পেশাগত উৎকর্ষে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে

সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার অগ্রগতি নেই

জনপ্রশাসনে রাজনীতিকরণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি ঘটায় পেশাগত উৎকর্ষে ব্যাপক ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদন উঠে এসেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলেও ‘জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার: নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি বলছে, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ প্রণোদনামূলক বিষয়ে অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও এখনো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জবাবদিহি নিশ্চিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে কৌশলের চর্চা শুরুই হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ না হওয়ায় প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গতকাল টিআইবির ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে টিআইবি। প্রতিবেদনে জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালনায় বিদ্যমান আইনি কাঠামো ও সংশ্লিষ্ট আইনের চর্চাসমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত কৌশলগুলো বাস্তবায়ন যেসব আইন ও নীতিকাঠামো দ্বারা পরিচালিত সেগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি জনপ্রশাসনের কার্যক্রমে এসব আইন ও নীতি প্রয়োগের চর্চাগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়া সরকারের সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ, দফতর, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ের প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা যাদের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি, শৃঙ্খলাজনিত বিষয়, মূল্যায়ন, প্রণোদনা ইত্যাদি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, তা গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত নীতিগুলো পর্যালোচনা এবং সেগুলোর চর্চার বিষয়ে গবেষণা করে জনপ্রশাসনে দক্ষ জনবল ও নিয়মতান্ত্রিক পদোন্নতি নিশ্চিত করা, অসন্তোষের ঝুঁকি নিরসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং সার্বিকভাবে জনস্বার্থে ৯ দফা সুপারিশও করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের মহাসচিব অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মহুয়া রউফ এবং গবেষণাটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম. আকরাম। প্রতিবেদনের বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে যেগুলোতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিমূলক ইতিবাচক প্রণোদনা দেয়ার অঙ্গীকার ছিল, সেক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা অভূতপূর্ব। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি, অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে বা দায়িত্বপালনের ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা জবাবদিহি নিশ্চিতে যেসব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে সেগুলো শক্তিশালী করতে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে যেসব দিকনির্দেশনা বা কৌশল ছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি বা কোন ধরনের অগ্রগতি হয়নি। কাজেই আমরা একদিক থেকে যেমন সার্বিকভাবে অগ্রগতি হচ্ছে বিবেচনায় সন্তোষ প্রকাশ করতে পারি, অন্যদিকে বাস্তবে শুদ্ধাচার কৌশলের প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া এখনো সুদূর পরাহত রয়েছে।

সরকারি কর্মচারী আইনের কতিপয় মৌলিক ধারার সমালোচনা করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি চাকরি আইন নামটিই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনটির নাম হওয়ার কথা ছিল জনপ্রশাসন আইন। তাই আমরা আইনটির নাম সংশোধনের দাবি জানাই। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধে গ্রেফতারের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণের বিধিও সম্পূর্ণরূপে সংবিধান পরিপন্থী ও বৈষম্যমূলক। এই বিধিও বাতিল করতে হবে। এছাড়া এই আইনের ৬.১ ধারায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব কর্তৃত্ব সরকারের কাছেই রাখা হয়েছে, যা ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ এই সাংবিধানিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ প্রণীত হওয়ার ছয় বছর পার হলেও এতে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে প্রণোদনা ও পারিতোষিক, প্রশিক্ষণ, যৌক্তিক বেতন কাঠামো, সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন, সরকারি সেবায় ই-গভর্নেন্স প্রবর্তন এই পাঁচটি কৌশলের চর্চা সন্তোষজনক। অন্যদিকে বার্ষিক কর্ম-মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন বাস্তবায়ন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়নÑ এই তিনটি কৌশলের চর্চা এখনো শুরু হয়নি। আবার রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের কারণে কোন কোন কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ হচ্ছে না (যেমন, প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি) এবং প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশাসনে রাজনীতিকরণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পেশাগত উৎকর্ষে ঘাটতির ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণের ফলে জনপ্রশাসনে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ২০ শতাংশ পদ খালি থাকে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যে পাঁচটি কৌশলের চর্চা সন্তেষজনক হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন ও তার পরবর্তী আরো কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। যেমনÑ প্রণোদনা ও পারিতোষিক ব্যবস্থার আওতায় নানা ধরনের পদক, পুরস্কার, বেতন-বোনাস ও পেনশন বৃদ্ধি, স্বল্প সুদে গৃহ ও গাড়ি ঋণ প্রদান এবং অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা বৃদ্ধির মতো ইতিবাচক কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হলেও শুদ্ধাচার বৃদ্ধির পথে বাস্তব কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বেতন বৃদ্ধির ফলে দুর্নীতি কমেছে তারও কোন সুনির্দিষ্ট উদাহরণ নেই। ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ অনুযায়ী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার না করার বিধান বৈষম্যমূলক ও সাংবিধানিক চেতনার পরিপন্থী। এছাড়া এই আইনে চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে যেকান সময় চাকরি থেকে অবসর প্রদানেরও বিধান রাখা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শুদ্ধাচার কৌশলের অংশ হিসেবে ‘জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ পলিসি ২০০৩’ প্রণীত হলেও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ ও প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে পদোন্নতির কোন সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া বিদেশে প্রশিক্ষণের পর এক বছর সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিয়ম থাকলেও অনেক সময়ই তা করা হয় না। আবার সরকারি সেবায় ই-গভর্নেন্স প্রবর্তন ও প্রসারে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮’ প্রণয়ন করা হলেও এখনো মন্ত্রণালয়গুলোতে অ্যানালগ পদ্ধতিতে ফাইল আদান-প্রদান হয়। বিভিন্ন দফতরের মধ্যে ই-সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বিত কার্যক্রমের ঘাটতি রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশের ক্ষেত্রে এখনো ই-গভর্নেন্স সংক্রান্ত কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া যৌক্তিক বেতন কাঠামো নির্ধারণে সর্বশেষ অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা বেতন-ভাতা পেলেও দুর্নীতি হ্রাসে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ১১টি কৌশলের মধ্যে যে তিনটি কৌশলের চর্চা এখনো শুরুই হয়নি তার মধ্যে অন্যতম হলো, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কোন কর্মকর্তার অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষায় প্রণীত ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা) আইন, ২০১১’ ও ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৭’। এ আইন ব্যবহার করে এখনো কোন অভিযোগ প্রদানের তথ্য প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে এ আইন বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে কাজ করছে সহায়ক পরিবেশের অভাব, আস্থার ঘাটতি, বিপদে পড়ার আশঙ্কা। দ্বিতীয়টি নতুন কৃতিভিত্তিক কর্ম-মূল্যায়ন পদ্ধতির খসড়া প্রণীত হলেও দীর্ঘ ছয় বছরেও তা চূড়ান্ত হয়নি। আর তৃতীয়টি হলো, শুদ্ধাচার কৌশলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়নের উল্লেখ থাকলেও এখন পর্যন্ত ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’র খসড়াপ্রণীত হয়েছে মাত্র।

প্রতিবেদনে টিআইবির পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টদের বিবেচনার জন্য ৯ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি, ১৯৭৯’-কে শুদ্ধাচার কৌশলের আলোকে হালনাগাদ করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট ডিজিটাল কাঠামো করে সে অনুযায়ী প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারে সরকারের অনুমতি রাখার বিধান এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ধারা বাতিল বা সংশোধন করতে হবে; সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-তে সরকারি শব্দটির পরিবর্তে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করে আইনের সংশোধন করতে হবে। জনপ্রশাসনের ওপরের পদগুলোতে অতিরিক্ত নিয়োগ না দিয়ে নিচের দিকের শূন্যপদগুলো পূরণ করতে হবে; পদোন্নতির ক্ষেত্রে সব ক্যাডারের সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশাসন ক্যাডার থেকে টেকনিক্যাল বিভাগের উচ্চপদে পদায়ন না করে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে পদোন্নতি দিতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত স্কোর এবং দক্ষতার মূল্যায়নপূর্বক পদোন্নতি নিশ্চিতের বিধান রাখতে হবে; জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ চূড়ান্ত করে তা কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ‘তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’ বাস্তবায়নের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ আইন সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে।

সোমবার, ২৪ জুন ২০১৯ , ১০ আষাঢ় ১৪২৫, ২০ শাওয়াল ১৪৪০

জনপ্রশাসনে রাজনীতিকরণে

পেশাগত উৎকর্ষে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে

সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার অগ্রগতি নেই

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

জনপ্রশাসনে রাজনীতিকরণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি ঘটায় পেশাগত উৎকর্ষে ব্যাপক ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদন উঠে এসেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়লেও দুর্নীতি কমার কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বলেও ‘জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার: নীতি ও চর্চা’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি বলছে, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ প্রণোদনামূলক বিষয়ে অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও এখনো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে জবাবদিহি নিশ্চিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে কৌশলের চর্চা শুরুই হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ না হওয়ায় প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গতকাল টিআইবির ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে টিআইবি। প্রতিবেদনে জনপ্রশাসনে শুদ্ধাচার বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিচালনায় বিদ্যমান আইনি কাঠামো ও সংশ্লিষ্ট আইনের চর্চাসমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত কৌশলগুলো বাস্তবায়ন যেসব আইন ও নীতিকাঠামো দ্বারা পরিচালিত সেগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি জনপ্রশাসনের কার্যক্রমে এসব আইন ও নীতি প্রয়োগের চর্চাগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়া সরকারের সব মন্ত্রণালয়/বিভাগ, দফতর, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কার্যালয়ের প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা যাদের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতি, শৃঙ্খলাজনিত বিষয়, মূল্যায়ন, প্রণোদনা ইত্যাদি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, তা গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুদ্ধাচার কৌশলে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত নীতিগুলো পর্যালোচনা এবং সেগুলোর চর্চার বিষয়ে গবেষণা করে জনপ্রশাসনে দক্ষ জনবল ও নিয়মতান্ত্রিক পদোন্নতি নিশ্চিত করা, অসন্তোষের ঝুঁকি নিরসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং সার্বিকভাবে জনস্বার্থে ৯ দফা সুপারিশও করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের মহাসচিব অধ্যাপক ড. পারভীন হাসান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রণয়ন ও উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মহুয়া রউফ এবং গবেষণাটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম. আকরাম। প্রতিবেদনের বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে যেগুলোতে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিমূলক ইতিবাচক প্রণোদনা দেয়ার অঙ্গীকার ছিল, সেক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা অভূতপূর্ব। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত উৎকর্ষ বৃদ্ধি, অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে বা দায়িত্বপালনের ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা জবাবদিহি নিশ্চিতে যেসব আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে সেগুলো শক্তিশালী করতে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে যেসব দিকনির্দেশনা বা কৌশল ছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি বা কোন ধরনের অগ্রগতি হয়নি। কাজেই আমরা একদিক থেকে যেমন সার্বিকভাবে অগ্রগতি হচ্ছে বিবেচনায় সন্তোষ প্রকাশ করতে পারি, অন্যদিকে বাস্তবে শুদ্ধাচার কৌশলের প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া এখনো সুদূর পরাহত রয়েছে।

সরকারি কর্মচারী আইনের কতিপয় মৌলিক ধারার সমালোচনা করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি চাকরি আইন নামটিই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনটির নাম হওয়ার কথা ছিল জনপ্রশাসন আইন। তাই আমরা আইনটির নাম সংশোধনের দাবি জানাই। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফৌজদারি অপরাধে গ্রেফতারের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণের বিধিও সম্পূর্ণরূপে সংবিধান পরিপন্থী ও বৈষম্যমূলক। এই বিধিও বাতিল করতে হবে। এছাড়া এই আইনের ৬.১ ধারায় প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব কর্তৃত্ব সরকারের কাছেই রাখা হয়েছে, যা ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ এই সাংবিধানিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ প্রণীত হওয়ার ছয় বছর পার হলেও এতে জনপ্রশাসন সম্পর্কিত ১১টি কৌশলের মধ্যে প্রণোদনা ও পারিতোষিক, প্রশিক্ষণ, যৌক্তিক বেতন কাঠামো, সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন, সরকারি সেবায় ই-গভর্নেন্স প্রবর্তন এই পাঁচটি কৌশলের চর্চা সন্তোষজনক। অন্যদিকে বার্ষিক কর্ম-মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রবর্তন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রদান (সুরক্ষা) আইন বাস্তবায়ন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়নÑ এই তিনটি কৌশলের চর্চা এখনো শুরু হয়নি। আবার রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রভাবের কারণে কোন কোন কৌশলের চর্চা ফলপ্রসূ হচ্ছে না (যেমন, প্রতিযোগিতামূলক পদোন্নতি) এবং প্রশাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রশাসনে রাজনীতিকরণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় পেশাগত উৎকর্ষে ঘাটতির ব্যাপক ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সময়ক্ষেপণের ফলে জনপ্রশাসনে প্রায় প্রতি বছরই গড়ে ২০ শতাংশ পদ খালি থাকে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যে পাঁচটি কৌশলের চর্চা সন্তেষজনক হলেও সেগুলো বাস্তবায়ন ও তার পরবর্তী আরো কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান। যেমনÑ প্রণোদনা ও পারিতোষিক ব্যবস্থার আওতায় নানা ধরনের পদক, পুরস্কার, বেতন-বোনাস ও পেনশন বৃদ্ধি, স্বল্প সুদে গৃহ ও গাড়ি ঋণ প্রদান এবং অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা বৃদ্ধির মতো ইতিবাচক কৌশলগুলো বাস্তবায়িত হলেও শুদ্ধাচার বৃদ্ধির পথে বাস্তব কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বেতন বৃদ্ধির ফলে দুর্নীতি কমেছে তারও কোন সুনির্দিষ্ট উদাহরণ নেই। ‘সরকারি চাকরি আইন ২০১৮’ অনুযায়ী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার না করার বিধান বৈষম্যমূলক ও সাংবিধানিক চেতনার পরিপন্থী। এছাড়া এই আইনে চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে যেকান সময় চাকরি থেকে অবসর প্রদানেরও বিধান রাখা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শুদ্ধাচার কৌশলের অংশ হিসেবে ‘জনপ্রশাসন প্রশিক্ষণ পলিসি ২০০৩’ প্রণীত হলেও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ ও প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে পদোন্নতির কোন সম্পর্ক নেই। এ ছাড়া বিদেশে প্রশিক্ষণের পর এক বছর সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে অংশগ্রহণের নিয়ম থাকলেও অনেক সময়ই তা করা হয় না। আবার সরকারি সেবায় ই-গভর্নেন্স প্রবর্তন ও প্রসারে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা ২০১৮’ প্রণয়ন করা হলেও এখনো মন্ত্রণালয়গুলোতে অ্যানালগ পদ্ধতিতে ফাইল আদান-প্রদান হয়। বিভিন্ন দফতরের মধ্যে ই-সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সমন্বিত কার্যক্রমের ঘাটতি রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশের ক্ষেত্রে এখনো ই-গভর্নেন্স সংক্রান্ত কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া যৌক্তিক বেতন কাঠামো নির্ধারণে সর্বশেষ অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা বেতন-ভাতা পেলেও দুর্নীতি হ্রাসে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী ১১টি কৌশলের মধ্যে যে তিনটি কৌশলের চর্চা এখনো শুরুই হয়নি তার মধ্যে অন্যতম হলো, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কোন কর্মকর্তার অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষায় প্রণীত ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা) আইন, ২০১১’ ও ‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা) বিধিমালা, ২০১৭’। এ আইন ব্যবহার করে এখনো কোন অভিযোগ প্রদানের তথ্য প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টদের মতে এ আইন বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে কাজ করছে সহায়ক পরিবেশের অভাব, আস্থার ঘাটতি, বিপদে পড়ার আশঙ্কা। দ্বিতীয়টি নতুন কৃতিভিত্তিক কর্ম-মূল্যায়ন পদ্ধতির খসড়া প্রণীত হলেও দীর্ঘ ছয় বছরেও তা চূড়ান্ত হয়নি। আর তৃতীয়টি হলো, শুদ্ধাচার কৌশলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়নের উল্লেখ থাকলেও এখন পর্যন্ত ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’র খসড়াপ্রণীত হয়েছে মাত্র।

প্রতিবেদনে টিআইবির পক্ষ থেকে জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টদের বিবেচনার জন্য ৯ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি, ১৯৭৯’-কে শুদ্ধাচার কৌশলের আলোকে হালনাগাদ করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব প্রদানের জন্য সুনির্দিষ্ট ডিজিটাল কাঠামো করে সে অনুযায়ী প্রতিবছর সম্পদের হিসাব প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতারে সরকারের অনুমতি রাখার বিধান এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ধারা বাতিল বা সংশোধন করতে হবে; সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-তে সরকারি শব্দটির পরিবর্তে ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করে আইনের সংশোধন করতে হবে। জনপ্রশাসনের ওপরের পদগুলোতে অতিরিক্ত নিয়োগ না দিয়ে নিচের দিকের শূন্যপদগুলো পূরণ করতে হবে; পদোন্নতির ক্ষেত্রে সব ক্যাডারের সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রশাসন ক্যাডার থেকে টেকনিক্যাল বিভাগের উচ্চপদে পদায়ন না করে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে পদোন্নতি দিতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণে প্রাপ্ত স্কোর এবং দক্ষতার মূল্যায়নপূর্বক পদোন্নতি নিশ্চিতের বিধান রাখতে হবে; জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে ‘কর্মজীবন উন্নয়ন পরিকল্পনা’ চূড়ান্ত করে তা কার্যকর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; ‘তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১’ বাস্তবায়নের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ আইন সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে।