্মহত্যার জন্য নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়েছে। ঘটনার পর আসামিদের গ্রেফতার না করে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। মূল ঘটনা ধামাচাপা দিতে মূল আসামিদের বাদ রেখে মনগড়া এজাহার তৈরি করে তাতে সাক্ষর দেয়ার জন্য একটি অভিযোগের কপি ঢাকায় পাঠান। আসামিদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন। পরে মামলা পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলে পিবিআই মূল আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করে। এরপরই ওসির নানা অপকর্মের কাহিনি বের হয়ে আসতে থাকে।

সোমবার, ১৭ জুন ২০১৯ , ৩ আষাঢ় ১৪২৫, ১৩ শাওয়াল ১৪৪০

পরোয়ানার ২০ দিন পর

ওসি মোয়াজ্জেম গ্রেফতার

ঢাকায় খালার বাসায় লুকিয়ে ছিল

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ২০ দিন পর হাইকোর্টে গোপনে জামিন নিতে এসে গ্রেফতার হয়েছেন সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। গতকাল বেলা ৩টার দিকে হাইকোর্ট থেকে বের হওয়ার সময় গেটের কাছ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের টিম তাকে গ্রেফতার করে। এরপর তাকে শাহবাগ থানা পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয়। তিনি রাজধানীর কল্যাণপুরে খালার বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন বলে জানা গেছে। খোদ রাজধানীতেই এতদিন আত্মগোপনে থাকার পরও গত ২০ দিন ধরে খুঁজে না পাওয়া; কিভাবে জামিন নিতে এসেছিলেন; তিনি কোথায় আত্মগোপনে ছিলেনÑ এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিভিন্ন মামলায় আসামিদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়, সেখানে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও কেন বরখাস্ত হওয়া পুলিশের একজন ওসিকে গ্রেফতার করতে ২০ দিন সময় লাগলো- তা নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

গ্রেফতার হওয়ার খবরে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ওসি মোয়াজ্জেমের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে নুসরাতের পরিবার।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সর্দার জানান, আমাদের কাছে গোপন তথ্য ছিল বরখাস্ত হওয়া ওসি মোয়াজ্জেম এখানে (হাইকোর্ট এলাকা) থাকতে পারেন। তাই পুলিশের গোয়েন্দা টিমসহ একাধিক টিম তাকে গ্রেফতারের জন্য হাইকোর্ট এলাকার আশপাশে অবস্থান নেয় এবং তাকে গ্রেফতার করে। ডিসি মারুফ জানান, সোনাগাজী থানায় তার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে। গ্রেফতারের পরই আমরা সোনাগাজী থানায় যোগাযোগ করেছি। সেই থানার প্রতিনিধি আসলে তাদের কাছে মোয়াজ্জেমকে হস্তান্তর করা হবে। যতক্ষণ হস্তান্তর না করা হবে ততক্ষণ শাহবাগ থানায় রাখা হবে তাকে।

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলায় করায় গত ৬ এপ্রিল আলিম পরীক্ষা চলাকালীন মাদ্রাসার কেন্দ্রে নুসরাত জাহান রাফির গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় তার অনুসারীরা। পরিকল্পিতভাবে ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে ওই ঘটনাকে আত্মহত্যার চেষ্টা ছিল বলে প্রচার করেন ওসি মোয়াজ্জেম। চিকিৎসাধীন থাকা অগ্নিদ্বগ্ধ রাফি জবানবন্দি দিলে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে মামলা করার উদ্যোগ নেন। ওসি মূল আসামিদের বাঁচাতে মনগড়া এজাহার লিখে নুসরাতের ভাইয়ের কাছ থেকে সাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করেন। পরে ওসির বিরুদ্ধে আসামিদের পক্ষ নেয়া এবং আসামিদের গ্রেফতার না করে তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ উঠলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দেয়া হয়। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় নুসরাত। এর আগে ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা কর্তৃক নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় মামলা করতে গেলে ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে অশ্লীল প্রশ্ন করে নাজেহাল করে। ওই জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ১৫ এপ্রিল ওই ভিডিও ছড়ানোর অভিযোগে ওসি মোয়াজ্জেমকে আসামি করে ঢাকায় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামছ জগলুল হোসেন ওই অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন পিবিআইকে। এর ধারাবাহিকতায় পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়, যেখানে ওসি মোয়াজ্জেমের নিজের মোবাইল ফোনে জবানবন্দি রেকর্ড করা এবং তা ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মাদ আস সামছ জগলুল হোসেন গত ২৭ মে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। হাসপাতালে নুসরাতের মৃত্যুর পর ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রথমে সোনাগাজী থানা থেকে প্রত্যাহার করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ও রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা তামিল করতে রংপুর রেঞ্জ ও ফেনী পুলিশের মধ্যে ঠেলাঠেলির মধ্যে ওসি মোয়াজ্জেম আত্মগোপন করে। এর মধ্যে নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয় পিবিআই। সব আসামিকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করে পিবিআই। হত্যার কয়েকদিনের মধ্যে আসামিরা গ্রেফতার হওয়া ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার পর বিচার কার্যক্রম শুরু হলেও ওসি মোয়াজ্জেম ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। ফলে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতারে পুলিশের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমে বলেন ওসি মোয়াজ্জেম পলাতক থাকায় তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। এরপর বলেন তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ওসি মোয়াজ্জেম পালিয়ে যেতে পারেন এমন আশঙ্কায় সীমান্ত, বিমানবন্দরগুলোতে সতর্কতা জারি করা হয়।

যেভাবে গ্রেফতার হলেন মোয়াজ্জেম : তথ্য প্রযুক্তি আইনে করা মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও আদালতের আদেশের কপি হাতে না পৌঁছানোর অজুহাত দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয়নি ওসি মোয়াজ্জেমকে। এর ফাঁকে তিনি গোপনে জামিন নিতে হাইকোর্টে আইনজীবীর মাধ্যমে নথিপত্র জমা দেন। বিষয়টি প্রকাশ হলে জামিনের শুনানি বন্ধ করে রাখে আদালত। এরপর ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার না করা নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর মোয়াজ্জেম আত্মগোপনে যান। পুলিশ তাকে গ্রেফতারে তৎপর হয়। ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠানো হয় তার গ্রামের বাড়ি যশোরে। এতো তৎপরতার মধ্যেও গতকাল তিনি হাইকোর্ট এলাকায় আসেন জামিন নেয়ার চেষ্টায়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যে করেই হোক আদালত থেকে জামিন নেয়ার চেষ্টা ছিল তার। এজন্য দাড়ি-গোঁফ বড় করে চেহারা পাল্টানোর চেষ্টাও করেন। শনিবার রাতে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। গোপনে জামিন নিতে কৌশলে আদালত চত্বরে প্রবেশ করেন। একজন আইনজীবীর মাধ্যমে মামলায় জামিনের আবেদনও করেন। তবে আগে থেকেই মোয়াজ্জেম হোসেনকে নজরদারিতে রেখেছিল শাহবাগ থানা পুলিশ। আদালত চত্বর থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শাহবাগ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন তিনি।

হাইকোর্টে ডিউটিরত ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, ওসি মোয়াজ্জেমের দাড়ি-গোঁফ বড় ছিল। তাই প্রথমে তাকে চিনতে পারেনি ডিবি পুলিশের টিম। কয়েকবারের চেষ্টায় তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। সোনাগাজী থানার সাবেক এই ওসির সঙ্গে থাকা তার সাবেক গাড়িচালক মোহাম্মদ জাফর জানান, সকাল ১০টায় তারা অ্যাডভোকেট সালমা ইসলামের চেম্বারে যান। সেখান থেকে আদালতে গিয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলাটির শুনানির জন্য আবেদন করেন। দুপুর ১টার দিকে আবেদনটিতে নম্বর পড়ে। নম্বর : ৪২৭৭০। এ সময় তাদের জানানো হয় সোমবার সকাল ১০টায় মামলাটির শুনানি হবে। দুপুরের পর তিনি খাবার খেতে রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে ডিবির একটি দল তাকে অনুসরণ করে। ডিবি পিছু নিয়েছে টের পেয়ে সেখান থেকে কৌশলে বের হয়ে আসেন মোয়াজ্জেম। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

খালার বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন মোয়াজ্জেম : পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রগুলোর ধারণা, গত ২০ দিন তিনি ঢাকায় পরিচয় লুকিয়ে বিভিন্ন বন্ধু-স্বজনের কাছে আত্মগোপনে ছিলেন। তার ধারণা ছিল, ১৬ জুন উচ্চ আদালত খুলবে। এদিন হয়তো তিনি আগাম জামিন পাবেন। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা না দেখে আবারও আত্মগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। পুলিশের ধারণা ছিল, উচ্চ আদালত খোলার দিন মোয়াজ্জেম জামিনের জন্য চেষ্টা করতে পারেন। সেজন্য হাইকোর্ট এলাকায়ও নজরদারি বাড়ানো হয়। এছাড়া মোবাইল ফোনে তিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন কিনাÑসেজন্য শুরু থেকেই তার স্বজনদের মোবাইল নম্বরও ট্র্যাকিং করা হচ্ছিল।

শাহবাগ থানার পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওসি মোয়াজ্জেম গত ২৭ এপ্রিল থেকে ১০ জুন পর্যন্ত রাজধানীর কল্যাণপুরে এক খালার বাসায় ছিলেন। গোয়েন্দারা তাকে খুঁজছেন, বিষয়টি টের পেয়ে সেখান থেকে সটকে পড়েন। চলে যান কুমিল্লা। সেখানে তার নিজের বাড়ি রয়েছে। কিন্তু তিনি ওই বাড়িতে না উঠে আত্মগোপন করেন চান্দিনায়। সেখানে তার খালাতো ভাই আসাদুজ্জামান রয়েছেন। আসাদুজ্জামান চান্দিনা থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসেবে রয়েছেন। কিন্তু ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে ধরতে গত কয়েকদিন কুমিল্লায় অবস্থান করছিল। গোয়েন্দা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গত ১৪ জুন রাতে ওই বাসা থেকেও সটকে পড়েন। সেখান থেকে তিনি আবার ঢাকায় এসে খালার বাসায় না উঠে অন্য এক বন্ধুর বাসায় ওঠেন। সেখান থেকেই গতকাল উচ্চ আদালতে যান আগাম জামিনের আশায়। তিনি কোন মোবাইল নম্বরে কথা বলতেন না। বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে কথা বলতেন।

যে অপকর্ম করেছিলেন : ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করে। নুসরাতের মা থানায় মামলা করতে গেলে ওসি নুসরাতকে নিজ কক্ষে ডাকেন। সেখানে একজন সাংবাদিককে সামনে রেখে নুসরাতকে অশ্লীল প্রশ্ন করেন। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে বলে চাপ প্রয়োগ করেন। ওসির অশ্লীল প্রশ্নে নুসরাত কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওইসব দৃশ্য ভিডিও করেন ওসি মোয়াজ্জেম। নুসরাতের বিরুদ্ধে নানা রকম কুৎসা রটিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেয়ার দাবিতে ‘সিরাজ মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনে পেছন থেকে ভূমিকা রাখেন ওসি মোয়াজ্জেম। নুসরাতের জীবন হুমকির মুখে জেনেও তার নিরাপত্তায় কোন ভূমিকা নেননি ওসি মোয়াজ্জেম। ওইদিন নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার পর পরই ঘটনা তদন্ত না করে উল্টো আলামত নষ্ট করেন। ঘটনা তদন্ত না করেই মন্তব্য করেন- নুসরাত আত্মহত্যার জন্য নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়েছে। ঘটনার পর আসামিদের গ্রেফতার না করে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। মূল ঘটনা ধামাচাপা দিতে মূল আসামিদের বাদ রেখে মনগড়া এজাহার তৈরি করে তাতে সাক্ষর দেয়ার জন্য একটি অভিযোগের কপি ঢাকায় পাঠান। আসামিদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন। পরে মামলা পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হলে পিবিআই মূল আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করে। এরপরই ওসির নানা অপকর্মের কাহিনি বের হয়ে আসতে থাকে।