ডিআইজি মিজানের ঘুষ লেনদেন ধামাচাপা দিতে অডিও রেকর্ড ফাঁস

অবৈধ সম্পদের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে লন্ডন প্রবাসী আবদুল দয়াছ নামে দুদক চেয়ারম্যানের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির মাধ্যমে ঘুষ লেনদেন করেছেন পুলিশের ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান। ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার বিষয়ে কাকে কী করতে হবে, এ নিয়ে আবদুল দয়াছের সঙ্গে কথাও হয়েছে ডিআইজি মিজানের। গত রোববার এ সংক্রান্ত ৫টি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। ওই অডিওতে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে কথা বলেছে ডিআইজি মিজান ও আবদুল দয়াছ এবং দুদকের অবসরে যাওয়া এক কর্মকর্তা। রাজধানীর একটি হোটেল ওই তিনজনের কথোপকথনের সময় অডিও রেকর্ড করা হয়। অডিও রেকর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ঘুষ লেনদেনের সমন্বয়কারী আবদুল দয়াছ যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী দয়াছের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার জাউয়াবাজার ইউনিয়নের ছাতারপইয়ে। তার সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, পুলিশের সাবেক আইজি নুর মোহাম্মদসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তির ছবিও প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে। (তথ্য সূত্র বাংলা ট্রিবিউন)

গতকাল দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ অফিসে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অবৈধ সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। এর আগে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলে দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন সদর দফতরে সংযুক্ত ডিআইজি মিজানুর রহমান। এ বিষয়ে একাধিক অডিও প্রকাশ করেন তিনি। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদক পরিচালক এনামুল বাছির। এ অভিযোগের পর দুদক খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে এবং ডিআইজি মিজানের ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রাখে। পুলিশ সদর দফতরও বিষয়টি পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি করেছে। ডিআইজি মিজান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ লন্ডন প্রবাসী দয়াছ এবং দুদকের সাবেক কর্মকর্তা মধ্যে কথোপকথনের ৫টি অডিও রেকর্ডের হুবহু অংশবিশেষ দেয়া হয়েছে। এসব অডিও বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশ হয়েছে।

কথোপকথন-১

ডিআইজি মিজান: বসের সঙ্গে দেখা হয় নাই।

আবদুল দয়াছ: বসের সঙ্গে দেখা হইল, গল্পটল্প হইল। বলল এবার ইলেকশনে মজা লাগল না। কয় এই দয়াছ তুমি জানো...আজিজ ভাই আছিল আমার লগে। ইলেকশনটা মজা লাগল না।

ডিআইজি মিজান: হা হা... (হাসি)। যাকগে এগুলা বাইরে বলা যাবে না। এখন কী?...এনামুল বাছির কী বলল?

আবদুল দয়াছ: ওকে আছে। আজকে আইবো। লেনদেনের কথা। কাল-পরশু দিয়া দিয়েন কিন্তু। না দিলেও কইরা দিত।

ডিআইজি মিজান: না, আমি দেব।

আবদুল দয়াছ: আপনি নিজেই দিয়েন।

ডিআইজি মিজান : ওর সামনে আমি ফেস হই না। আপনি নিয়ে নেন। ডিমান্ড বেশি না। আজকেই দিয়া দেই। আজিজ ভাই থাকব।

আবদুল দয়াছ: ডিমান্ড-টিমান্ড বুঝি না। ওইসব কথা বইলা লাভ নেই। আমাদের প্ল্যান করতে হইব। আপনার বিষয়টা তো ক্লিয়ার করতে হইব। নিলে বলব আরও দেব। কারণ, আপনারটা ক্লিয়ার করতে হইব।

ডিআইজি মিজান: আর বসের ব্যাপারটা?

আবদুল দয়াছ: আরেকজন বন্ড কমিশনার আছিল, তারে ক্লিয়ার কইরা দিয়া আইছি। ৪০ লাখ ইকবাল ভাইরে কয়া আমি ক্লিয়ার কইরা আলাইছি।

ডিআইজি মিজান: ইকবাল ভাইরে দিয়া আপনের বলাইতে হইব।

আবদুল দয়াছ: আমি তো...শুনেন।

ডিআইজি মিজান: শুনে আমি করব?

আবদুল দয়াছ: করছি তো। আপনারে আমি দেখাই। আপনি তো বিশ্বাস করবেন না। আমার কাজ তো আপনি বুঝবেন না।

ডিআইজি মিজান: দরকার নেই। আমার দরকার কাজ। ইকবাল ভাইয়ের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক না সম্পর্ক সেটা আমার দরকার নেই।ইত্যাদি...

কথোপকথন-২

ডিআইজি মিজান : আজিজ ভাই, দয়াছ ভাই, দুজনেই আছেন। আমার এটা কী করবেন? শেষপর্যায়ে আর কী।

আবদুল দয়াছ : উনি (বাছির) আপনার সঙ্গে কথা বলছে কি?

ডিআইজি মিজান : উনি (বাছির) আমার সঙ্গে অত...ই...হবে না। এখন আমি বলি, ওখানে যে...ই...আছে না...ডিরেক্টর শফিক...শফিককে কীভাবে কী দেয়া যায়?

আবদুল দয়াছ : না না..., শফিক কোন সমস্যা না।

আজিজ : শফিক কিছু করবে না। হেই রিপোর্ট দিয়া দেব। সে সাইন দিয়া দেব শেষ।

ডিআইজি মিজান : এখন আমার কী করার আছে?

আজিজ: শফিকরে আমরা...এই যে...এর আগে যা হইছে না। শফিকরে এর আগে আমরা কম বোঝাইছি?

আবদুল দয়াছ: তাইলে...কী আর কই!

ডিআইজি মিজান: না, কাজ তো অনেক আগাইছে। দয়াছ ভাই যে উপকারটা করছে। উপকার তো করছে। অস্বীকার করার কিছু নেই।

আবদুল দয়াছ: রিপোর্টটা দেবে।

ডিআইজি মিজান : এখন আমি বলি, আমি আপনাকে বলি ভাই। আমার তো যা...

আজিজ : দিছেন...

ডিআইজি মিজান : আরে ১০, ১০-২০ টোটাল দেয়া হইছে। এখন তো আমার ক্ষতি তো বা...

আজিজ : দয়াছ তাইলে বলে না ক্যা, করে না কেন।

ডিআইজি মিজান : এখন সে নিছে নাকি অন্যরে দিছে, তা তো আমি জানি না।

আজিজ : সে নিতে যাবে কেন?

ডিআইজি মিজান : এখন আমি...শফিকরে দিয়া একটু বলান না।

আজিজ: শফিকরে আমি বলতে পারব।

ডিআইজি মিজান : ভাই...এখন যেটা বোঝা গেছে...ভাই হিসেবে বলি আপনাকে।

আবদুল দয়াছ: ভাই হিসেবে না বইন হিসেবে বলেন।

ডিআইজি মিজান : (হাসি...) ও শালা...আপনারে ভয় পায়...কি নাম ওর?

আবদুল দয়াছ : হু...এনামুল

ডিআইজি মিজান : এনামুল বাছির...। এখন সে...ভেতরের খবর পাইলাম। ভেতরের মানে কি নিচের লেভেলে। কাজ করতে আছে। ও কী করতে আছে আমি জানি না।

আবদুল দয়াছ : হু...

ডিআইজি মিজান : সে আমার কথা শুইনা...যেহেতু আপনার সঙ্গে কথা বলছে...ভাইয়ের (আজিজ) সঙ্গে কথা বলছে। জাহিদ ভাই কথা বলছে। এখন আমার কথা হলো যে, কোন যদি খেদমত লাগে, শফিক বা শফিক হলো মেইন। তাহলে সেটা তো ফুলফিল করতে পারি। অসুবিধা নেই বা ও যদি চায়...।

আবদুল দয়াছ: আজকালের মধ্যেই কথা হইব।

ডিআইজি মিজান : ও যদি চায়...

(সবাই হাসেন)

ডিআইজি মিজান : আমি তো আর কল করি নাই।

আবদুল দয়াছ: কল দিছে...কল দিছে... সে কল দেবে তারটা ট্র্যাকিং হবে...আমারটা...আমারটা ট্র্যাকিং হবে না। (ফোনে কথা বলেন) ওয়ালাইকুম সালাম। ভাই কই। আমি আইছি তো ঢাকা, গতকালকে বিয়াশাদি খাইয়া সিলেট থেকে। আপনি ফ্রি হইলে ফোন দিয়েন, আমি তো আছি একা একা। আমি তো অফিসে যাইতামই। আপনিও সময় পেলে চইলা আইসেন এদিকে। হোয়েন এভার ইউ ফ্রি...আমি তো হোটেলেই। (অপর প্রান্তের কথা শুনে) তাইলে আমি দেখমুনে। গোসল-টোসল কইরা আপনারে ফোন কইরা আসমুনে ওই দিকে। ওকে সালামালাইকুম।

ডিআইজি মিজান : ভয় পাইছে, ভয় পাইছে। দয়াছ ভাই আমি বলি, টাকাডা বড় কথা না; মানসম্মান বড় কথা। আমার ফাইলে তো কী আছে সবাই জানেÑ কিছুই নেই। উনারা তো বিশেষজ্ঞ। উনারা দেখছে, ইয়ে দেখছে, আপনি নিজে দেখছেন। এরপর আমার কাছে যে কাগজপত্র চাইছে আমি সব দিছি।

আজিজ : দিয়া দিছেন?

ডিআইজি মিজান: সব দিয়া দিছি। তারপর সে নিজে নেগেটিভ, পজেটিভ কিছু বলে নাই। তবে একটা জিনিস বলছে যে, মিজান ভাই আমি যেটুকু পারি আপনার মানসম্মান রাখবে; এটুকু বলছে। সে কিন্তু একেবারে নেগেটিভ কিছু বলে নাই...আবার পজেটিভও না।

আবদুল দয়াছ : আমি আপনাকে বলি, আমরা কি বুঝি না। ইকবাল স্যার তো ডেইলি বলবে না। ওইদিন যা বলার বলছে।

ডিআইজি মিজান : না, না, না ইকবাল স্যার তো...

আবদুল দয়াছ: ইকবাল ভাই, বলছে জাস্টিস ফর এনাফ।

ডিআইজি মিজান : এইটুকু বললেই হয়...

আবুল দয়াছ: বুঝছেন, এইটা তো বলছে, নাইলে ওরা কী বলছে; আমি বুঝি না।

ডিআইজি মিজান : এইটা কি শফিকরে বলছে?

আবদুল দয়াছ: শুনেন, তার প্রমোশন আছে না... ১০ লাখ, ২০ লাখ আর ৫০ লাখ তো ব্যাপার না। শুনেন, এখানে নাসিম ভাই ছিল; তারে খুলনায় পাঠাইছিল। এরপর ইকবাল ভাইরে সাইজ-টাইজ কইরা তারে ঢাকায় নিয়া আসছি না...

(দয়াছ আবারও বলেন)

আবদুল দয়াছ: এনামুল বাছিরের কথা যদি কইয়া দেই সে টাকা খাইছিল। একটা প্রধানের ব্যাপারে আপনার ভালো কইতে হইব। তার ভালো ছাড়া খারাপ কইবার পারেন না, আনলেস আপনার ম্যাজিস্ট্রেসি দেখাইতে হবে...এনামুল বাছিররা যে সিন্ডিকেট ক্রিয়েট করছে....

ডিআইজি মিজান : বাড়ি কই? এনামুল বাছিরের বাড়ি কই? কুমিল্লা?

কথোপকথন-৪

ডিআইজি মিজান: বসেন, বসেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলে চলে যাব। আরে ভাই এক ঘণ্টা লাগল। জ্যাম, পুরা জ্যাম। আপনার ফ্লাইট কবে? যাবেন কবে?

আবদুল দয়াছ : শনিবার।

ডিআইজি মিজান : কনফার্ম? যাক এখন কী অবস্থা?

আবদুল দয়াছ : অবস্থা হইল, আমি আপনারে...

ডিআইজি মিজান : না...বাছিরকে আজকে আসতে বলেন।

আবদুল দয়াছ : কথা হইছে।

ডিআইজি মিজান: কী বলল... আমি জানি যে মিস্টার দয়াছ পারবে...বলেন...আপনি যদি না থাকেন, লন্ডন চলে যান। তাইলে এই ফাইলটা যদি নোট হয়। যে রিপোর্ট দেবে...পজেটিভ রিপোর্ট দেবে বা মেম্বার দুজন লেখবে, তারপর চেয়ারম্যানের কাছে যাবে।

আবদুল দয়াছ : আপনার স্ত্রীর বিষয়টাও...লেখা থাকবে... থাকতে পারে।

ডিআইজি মিজান : ওর ট্যাক্স ফাইল আছে তো? প্রোপার্টির ঘোষণা দেয়া আছে তো। ১০-১২ বছরের ট্যাক্সের কাগজ নিয়ে আসছে তো। ওনারে নিয়া রিপোর্ট হয় না। আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা পাটোয়ারী আমারে নিজে কইছে।

আবদুল দয়াছ : ওনার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।

ডিআইজি মিজান : এটা করলে ভুল করবে তারা।

কথোপকথন-৫

আবদুল দয়াছ: আমি বলছি, মিজান ভাই সবকিছু ওভারকাম করব। আইজি না হলেও অতিরিক্ত আইজি হইব।

ডিআইজি মিজান : স্যারকে কী করা যায়?

আবদুল দয়াছ : স্যার কনভিন্সড।

ডিআইজি মিজান : এখন শফিককে কী করা যায়?

আবদুল দয়াছ : কোন সমস্যা নেই।

ডিআইজি মিজান : ও খায়। মুন্সীগঞ্জে ওর এক আত্মীয় আছে, তার মাধ্যমে খায়।

ডিআইজি মিজান : দিনাজপুরের কয়লাখনি নিয়ে পকানও ঘটনা আছে। এইটা নিয়া খাইছে।

আবদুল দয়াছ : বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। দোষীদের ছাইরা দিচ্ছে ও।

ডিআইজি মিজান : আমি না একদম জিরো হইয়া গেছি। বিশ্বাস করেন। আমার কান্না, আপনার ভাবির কান্না কেউ দেখলে এই ক্ষতি করতে পারত না আমাদের।

অডিও রেকর্ডে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, অনুসন্ধান কর্মকর্তা এনামুল বাছির ছাড়া যাদের বিষয়ে কথা হয়েছে তারা হলেনÑ দুদক পরিচালক কাজী শফিক, নাসিম আনোয়ার এবং ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি ৩০/এ, ভিআইপি রোড, নয়াপল্টনের হোটেল ভিক্টোরির ২১১ নম্বর রুমে দয়াছ, ডিআইজি মিজান ও দুদক পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়ার মধ্যে ওই কথোপকথন হয়। দয়াছ জানুয়ারি মাসে দেশে এসেছিলেন। দেশে অবস্থান করেন প্রায় দুই সপ্তাহ। গত এপ্রিল মাসে সর্বশেষ লন্ডন থেকে ঢাকায় আসার পর হোটেল ভিক্টোরিতেই উঠেছিলেন দয়াছ। কথোপকথনে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা গায়েব নিয়ে গঠিত দুদকের তদন্ত কমিটি এবং এ নিয়ে দুদক কর্মকর্তা শফিকের ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। কথোপকথনে সবচেয়ে আলোচিত নামটিও তার। শফিককে নিয়ে ডিআইজি মিজানের ভীতির বিষয়টিও কথোপকথনে স্পষ্ট। তাকে (শফিক) এনামুল বাছির সিন্ডিকেটের প্রধান বলেও কথোপকথনে মন্তব্য করা হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ কথোপকথনে দুদক কর্মকর্তাদের প্রমোশন, বদলি ও স্ট্যান্ড রিলিজের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।

মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০১৯ , ১১ আষাঢ় ১৪২৫, ২১ শাওয়াল ১৪৪০

ডিআইজি মিজানের ঘুষ লেনদেন ধামাচাপা দিতে অডিও রেকর্ড ফাঁস

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক |

অবৈধ সম্পদের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে লন্ডন প্রবাসী আবদুল দয়াছ নামে দুদক চেয়ারম্যানের এক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির মাধ্যমে ঘুষ লেনদেন করেছেন পুলিশের ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান। ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধামাচাপা দেয়ার বিষয়ে কাকে কী করতে হবে, এ নিয়ে আবদুল দয়াছের সঙ্গে কথাও হয়েছে ডিআইজি মিজানের। গত রোববার এ সংক্রান্ত ৫টি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। ওই অডিওতে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিষয়ে কথা বলেছে ডিআইজি মিজান ও আবদুল দয়াছ এবং দুদকের অবসরে যাওয়া এক কর্মকর্তা। রাজধানীর একটি হোটেল ওই তিনজনের কথোপকথনের সময় অডিও রেকর্ড করা হয়। অডিও রেকর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ঘুষ লেনদেনের সমন্বয়কারী আবদুল দয়াছ যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী দয়াছের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার জাউয়াবাজার ইউনিয়নের ছাতারপইয়ে। তার সঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, পুলিশের সাবেক আইজি নুর মোহাম্মদসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তির ছবিও প্রকাশ পেয়েছে গণমাধ্যমে। (তথ্য সূত্র বাংলা ট্রিবিউন)

গতকাল দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ অফিসে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অবৈধ সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। এর আগে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলে দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন সদর দফতরে সংযুক্ত ডিআইজি মিজানুর রহমান। এ বিষয়ে একাধিক অডিও প্রকাশ করেন তিনি। তার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদক পরিচালক এনামুল বাছির। এ অভিযোগের পর দুদক খন্দকার এনামুল বাছিরকে সাময়িক বরখাস্ত করে এবং ডিআইজি মিজানের ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রাখে। পুলিশ সদর দফতরও বিষয়টি পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি করেছে। ডিআইজি মিজান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ লন্ডন প্রবাসী দয়াছ এবং দুদকের সাবেক কর্মকর্তা মধ্যে কথোপকথনের ৫টি অডিও রেকর্ডের হুবহু অংশবিশেষ দেয়া হয়েছে। এসব অডিও বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশ হয়েছে।

কথোপকথন-১

ডিআইজি মিজান: বসের সঙ্গে দেখা হয় নাই।

আবদুল দয়াছ: বসের সঙ্গে দেখা হইল, গল্পটল্প হইল। বলল এবার ইলেকশনে মজা লাগল না। কয় এই দয়াছ তুমি জানো...আজিজ ভাই আছিল আমার লগে। ইলেকশনটা মজা লাগল না।

ডিআইজি মিজান: হা হা... (হাসি)। যাকগে এগুলা বাইরে বলা যাবে না। এখন কী?...এনামুল বাছির কী বলল?

আবদুল দয়াছ: ওকে আছে। আজকে আইবো। লেনদেনের কথা। কাল-পরশু দিয়া দিয়েন কিন্তু। না দিলেও কইরা দিত।

ডিআইজি মিজান: না, আমি দেব।

আবদুল দয়াছ: আপনি নিজেই দিয়েন।

ডিআইজি মিজান : ওর সামনে আমি ফেস হই না। আপনি নিয়ে নেন। ডিমান্ড বেশি না। আজকেই দিয়া দেই। আজিজ ভাই থাকব।

আবদুল দয়াছ: ডিমান্ড-টিমান্ড বুঝি না। ওইসব কথা বইলা লাভ নেই। আমাদের প্ল্যান করতে হইব। আপনার বিষয়টা তো ক্লিয়ার করতে হইব। নিলে বলব আরও দেব। কারণ, আপনারটা ক্লিয়ার করতে হইব।

ডিআইজি মিজান: আর বসের ব্যাপারটা?

আবদুল দয়াছ: আরেকজন বন্ড কমিশনার আছিল, তারে ক্লিয়ার কইরা দিয়া আইছি। ৪০ লাখ ইকবাল ভাইরে কয়া আমি ক্লিয়ার কইরা আলাইছি।

ডিআইজি মিজান: ইকবাল ভাইরে দিয়া আপনের বলাইতে হইব।

আবদুল দয়াছ: আমি তো...শুনেন।

ডিআইজি মিজান: শুনে আমি করব?

আবদুল দয়াছ: করছি তো। আপনারে আমি দেখাই। আপনি তো বিশ্বাস করবেন না। আমার কাজ তো আপনি বুঝবেন না।

ডিআইজি মিজান: দরকার নেই। আমার দরকার কাজ। ইকবাল ভাইয়ের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক না সম্পর্ক সেটা আমার দরকার নেই।ইত্যাদি...

কথোপকথন-২

ডিআইজি মিজান : আজিজ ভাই, দয়াছ ভাই, দুজনেই আছেন। আমার এটা কী করবেন? শেষপর্যায়ে আর কী।

আবদুল দয়াছ : উনি (বাছির) আপনার সঙ্গে কথা বলছে কি?

ডিআইজি মিজান : উনি (বাছির) আমার সঙ্গে অত...ই...হবে না। এখন আমি বলি, ওখানে যে...ই...আছে না...ডিরেক্টর শফিক...শফিককে কীভাবে কী দেয়া যায়?

আবদুল দয়াছ : না না..., শফিক কোন সমস্যা না।

আজিজ : শফিক কিছু করবে না। হেই রিপোর্ট দিয়া দেব। সে সাইন দিয়া দেব শেষ।

ডিআইজি মিজান : এখন আমার কী করার আছে?

আজিজ: শফিকরে আমরা...এই যে...এর আগে যা হইছে না। শফিকরে এর আগে আমরা কম বোঝাইছি?

আবদুল দয়াছ: তাইলে...কী আর কই!

ডিআইজি মিজান: না, কাজ তো অনেক আগাইছে। দয়াছ ভাই যে উপকারটা করছে। উপকার তো করছে। অস্বীকার করার কিছু নেই।

আবদুল দয়াছ: রিপোর্টটা দেবে।

ডিআইজি মিজান : এখন আমি বলি, আমি আপনাকে বলি ভাই। আমার তো যা...

আজিজ : দিছেন...

ডিআইজি মিজান : আরে ১০, ১০-২০ টোটাল দেয়া হইছে। এখন তো আমার ক্ষতি তো বা...

আজিজ : দয়াছ তাইলে বলে না ক্যা, করে না কেন।

ডিআইজি মিজান : এখন সে নিছে নাকি অন্যরে দিছে, তা তো আমি জানি না।

আজিজ : সে নিতে যাবে কেন?

ডিআইজি মিজান : এখন আমি...শফিকরে দিয়া একটু বলান না।

আজিজ: শফিকরে আমি বলতে পারব।

ডিআইজি মিজান : ভাই...এখন যেটা বোঝা গেছে...ভাই হিসেবে বলি আপনাকে।

আবদুল দয়াছ: ভাই হিসেবে না বইন হিসেবে বলেন।

ডিআইজি মিজান : (হাসি...) ও শালা...আপনারে ভয় পায়...কি নাম ওর?

আবদুল দয়াছ : হু...এনামুল

ডিআইজি মিজান : এনামুল বাছির...। এখন সে...ভেতরের খবর পাইলাম। ভেতরের মানে কি নিচের লেভেলে। কাজ করতে আছে। ও কী করতে আছে আমি জানি না।

আবদুল দয়াছ : হু...

ডিআইজি মিজান : সে আমার কথা শুইনা...যেহেতু আপনার সঙ্গে কথা বলছে...ভাইয়ের (আজিজ) সঙ্গে কথা বলছে। জাহিদ ভাই কথা বলছে। এখন আমার কথা হলো যে, কোন যদি খেদমত লাগে, শফিক বা শফিক হলো মেইন। তাহলে সেটা তো ফুলফিল করতে পারি। অসুবিধা নেই বা ও যদি চায়...।

আবদুল দয়াছ: আজকালের মধ্যেই কথা হইব।

ডিআইজি মিজান : ও যদি চায়...

(সবাই হাসেন)

ডিআইজি মিজান : আমি তো আর কল করি নাই।

আবদুল দয়াছ: কল দিছে...কল দিছে... সে কল দেবে তারটা ট্র্যাকিং হবে...আমারটা...আমারটা ট্র্যাকিং হবে না। (ফোনে কথা বলেন) ওয়ালাইকুম সালাম। ভাই কই। আমি আইছি তো ঢাকা, গতকালকে বিয়াশাদি খাইয়া সিলেট থেকে। আপনি ফ্রি হইলে ফোন দিয়েন, আমি তো আছি একা একা। আমি তো অফিসে যাইতামই। আপনিও সময় পেলে চইলা আইসেন এদিকে। হোয়েন এভার ইউ ফ্রি...আমি তো হোটেলেই। (অপর প্রান্তের কথা শুনে) তাইলে আমি দেখমুনে। গোসল-টোসল কইরা আপনারে ফোন কইরা আসমুনে ওই দিকে। ওকে সালামালাইকুম।

ডিআইজি মিজান : ভয় পাইছে, ভয় পাইছে। দয়াছ ভাই আমি বলি, টাকাডা বড় কথা না; মানসম্মান বড় কথা। আমার ফাইলে তো কী আছে সবাই জানেÑ কিছুই নেই। উনারা তো বিশেষজ্ঞ। উনারা দেখছে, ইয়ে দেখছে, আপনি নিজে দেখছেন। এরপর আমার কাছে যে কাগজপত্র চাইছে আমি সব দিছি।

আজিজ : দিয়া দিছেন?

ডিআইজি মিজান: সব দিয়া দিছি। তারপর সে নিজে নেগেটিভ, পজেটিভ কিছু বলে নাই। তবে একটা জিনিস বলছে যে, মিজান ভাই আমি যেটুকু পারি আপনার মানসম্মান রাখবে; এটুকু বলছে। সে কিন্তু একেবারে নেগেটিভ কিছু বলে নাই...আবার পজেটিভও না।

আবদুল দয়াছ : আমি আপনাকে বলি, আমরা কি বুঝি না। ইকবাল স্যার তো ডেইলি বলবে না। ওইদিন যা বলার বলছে।

ডিআইজি মিজান : না, না, না ইকবাল স্যার তো...

আবদুল দয়াছ: ইকবাল ভাই, বলছে জাস্টিস ফর এনাফ।

ডিআইজি মিজান : এইটুকু বললেই হয়...

আবুল দয়াছ: বুঝছেন, এইটা তো বলছে, নাইলে ওরা কী বলছে; আমি বুঝি না।

ডিআইজি মিজান : এইটা কি শফিকরে বলছে?

আবদুল দয়াছ: শুনেন, তার প্রমোশন আছে না... ১০ লাখ, ২০ লাখ আর ৫০ লাখ তো ব্যাপার না। শুনেন, এখানে নাসিম ভাই ছিল; তারে খুলনায় পাঠাইছিল। এরপর ইকবাল ভাইরে সাইজ-টাইজ কইরা তারে ঢাকায় নিয়া আসছি না...

(দয়াছ আবারও বলেন)

আবদুল দয়াছ: এনামুল বাছিরের কথা যদি কইয়া দেই সে টাকা খাইছিল। একটা প্রধানের ব্যাপারে আপনার ভালো কইতে হইব। তার ভালো ছাড়া খারাপ কইবার পারেন না, আনলেস আপনার ম্যাজিস্ট্রেসি দেখাইতে হবে...এনামুল বাছিররা যে সিন্ডিকেট ক্রিয়েট করছে....

ডিআইজি মিজান : বাড়ি কই? এনামুল বাছিরের বাড়ি কই? কুমিল্লা?

কথোপকথন-৪

ডিআইজি মিজান: বসেন, বসেন। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলে চলে যাব। আরে ভাই এক ঘণ্টা লাগল। জ্যাম, পুরা জ্যাম। আপনার ফ্লাইট কবে? যাবেন কবে?

আবদুল দয়াছ : শনিবার।

ডিআইজি মিজান : কনফার্ম? যাক এখন কী অবস্থা?

আবদুল দয়াছ : অবস্থা হইল, আমি আপনারে...

ডিআইজি মিজান : না...বাছিরকে আজকে আসতে বলেন।

আবদুল দয়াছ : কথা হইছে।

ডিআইজি মিজান: কী বলল... আমি জানি যে মিস্টার দয়াছ পারবে...বলেন...আপনি যদি না থাকেন, লন্ডন চলে যান। তাইলে এই ফাইলটা যদি নোট হয়। যে রিপোর্ট দেবে...পজেটিভ রিপোর্ট দেবে বা মেম্বার দুজন লেখবে, তারপর চেয়ারম্যানের কাছে যাবে।

আবদুল দয়াছ : আপনার স্ত্রীর বিষয়টাও...লেখা থাকবে... থাকতে পারে।

ডিআইজি মিজান : ওর ট্যাক্স ফাইল আছে তো? প্রোপার্টির ঘোষণা দেয়া আছে তো। ১০-১২ বছরের ট্যাক্সের কাগজ নিয়ে আসছে তো। ওনারে নিয়া রিপোর্ট হয় না। আগের অনুসন্ধান কর্মকর্তা পাটোয়ারী আমারে নিজে কইছে।

আবদুল দয়াছ : ওনার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।

ডিআইজি মিজান : এটা করলে ভুল করবে তারা।

কথোপকথন-৫

আবদুল দয়াছ: আমি বলছি, মিজান ভাই সবকিছু ওভারকাম করব। আইজি না হলেও অতিরিক্ত আইজি হইব।

ডিআইজি মিজান : স্যারকে কী করা যায়?

আবদুল দয়াছ : স্যার কনভিন্সড।

ডিআইজি মিজান : এখন শফিককে কী করা যায়?

আবদুল দয়াছ : কোন সমস্যা নেই।

ডিআইজি মিজান : ও খায়। মুন্সীগঞ্জে ওর এক আত্মীয় আছে, তার মাধ্যমে খায়।

ডিআইজি মিজান : দিনাজপুরের কয়লাখনি নিয়ে পকানও ঘটনা আছে। এইটা নিয়া খাইছে।

আবদুল দয়াছ : বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। দোষীদের ছাইরা দিচ্ছে ও।

ডিআইজি মিজান : আমি না একদম জিরো হইয়া গেছি। বিশ্বাস করেন। আমার কান্না, আপনার ভাবির কান্না কেউ দেখলে এই ক্ষতি করতে পারত না আমাদের।

অডিও রেকর্ডে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, অনুসন্ধান কর্মকর্তা এনামুল বাছির ছাড়া যাদের বিষয়ে কথা হয়েছে তারা হলেনÑ দুদক পরিচালক কাজী শফিক, নাসিম আনোয়ার এবং ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি ৩০/এ, ভিআইপি রোড, নয়াপল্টনের হোটেল ভিক্টোরির ২১১ নম্বর রুমে দয়াছ, ডিআইজি মিজান ও দুদক পরিচালক আবদুল আজিজ ভূঁইয়ার মধ্যে ওই কথোপকথন হয়। দয়াছ জানুয়ারি মাসে দেশে এসেছিলেন। দেশে অবস্থান করেন প্রায় দুই সপ্তাহ। গত এপ্রিল মাসে সর্বশেষ লন্ডন থেকে ঢাকায় আসার পর হোটেল ভিক্টোরিতেই উঠেছিলেন দয়াছ। কথোপকথনে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে কয়লা গায়েব নিয়ে গঠিত দুদকের তদন্ত কমিটি এবং এ নিয়ে দুদক কর্মকর্তা শফিকের ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। কথোপকথনে সবচেয়ে আলোচিত নামটিও তার। শফিককে নিয়ে ডিআইজি মিজানের ভীতির বিষয়টিও কথোপকথনে স্পষ্ট। তাকে (শফিক) এনামুল বাছির সিন্ডিকেটের প্রধান বলেও কথোপকথনে মন্তব্য করা হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ কথোপকথনে দুদক কর্মকর্তাদের প্রমোশন, বদলি ও স্ট্যান্ড রিলিজের বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে।