রেললাইনের দুর্বলতা ও অতিরিক্ত যাত্রী দুর্ঘটনার কারণ

নিহত ৪, আহত দু’শতাধিক : ১৮ ঘণ্টা পর ট্রেন চালু

রেললাইনের দুর্বলতা, দ্রুত গতি ও অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান স্থানীয়রা। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে; আগামী তিনদিনে মধ্যে প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন রেল সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন। গত রোববার রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় ৪ জন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে ২ জন ছাত্রী, একজন গৃহিণী ও একজন পুরুষ। এ দুর্ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছে। প্রায় সাড়ে ১৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর গতকাল বিকেল থেকে পুনরায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল চলাচল শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে রেলওয়ে সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেইন সংবাদকে বলেন, মৌলভীবাজারের ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করা হচ্ছে। তিনদিনের মধ্যে কারণ জানা যাবে। তবে লাইনের দুর্বলতা কিংবা চাকার কম্বিনেশনের কারণে ঘটতে পারে এ দুর্ঘটনা। একটি ট্রেনে সচরাচর ১২-১৪টি কোচ থাকে। কিন্তু দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটিতে কোচ লাগানো হয়েছিল ১৭টি। প্রতিটি কোচে সিট ছিল ৬৫টি। এ হিসাবে ট্রেনটিতে প্রায় ১ হাজার ১০৫ জন যাত্রী ছিলেন। এর বাইরে আরও অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনের সর্বশেষ কোচ বড়ছড়া রেলসেতুর নিচে পড়ে যায়। পরে দুটি কোচ উল্টে যায় এবং এর পরের দুটি কোচ লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে। তদন্তকারীরা দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন এবং ব্রিজের ছবি নিয়ে গেছে। তদন্ত কমিটি সার্বিক বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ৮০০ গজ রেললাইন মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলস্টেশনের কাছে বড়ছড়া নদীর ব্রিজে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী উপবন ট্রেন এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে। দুর্ঘটনায় ট্রেনটির পেছনের দিকের অন্তত ৫টি কোচ মূল ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং উল্টে খাদে পড়ে যায়। ট্রেনটির সামনের দিক তখন পাশর্^বর্তী বড়ছড়া ব্রিজ অতিক্রম করে গিয়েছিল। ফলে ব্রিজের উপর থাকা কোচটি ছিটকে বড়ছড়া নদীতে পড়ে যায়। তবে নদীতে পানি কম থাকায় অনেকটা ঝুলে থাকে বগিটি। লাইনচ্যুত অন্য কোচের মধ্যে ৪টি উল্টে পাশে পড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাশেই কালাবাজারে তখনো কিছু লোকজন ছিল। তারা বিকট শব্দ শুনে ছুটে আসেন এবং উদ্ধারকাজ শুরু করেন। এ সময় স্থানীয় বরমচাল মসজিদের মাইকে এলাকাবাসীকে উদ্ধার কাজে শরিক হওয়ার আহ্বান করা হয়।

গ্রামের লোকজন ছুটে এসে প্রথমে উদ্ধার কাজ শুরু করেন বলে জানিয়েছেন বরমচাল গ্রামের বাসিন্দা ছালিক আহমদ চৌধুরী। তিনি জানান, ট্রেন থেকে উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে গুরুতর আহত যাত্রীদের একাংশকে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়নি তাদের আশপাশের বাড়িতে নিয়ে রাখা হয়। অনেক লোক পাশর্^বর্তী মসজিদে আশ্রয় নেন। এলাকায় মাইকিং করে লোকজনের গাড়ি, সিএনজি ও অটোরিকশা বের করে আনা হয় আহত ও উদ্ধারকৃত যাত্রীদের পরিবহনের জন্য। স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দারা রাতভর দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রীদের পাশে থেকে সেবা শুশ্রুষা করেছেন বলে আক্রান্ত যাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে।

গতকাল সকাল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা প্রথমে ৪ জন, পরে ৫ জন বলা হলেও সর্বশেষ পুলিশ ও রেলওয়ে ৪ জনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করেছে। তবে আহতদের সঠিক কোন সংখ্যা জানা যায়নি। তবে উদ্ধারকারী লোকজন মনে করছেন আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক হবে। ঘটনার পর পরই মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল, সিভিল সার্জন মো. শাহজাহান কবির চৌধুরীসহ পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং রেলওয়ের বিভাগীয় কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। গতকাল সকালে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পরে আরেকটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে সোমবার সকাল থেকে দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটির উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। তবে ট্রেনের পেছনের ৫টি কোচ দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় পরবর্তীতে সামনের ১২টি কোচ নিয়ে উপবন ট্রেনটি শেষরাতের দিকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছে বলে রেলওয়ের সূত্র জানিয়েছে।

সাড়ে ১৯ ঘণ্টা পর রেলপথ চালু :

বরমচালের ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে বোরবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টা থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। দিনভর রেলওয়ে উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেনের ক্রেনের সাহায্যে ছিটকে পড়া বগিগুলোর মধ্যে ৪টি টেনে তুলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথে নতুন সিøপার বসিয়ে লাইন মেরামত কাজ করেছে। মেরামত কাজ শেষে গতকাল সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে রেলওয়ে বিভাগ পরীক্ষামূলক ট্রেন চালায় এবং ট্রেনলাইন ট্রেন চলাচলের উপযোগী হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে প্রায় সাড়ে ১৯ ঘণ্টা পরে এ রেলপথটি পুনরায় চালু করা হয়। এদিকে দুর্ঘটনার কারণে সিলেটের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলো মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার রেলওয়ে জংশনে এসে থামে এবং সেখান থেকে ফিরতি যাত্রায় নিজ নিজ গন্তব্যে চলাচল করে।

রেলওয়ের সূত্র জানায়, ঢাকা সিলেটে মহাসড়কে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাজবাজপুরে সড়কের ব্রিজ ভেঙে গিয়ে সিলেটের সঙ্গে ঢাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ট্রেনের উপর যাত্রীর চাপ বাড়ে। ফলে দুর্ঘটনা কবলিত উপবন ট্রেনে কয়েকটি এক্সট্রা বগি সংযোজন করা হয়। বহু যাত্রী স্ট্যান্ডিং টিকেট নিয়ে ট্রেনে উঠেন।

নিহত ৪ জনের পরিচয় : ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সানজিদা বেগম (১৮) ও ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (১৯) সিলেট নার্সিং কলেজের বিএসসি (নার্র্সিং) তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সানজিদা বেগমের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায় এবং ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভার বাড়ি সিলেটের মোগলাবাজার এলাকায়। অপর দুইজন হলেন- হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার ডবল বহর গ্রামের কাওসার আহমদ (২৬) এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া পৌর এলাকার ডিটিটিসির বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম (৪৫)। সানজিদা ঢাকায় চিকিৎসাধীন বাবাকে দেখতে বান্ধবি ইভাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে তার এক শিক্ষক জানিয়েছেন।

লুজ সিøপার থেকে দুর্ঘটনা : দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন উদ্ধারকারী কর্মী ও এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনাস্থল বড়ছড়া ব্রিজের প্রায় ১০০ ফুট দূরে সিøপারের লুজ কানেকশনের জন্য এ ট্রেনটির পেছনের দিক থেকে ছয় নম্বর কোচটি প্রথমে লাইনচ্যুত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই স্থানে দুটি লাইনের সংযোগস্থল রয়েছে। এরপর অন্য কোচগুলো একে অপরের ধাক্কায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে যায়। এ দুর্ঘটনার জন্য সিøপারের লুজ কানেকশন এবং ট্রেনটির দ্রুত গতি দায়ী হতে পারে। এ সময় ট্রেনের সামনের দিকে অন্তত ১২টি কোচ ইঞ্জিনের সঙ্গে চলতে থাকে। লাইনচ্যুত কোচগুলো হলো ট্রেনটির এক্সট্রা-৩, ড, ঢ, ণ ও ত নম্বর কোচ। সড়কপথে শাহবাজপুরে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ট্রেনটিতে অধিক যাত্রী ছিল। ফলে উপবন ট্রেনটি ১৭টি কোচ নিয়ে চলছিল। বরমচাল কালা বাজার এলাকার একাধিক বাসিন্দা গতকাল সংবাদকে বলেছেন, দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকায় রেলপথের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। সিøপারগুলো অনেক পুরনো এবং স্থানে স্থানে ক্লিপ নেই।

এক ট্রেনযাত্রীর বিবরণ : দুর্ঘটনা কবলিত উপবন ট্রেনের উল্টে যাওয়া এক্সট্রা কোচের যাত্রী সিলেটের বাসিন্দা শিক্ষানবিশ আইনজীবী সাইফুর রহমান বলেন, ট্রেনটিতে যাত্রী ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। দুর্ঘটনাকালীন ট্রেনটি দ্রুতগতিতে চলছিল। ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়লে দুর্ঘটনাকবলিত কোচগুলো হঠাৎ প্রচ- শব্দে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। পাথরের সঙ্গে ট্রেনের চাকা ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি দেখা যায়। এদিক-সেদিক ওলট-পালট হতে থাকে দুর্ঘটনাকবলিত কোচগুলো। তখন ট্রেনের একদিকের কোচ আরেকদিকে যেতে থাকে এবং কোচের ভেতরের লোকজন একে অপরের উপর আছড়ে পড়ে। এ ট্রেনে দুটি কোচের মাঝের জায়গাতেও অনেক লোক ভ্রমণ করছিলেন। এসব লোকের কেউ টেনের কোচ থেকে ছিটকে পড়েন। অনেকের হাত ভেঙেছে। এ দুর্ঘটনায় নিহত এক মহিলা তাদের কোচের যাত্রী ছিলেন। প্রতি কোচে শতাধিক লোক ছিল বলে তিনি দাবি করেন।

নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন ও বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।

মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০১৯ , ১১ আষাঢ় ১৪২৫, ২১ শাওয়াল ১৪৪০

কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনা

রেললাইনের দুর্বলতা ও অতিরিক্ত যাত্রী দুর্ঘটনার কারণ

নিহত ৪, আহত দু’শতাধিক : ১৮ ঘণ্টা পর ট্রেন চালু

জেলা বার্তা পরিবেশক, মৌলভীবাজার

রেললাইনের দুর্বলতা, দ্রুত গতি ও অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান স্থানীয়রা। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে; আগামী তিনদিনে মধ্যে প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন রেল সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন। গত রোববার রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় ৪ জন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে ২ জন ছাত্রী, একজন গৃহিণী ও একজন পুরুষ। এ দুর্ঘটনায় অন্তত দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছে। প্রায় সাড়ে ১৯ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর গতকাল বিকেল থেকে পুনরায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল চলাচল শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে রেলওয়ে সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেইন সংবাদকে বলেন, মৌলভীবাজারের ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করা হচ্ছে। তিনদিনের মধ্যে কারণ জানা যাবে। তবে লাইনের দুর্বলতা কিংবা চাকার কম্বিনেশনের কারণে ঘটতে পারে এ দুর্ঘটনা। একটি ট্রেনে সচরাচর ১২-১৪টি কোচ থাকে। কিন্তু দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটিতে কোচ লাগানো হয়েছিল ১৭টি। প্রতিটি কোচে সিট ছিল ৬৫টি। এ হিসাবে ট্রেনটিতে প্রায় ১ হাজার ১০৫ জন যাত্রী ছিলেন। এর বাইরে আরও অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনের সর্বশেষ কোচ বড়ছড়া রেলসেতুর নিচে পড়ে যায়। পরে দুটি কোচ উল্টে যায় এবং এর পরের দুটি কোচ লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় কাত হয়ে পড়ে। তদন্তকারীরা দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেন এবং ব্রিজের ছবি নিয়ে গেছে। তদন্ত কমিটি সার্বিক বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এ দুর্ঘটনার কারণে প্রায় ৮০০ গজ রেললাইন মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল রেলস্টেশনের কাছে বড়ছড়া নদীর ব্রিজে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী উপবন ট্রেন এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে। দুর্ঘটনায় ট্রেনটির পেছনের দিকের অন্তত ৫টি কোচ মূল ট্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং উল্টে খাদে পড়ে যায়। ট্রেনটির সামনের দিক তখন পাশর্^বর্তী বড়ছড়া ব্রিজ অতিক্রম করে গিয়েছিল। ফলে ব্রিজের উপর থাকা কোচটি ছিটকে বড়ছড়া নদীতে পড়ে যায়। তবে নদীতে পানি কম থাকায় অনেকটা ঝুলে থাকে বগিটি। লাইনচ্যুত অন্য কোচের মধ্যে ৪টি উল্টে পাশে পড়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাশেই কালাবাজারে তখনো কিছু লোকজন ছিল। তারা বিকট শব্দ শুনে ছুটে আসেন এবং উদ্ধারকাজ শুরু করেন। এ সময় স্থানীয় বরমচাল মসজিদের মাইকে এলাকাবাসীকে উদ্ধার কাজে শরিক হওয়ার আহ্বান করা হয়।

গ্রামের লোকজন ছুটে এসে প্রথমে উদ্ধার কাজ শুরু করেন বলে জানিয়েছেন বরমচাল গ্রামের বাসিন্দা ছালিক আহমদ চৌধুরী। তিনি জানান, ট্রেন থেকে উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্যে গুরুতর আহত যাত্রীদের একাংশকে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়নি তাদের আশপাশের বাড়িতে নিয়ে রাখা হয়। অনেক লোক পাশর্^বর্তী মসজিদে আশ্রয় নেন। এলাকায় মাইকিং করে লোকজনের গাড়ি, সিএনজি ও অটোরিকশা বের করে আনা হয় আহত ও উদ্ধারকৃত যাত্রীদের পরিবহনের জন্য। স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দারা রাতভর দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রীদের পাশে থেকে সেবা শুশ্রুষা করেছেন বলে আক্রান্ত যাত্রীদের কাছ থেকে জানা গেছে।

গতকাল সকাল পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা প্রথমে ৪ জন, পরে ৫ জন বলা হলেও সর্বশেষ পুলিশ ও রেলওয়ে ৪ জনের মৃত্যুর বিষয় নিশ্চিত করেছে। তবে আহতদের সঠিক কোন সংখ্যা জানা যায়নি। তবে উদ্ধারকারী লোকজন মনে করছেন আহতের সংখ্যা দুই শতাধিক হবে। ঘটনার পর পরই মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. শাহজালাল, সিভিল সার্জন মো. শাহজাহান কবির চৌধুরীসহ পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং রেলওয়ের বিভাগীয় কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। গতকাল সকালে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পরে আরেকটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে সোমবার সকাল থেকে দুর্ঘটনা কবলিত ট্রেনটির উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। তবে ট্রেনের পেছনের ৫টি কোচ দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় পরবর্তীতে সামনের ১২টি কোচ নিয়ে উপবন ট্রেনটি শেষরাতের দিকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেছে বলে রেলওয়ের সূত্র জানিয়েছে।

সাড়ে ১৯ ঘণ্টা পর রেলপথ চালু :

বরমচালের ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে বোরবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টা থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। দিনভর রেলওয়ে উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেনের ক্রেনের সাহায্যে ছিটকে পড়া বগিগুলোর মধ্যে ৪টি টেনে তুলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথে নতুন সিøপার বসিয়ে লাইন মেরামত কাজ করেছে। মেরামত কাজ শেষে গতকাল সন্ধ্যা ৭টার কিছু পরে রেলওয়ে বিভাগ পরীক্ষামূলক ট্রেন চালায় এবং ট্রেনলাইন ট্রেন চলাচলের উপযোগী হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে প্রায় সাড়ে ১৯ ঘণ্টা পরে এ রেলপথটি পুনরায় চালু করা হয়। এদিকে দুর্ঘটনার কারণে সিলেটের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনগুলো মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার রেলওয়ে জংশনে এসে থামে এবং সেখান থেকে ফিরতি যাত্রায় নিজ নিজ গন্তব্যে চলাচল করে।

রেলওয়ের সূত্র জানায়, ঢাকা সিলেটে মহাসড়কে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাজবাজপুরে সড়কের ব্রিজ ভেঙে গিয়ে সিলেটের সঙ্গে ঢাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ট্রেনের উপর যাত্রীর চাপ বাড়ে। ফলে দুর্ঘটনা কবলিত উপবন ট্রেনে কয়েকটি এক্সট্রা বগি সংযোজন করা হয়। বহু যাত্রী স্ট্যান্ডিং টিকেট নিয়ে ট্রেনে উঠেন।

নিহত ৪ জনের পরিচয় : ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৪ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরমধ্যে সানজিদা বেগম (১৮) ও ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (১৯) সিলেট নার্সিং কলেজের বিএসসি (নার্র্সিং) তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সানজিদা বেগমের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায় এবং ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভার বাড়ি সিলেটের মোগলাবাজার এলাকায়। অপর দুইজন হলেন- হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার ডবল বহর গ্রামের কাওসার আহমদ (২৬) এবং মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া পৌর এলাকার ডিটিটিসির বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম (৪৫)। সানজিদা ঢাকায় চিকিৎসাধীন বাবাকে দেখতে বান্ধবি ইভাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে তার এক শিক্ষক জানিয়েছেন।

লুজ সিøপার থেকে দুর্ঘটনা : দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন উদ্ধারকারী কর্মী ও এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনাস্থল বড়ছড়া ব্রিজের প্রায় ১০০ ফুট দূরে সিøপারের লুজ কানেকশনের জন্য এ ট্রেনটির পেছনের দিক থেকে ছয় নম্বর কোচটি প্রথমে লাইনচ্যুত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই স্থানে দুটি লাইনের সংযোগস্থল রয়েছে। এরপর অন্য কোচগুলো একে অপরের ধাক্কায় লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে যায়। এ দুর্ঘটনার জন্য সিøপারের লুজ কানেকশন এবং ট্রেনটির দ্রুত গতি দায়ী হতে পারে। এ সময় ট্রেনের সামনের দিকে অন্তত ১২টি কোচ ইঞ্জিনের সঙ্গে চলতে থাকে। লাইনচ্যুত কোচগুলো হলো ট্রেনটির এক্সট্রা-৩, ড, ঢ, ণ ও ত নম্বর কোচ। সড়কপথে শাহবাজপুরে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় ট্রেনটিতে অধিক যাত্রী ছিল। ফলে উপবন ট্রেনটি ১৭টি কোচ নিয়ে চলছিল। বরমচাল কালা বাজার এলাকার একাধিক বাসিন্দা গতকাল সংবাদকে বলেছেন, দুর্ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকায় রেলপথের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। সিøপারগুলো অনেক পুরনো এবং স্থানে স্থানে ক্লিপ নেই।

এক ট্রেনযাত্রীর বিবরণ : দুর্ঘটনা কবলিত উপবন ট্রেনের উল্টে যাওয়া এক্সট্রা কোচের যাত্রী সিলেটের বাসিন্দা শিক্ষানবিশ আইনজীবী সাইফুর রহমান বলেন, ট্রেনটিতে যাত্রী ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। দুর্ঘটনাকালীন ট্রেনটি দ্রুতগতিতে চলছিল। ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়লে দুর্ঘটনাকবলিত কোচগুলো হঠাৎ প্রচ- শব্দে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। পাথরের সঙ্গে ট্রেনের চাকা ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি দেখা যায়। এদিক-সেদিক ওলট-পালট হতে থাকে দুর্ঘটনাকবলিত কোচগুলো। তখন ট্রেনের একদিকের কোচ আরেকদিকে যেতে থাকে এবং কোচের ভেতরের লোকজন একে অপরের উপর আছড়ে পড়ে। এ ট্রেনে দুটি কোচের মাঝের জায়গাতেও অনেক লোক ভ্রমণ করছিলেন। এসব লোকের কেউ টেনের কোচ থেকে ছিটকে পড়েন। অনেকের হাত ভেঙেছে। এ দুর্ঘটনায় নিহত এক মহিলা তাদের কোচের যাত্রী ছিলেন। প্রতি কোচে শতাধিক লোক ছিল বলে তিনি দাবি করেন।

নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল এলাকায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন ও বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।