শুভ্রতায় আবৃত কামাল লোহানী

হারুন হাবীব

উনিশ’ আশি সালের কথা। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রবল প্রতাপে দেশ শাসন করছেন। স্বাধীনতাবিরোধীরা রাতারাতি পুনর্বাসিত হতে শুরু করেছে তার নতুন রাজনীতির কল্যাণে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সবকিছু পাল্টে যেতে শুরু করেছে। রাজাকাররা প্রবল প্রতাপে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। রাজনীতিতে কেনাবেচা শুরু হয়েছে। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পরাজিতরা ছাড়া সে পাল্টে যাওয়া কেউই আশা করেনি।

কিন্তু এরপরও জীবন থেমে থাকেনি। অফিস-আদালত চলেছে। যানবাহন চলছে। সরকারি আদেশ-নির্দেশের বাইরে কিছু লিখতে না পারলেও পত্রপত্রিকা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা সেদিনের নবীন সাংবাদিকরাও কাজ করছি। প্রতিরাতে কারফিউর মধ্যে রিকশায় বাড়ি ফেরার সময় রাইফেল উঁচিয়ে পুলিশ-মিলিটারি থামিয়ে দিচ্ছে, পরিচয় জানাতে হচ্ছে। আমরা না হয় উতরে গেছি ‘কারফিউ পাস’ আছে বলে, বিপন্ন হয়েছেন সাধারণ মানুষ। বলাই বাহুল্য, জেনারেল জিয়ার আমলের ‘নৈশ কারফিউ’ যেন শেষ হওয়ার ছিল না! বছরের পর বছর চলেছে!

আমি তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রায়-নবীন রিপোর্টার। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফিরে যোগ দিয়েছিলাম ‘বিপিআই’ বা বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের ছোট্ট একটি বার্তা সংস্থায়। ১৯৭৫ সালে যোগ দিয়েছি বাসসে। প্রথাগত ভাবেই বাসস থেকে দু’জন রিপোর্টারকে প্রেসিডেন্ট ভবনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। একজন আমার বয়োজ্যেষ্ঠ সৈয়দ মোজাম্মেল হক, অন্যজন আমি। সামরিক শাসক- তথা প্রেসিডেন্ট জিয়া মাঝে মধ্যেই বিদেশ সফর করেন। বেশির ভাগ সময়েই মোজাম্মেল ভাই বা আমার অন্য সব জ্যেষ্ঠরা, হয়তো যোগ্যতার কারণেই, রাষ্ট্রপতির সফর সঙ্গী হন। বিদেশ যেতে আমার যে লোভ হয় না তা নয়, কিন্তু পেরে ওঠি না।

সেবার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে বলে মনে হলো। প্রেসিডেন্ট হাউজ সফরসঙ্গীদের তালিকা তৈরি করেছে। শুনলাম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের এবারকার তালিকায় আছেন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী, ফজলে রশিদ এবং কনিষ্ঠদের মধ্যে আমিসহ বিভিন্ন পত্রিকার কয়েকজন। কিন্তু আমার বেলায় ভালো কিছু সহজে হয় না, হলোও না। শুনলাম, ‘ড্রেস রিহারসেল’ দিতে হবে এবং পরীক্ষা নেবেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। প্রেস সেক্রেটারি কাফি খান ফোনে জানালেন, মনে রেখ, যেনতেন পোশাক পরে রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হওয়া যায় না। স্যুট-টাই চাই। ভাবলাম হয়তো তাই। কিন্তু মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। গরমকালে আমি হাফ শার্ট ও স্যান্ডেল পরি। কনকনে শীতের সময়, খুব বিপদে পড়লে, সোয়েটার-জুতা পরি। কিন্তু এখন শুনছি, বিদেশ যেতে হলে স্যুট-টাই লাগবেই। ওটা ছাড়া নাকি চলবে না।

স্যুট-টাই যে একেবারে ছিল নাÑ তা নয়। কয়েক বছর আগেই বিয়ে করেছি, কাজেই ছিল একটা বাক্সবন্দী হয়ে। মাস কয়েক আগে সংবাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি মোনাজাতউদ্দিন গভীর রাতে হন্তদন্ত হয়ে আমার সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে এসে হাজির হল। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে তারও থাইল্যান্ডে যাওয়ার ডাক এসেছে। সে খুব খুশি। খবর পেয়েই রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছে। কিন্তু দু’দিনের মধ্যে স্যুট-টাই বানাবে কিভাবে? টাকাই বা কোথায়? লম্বায় আমরা প্রায় সমান বলে আমার দ্বারস্থ হয়েছে বিপন্ন বন্ধুবর! বাক্সপেটারায় বেশ খোঁজাখুজির পর দুমড়ানো-মোচড়ানো স্যুট-টাই পাওয়া গেল। বন্ধুবর ভাবল, বাঁচা গেল। অতি-যতনে সেই স্যুট-টাই সে গায়ে চাপাল এবং আয়নার সামনে দাঁড়াল। বলাই বাহুল্য, পোশাকটা যে না পরলেই ভালো হতো, মোনাজাতের দিকে তাকালেই তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু মোনাজাত সেই স্যুট-টাই নিয়ে সানন্দে বেরিয়ে গেল।

যাই হোক, যথাসময়ে বঙ্গভবনে সফরসঙ্গীদের ‘ড্রেস রিহারসেল’ শুরু হলো। আমি ছিলাম ১১ নম্বর সেক্টরের একজন গেরিলা যোদ্ধা, বাড়তি দায়িত্ব ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা ও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’র রণাঙ্গন সংবাদদাতার। সেই সুবাদেই নিজ অঞ্চল ছেড়ে অনেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। আসামের মানকারচরের কাছে তেলঢালার পাহাড়েও গিয়েছি বার কয়েক, সেখানে ছিল মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ‘জেড ফোর্স’। এরপর, সম্ভবত সেপ্টেম্বরের দিকে, নানা সন্দেহভাজন কাজকর্মের অভিযোগ এবং যুদ্ধের কৌশলগত প্রয়োজনে ‘জেড ফোর্স’কে সিলেটের দিকে পাঠিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার।

অনুমান করি, হয়তো সেদিনকার মুখ চেনার সুবাদেই বেশি কিছু প্রশ্ন করলেন না জেনারেল। বললেন, স্যুট-টাই পরতে হবে, ওসব ছাড়া চলবে না, জলদি বানিয়ে ফেলুন, যান। কিন্তু আমি উতরে গেলেও বড় সংকট বাধল শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীকে নিয়ে। তিনি কিছুতেই তার চিরায়ত সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি ছাড়বেন না, স্যুট-টাই পরবেন না। যেতে হলে ওভাবেই যাবেন।

বলতে গেলে খানিকটা তর্কই হরেলা জেনারেল জিয়ার সঙ্গে লোহানী ভাইয়ের। কিন্তু তার এক কথা, পায়জামা-পাঞ্জাবি ছাড়বেন না, তার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে মিলিটারি প্রেসিডেন্টও জানিয়ে দিলেন তার সফরসঙ্গী হতে হলে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা চলবে না, স্যুট-টাই পরতে হবে। কিন্তু যে কামাল লোহানী নিজের পোশাক ও জীবনধর্ম নিজেই নির্বাচন করেন, তিনি একজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরের কথামতো বদলাবেন কোন দুঃখে ? শেষ পর্যন্ত লোহানী ভাই জেনারেল জিয়ার সফরসঙ্গী হননি।

কাহিনীটা মনে পড়ল যখন লোহানী ভাইয়ের ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে এই লেখাটা লিখছি। কারও রাজনৈতিক বিশ্বাস ও জীবনচর্চা সবাই সমান ভাবে মেনে নিয়েছে কিংবা মানবেÑ এমনটা নয়। এ বৈপরীত্য থাকবেই। কিন্তু একজন মানুষ তার নিজের বিশ্বাস ও পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে কতটা সৎ থাকতে পারেন, কতটা দৃঢ় থাকতে পারেন, কীর্তিমান সাংবাদিক ও বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী তার বড় প্রমাণ।

লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক অনেক। দেখা-সাক্ষাৎও হয় না তেমন। আমার নিজের একটা ছোট্ট, বলা চলে, একেবারেই অতিÑসাধারণ বলয় আছে, সেখানেই আমি নিজের মতো করে থাকি। রাষ্ট্রের কাছে, ক্ষমতাধরদের কাছে, নিজের জন্যে তেমন প্রত্যাশা নেই; যদি থাকে তা এতটুকুনই যে তারা যেন গণতান্ত্রিক হন, সুবিবেচক হন, তারা যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হন, গণমানুষের মঙ্গল সম্পাদন করেন। দুর্ভ্যাগ্য, ১৯৭৫ সালের পর অনেককাল সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তের দামে কেনা সেই বাংলাদেশকে তারা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, যা লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বসঘাতকতা।

এরপরও বলি, লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা যে একেবারেই হয় না তাও সত্যি নয়। দেখা হয় কখনও কোন আলোচনা সভায়, সাংস্কৃতিক পরিম-ল কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিকাশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কোন অনুষ্ঠানে। আমাদের জেনারেশনের অনেকের জীবনটা এভাবেই নির্ধারিত। মনে পড়ে, ২০০১ সালে লোহানী ভাই, আমি এবং আরও কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধের পর আগরতলায় প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছিলাম ‘মুক্তিযুদ্ধ উৎসব’, যেখানে এক ঐতিহাসিক মিলনমেলা ঘটেছিল দুই ভূখ-ের মানুষদের। ত্রিপুরার সরকার এবং গণমানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ, আবারও নতুন করে ১৯৭১ সালের পর।

আমি জানি, লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ থাক না থাক মনের দেখা-সাক্ষাৎ হয়। এই মানুষটির প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। দৃঢ়তা সমৃদ্ধ মানুষ তিনি, আদর্শের গৌরবে আজও, এই বয়সেও, দৃঢ়পায়ে দাঁিড়য়ে থাকেন।

৮৫ বছরে পা রেখেও কর্ম ও মননে আজও তরুণ কামাল লোহানী। কাশফুলের মতো সাদা চুল। তার এই সাদা চুল যে কবে দেখা শুরু করেছিলাম, মনে পড়ে না ! ঢাকায় যখন প্রথম আসি সেই তখন থেকেই দেখে চলেছি সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও জয়বাংলা সাপ্তাহিকের অফিসে আসা-যাওয়া করতেন এ পোশাকেই। বলাবাহুল্য, শুভ্রতায় আবৃত কামাল লোহানী; প্রগতিশীল জাতীয় আন্দোলনে, এক সময়ের লড়াকু সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাÑ কোথায় তিনি নেই? রাজপথে, মিছিলে, বৈঠকে, সভা-সমিতিসহ সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনেÑ সব জায়গাতেই লড়াকু সৈনিক লোহানী ভাই। এমন আত্মনিবেদিত, এমন দৃঢ়, সাহসী মানুষ খুব কি মেলে?

মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখেন লোহানী ভাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও ঐতিহাসিক ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক তিনি। শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এমআর আখতার মুকুল, সন্তোস গুপ্ত, সিকান্দার আবু জাফর, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহমদ, আমিনুল হক বাদশা, সলিমুল্লাহ সহ আরও কিছু নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে আমি দেখেছি কলকাতার বালুহক্কাক লেনের অফিসে দিনরাত পরিশ্রম করতে। মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় এদের কারও অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের এ দুই গণমাধ্যমের সঙ্গে রণাঙ্গন থেকে যুক্ত থাকার সুবাদে এদের সবকে বেশি করে জানার সুযোগ ঘটেছিল আমার।

স্বাধীনতা-উত্তর কালের সাংবাদিকতারও একনিষ্ঠ মানুষ লোহানী ভাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালের সামরিক শাসন কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আজও, এ ৮৫ বছরেও নিজের চিন্তা ও চেতনাকে প্রকাশ করেন তার ক্ষুরধার কলমে।

কয়েক বছর আগে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’সহ মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি কালজয়ী গানের রচয়িতা পশ্চিমবঙ্গের কবি গোবিন্দ হালদারের একটি অপ্রকাশিত ডায়েরি হাতে আসে আমার কবিকন্যা গোপার সহযোগিতায়। আমি তখন ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত’ নামে তিন খ-ের একটি বৃহৎ গবেষণা গ্রন্থ রচনায় যুক্ত। চারদিক থেকে সম্ভাব্য সব তথ্য সংগ্রহ করে চলেছি। গোবিন্দ হালদারের সেই ডায়েরিতে কামাল লোহানীর কথা বহুবার উল্লেখ আছে। কারণ তার গানগুলো থেকে বাছাই করে উল্লেখযোগ্য গানগুলোতে সুরারোপ করিয়ে তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন লোহানী ভাই। একটি গান সম্পর্কে গোবিন্দ হালদার লিখেছেনÑ ‘প্রথম রচনাকালে গানটির যে ভাষারূপ ছিল, পরবর্তীকালে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী সাহেবের অনুরোধে গানটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অন্তরা পরিবর্তন করে বর্তমান রূপ গৃহীত হয়।’

গানগুলোর রচনা ও সুরারোপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গোবিন্দ হালদার লেখেনÑ ‘যতদূর মনে পড়ছে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই কামাল ভাই আমাকে প্রথম জানালেন যে, আমার গানের খাতাটি তিনি ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে’ পৌঁছে দিয়েছেন। আমার কয়েকটি গানে সুর হচ্ছে। দু’জন সুর করেছেন। তখন আর বিস্তারিত কিছু বললেন না। কেননা, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ তৎকালীন অবস্থান এবং তার কার্য্যপ্রণালী সম্পর্কে বাইরের কেউ যাতে কোনরূপ কিছু জানতে না পারে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ গোপন কেন্দ্র একরকম পাকাপাকিভাবে স্থাপিত হয়ে যায় কলকাতায়। কর্মকর্তাদের অন্যতম প্রধান এবং বেতারের সংবাদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী সাহেব ছিলেন কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে, লোহানী সাহেব কলকাতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই কামাল ভাইয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ গোপন কেন্দ্রে নানা কর্মসূত্রে তার যাতায়াত শুরু হয়। অনুষ্ঠান প্রচারের প্রথম যুগে ভালো গানের অভাবের কথা শুনে, তিনি আমার গানের খাতাটি লোহানী সাহেবের হাতে তুলে দেন। লোহানী সাহেব তখন খাতাটি বেতারের সংশ্লিষ্ট সুরকারদের দেন খাতা থেকে গান বাছাই করে সুর করার এবং তা’ প্রচার করার জন্য। খাতার ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটির ‘কথা’ লোহানী সাহেবেরও বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গানটির যাতে ভালো সুর হয় এজন্য দুই বন্ধুতে পরামর্শ করে লোহানী সাহেব প্রথম আমার গানের খাতাটি বেতারের বর্ষীয়ান, অভিজ্ঞ সুরকার ও সংগীত শ্রষ্টা শ্রী সমর দাস মহাশয়কে দেন। কিন্তু আপেল মাহমুদ নামে বেতারের একজন তরুণ সংগীতশিল্পী খাতা থেকে ওই গানটি পছন্দ করে বেছে নিয়ে সুর করতে আরম্ভ করেন। আপেল মাহমুদ অভিজ্ঞ সুরকার না হওয়ায় তার দেয়া সুর কেমন হবে এ বিষয়ে লোহানী সাহেব ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও গানটিতে ইচ্ছামতো সুর করার জন্য তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়।’

‘আমার যতদূর স্মরণে আসছে, তাতে ১৯৭১-এর জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ার দিকে গানটি প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। কারণ, নির্দিষ্ট দিন ও তারিখ মনে না থাকলেও, এটুকু মনে আছে যে, জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আমি গানটি প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে শুনেছিলাম। কেননা, স্বাধীন বাংলা বেতারের দেশাত্মবোধক সংগীতের অনুষ্ঠান সে সময় আমি নিয়মিত দু’বেলাই শুনতাম। বিশেষ করে, আমার গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতারে দেয়া হয়েছে এবং কয়েকটি গানে সুর হচ্ছে কামাল ভাইয়ের মুখে একথা শোনার পর আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে বেতারের অনুষ্ঠান শুনতাম। ... লোহানী সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটি আজও বেশ মনে পড়ে। কারণ সেই প্রথম পরিচয়েই লোহানী সাহেবের ব্যক্তিত্ব এবং স্বভাব মাধুর্য আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। তারিখটা ঠিক মনে নেই। অফিস পালিয়ে কামাল ভাইয়ের ডেরায় গিয়ে হাজির হয়েছি। বেলা বোধহয় তখন ৩টা সাড়ে ৩টা হবে। ঘরে ঢুকেই দেখি কামাল ভাই সামনে বসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে গল্প করছেন। ভদ্রলোকের গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, পরনে সাদা ধবধবে পায়জামা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ন। মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ। প্রথম দৃষ্টিতেই আকর্ষণ করার মতো চেহারা। কামাল ভাই লোহানী সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। লোহানী সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করে শুভেচ্ছা জানালেন তারপর ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটির রচনার জন্য আমাকে সবিশেষ অভিনন্দন জানালেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘আপনার লেখা গানটি বাংলাদেশে দারুণ ঝড় তুলেছে। লোহানী সাহেবের কথা শুনে খুব আনন্দ হলো। তারপর বললেন, ‘আপনার খাতা থেকে আরও কয়েকটি গান সুর করা হয়ে গেছে, শীঘ্রই প্রচার করা শুরু হবে।’

২০১৮ তে বরেণ্য কামাল লোহানী পা রাখলেন ৮৫তে। তার প্রতি একজন বয়োকনিষ্ঠের বিনম্র শ্রদ্ধা। আরও দীর্ঘদিন থাকুন লোহানী ভাই; যে তারুণ্য ধারণ করে আপনি আজ ৮৫ বছরে, সে তারুণ্যের প্রতি আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসা।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক ]

বুধবার, ২৬ জুন ২০১৯ , ১২ আষাঢ় ১৪২৫, ২২ শাওয়াল ১৪৪০

শুভ্রতায় আবৃত কামাল লোহানী

হারুন হাবীব

উনিশ’ আশি সালের কথা। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়ে প্রবল প্রতাপে দেশ শাসন করছেন। স্বাধীনতাবিরোধীরা রাতারাতি পুনর্বাসিত হতে শুরু করেছে তার নতুন রাজনীতির কল্যাণে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সবকিছু পাল্টে যেতে শুরু করেছে। রাজাকাররা প্রবল প্রতাপে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। রাজনীতিতে কেনাবেচা শুরু হয়েছে। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পরাজিতরা ছাড়া সে পাল্টে যাওয়া কেউই আশা করেনি।

কিন্তু এরপরও জীবন থেমে থাকেনি। অফিস-আদালত চলেছে। যানবাহন চলছে। সরকারি আদেশ-নির্দেশের বাইরে কিছু লিখতে না পারলেও পত্রপত্রিকা প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা সেদিনের নবীন সাংবাদিকরাও কাজ করছি। প্রতিরাতে কারফিউর মধ্যে রিকশায় বাড়ি ফেরার সময় রাইফেল উঁচিয়ে পুলিশ-মিলিটারি থামিয়ে দিচ্ছে, পরিচয় জানাতে হচ্ছে। আমরা না হয় উতরে গেছি ‘কারফিউ পাস’ আছে বলে, বিপন্ন হয়েছেন সাধারণ মানুষ। বলাই বাহুল্য, জেনারেল জিয়ার আমলের ‘নৈশ কারফিউ’ যেন শেষ হওয়ার ছিল না! বছরের পর বছর চলেছে!

আমি তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রায়-নবীন রিপোর্টার। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে ফিরে যোগ দিয়েছিলাম ‘বিপিআই’ বা বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের ছোট্ট একটি বার্তা সংস্থায়। ১৯৭৫ সালে যোগ দিয়েছি বাসসে। প্রথাগত ভাবেই বাসস থেকে দু’জন রিপোর্টারকে প্রেসিডেন্ট ভবনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। একজন আমার বয়োজ্যেষ্ঠ সৈয়দ মোজাম্মেল হক, অন্যজন আমি। সামরিক শাসক- তথা প্রেসিডেন্ট জিয়া মাঝে মধ্যেই বিদেশ সফর করেন। বেশির ভাগ সময়েই মোজাম্মেল ভাই বা আমার অন্য সব জ্যেষ্ঠরা, হয়তো যোগ্যতার কারণেই, রাষ্ট্রপতির সফর সঙ্গী হন। বিদেশ যেতে আমার যে লোভ হয় না তা নয়, কিন্তু পেরে ওঠি না।

সেবার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে বলে মনে হলো। প্রেসিডেন্ট হাউজ সফরসঙ্গীদের তালিকা তৈরি করেছে। শুনলাম, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের এবারকার তালিকায় আছেন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী, ফজলে রশিদ এবং কনিষ্ঠদের মধ্যে আমিসহ বিভিন্ন পত্রিকার কয়েকজন। কিন্তু আমার বেলায় ভালো কিছু সহজে হয় না, হলোও না। শুনলাম, ‘ড্রেস রিহারসেল’ দিতে হবে এবং পরীক্ষা নেবেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। প্রেস সেক্রেটারি কাফি খান ফোনে জানালেন, মনে রেখ, যেনতেন পোশাক পরে রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গী হওয়া যায় না। স্যুট-টাই চাই। ভাবলাম হয়তো তাই। কিন্তু মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়। গরমকালে আমি হাফ শার্ট ও স্যান্ডেল পরি। কনকনে শীতের সময়, খুব বিপদে পড়লে, সোয়েটার-জুতা পরি। কিন্তু এখন শুনছি, বিদেশ যেতে হলে স্যুট-টাই লাগবেই। ওটা ছাড়া নাকি চলবে না।

স্যুট-টাই যে একেবারে ছিল নাÑ তা নয়। কয়েক বছর আগেই বিয়ে করেছি, কাজেই ছিল একটা বাক্সবন্দী হয়ে। মাস কয়েক আগে সংবাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি মোনাজাতউদ্দিন গভীর রাতে হন্তদন্ত হয়ে আমার সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে এসে হাজির হল। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে তারও থাইল্যান্ডে যাওয়ার ডাক এসেছে। সে খুব খুশি। খবর পেয়েই রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছে। কিন্তু দু’দিনের মধ্যে স্যুট-টাই বানাবে কিভাবে? টাকাই বা কোথায়? লম্বায় আমরা প্রায় সমান বলে আমার দ্বারস্থ হয়েছে বিপন্ন বন্ধুবর! বাক্সপেটারায় বেশ খোঁজাখুজির পর দুমড়ানো-মোচড়ানো স্যুট-টাই পাওয়া গেল। বন্ধুবর ভাবল, বাঁচা গেল। অতি-যতনে সেই স্যুট-টাই সে গায়ে চাপাল এবং আয়নার সামনে দাঁড়াল। বলাই বাহুল্য, পোশাকটা যে না পরলেই ভালো হতো, মোনাজাতের দিকে তাকালেই তা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু মোনাজাত সেই স্যুট-টাই নিয়ে সানন্দে বেরিয়ে গেল।

যাই হোক, যথাসময়ে বঙ্গভবনে সফরসঙ্গীদের ‘ড্রেস রিহারসেল’ শুরু হলো। আমি ছিলাম ১১ নম্বর সেক্টরের একজন গেরিলা যোদ্ধা, বাড়তি দায়িত্ব ‘জয়বাংলা’ পত্রিকা ও ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’র রণাঙ্গন সংবাদদাতার। সেই সুবাদেই নিজ অঞ্চল ছেড়ে অনেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে। আসামের মানকারচরের কাছে তেলঢালার পাহাড়েও গিয়েছি বার কয়েক, সেখানে ছিল মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ‘জেড ফোর্স’। এরপর, সম্ভবত সেপ্টেম্বরের দিকে, নানা সন্দেহভাজন কাজকর্মের অভিযোগ এবং যুদ্ধের কৌশলগত প্রয়োজনে ‘জেড ফোর্স’কে সিলেটের দিকে পাঠিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী মুজিবনগর সরকার।

অনুমান করি, হয়তো সেদিনকার মুখ চেনার সুবাদেই বেশি কিছু প্রশ্ন করলেন না জেনারেল। বললেন, স্যুট-টাই পরতে হবে, ওসব ছাড়া চলবে না, জলদি বানিয়ে ফেলুন, যান। কিন্তু আমি উতরে গেলেও বড় সংকট বাধল শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীকে নিয়ে। তিনি কিছুতেই তার চিরায়ত সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি ছাড়বেন না, স্যুট-টাই পরবেন না। যেতে হলে ওভাবেই যাবেন।

বলতে গেলে খানিকটা তর্কই হরেলা জেনারেল জিয়ার সঙ্গে লোহানী ভাইয়ের। কিন্তু তার এক কথা, পায়জামা-পাঞ্জাবি ছাড়বেন না, তার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে মিলিটারি প্রেসিডেন্টও জানিয়ে দিলেন তার সফরসঙ্গী হতে হলে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা চলবে না, স্যুট-টাই পরতে হবে। কিন্তু যে কামাল লোহানী নিজের পোশাক ও জীবনধর্ম নিজেই নির্বাচন করেন, তিনি একজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধরের কথামতো বদলাবেন কোন দুঃখে ? শেষ পর্যন্ত লোহানী ভাই জেনারেল জিয়ার সফরসঙ্গী হননি।

কাহিনীটা মনে পড়ল যখন লোহানী ভাইয়ের ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে এই লেখাটা লিখছি। কারও রাজনৈতিক বিশ্বাস ও জীবনচর্চা সবাই সমান ভাবে মেনে নিয়েছে কিংবা মানবেÑ এমনটা নয়। এ বৈপরীত্য থাকবেই। কিন্তু একজন মানুষ তার নিজের বিশ্বাস ও পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে কতটা সৎ থাকতে পারেন, কতটা দৃঢ় থাকতে পারেন, কীর্তিমান সাংবাদিক ও বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী তার বড় প্রমাণ।

লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক অনেক। দেখা-সাক্ষাৎও হয় না তেমন। আমার নিজের একটা ছোট্ট, বলা চলে, একেবারেই অতিÑসাধারণ বলয় আছে, সেখানেই আমি নিজের মতো করে থাকি। রাষ্ট্রের কাছে, ক্ষমতাধরদের কাছে, নিজের জন্যে তেমন প্রত্যাশা নেই; যদি থাকে তা এতটুকুনই যে তারা যেন গণতান্ত্রিক হন, সুবিবেচক হন, তারা যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হন, গণমানুষের মঙ্গল সম্পাদন করেন। দুর্ভ্যাগ্য, ১৯৭৫ সালের পর অনেককাল সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, যে বাংলাদেশ লাখো শহীদের রক্তের দামে কেনা সেই বাংলাদেশকে তারা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতিপথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে, যা লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বসঘাতকতা।

এরপরও বলি, লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা যে একেবারেই হয় না তাও সত্যি নয়। দেখা হয় কখনও কোন আলোচনা সভায়, সাংস্কৃতিক পরিম-ল কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিকাশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কোন অনুষ্ঠানে। আমাদের জেনারেশনের অনেকের জীবনটা এভাবেই নির্ধারিত। মনে পড়ে, ২০০১ সালে লোহানী ভাই, আমি এবং আরও কিছু বন্ধুর সঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধের পর আগরতলায় প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছিলাম ‘মুক্তিযুদ্ধ উৎসব’, যেখানে এক ঐতিহাসিক মিলনমেলা ঘটেছিল দুই ভূখ-ের মানুষদের। ত্রিপুরার সরকার এবং গণমানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ, আবারও নতুন করে ১৯৭১ সালের পর।

আমি জানি, লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ থাক না থাক মনের দেখা-সাক্ষাৎ হয়। এই মানুষটির প্রতি আমার প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। দৃঢ়তা সমৃদ্ধ মানুষ তিনি, আদর্শের গৌরবে আজও, এই বয়সেও, দৃঢ়পায়ে দাঁিড়য়ে থাকেন।

৮৫ বছরে পা রেখেও কর্ম ও মননে আজও তরুণ কামাল লোহানী। কাশফুলের মতো সাদা চুল। তার এই সাদা চুল যে কবে দেখা শুরু করেছিলাম, মনে পড়ে না ! ঢাকায় যখন প্রথম আসি সেই তখন থেকেই দেখে চলেছি সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। কলকাতার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও জয়বাংলা সাপ্তাহিকের অফিসে আসা-যাওয়া করতেন এ পোশাকেই। বলাবাহুল্য, শুভ্রতায় আবৃত কামাল লোহানী; প্রগতিশীল জাতীয় আন্দোলনে, এক সময়ের লড়াকু সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাÑ কোথায় তিনি নেই? রাজপথে, মিছিলে, বৈঠকে, সভা-সমিতিসহ সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনেÑ সব জায়গাতেই লড়াকু সৈনিক লোহানী ভাই। এমন আত্মনিবেদিত, এমন দৃঢ়, সাহসী মানুষ খুব কি মেলে?

মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখেন লোহানী ভাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও ঐতিহাসিক ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক তিনি। শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এমআর আখতার মুকুল, সন্তোস গুপ্ত, সিকান্দার আবু জাফর, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহমদ, আমিনুল হক বাদশা, সলিমুল্লাহ সহ আরও কিছু নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিকে আমি দেখেছি কলকাতার বালুহক্কাক লেনের অফিসে দিনরাত পরিশ্রম করতে। মুক্তিযুদ্ধের সাংবাদিকতায় এদের কারও অবদান খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের এ দুই গণমাধ্যমের সঙ্গে রণাঙ্গন থেকে যুক্ত থাকার সুবাদে এদের সবকে বেশি করে জানার সুযোগ ঘটেছিল আমার।

স্বাধীনতা-উত্তর কালের সাংবাদিকতারও একনিষ্ঠ মানুষ লোহানী ভাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালের সামরিক শাসন কিংবা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ছিল অবধারিত। কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আজও, এ ৮৫ বছরেও নিজের চিন্তা ও চেতনাকে প্রকাশ করেন তার ক্ষুরধার কলমে।

কয়েক বছর আগে ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’সহ মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি কালজয়ী গানের রচয়িতা পশ্চিমবঙ্গের কবি গোবিন্দ হালদারের একটি অপ্রকাশিত ডায়েরি হাতে আসে আমার কবিকন্যা গোপার সহযোগিতায়। আমি তখন ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত’ নামে তিন খ-ের একটি বৃহৎ গবেষণা গ্রন্থ রচনায় যুক্ত। চারদিক থেকে সম্ভাব্য সব তথ্য সংগ্রহ করে চলেছি। গোবিন্দ হালদারের সেই ডায়েরিতে কামাল লোহানীর কথা বহুবার উল্লেখ আছে। কারণ তার গানগুলো থেকে বাছাই করে উল্লেখযোগ্য গানগুলোতে সুরারোপ করিয়ে তা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন লোহানী ভাই। একটি গান সম্পর্কে গোবিন্দ হালদার লিখেছেনÑ ‘প্রথম রচনাকালে গানটির যে ভাষারূপ ছিল, পরবর্তীকালে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ অন্যতম প্রধান কর্মকর্তা এবং সংবাদ বিভাগের প্রধান বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী সাহেবের অনুরোধে গানটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় অন্তরা পরিবর্তন করে বর্তমান রূপ গৃহীত হয়।’

গানগুলোর রচনা ও সুরারোপের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গোবিন্দ হালদার লেখেনÑ ‘যতদূর মনে পড়ছে, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই কামাল ভাই আমাকে প্রথম জানালেন যে, আমার গানের খাতাটি তিনি ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে’ পৌঁছে দিয়েছেন। আমার কয়েকটি গানে সুর হচ্ছে। দু’জন সুর করেছেন। তখন আর বিস্তারিত কিছু বললেন না। কেননা, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ তৎকালীন অবস্থান এবং তার কার্য্যপ্রণালী সম্পর্কে বাইরের কেউ যাতে কোনরূপ কিছু জানতে না পারে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ গোপন কেন্দ্র একরকম পাকাপাকিভাবে স্থাপিত হয়ে যায় কলকাতায়। কর্মকর্তাদের অন্যতম প্রধান এবং বেতারের সংবাদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিখ্যাত সাংবাদিক কামাল লোহানী সাহেব ছিলেন কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে, লোহানী সাহেব কলকাতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই কামাল ভাইয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ‘স্বাধীন বাংলা বেতারের’ গোপন কেন্দ্রে নানা কর্মসূত্রে তার যাতায়াত শুরু হয়। অনুষ্ঠান প্রচারের প্রথম যুগে ভালো গানের অভাবের কথা শুনে, তিনি আমার গানের খাতাটি লোহানী সাহেবের হাতে তুলে দেন। লোহানী সাহেব তখন খাতাটি বেতারের সংশ্লিষ্ট সুরকারদের দেন খাতা থেকে গান বাছাই করে সুর করার এবং তা’ প্রচার করার জন্য। খাতার ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটির ‘কথা’ লোহানী সাহেবেরও বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গানটির যাতে ভালো সুর হয় এজন্য দুই বন্ধুতে পরামর্শ করে লোহানী সাহেব প্রথম আমার গানের খাতাটি বেতারের বর্ষীয়ান, অভিজ্ঞ সুরকার ও সংগীত শ্রষ্টা শ্রী সমর দাস মহাশয়কে দেন। কিন্তু আপেল মাহমুদ নামে বেতারের একজন তরুণ সংগীতশিল্পী খাতা থেকে ওই গানটি পছন্দ করে বেছে নিয়ে সুর করতে আরম্ভ করেন। আপেল মাহমুদ অভিজ্ঞ সুরকার না হওয়ায় তার দেয়া সুর কেমন হবে এ বিষয়ে লোহানী সাহেব ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও গানটিতে ইচ্ছামতো সুর করার জন্য তাকে স্বাধীনতা দেয়া হয়।’

‘আমার যতদূর স্মরণে আসছে, তাতে ১৯৭১-এর জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ার দিকে গানটি প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়। কারণ, নির্দিষ্ট দিন ও তারিখ মনে না থাকলেও, এটুকু মনে আছে যে, জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই আমি গানটি প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে শুনেছিলাম। কেননা, স্বাধীন বাংলা বেতারের দেশাত্মবোধক সংগীতের অনুষ্ঠান সে সময় আমি নিয়মিত দু’বেলাই শুনতাম। বিশেষ করে, আমার গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতারে দেয়া হয়েছে এবং কয়েকটি গানে সুর হচ্ছে কামাল ভাইয়ের মুখে একথা শোনার পর আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে বেতারের অনুষ্ঠান শুনতাম। ... লোহানী সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের ঘটনাটি আজও বেশ মনে পড়ে। কারণ সেই প্রথম পরিচয়েই লোহানী সাহেবের ব্যক্তিত্ব এবং স্বভাব মাধুর্য আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। তারিখটা ঠিক মনে নেই। অফিস পালিয়ে কামাল ভাইয়ের ডেরায় গিয়ে হাজির হয়েছি। বেলা বোধহয় তখন ৩টা সাড়ে ৩টা হবে। ঘরে ঢুকেই দেখি কামাল ভাই সামনে বসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে গল্প করছেন। ভদ্রলোকের গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, পরনে সাদা ধবধবে পায়জামা। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ন। মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ। প্রথম দৃষ্টিতেই আকর্ষণ করার মতো চেহারা। কামাল ভাই লোহানী সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। লোহানী সাহেবের সঙ্গে করমর্দন করে শুভেচ্ছা জানালেন তারপর ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’ গানটির রচনার জন্য আমাকে সবিশেষ অভিনন্দন জানালেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘আপনার লেখা গানটি বাংলাদেশে দারুণ ঝড় তুলেছে। লোহানী সাহেবের কথা শুনে খুব আনন্দ হলো। তারপর বললেন, ‘আপনার খাতা থেকে আরও কয়েকটি গান সুর করা হয়ে গেছে, শীঘ্রই প্রচার করা শুরু হবে।’

২০১৮ তে বরেণ্য কামাল লোহানী পা রাখলেন ৮৫তে। তার প্রতি একজন বয়োকনিষ্ঠের বিনম্র শ্রদ্ধা। আরও দীর্ঘদিন থাকুন লোহানী ভাই; যে তারুণ্য ধারণ করে আপনি আজ ৮৫ বছরে, সে তারুণ্যের প্রতি আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসা।

[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক ]