রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শাহবাজপুর সেতু ভেঙে যাওয়ার কারণে এ সড়ক দিয়ে গত ১৯ জুন থেকে সিলেট-ঢাকাগামী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছিলেন। যার কারণে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে রেলওয়েকেই বেছে নিয়েছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের চরম দায়িত্বহীন উদাসীনতার কারণেই শেষ পর্যন্ত বিশ^াসের রেলওয়ে যাত্রাপথে কুলাউড়ায় এত মানুষকে জীবন দিতে হলো।

গত ২ জুন স্থানীয় অনলাইন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বড়ছড়া ব্রিজের পাশসহ আশপাশের রেললাইন থেকে কে বা কাহারা রেললাইনের ক্লিপগুলো খুলে নিচ্ছে। যার ফলে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে মর্মে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টিকে নজর দেয়ার জন্য অনুরোধই ছিল বিভিন্ন অনলাইন প্রচারণায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে রেল কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রশাসনিক কারওই এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত পড়েনি। পড়লেও কেউ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। যার ফলে গত রোববার ঘটে গেল স্মরণকালের এমন মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনা। রেললাইনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইতিমধ্যে ঝরে গেছে কয়েকটি তাজা প্রাণ। আর সিলেটের বিভিন্ন হাসপাতাল বেডে কাতরাচ্ছেন প্রায় তিন শতাধিক আহত যাত্রী।

একদিকে চলছিল স্থানীয় জনতা, ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট, পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে উদ্ধার অভিযান। অপরদিকে এলাকার কিছু অসাধু দুষ্ঠু প্রকৃতির লোকজন এ রকম অসহায় মুহূর্তে চালিয়েছিল মর্মান্তিক লুটপাট। মানুষ তার জীবন বাঁচাতে যখন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, তার সঙ্গে মালামাল আছে কি নেই এগুলোর দিকে তাদের কোন নজরই ছিল না। কিন্তু এ রকম দুর্যোগময় সময়ে স্থানীয় অসাধুদের নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতা সব মানবিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে। যাদের কাছে লোকজন উদ্ধারের সহযোগিতার আশা করছিল, সে রকমই কিছু লোকজন এ ধরনের লুটপাট চালিয়েছে রাতভর। তবে বরমচাল এলাকার লোকজনসহ কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকার বেশির ভাগ লোকজনই জীবনবাজি রেখে যার যার অবস্থান থেকে উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেছে।

দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর ইতিমধ্যে রেল যোগাযোগ আবার চালু হয়েছে। রেল বিভাগের কর্মকর্তারা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া তিনটি বগি রেললাইনের পাশে রেখেই গতকাল দিনভর উদ্ধার ও মেরামত শেষে ব্রিজ ও রেললাইনটি চলাচলের উপযোগী সন্ধ্যা ৭টায় এই রেলপথ দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ট্রায়াল ট্রেন ওই পথ ও ব্রিজ দিয়ে চলাচল করলে সিলেটের সঙ্গে ঢাকার বিচ্ছিন্ন হওয়া যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলপথ বিভাগের প্রকৌশলী আহসান জাবিদ।

অতীতে স্টেশন মাস্টার, পয়েন্টস ম্যান, লাইনম্যান, চাবিওয়ালা ইত্যাদি নামের সঙ্গে রেলপথের পার্শ্ববর্তী মানুষের বিশেষ পরিচয় ছিল। রেললাইনে দলবেঁধে একদল শ্রমিক সারা বছর কাজ করত। ঘাস পরিষ্কার করে রেললাইনের নিচের পাথরগুলো সাজিয়ে দিত। কোথাও রেললাইনের চিফ, চাবি, জোড়া বা অন্য কোন স্থানে ত্রুটি আছে কি না তা প্রতিদিন হেঁটে পরীক্ষা করত। চাবিওয়ালাদের নির্দিষ্ট কিলোমিটার রেললাইন পরীক্ষা করতে হতো প্রতিদিন। বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের পাশে চাবিওয়ালাদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল। যা মাইল পাশা নামে সমধিক পরিচিত ছিল। শ্রমিক, চা, চাবিওয়ালা ঠিকমতো কাজ করছে কি না তা তদারকি, রেললাইনে বা রেল ব্রিজে ত্রুটি আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য দুই ধরনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়িত্বপালন করতেন। মাঝারি ধরনের কর্মকর্তারা চলাচল করতেন পুশ ট্রলিতে। লোকজন হাসাহাসি করত, একজন মানুষ বসে আছে আর পেছনে চারজন ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করে ঠেলছে। পথিমধ্যে ট্রেন আসলে চারজন ধরাধরি করে ট্রলিটিকে ঝুঁকি নিয়ে রেললাইনের পাশে নামিয়ে রাখত। ট্রেন চলে গেলে আবার রেললাইনে উঠিয়ে যাত্রা শুরু করত। এসবই এখন অনেক অতীত হয়ে আছে। রেল কর্তৃপক্ষকে এলাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে অবগতি করার পরেও উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও এ ধরনের দুর্ঘটনার সংঘটিত হচ্ছে। যার সর্বশেষ বলি কুলাউড়ার বরমচালে বড়ছড়া ব্রিজের সামনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় এত মানুষের জীবন।

এলাকাবাসীর জোর দাবিÑ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক এই ঘটনার জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

মঙ্গলবার, ২৫ জুন ২০১৯ , ১১ আষাঢ় ১৪২৫, ২১ শাওয়াল ১৪৪০

রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী

মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন, কুলাউড়া (মৌলভীবাজার)

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শাহবাজপুর সেতু ভেঙে যাওয়ার কারণে এ সড়ক দিয়ে গত ১৯ জুন থেকে সিলেট-ঢাকাগামী বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ায় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছিলেন। যার কারণে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে রেলওয়েকেই বেছে নিয়েছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের চরম দায়িত্বহীন উদাসীনতার কারণেই শেষ পর্যন্ত বিশ^াসের রেলওয়ে যাত্রাপথে কুলাউড়ায় এত মানুষকে জীবন দিতে হলো।

গত ২ জুন স্থানীয় অনলাইন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বড়ছড়া ব্রিজের পাশসহ আশপাশের রেললাইন থেকে কে বা কাহারা রেললাইনের ক্লিপগুলো খুলে নিচ্ছে। যার ফলে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে মর্মে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টিকে নজর দেয়ার জন্য অনুরোধই ছিল বিভিন্ন অনলাইন প্রচারণায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে রেল কর্তৃপক্ষ কিংবা প্রশাসনিক কারওই এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিপাত পড়েনি। পড়লেও কেউ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। যার ফলে গত রোববার ঘটে গেল স্মরণকালের এমন মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনা। রেললাইনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ইতিমধ্যে ঝরে গেছে কয়েকটি তাজা প্রাণ। আর সিলেটের বিভিন্ন হাসপাতাল বেডে কাতরাচ্ছেন প্রায় তিন শতাধিক আহত যাত্রী।

একদিকে চলছিল স্থানীয় জনতা, ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট, পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে উদ্ধার অভিযান। অপরদিকে এলাকার কিছু অসাধু দুষ্ঠু প্রকৃতির লোকজন এ রকম অসহায় মুহূর্তে চালিয়েছিল মর্মান্তিক লুটপাট। মানুষ তার জীবন বাঁচাতে যখন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, তার সঙ্গে মালামাল আছে কি নেই এগুলোর দিকে তাদের কোন নজরই ছিল না। কিন্তু এ রকম দুর্যোগময় সময়ে স্থানীয় অসাধুদের নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতা সব মানবিকতাকে ছাড়িয়ে গেছে। যাদের কাছে লোকজন উদ্ধারের সহযোগিতার আশা করছিল, সে রকমই কিছু লোকজন এ ধরনের লুটপাট চালিয়েছে রাতভর। তবে বরমচাল এলাকার লোকজনসহ কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকার বেশির ভাগ লোকজনই জীবনবাজি রেখে যার যার অবস্থান থেকে উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করেছে।

দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টা সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর ইতিমধ্যে রেল যোগাযোগ আবার চালু হয়েছে। রেল বিভাগের কর্মকর্তারা দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া তিনটি বগি রেললাইনের পাশে রেখেই গতকাল দিনভর উদ্ধার ও মেরামত শেষে ব্রিজ ও রেললাইনটি চলাচলের উপযোগী সন্ধ্যা ৭টায় এই রেলপথ দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ট্রায়াল ট্রেন ওই পথ ও ব্রিজ দিয়ে চলাচল করলে সিলেটের সঙ্গে ঢাকার বিচ্ছিন্ন হওয়া যোগাযোগ পুনরায় স্থাপিত হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলপথ বিভাগের প্রকৌশলী আহসান জাবিদ।

অতীতে স্টেশন মাস্টার, পয়েন্টস ম্যান, লাইনম্যান, চাবিওয়ালা ইত্যাদি নামের সঙ্গে রেলপথের পার্শ্ববর্তী মানুষের বিশেষ পরিচয় ছিল। রেললাইনে দলবেঁধে একদল শ্রমিক সারা বছর কাজ করত। ঘাস পরিষ্কার করে রেললাইনের নিচের পাথরগুলো সাজিয়ে দিত। কোথাও রেললাইনের চিফ, চাবি, জোড়া বা অন্য কোন স্থানে ত্রুটি আছে কি না তা প্রতিদিন হেঁটে পরীক্ষা করত। চাবিওয়ালাদের নির্দিষ্ট কিলোমিটার রেললাইন পরীক্ষা করতে হতো প্রতিদিন। বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের পাশে চাবিওয়ালাদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল। যা মাইল পাশা নামে সমধিক পরিচিত ছিল। শ্রমিক, চা, চাবিওয়ালা ঠিকমতো কাজ করছে কি না তা তদারকি, রেললাইনে বা রেল ব্রিজে ত্রুটি আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য দুই ধরনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়িত্বপালন করতেন। মাঝারি ধরনের কর্মকর্তারা চলাচল করতেন পুশ ট্রলিতে। লোকজন হাসাহাসি করত, একজন মানুষ বসে আছে আর পেছনে চারজন ঘাম ঝরানো পরিশ্রম করে ঠেলছে। পথিমধ্যে ট্রেন আসলে চারজন ধরাধরি করে ট্রলিটিকে ঝুঁকি নিয়ে রেললাইনের পাশে নামিয়ে রাখত। ট্রেন চলে গেলে আবার রেললাইনে উঠিয়ে যাত্রা শুরু করত। এসবই এখন অনেক অতীত হয়ে আছে। রেল কর্তৃপক্ষকে এলাকার জনসাধারণের পক্ষ থেকে অবগতি করার পরেও উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও এ ধরনের দুর্ঘটনার সংঘটিত হচ্ছে। যার সর্বশেষ বলি কুলাউড়ার বরমচালে বড়ছড়া ব্রিজের সামনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় এত মানুষের জীবন।

এলাকাবাসীর জোর দাবিÑ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক এই ঘটনার জন্য দায়ীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।