মোস্তাফিজুর রহমান
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে চরম ভরাডুবি, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে ব্যর্থতা এবং বিরাজমান সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চাঙ্গা করতে খুব শীঘ্রই জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিএনপি। সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারক নেতারা। ইতিমধ্যেই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে দুজনকে স্থান দিয়ে ঢেলে সাজানোর সূচনা করেছে দলটি। এছাড়া দ্রুত মূল দল এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কাউন্সিল করার কথা জানানো হয়েছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রত্যেকটি সংগঠন পুনর্গঠন করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বলে বিএনপির সূত্র জানায়। দলটির সূত্রমতে, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে রাজনৈতিক মাঠে অবস্থান হারানোয় দল গোছানোর উদ্যোগ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দী হওয়ায় তারেক রহমানের নির্দেশে সাংগঠনিকভাবে দলটিকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি শুরু করে দলটির নীতিনির্ধারকরা। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্থায়ী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে জানা গেছে।
বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলে খালেদা জিয়াকে দলের চেয়ারপারসন পদে পুনর্নির্বাচিত করার পাশপাশি দ্বিতীয় শীর্ষ পদ সৃষ্টি করে (জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান) দায়িত্বে আনা হয় তারেক রহমানকে। ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করা হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। নতুন কয়েকজনকে স্থান দেয়া হয় স্থায়ী কমিটিতে। যদিও পরবর্তিতে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের মৃত্যুর কারণে কয়েকটি পদ শূন্য হয়ে পড়ে। ওই কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে দলকে সক্রিয় করার লক্ষ্য থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে গত বছর দুর্নীতির মামলায় দ- নিয়ে দ-িত হয়ে কারাগারে যান দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাকে কারাগারে রেখে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে ভরাডুবি হয় বিএনপির। ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করা বিএনপি অবশ্য অভিযোগ করে আসছে, ‘ভোট ডাকাতি’ করে গণরায় ‘ছিনিয়ে নিয়েছে’ আওয়ামী লীগ। যদিও তাদের অভিযোগ নাকচ করে আসছে ক্ষমতাসীন দল।
সাম্প্রতিক সময়ে দুই জোটের সঙ্গে অস্থিরতা, জামায়াত নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি বিএনপির মেরুদ-হীন সাংগঠনিক চিত্র নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। একাদশ নির্বাচনের আগে পরে কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। দীর্ঘ সময় ধরে বড় ধরনের কোন আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি। কারাগারে যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের কথা বলা হলেও তা চাঙ্গা করতে ব্যর্থতা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোর পুনর্গঠনের বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে দলের অভ্যন্তরেও তুমুল আলোচনা হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে কথা বললেও একাদশ নির্বাচনের পরে প্রকাশ্যেই কথা বলেছেন কেউ কেউ। অনেকের মধ্যে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ। তৃণমূল নেতারাও চান দলের পুনর্গঠন করা হোক। তারা থানা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। কর্মসূচি দিয়ে নেতারা মাঠে না থাকা, তৃণমূল নেতাকর্মীদের খোঁজখবর না রাখাসহ নানাবিধ কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্র। যার চূড়ান্ত পরিণতি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দেখা গেছে। বহু কেন্দ্রে এজেন্টেই দিতে পারেনি দীর্ঘদিন নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা দলটি। সব মিলিয়ে বিএনপির সাংগঠনিক স্থবিরতা বিরাজ করছে।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোর পুনর্গঠনের বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে দলের অভ্যন্তরে তুমুল আলোচনা চলছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত, জোটের সঙ্গে টানাপড়েনসহ নানা কারণে বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেনি দলের নীতিনির্ধারকরা। পরবর্তিতে দল গোছানোর নির্দেশ দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপর দলের সাংগঠনিক কাঠামোর পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এর পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদলসহ বিএনপির অঙ্গ সংগঠনও পুনর্গঠন করার প্রস্তুতি শুরু করে। এরই মধ্যে আগামী ১৫ জুলাই নির্ধারণ করে ছাত্রদলের কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির সিনিয়র যুগ্মসচিব খায়রুল কবির খোকনকে প্রধান করে ছাত্রদলের কাউন্সিল উপলক্ষে নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে ছাত্রদলের আগামী নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য কাউন্সিল আয়োজন করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, সপ্তম কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা ওঠলেও এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত আলোচনা, সিদ্ধান্ত বা আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। গত শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। স্কাইপে’র মাধ্যমে লন্ডন থেকে ওই বৈঠক যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে এ নিয়ে আরও আলোচনা শেষে কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ করার পর কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবেন বিএনপির নেতারা। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর সপ্তম কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে। দলটির একাধিক সূত্রমতে, বিএনপি চেয়ারপারসন কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থাকায় কাউন্সিলের জন্য দলের মহাসচিবকে প্রধান করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিয়ে বেশকিছু উপকমিটি গঠন করা হবে। এসব উপকমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম-মহাসচিব ও উপদেষ্টাদের দায়িত্ব দেয়া হবে।
দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের একজন সদস্য বলেন, সাধারণত কাউন্সিলে নেতাদের পদ-পদবি দেয়ার কয়েকটি খসড়া তালিকা করে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার হাতে দেয়া হয়। ওই তালিকা দেখেই নীতিনির্ধারকরা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকায় যারা থাকেন তাদের নাম ও পদবি কাউন্সিলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। এখন কাউন্সিলের আগে তিনি মুক্তি পেলে কাউন্সিলের কার্যক্রমে অংশ নেবেন। তা না হলে খসড়া তালিকা করা পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরামর্শে চূড়ান্ত তালিকা করা হবে। বিএনপির নীতিনির্ধারক কয়েকজন নেতা সংবাদকে জানান, যত সঙ্কট আসুক, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তাই দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের সমন্বয়ে বিএনপি পুনর্গঠন জরুরি। বিএনপির কাউন্সিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে এই প্রসঙ্গে গত শনিবার স্থায়ী কমিটির নতুন দুই সদস্যকে নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দেয়ার পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সপ্তম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এজন্য ইতিমধ্যে দলীয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জেলা কমিটিগুলোও পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে।
বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে সমালোচনা করার পাশাপাশি তার শক্তিশালী করা খুবই জরুরি হয়ে পড়ার কথা বলে আসছিলেন বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শকরাও। সম্প্রতি এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ সংবাদকে বলেন, বিএনপি এখন ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু তারা সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল। এটা শক্তিশালী করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুই নেতা (খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান) দুই জায়গাতে আবদ্ধ। একজন এখানে কারাগারে, আরেকজন লন্ডনে। আর যারা স্ট্যাডিং কমিটির মেম্বার তারাও অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এ কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত আসছে না। তাই সংগঠন শক্তিশালী করার পাশাপাশি এখন যেকোনভাবেই হোক না কেন নেত্রীকে যেমন মুক্ত করা দরকার, তেমনি তারেক রহমানকেও আরও কাছাকাছি রাখা দরকার। এসবগুলো মিলিয়ে নেতৃত্বের প্রভাবটা খুব বেশি করে অনুভব করা হচ্ছে। তাই সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের বিষয়টি যদি নিশ্চিত হয় তাহলে বিএনপি আবার আগের রূপে ফিরতে পারবে।
বুধবার, ২৬ জুন ২০১৯ , ১২ আষাঢ় ১৪২৫, ২২ শাওয়াল ১৪৪০
মোস্তাফিজুর রহমান
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে চরম ভরাডুবি, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে ব্যর্থতা এবং বিরাজমান সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটিয়ে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চাঙ্গা করতে খুব শীঘ্রই জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বিএনপি। সম্মেলনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারক নেতারা। ইতিমধ্যেই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে দুজনকে স্থান দিয়ে ঢেলে সাজানোর সূচনা করেছে দলটি। এছাড়া দ্রুত মূল দল এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কাউন্সিল করার কথা জানানো হয়েছে। কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রত্যেকটি সংগঠন পুনর্গঠন করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বলে বিএনপির সূত্র জানায়। দলটির সূত্রমতে, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে রাজনৈতিক মাঠে অবস্থান হারানোয় দল গোছানোর উদ্যোগ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দী হওয়ায় তারেক রহমানের নির্দেশে সাংগঠনিকভাবে দলটিকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি শুরু করে দলটির নীতিনির্ধারকরা। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্থায়ী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে জানা গেছে।
বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলে খালেদা জিয়াকে দলের চেয়ারপারসন পদে পুনর্নির্বাচিত করার পাশপাশি দ্বিতীয় শীর্ষ পদ সৃষ্টি করে (জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান) দায়িত্বে আনা হয় তারেক রহমানকে। ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করা হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। নতুন কয়েকজনকে স্থান দেয়া হয় স্থায়ী কমিটিতে। যদিও পরবর্তিতে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্যের মৃত্যুর কারণে কয়েকটি পদ শূন্য হয়ে পড়ে। ওই কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে দলকে সক্রিয় করার লক্ষ্য থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এরমধ্যে গত বছর দুর্নীতির মামলায় দ- নিয়ে দ-িত হয়ে কারাগারে যান দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তাকে কারাগারে রেখে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে ভরাডুবি হয় বিএনপির। ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করা বিএনপি অবশ্য অভিযোগ করে আসছে, ‘ভোট ডাকাতি’ করে গণরায় ‘ছিনিয়ে নিয়েছে’ আওয়ামী লীগ। যদিও তাদের অভিযোগ নাকচ করে আসছে ক্ষমতাসীন দল।
সাম্প্রতিক সময়ে দুই জোটের সঙ্গে অস্থিরতা, জামায়াত নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি বিএনপির মেরুদ-হীন সাংগঠনিক চিত্র নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। একাদশ নির্বাচনের আগে পরে কোথাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। দীর্ঘ সময় ধরে বড় ধরনের কোন আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারেনি। কারাগারে যাওয়ার পর খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের কথা বলা হলেও তা চাঙ্গা করতে ব্যর্থতা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপির সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোর পুনর্গঠনের বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে দলের অভ্যন্তরেও তুমুল আলোচনা হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে কথা বললেও একাদশ নির্বাচনের পরে প্রকাশ্যেই কথা বলেছেন কেউ কেউ। অনেকের মধ্যে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ। তৃণমূল নেতারাও চান দলের পুনর্গঠন করা হোক। তারা থানা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। কর্মসূচি দিয়ে নেতারা মাঠে না থাকা, তৃণমূল নেতাকর্মীদের খোঁজখবর না রাখাসহ নানাবিধ কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্র। যার চূড়ান্ত পরিণতি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দেখা গেছে। বহু কেন্দ্রে এজেন্টেই দিতে পারেনি দীর্ঘদিন নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা দলটি। সব মিলিয়ে বিএনপির সাংগঠনিক স্থবিরতা বিরাজ করছে।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোর পুনর্গঠনের বিষয়টি জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে দলের অভ্যন্তরে তুমুল আলোচনা চলছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত, জোটের সঙ্গে টানাপড়েনসহ নানা কারণে বিষয়টি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেনি দলের নীতিনির্ধারকরা। পরবর্তিতে দল গোছানোর নির্দেশ দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপর দলের সাংগঠনিক কাঠামোর পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এর পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদলসহ বিএনপির অঙ্গ সংগঠনও পুনর্গঠন করার প্রস্তুতি শুরু করে। এরই মধ্যে আগামী ১৫ জুলাই নির্ধারণ করে ছাত্রদলের কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির সিনিয়র যুগ্মসচিব খায়রুল কবির খোকনকে প্রধান করে ছাত্রদলের কাউন্সিল উপলক্ষে নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করা হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে ছাত্রদলের আগামী নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য কাউন্সিল আয়োজন করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, সপ্তম কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা ওঠলেও এখনও পর্যন্ত চূড়ান্ত আলোচনা, সিদ্ধান্ত বা আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। গত শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। স্কাইপে’র মাধ্যমে লন্ডন থেকে ওই বৈঠক যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে এ নিয়ে আরও আলোচনা শেষে কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারণ করার পর কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবেন বিএনপির নেতারা। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পর সপ্তম কাউন্সিলের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হবে। দলটির একাধিক সূত্রমতে, বিএনপি চেয়ারপারসন কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে থাকায় কাউন্সিলের জন্য দলের মহাসচিবকে প্রধান করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিয়ে বেশকিছু উপকমিটি গঠন করা হবে। এসব উপকমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম-মহাসচিব ও উপদেষ্টাদের দায়িত্ব দেয়া হবে।
দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের একজন সদস্য বলেন, সাধারণত কাউন্সিলে নেতাদের পদ-পদবি দেয়ার কয়েকটি খসড়া তালিকা করে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার হাতে দেয়া হয়। ওই তালিকা দেখেই নীতিনির্ধারকরা চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকায় যারা থাকেন তাদের নাম ও পদবি কাউন্সিলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। এখন কাউন্সিলের আগে তিনি মুক্তি পেলে কাউন্সিলের কার্যক্রমে অংশ নেবেন। তা না হলে খসড়া তালিকা করা পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরামর্শে চূড়ান্ত তালিকা করা হবে। বিএনপির নীতিনির্ধারক কয়েকজন নেতা সংবাদকে জানান, যত সঙ্কট আসুক, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তাই দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের সমন্বয়ে বিএনপি পুনর্গঠন জরুরি। বিএনপির কাউন্সিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে এই প্রসঙ্গে গত শনিবার স্থায়ী কমিটির নতুন দুই সদস্যকে নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দেয়ার পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সপ্তম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এজন্য ইতিমধ্যে দলীয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জেলা কমিটিগুলোও পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে।
বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে সমালোচনা করার পাশাপাশি তার শক্তিশালী করা খুবই জরুরি হয়ে পড়ার কথা বলে আসছিলেন বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শকরাও। সম্প্রতি এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ সংবাদকে বলেন, বিএনপি এখন ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু তারা সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল। এটা শক্তিশালী করতে হবে। তিনি আরও বলেন, দুই নেতা (খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান) দুই জায়গাতে আবদ্ধ। একজন এখানে কারাগারে, আরেকজন লন্ডনে। আর যারা স্ট্যাডিং কমিটির মেম্বার তারাও অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এ কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত আসছে না। তাই সংগঠন শক্তিশালী করার পাশাপাশি এখন যেকোনভাবেই হোক না কেন নেত্রীকে যেমন মুক্ত করা দরকার, তেমনি তারেক রহমানকেও আরও কাছাকাছি রাখা দরকার। এসবগুলো মিলিয়ে নেতৃত্বের প্রভাবটা খুব বেশি করে অনুভব করা হচ্ছে। তাই সাংগঠনিক ও নেতৃত্বের বিষয়টি যদি নিশ্চিত হয় তাহলে বিএনপি আবার আগের রূপে ফিরতে পারবে।