প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষায় পরিবার ও রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে

নিতাই চন্দ্র রায়

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ষাট বছর ও তার বেশি বয়সীদের দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিক ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যারা এ সমাজ গড়ছেন, তাদের শেষ জীবন স্বস্তিময় করতে সন্তানদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তার ওই ঘোষণার ফলে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ নাগরিক বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের স্বল্পমূল্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য, আবাসন ও যানবাহনের সুবিধা পাওয়ার। তার মতে, পরিবারই নাগরিকদের সবচেয়ে স্বস্তিময় ও নিরাপদ স্থান। এ কারণে পরিবারে যাতে প্রবীণ ব্যক্তিরা স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদায় অন্য সদস্যদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে পারেন, তার দায়িত্ব সন্তানকেই নিতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নির্ধারিত দিনে ‘প্যারেন্টস ডে’ বা ‘ মাদারস ডে’ উদযাপন না করে বাংলাদেশে প্রতিটি দিনই প্রতিটি পরিবারে ‘প্যারেন্টস ডে’ হিসেবে উদযাপিত হবে। বিশ্ব প্রবীণ দিবস -২০১৪ সালে Ñএটাই ছিল মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রত্যাশা। রাষ্ট্রপতির সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন দীর্ঘ পাঁচ বছরেও দৃশ্যমান হচ্ছে না বাংলাদেশে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাথাপিছু আয় ও পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে বাড়ছে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে গড় আয়ু। বিশ্বে বর্তমানে ৬০ বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৯০ কোটি ১০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবীণ লোকদের সংখ্যা বেড়ে ১৪০ কোটিতে দাঁড়াবে। আর ২০৫০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াবে ২১০ কোটিতে। বিশ্বের আন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার আট শতাংশ প্রবীণ। ২০২৬ সালে এ জনসংখ্যা হবে ১০ ভাগ। আর ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। তখন দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে ৪ কোটিরও বেশি। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ প্রবীণই দরিদ্র। তারা অর্ধাহারে-অনাহারে, স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর শতকরা ৭৭ ভাগই গ্রামে বাস করেন। তারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, অসহায়, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত ও বিচ্ছিন্ন।

প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসেবা, বিনোদন, যতœ ও নিরাপত্তা নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে নানা প্রকার সমস্যা। প্রবীণদের এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে পরিবার, রাষ্ট্র্রীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। প্রবীণরাই এ সমাজ ও সভ্যতার কারিগর। তারা তাদের শ্রম, মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়নে রাখছেন অশেষ অবদান। অবদান রেখেছেন জাতীয় অর্থনীতিতে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। এগিয়ে নিয়ে গেছেন মানব সভ্যতাকে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাধ্যমে- এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আজ যারা যুবক, তারাও একদিন বৃদ্ধ হবে। মহাকাল কাউকেই ক্ষমা করবে না। এটাই বাস্তব। এটাই সত্য। এ সত্যকে ধারণ করে সমাজের যুবক শ্রেণীকে প্রবীণদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখাতে হবে। ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষায় সোচ্চার হতে হবে। নিজের প্রবীণ বাবা-মায়ের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে সন্তানদের শিক্ষা দিতে হবে প্রবীণদের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের।

প্রবীণদের ভাতা দেয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান কিংবা আয়ের সুযোগ তাদের ক্ষমতায়ন করবে। পরিবারের সদস্যদের প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, পরিবার ছাড়া প্রবীণদের সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব নয়। এতেই সমাজে প্রবীণদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘প্রবীণ অধিকার সুরক্ষা : চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তরা এসব কথা বলেন। বয়স্ক বাবা-মায়ের ভরণপোষণ, তাদের ভালাবাসা, চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা, শ্রদ্ধা করা, তাদের প্রতি বিনয়ী হওয়া- আমাদের আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা তার সন্তানের সঙ্গেই থাকবেনÑ এটাও দেশের প্রচলিত রীতি। বিদ্যমান আইনেও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণ সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক। তারপরও দেখা যায়, কোন কোন সন্তান বাবা-মায়ের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছলেবলে কৌশলে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে বাবামাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বাবা-মা অনাহারে রাস্তায় দিন কাটান। ছেলে তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকে সুরম্য অট্টালিকায়। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ঘটনা বেশি করে ঘটছে সমাজে।

বাংলাদেশে মোট সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ প্রবীণ। দেশের প্রবীণরা নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। চ্যালেঞ্জগুলো হলো- প্রবীণেরা বিপদাপন্ন ও দারিদ্র্যের শিকার, একাকিত্বে জর্জরিত, সরকারি সেবা কার্যক্রমে প্রবীণদের প্রবেশগম্যতা সীমিত। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব এএসএম আতিকুর রহমানের মতে, প্রবীণদের সম্মানের সঙ্গে দেখভাল করতে হবে। প্রবীণেরা পরিবারের বাইরের কেউ নন। প্রবীণ নারীর চেয়ে প্রবীণ পুরুষ সামলানো সহজ। প্রবীণেরা কথা বলতে চান, কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনতে চায় না। অথচ এ প্রবীণদের হাত ধরেই সবাই বড় হয়েছে। প্রবীণদের জন্য চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বিষয়গুলো হলোÑ ২৪ ঘণ্টা থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা, চিকিৎসা, সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। প্রবীণদের প্রতি কোন অবহেলা নয়। এজন্য অনেক প্রবীণ নিবাস প্রয়োজন। দেশের ছয়টি বিভাগীয় শহরে মাত্র ছয়টি প্রবীণ নিবাস আছে। প্রতিটিতে ৫০ জন করে মাত্র ৩০০ জন প্রবীণের থাকার ব্যবস্থা আছে, মোট প্রবীণ সংখ্যার অনুপাতে এটি খুবই নগণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাসে ৫০০ টাকা করে ৪০ লাখ গরিব প্রবীণদের বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে আরও ৪ লাখ প্রবীণকে- এ বয়স্ক ভাতা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ বাজারে ৫০০ টাকা দিয়ে একজন অসহায় প্রবীণের কী হয়? না হয় তিন বেলা খাবার খরচ। না হয় তার ওষুধ কেনার অর্থ। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বয়স্ক ভাতাসহ প্রবীণদের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানে উচিত।

বিদেশে প্রবীণদের অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সেখানে বিনা মূল্যে প্রবীণদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাসিক পেনশন আছে। বিনা মূল্যে চিকিৎসা সুবিধা আছে। কম পরিশ্রমের হালকা চাকরির ব্যবস্থা আছে। বিনা মূল্যে রেল ভ্রমণের সুবিধা আছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে প্রবীণদের তেমন সুযোগ-সুবিধাই নেই বললেই চলে। প্রতি বছর দেশের হাজার হাজার বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারী অবসর গ্রহণ করেন। অবসরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা অবসরোত্তর সুয়োগ-সুবিধাগুলো পান না। এ জন্য তাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া দেশের অনেক মিলকারখানা ও করপোরেশন থেকে যেসব কর্মকর্তাও কর্মচারী অবসর গ্রহণ করেন, তারাও সময় মতো গ্রাচুইটির টাকা পান না। তাদের গ্রাচুইটির টাকা পেতে হয়রানির শিকার হতে হয়। আমরা যদি সত্যই প্রবীণদের মঙ্গল চাই, তাহলে অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণদের পাওনা পরিশোধের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রবীণরা যাতে কোন হয়রানির শিকার না হন তাও নিশ্চিত করতে হবে।

কোন কোন বিশেষজ্ঞগণের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই প্রবীণদের অবস্থার উন্নয়ন করতে পারে। কারণ, হাতে টাকা থাকলেই প্রবীণেরা সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। যেভাবে সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে আন্তপ্রজন্ম সম্পর্কগুলোর পরিবর্তনের ফলে প্রবীণেরা খারাপ অবস্থায় পড়বেন। প্রবীণদের ওপর নানা রকম নির্যাতন আছে, বৈষম্য আছে। এ এসব বিষয়ে পরিবারের সদস্যদেরকেই খেয়াল রাখতে হবে। প্রবীণ মানেই দুর্দশাগ্রস্ত নন। প্রবীণদের নিজেদেরও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পরিবার ছাড়া প্রবীণদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রবীণদের অধিকার সংরক্ষণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রবীণরা সম্মান চান। তারা চান, তাদের দীর্ঘ পথের অভিজ্ঞতাকে মানুষ প্রশংসা করুক। বার্ধক্য তো কোন অপরাধ নয়। পরিবার ছোট হয়ে আসার কারণে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি যেমন যতœ নেন, প্রবীণদের প্রতি তেমন যতœ নেন না। মাঠ পর্যায়ে প্রবীণ সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী হতে হবে। প্রবীণদের সম্পদ হিসেবে চিন্তা করতে হবে। প্রবীণদের শারীরিক সক্ষমতা হয়তো সীমিত থাকে, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকে অনেক।

প্রবীণ ও তরুণদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন আনতে হবে। প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রবীণ নিবাস গড়ে তুলতে হবে। সারা বিশ্বে এ সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো- কাউকে পেছেনে ফেলে নয়, কাউকে বাদ দিয়ে নয়। তাই এসডিজি অর্জন করতে হলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। প্রবীণদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সেবা কার্যক্রম চালু করতে হবে। এছাড়া আমাদের স্বাস্থ্য ও নারী নীতিতে প্রবীণদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রবীণদের তাদের অধিকারের প্রতি সোচ্চার হতে হবে। অধিকার বঞ্চিত হলে বিচার চাওয়ার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রবীণদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো একাকিত্ব। এ সমস্যা সমাধানে প্রচুর প্রবীণ নিবাস ও প্রবীণদের জন্য সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এসব সংগঠনের নেতৃত্বও সৃষ্টি করতে হবে তাদের মধ্য থেকে। দেশে অতি প্রবীণদের সংখ্যাও বাড়ছে। এদের প্রায় সবাই নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এ সমস্যা সমাধানে সর্বজনীন সোশ্যাল পেনশন স্কিম চালু করতে হবে। প্রবীণরা রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার। তাই প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় ও প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠন করাও প্রয়োজন।

[লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.

গোপালপুর , নাটোর]

netairoy18@yahoo.com

বুধবার, ২৬ জুন ২০১৯ , ১২ আষাঢ় ১৪২৫, ২২ শাওয়াল ১৪৪০

প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষায় পরিবার ও রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে

নিতাই চন্দ্র রায়

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ষাট বছর ও তার বেশি বয়সীদের দেশের জ্যেষ্ঠ নাগরিক ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যারা এ সমাজ গড়ছেন, তাদের শেষ জীবন স্বস্তিময় করতে সন্তানদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তার ওই ঘোষণার ফলে দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ নাগরিক বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের স্বল্পমূল্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য, আবাসন ও যানবাহনের সুবিধা পাওয়ার। তার মতে, পরিবারই নাগরিকদের সবচেয়ে স্বস্তিময় ও নিরাপদ স্থান। এ কারণে পরিবারে যাতে প্রবীণ ব্যক্তিরা স্বাচ্ছন্দ্য ও মর্যাদায় অন্য সদস্যদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে পারেন, তার দায়িত্ব সন্তানকেই নিতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নির্ধারিত দিনে ‘প্যারেন্টস ডে’ বা ‘ মাদারস ডে’ উদযাপন না করে বাংলাদেশে প্রতিটি দিনই প্রতিটি পরিবারে ‘প্যারেন্টস ডে’ হিসেবে উদযাপিত হবে। বিশ্ব প্রবীণ দিবস -২০১৪ সালে Ñএটাই ছিল মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রত্যাশা। রাষ্ট্রপতির সেই প্রত্যাশার বাস্তবায়ন দীর্ঘ পাঁচ বছরেও দৃশ্যমান হচ্ছে না বাংলাদেশে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাথাপিছু আয় ও পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে বাড়ছে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে গড় আয়ু। বিশ্বে বর্তমানে ৬০ বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ৯০ কোটি ১০ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রবীণ লোকদের সংখ্যা বেড়ে ১৪০ কোটিতে দাঁড়াবে। আর ২০৫০ সালে তা গিয়ে দাঁড়াবে ২১০ কোটিতে। বিশ্বের আন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার আট শতাংশ প্রবীণ। ২০২৬ সালে এ জনসংখ্যা হবে ১০ ভাগ। আর ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে। তখন দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে ৪ কোটিরও বেশি। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ প্রবীণই দরিদ্র। তারা অর্ধাহারে-অনাহারে, স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর শতকরা ৭৭ ভাগই গ্রামে বাস করেন। তারা আর্থিকভাবে অসচ্ছল, অসহায়, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত ও বিচ্ছিন্ন।

প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাদের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসেবা, বিনোদন, যতœ ও নিরাপত্তা নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে নানা প্রকার সমস্যা। প্রবীণদের এ সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে পরিবার, রাষ্ট্র্রীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। প্রবীণরাই এ সমাজ ও সভ্যতার কারিগর। তারা তাদের শ্রম, মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়নে রাখছেন অশেষ অবদান। অবদান রেখেছেন জাতীয় অর্থনীতিতে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে। এগিয়ে নিয়ে গেছেন মানব সভ্যতাকে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মাধ্যমে- এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আজ যারা যুবক, তারাও একদিন বৃদ্ধ হবে। মহাকাল কাউকেই ক্ষমা করবে না। এটাই বাস্তব। এটাই সত্য। এ সত্যকে ধারণ করে সমাজের যুবক শ্রেণীকে প্রবীণদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখাতে হবে। ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষায় সোচ্চার হতে হবে। নিজের প্রবীণ বাবা-মায়ের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে সন্তানদের শিক্ষা দিতে হবে প্রবীণদের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের।

প্রবীণদের ভাতা দেয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান কিংবা আয়ের সুযোগ তাদের ক্ষমতায়ন করবে। পরিবারের সদস্যদের প্রবীণ অধিকার সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, পরিবার ছাড়া প্রবীণদের সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব নয়। এতেই সমাজে প্রবীণদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘প্রবীণ অধিকার সুরক্ষা : চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তরা এসব কথা বলেন। বয়স্ক বাবা-মায়ের ভরণপোষণ, তাদের ভালাবাসা, চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা, শ্রদ্ধা করা, তাদের প্রতি বিনয়ী হওয়া- আমাদের আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ। বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মা তার সন্তানের সঙ্গেই থাকবেনÑ এটাও দেশের প্রচলিত রীতি। বিদ্যমান আইনেও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণ সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক। তারপরও দেখা যায়, কোন কোন সন্তান বাবা-মায়ের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছলেবলে কৌশলে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে বাবামাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বাবা-মা অনাহারে রাস্তায় দিন কাটান। ছেলে তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকে সুরম্য অট্টালিকায়। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ঘটনা বেশি করে ঘটছে সমাজে।

বাংলাদেশে মোট সাড়ে ১৬ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ প্রবীণ। দেশের প্রবীণরা নানা রকম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। চ্যালেঞ্জগুলো হলো- প্রবীণেরা বিপদাপন্ন ও দারিদ্র্যের শিকার, একাকিত্বে জর্জরিত, সরকারি সেবা কার্যক্রমে প্রবীণদের প্রবেশগম্যতা সীমিত। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মহাসচিব এএসএম আতিকুর রহমানের মতে, প্রবীণদের সম্মানের সঙ্গে দেখভাল করতে হবে। প্রবীণেরা পরিবারের বাইরের কেউ নন। প্রবীণ নারীর চেয়ে প্রবীণ পুরুষ সামলানো সহজ। প্রবীণেরা কথা বলতে চান, কিন্তু কেউ তাদের কথা শুনতে চায় না। অথচ এ প্রবীণদের হাত ধরেই সবাই বড় হয়েছে। প্রবীণদের জন্য চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। বিষয়গুলো হলোÑ ২৪ ঘণ্টা থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা, চিকিৎসা, সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। প্রবীণদের প্রতি কোন অবহেলা নয়। এজন্য অনেক প্রবীণ নিবাস প্রয়োজন। দেশের ছয়টি বিভাগীয় শহরে মাত্র ছয়টি প্রবীণ নিবাস আছে। প্রতিটিতে ৫০ জন করে মাত্র ৩০০ জন প্রবীণের থাকার ব্যবস্থা আছে, মোট প্রবীণ সংখ্যার অনুপাতে এটি খুবই নগণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাসে ৫০০ টাকা করে ৪০ লাখ গরিব প্রবীণদের বয়স্ক ভাতা দেয়া হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে আরও ৪ লাখ প্রবীণকে- এ বয়স্ক ভাতা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ বাজারে ৫০০ টাকা দিয়ে একজন অসহায় প্রবীণের কী হয়? না হয় তিন বেলা খাবার খরচ। না হয় তার ওষুধ কেনার অর্থ। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বয়স্ক ভাতাসহ প্রবীণদের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানে উচিত।

বিদেশে প্রবীণদের অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সেখানে বিনা মূল্যে প্রবীণদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাসিক পেনশন আছে। বিনা মূল্যে চিকিৎসা সুবিধা আছে। কম পরিশ্রমের হালকা চাকরির ব্যবস্থা আছে। বিনা মূল্যে রেল ভ্রমণের সুবিধা আছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে প্রবীণদের তেমন সুযোগ-সুবিধাই নেই বললেই চলে। প্রতি বছর দেশের হাজার হাজার বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মচারী অবসর গ্রহণ করেন। অবসরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা অবসরোত্তর সুয়োগ-সুবিধাগুলো পান না। এ জন্য তাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়া দেশের অনেক মিলকারখানা ও করপোরেশন থেকে যেসব কর্মকর্তাও কর্মচারী অবসর গ্রহণ করেন, তারাও সময় মতো গ্রাচুইটির টাকা পান না। তাদের গ্রাচুইটির টাকা পেতে হয়রানির শিকার হতে হয়। আমরা যদি সত্যই প্রবীণদের মঙ্গল চাই, তাহলে অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণদের পাওনা পরিশোধের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রবীণরা যাতে কোন হয়রানির শিকার না হন তাও নিশ্চিত করতে হবে।

কোন কোন বিশেষজ্ঞগণের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই প্রবীণদের অবস্থার উন্নয়ন করতে পারে। কারণ, হাতে টাকা থাকলেই প্রবীণেরা সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। যেভাবে সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে আন্তপ্রজন্ম সম্পর্কগুলোর পরিবর্তনের ফলে প্রবীণেরা খারাপ অবস্থায় পড়বেন। প্রবীণদের ওপর নানা রকম নির্যাতন আছে, বৈষম্য আছে। এ এসব বিষয়ে পরিবারের সদস্যদেরকেই খেয়াল রাখতে হবে। প্রবীণ মানেই দুর্দশাগ্রস্ত নন। প্রবীণদের নিজেদেরও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পরিবার ছাড়া প্রবীণদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রবীণদের অধিকার সংরক্ষণে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রবীণরা সম্মান চান। তারা চান, তাদের দীর্ঘ পথের অভিজ্ঞতাকে মানুষ প্রশংসা করুক। বার্ধক্য তো কোন অপরাধ নয়। পরিবার ছোট হয়ে আসার কারণে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি যেমন যতœ নেন, প্রবীণদের প্রতি তেমন যতœ নেন না। মাঠ পর্যায়ে প্রবীণ সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী হতে হবে। প্রবীণদের সম্পদ হিসেবে চিন্তা করতে হবে। প্রবীণদের শারীরিক সক্ষমতা হয়তো সীমিত থাকে, কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান থাকে অনেক।

প্রবীণ ও তরুণদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন আনতে হবে। প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রবীণ নিবাস গড়ে তুলতে হবে। সারা বিশ্বে এ সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো- কাউকে পেছেনে ফেলে নয়, কাউকে বাদ দিয়ে নয়। তাই এসডিজি অর্জন করতে হলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। প্রবীণদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সেবা কার্যক্রম চালু করতে হবে। এছাড়া আমাদের স্বাস্থ্য ও নারী নীতিতে প্রবীণদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রবীণদের তাদের অধিকারের প্রতি সোচ্চার হতে হবে। অধিকার বঞ্চিত হলে বিচার চাওয়ার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রবীণদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো একাকিত্ব। এ সমস্যা সমাধানে প্রচুর প্রবীণ নিবাস ও প্রবীণদের জন্য সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। এসব সংগঠনের নেতৃত্বও সৃষ্টি করতে হবে তাদের মধ্য থেকে। দেশে অতি প্রবীণদের সংখ্যাও বাড়ছে। এদের প্রায় সবাই নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এ সমস্যা সমাধানে সর্বজনীন সোশ্যাল পেনশন স্কিম চালু করতে হবে। প্রবীণরা রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার। তাই প্রবীণদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় ও প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠন করাও প্রয়োজন।

[লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি.

গোপালপুর , নাটোর]

netairoy18@yahoo.com