জাহানারা ইমামের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য

নাসিমা হক

http://print.thesangbad.net/images/2019/June/26Jun19/news/opinion.jpg

যাদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ অর্জিত হয়েছে তেমনই একজন মানুষ জাহানারা ইমাম। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শুধু নিজের ছেলেকে যুদ্ধেই পাঠাননি তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছিলেন যুদ্ধযাত্রার পথের প্রথম নির্দিষ্ট গন্তব্যে। বলছি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদ রুমি ও তার মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা। গতকাল ২৬ জুন ছিল তার মৃত্যুবার্ষিকী।

তিনি দেশের অগণিত শহীদ জননীর প্রতিনিধি জাহানারা ইমাম। জাহানারা ইমাম শুধু শহীদ জননী নন, তিনি নিজেই একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আদান-প্রদান করেছেন। যুদ্ধকালীন পুরো সময় আরও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন।

যুদ্ধ চলাকালীন একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা রুমিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল ভারতের মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে আসে। ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত এই গেরিলা দলের সদস্যরা অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে ফিরে আসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল ঢাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ পরিচালনার। পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া। টিভি স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো।

পাকিস্তান সরকার বলে বেড়াচ্ছিল ঢাকায় সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। ঢাকায় ও পূর্ব পাকিস্তানে যে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলছে না ঢাকায় নানা অপারেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়া ছিল ক্র্যাক প্লাটুনের দায়িত্ব। তারা সেই দায়িত্ব অত্যন্ত সাফল্য ও নৈপুণ্যের সঙ্গে পালন করেছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যুদ্ধের একপর্যায়ে এক রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেফতার করে। জাহানারা ইমাম ও প্রকৌশলী শরীফ ইমামের ছেলে রুমি এবং রুমির ছোট ভাই জামিকেও সেদিন গ্রেফতার করা হয় নিজ বাড়ি থেকে।

গ্রেফতার করে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। কয়েকদিন পর শরীফ ইমাম ও জামিকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু রুমি ছাড়া পাননি। বস্তুত রুমি আর কোনদিনই ফিরে আসেননি। পাকিস্তান আর্মিরা জেনে গিয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনের এ সদস্যদের নাম। এ গেরিলা দলের সদস্যদের মধ্যে যারা ধরা পড়ে গিয়েছিল তাদের সবাইকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।

রুমি ধরা পড়ার পর জাহানারা ইমাম পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজেছেন। বারবার নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলে গিয়েছেন। সেটি ছিল তখন আর্মির কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এখানে আটকে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হতো। এই এমপি হোস্টেলের কক্ষ সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের। এখানেই অত্যাচার, নির্যাতন করা হয়েছে জুয়েল, বদি, রুমি, আজাদসহ দলের সদস্যদের।

এখানেই নির্যাতন করা হয়েছে সঙ্গীত শিল্পী শহীদ আলতাফ মাহমুদ ও তার সহবন্দীদের। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ইকবাল আহমেদ ও চিত্র শিল্পী আবুল বারক আলভিসহ অনেকের ওপর। শেষোক্ত দু’জন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন। সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তারা আজও বেঁচে আছেন।

নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেল ও লালমাটিয়ার ফিজিকাল এডুকেশন কলেজ এই দুটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বস্তুত ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন জাদুঘর হিসাবে বর্তমান প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল।

ফিরে যাই মূল কথায়। জাহানারা ইমাম পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজে ফিরেছেন। যুদ্ধের সাড়ে ৯ মাস। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। আশা ছিল রুমি হয়তো ফিরে আসবে। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে দলে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু ফিরে আসেনি রুমি। বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন রুমির বাবা প্রকৌশলী শরীফ ইমাম। গ্রেফতারের পর তার ওপরও চরম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। সেই অত্যাচারে, অপমানে, ছেলের শোকে মারা যান তিনি। স্বাধীন দেশের বিজয় তিনি দেখে যেতে পারলেন না।

এই শোকের মধ্য দিয়ে বিজয় আসলো তাদের বাড়িতে। তারপরও উঠে দাঁড়ালের জাহানারা ইমাম শোক তার নিত্যসঙ্গ। তবু জীবন তো থেমে থাকে না। ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলেরা নিয়মিত তার কাছে আসে। এখন তাদের তিনি মা। তারা তাকে আম্মা ডাকে। নতুন করে ডুবে গেলেন কাজের মধ্যে। আবার শুরু করলেও লেখালেখি। কিন্তু এ লেখা অন্যরকম লেখা। দীর্ঘদিন থেকেই লেখালেখি করতেন। ছিলেন সফল অনুবাদক। প্রতিষ্ঠিত লেখিকা।

কিন্তু এ তো সেই লেখা নয়। দুই ছেলের মধ্যে এখন তার পাশে আছে ছোট ছেলে শাফি ইমাম জামি। আছে ছেলের বন্ধুরা।

রুমি তার প্রথম সন্তান। তাকে হারানো যে বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়া। সেই দুঃখের দিনগুলো যতো দুঃসহ ছিল সেই কথাগুলো লেখা ছিল তার চাইতেও ভয়াবহ ও দুঃসহ। সেই দুঃখময় দিনগুলোর কথা নিয়ে জাহানারা ইমাম লিখলেন। বুকের রক্তে কলম ডুবিয়ে ডুবিয়ে তিনি লিখলেন তার আত্মস্মৃতি ‘একাত্তরের দিনগুলি’। যুদ্ধের শুরু থেকেই সাংকেতিক ভাষায় ডায়েরি লিখতেন। সেই ডায়েরিকে ভিত্তি করে লিখলেন তার অমর স্মৃতিকথা একাত্তরের দিনগুলি। যা শুধু তার আত্মকথা নয়, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল, অমর সাহিত্য।

এ স্মৃতিকথা লিখে তিনি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এ যেন সব শহীদের মায়ের কথা। তিনি তাদের কথাই যেন লিপিবদ্ধ করেছেন। অসংখ্য শহীদ জননী অগণিত শহীদ পরিবার এ কষ্টের ভেতর দিয়ে গেছে। কিন্তু সবাইতো এভাবে লিখতে পারেন না। তিনি সেই দায়িত্বটি পালন করেছেন যেন সবার হয়ে।

এও এক অসম্ভব দুরূহ কাজ। কষ্টের দিনগুলোর কথা লিখতে গেলে সেই কষ্টের কথা আবার ফিরে আসে। অসাধ্য সেই কাজটি তিনি করেছিলেন।

আমরা সবাই বলি ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এগুলো শুধু একেকটা সংখ্যা নয়। এদের প্রত্যেকে রক্ত মাংসের মানুষ ছিল। প্রত্যেকের একটা নাম ছিল। স্বপ্ন ছিল। পরিবার ছিল। তাদের কারও কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।

জাহানারা ইমাম নতুন প্রজন্মের কাছে সেই ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সারাদেশে সাড়া ফেলে দেয় একাত্তরের দিনগুলি। একের পর এক সংস্করণ বের হতে থাকে। এ পর্যন্ত বহু সংস্করণ হয়েছে বইটির।

শুধু বই লিখেই ক্ষান্ত থাকেননি। একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে গড়ে তুললেন তুমুল আন্দোলন। গঠন করলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। যখন মনে হচ্ছিল দেশের মানুষ বুঝি মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যেতে বসেছে। তখন তার নেতৃত্বে গড়ে উঠল এ সংগঠন।

ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) তার নেতৃত্বে বসলো গণআদালত। গণআদালতে বিচার হলো যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধীদের।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাখা গঠনের জন্য ঘুরে বেড়ালেন দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।

ইতোমধ্যে তার দেহে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত শরীর নিয়েই তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেন। হয়ে উঠলেন নব পর্যায়ের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কা-ারি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে নেতৃত্ব দিলেন তিনি।

সেই সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে জোরালো ও ছড়িয়ে দিলেন সারা দেশে। দেশ যেন নতুন করে আবার জেগে উঠলো। আর সেই জাগরণে নেতৃত্ব দিলেন জাহানারা ইমাম। বয়স ও শোকের ভারে জীর্ণ অশক্ত দেহের কিন্তু দৃঢ় মনোবলের এক সাহসী মানুষ। দেশের জন্য, জাতির জন্য বিরাট এক দায়িত্ব পালন করে গেলেন তিনি। কখনও কোন রাজনৈতিক দল করেননি। ছিলেন শিক্ষিকা, লেখিকা। এবারে তিনি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে গঠিত এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিলেন। দিনরাত কাজ করে গেলেও অক্লান্ত। শক্তি তার মনোবল, দেশপ্রেম ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। একাত্তরের ঘাতক দালালদের তথা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই হবে এদেশের মাটিতে। সেই আন্দোলনের পথ ধরেই অবশেষে দেশে ঘাতক দালালদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে।

এই আন্দোলন করার সময় বায়তুল মোকাররমের সামনে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পুলিশের লাঠির আঘাত পড়েছে এই সাহসী মানুষটির ওপর। তখন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতাসীন।

খালেদা জিয়ার সরকার জাহানারা ইমামদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। মামলা করেছিল তার বিরুদ্ধে। মৃত্যুর পূর্বে সেই মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। দেশদ্রোহী খেতাব নিয়েই মৃত্যু হয় এ দেশপ্রেমী মানুষটির।

বায়তুল মোকাররমে পুলিশি নির্যাতনে আক্রান্ত হওয়ার পর জাহানারা ইমামকে দেখতে গিয়েছিলাম এলিফ্যান্ট রোডের ক্ষণিকা বাড়িটিতে। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে যেতাম তার কাছে। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি রয়েছে অনেক ¯েœহ পেয়েছি, উপদেশ পেয়েছি তার কাছে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের সময়ে তিনি নিজে আমাকে যুক্ত করেছিলেন এই কাজে। তার সঙ্গে সঙ্গী হয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে একাত্তরের দিনগুলো নিয়ে আলোচনা সভায় গিয়েছি। তার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো মূল্যবান স্মৃতি হয়ে রয়েছে হৃদয়ের মণিকোঠায়। তিনি যখন মহিলা পরিষদের সহ-সভানেত্রী তখনও তার সঙ্গে একই কমিটিতে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

রূপান্তর (অধুনা বিলুপ্ত) পত্রিকার জন্য তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। তার বাড়িতে বসেই লেখিকা ও দার্শনিক গৌরী আয়ুবের সাক্ষাৎকার নিয়েছি তারই উৎসাহে। এ মহান মানুষটির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম এ আমার পরম সৌভাগ্য।

সারা দেশে যখন সংগঠনের কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এমনই এক সময়ে ক্যান্সার আবার বেড়ে গেলে তাকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ছোট ছেলের কাছে চলে যেতে হয়। সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তার মৃত্যু হয়। শেষের দিকে তিনি আর কথা বলতে পারতেন না। লিখে লিখে নিজেকে প্রকাশ করতে হতো।

মৃত্যুর আগে লেখা দেশবাসীর উদ্দেশে শেষ চিঠিতে তিনি তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব দেশবাসীর কাছে অর্পণ করে গেছেন।

তার গড়ে তোলা সেই আন্দোলনের পথ ধরেই দেশে জোরালো দাবি উঠেছে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের।

অবশেষে দেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকজনের বিচারকাজ শেষ হয়েছে। ফাঁসির সাজাসহ দ- ঘোষণা হয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। সেসব সাজা কার্যকরও হয়েছে। এ বিচারকাজ তিনি দেখে যেতে পারেননি তবু এটাই তার আন্দোলনের সার্থকতা।

তার দেয়া সে দায়িত্বের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশ যেন বেপথু হতে না পারে। শহীদদের স্বপ্ন সাধ পূরণের লক্ষ্য অর্জনের পথ থেকে আমরা যেন কখনও সরে না যাই। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুদিন উপলক্ষে এ কথাটাই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। জননী সাহসিকা জাহানারা ইমামকে জানাই গভীর শ্রদ্ধ।

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০১৯ , ১৩ আষাঢ় ১৪২৫, ২৩ শাওয়াল ১৪৪০

জাহানারা ইমামের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য

নাসিমা হক

image

http://print.thesangbad.net/images/2019/June/26Jun19/news/opinion.jpg

যাদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই দেশ অর্জিত হয়েছে তেমনই একজন মানুষ জাহানারা ইমাম। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শুধু নিজের ছেলেকে যুদ্ধেই পাঠাননি তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছিলেন যুদ্ধযাত্রার পথের প্রথম নির্দিষ্ট গন্তব্যে। বলছি ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের শহীদ রুমি ও তার মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা। গতকাল ২৬ জুন ছিল তার মৃত্যুবার্ষিকী।

তিনি দেশের অগণিত শহীদ জননীর প্রতিনিধি জাহানারা ইমাম। জাহানারা ইমাম শুধু শহীদ জননী নন, তিনি নিজেই একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের খবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আদান-প্রদান করেছেন। যুদ্ধকালীন পুরো সময় আরও নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন।

যুদ্ধ চলাকালীন একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা রুমিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল ভারতের মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ করে দেশে ফিরে আসে। ক্র্যাক প্লাটুন নামে পরিচিত এই গেরিলা দলের সদস্যরা অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে ফিরে আসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালানোর জন্য। তাদের ওপর দায়িত্ব ছিল ঢাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ পরিচালনার। পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া। টিভি স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো।

পাকিস্তান সরকার বলে বেড়াচ্ছিল ঢাকায় সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। ঢাকায় ও পূর্ব পাকিস্তানে যে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলছে না ঢাকায় নানা অপারেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেয়া ছিল ক্র্যাক প্লাটুনের দায়িত্ব। তারা সেই দায়িত্ব অত্যন্ত সাফল্য ও নৈপুণ্যের সঙ্গে পালন করেছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো যুদ্ধের একপর্যায়ে এক রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেফতার করে। জাহানারা ইমাম ও প্রকৌশলী শরীফ ইমামের ছেলে রুমি এবং রুমির ছোট ভাই জামিকেও সেদিন গ্রেফতার করা হয় নিজ বাড়ি থেকে।

গ্রেফতার করে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। কয়েকদিন পর শরীফ ইমাম ও জামিকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু রুমি ছাড়া পাননি। বস্তুত রুমি আর কোনদিনই ফিরে আসেননি। পাকিস্তান আর্মিরা জেনে গিয়েছিল ক্র্যাক প্লাটুনের এ সদস্যদের নাম। এ গেরিলা দলের সদস্যদের মধ্যে যারা ধরা পড়ে গিয়েছিল তাদের সবাইকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।

রুমি ধরা পড়ার পর জাহানারা ইমাম পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজেছেন। বারবার নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেলে গিয়েছেন। সেটি ছিল তখন আর্মির কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। এখানে আটকে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হতো। এই এমপি হোস্টেলের কক্ষ সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের। এখানেই অত্যাচার, নির্যাতন করা হয়েছে জুয়েল, বদি, রুমি, আজাদসহ দলের সদস্যদের।

এখানেই নির্যাতন করা হয়েছে সঙ্গীত শিল্পী শহীদ আলতাফ মাহমুদ ও তার সহবন্দীদের। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ইকবাল আহমেদ ও চিত্র শিল্পী আবুল বারক আলভিসহ অনেকের ওপর। শেষোক্ত দু’জন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন। সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে তারা আজও বেঁচে আছেন।

নাখালপাড়ার এমপি হোস্টেল ও লালমাটিয়ার ফিজিকাল এডুকেশন কলেজ এই দুটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বস্তুত ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন জাদুঘর হিসাবে বর্তমান প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল।

ফিরে যাই মূল কথায়। জাহানারা ইমাম পাগলের মতো ছেলেকে খুঁজে ফিরেছেন। যুদ্ধের সাড়ে ৯ মাস। ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। আশা ছিল রুমি হয়তো ফিরে আসবে। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে দলে ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু ফিরে আসেনি রুমি। বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন রুমির বাবা প্রকৌশলী শরীফ ইমাম। গ্রেফতারের পর তার ওপরও চরম নির্যাতন চালানো হয়েছিল। সেই অত্যাচারে, অপমানে, ছেলের শোকে মারা যান তিনি। স্বাধীন দেশের বিজয় তিনি দেখে যেতে পারলেন না।

এই শোকের মধ্য দিয়ে বিজয় আসলো তাদের বাড়িতে। তারপরও উঠে দাঁড়ালের জাহানারা ইমাম শোক তার নিত্যসঙ্গ। তবু জীবন তো থেমে থাকে না। ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলেরা নিয়মিত তার কাছে আসে। এখন তাদের তিনি মা। তারা তাকে আম্মা ডাকে। নতুন করে ডুবে গেলেন কাজের মধ্যে। আবার শুরু করলেও লেখালেখি। কিন্তু এ লেখা অন্যরকম লেখা। দীর্ঘদিন থেকেই লেখালেখি করতেন। ছিলেন সফল অনুবাদক। প্রতিষ্ঠিত লেখিকা।

কিন্তু এ তো সেই লেখা নয়। দুই ছেলের মধ্যে এখন তার পাশে আছে ছোট ছেলে শাফি ইমাম জামি। আছে ছেলের বন্ধুরা।

রুমি তার প্রথম সন্তান। তাকে হারানো যে বুকের পাঁজর ভেঙে যাওয়া। সেই দুঃখের দিনগুলো যতো দুঃসহ ছিল সেই কথাগুলো লেখা ছিল তার চাইতেও ভয়াবহ ও দুঃসহ। সেই দুঃখময় দিনগুলোর কথা নিয়ে জাহানারা ইমাম লিখলেন। বুকের রক্তে কলম ডুবিয়ে ডুবিয়ে তিনি লিখলেন তার আত্মস্মৃতি ‘একাত্তরের দিনগুলি’। যুদ্ধের শুরু থেকেই সাংকেতিক ভাষায় ডায়েরি লিখতেন। সেই ডায়েরিকে ভিত্তি করে লিখলেন তার অমর স্মৃতিকথা একাত্তরের দিনগুলি। যা শুধু তার আত্মকথা নয়, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দলিল, অমর সাহিত্য।

এ স্মৃতিকথা লিখে তিনি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এ যেন সব শহীদের মায়ের কথা। তিনি তাদের কথাই যেন লিপিবদ্ধ করেছেন। অসংখ্য শহীদ জননী অগণিত শহীদ পরিবার এ কষ্টের ভেতর দিয়ে গেছে। কিন্তু সবাইতো এভাবে লিখতে পারেন না। তিনি সেই দায়িত্বটি পালন করেছেন যেন সবার হয়ে।

এও এক অসম্ভব দুরূহ কাজ। কষ্টের দিনগুলোর কথা লিখতে গেলে সেই কষ্টের কথা আবার ফিরে আসে। অসাধ্য সেই কাজটি তিনি করেছিলেন।

আমরা সবাই বলি ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এগুলো শুধু একেকটা সংখ্যা নয়। এদের প্রত্যেকে রক্ত মাংসের মানুষ ছিল। প্রত্যেকের একটা নাম ছিল। স্বপ্ন ছিল। পরিবার ছিল। তাদের কারও কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।

জাহানারা ইমাম নতুন প্রজন্মের কাছে সেই ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সারাদেশে সাড়া ফেলে দেয় একাত্তরের দিনগুলি। একের পর এক সংস্করণ বের হতে থাকে। এ পর্যন্ত বহু সংস্করণ হয়েছে বইটির।

শুধু বই লিখেই ক্ষান্ত থাকেননি। একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে গড়ে তুললেন তুমুল আন্দোলন। গঠন করলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। যখন মনে হচ্ছিল দেশের মানুষ বুঝি মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলে যেতে বসেছে। তখন তার নেতৃত্বে গড়ে উঠল এ সংগঠন।

ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) তার নেতৃত্বে বসলো গণআদালত। গণআদালতে বিচার হলো যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ যুদ্ধাপরাধীদের।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির শাখা গঠনের জন্য ঘুরে বেড়ালেন দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।

ইতোমধ্যে তার দেহে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত শরীর নিয়েই তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেন। হয়ে উঠলেন নব পর্যায়ের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কা-ারি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে নেতৃত্ব দিলেন তিনি।

সেই সঙ্গে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে জোরালো ও ছড়িয়ে দিলেন সারা দেশে। দেশ যেন নতুন করে আবার জেগে উঠলো। আর সেই জাগরণে নেতৃত্ব দিলেন জাহানারা ইমাম। বয়স ও শোকের ভারে জীর্ণ অশক্ত দেহের কিন্তু দৃঢ় মনোবলের এক সাহসী মানুষ। দেশের জন্য, জাতির জন্য বিরাট এক দায়িত্ব পালন করে গেলেন তিনি। কখনও কোন রাজনৈতিক দল করেননি। ছিলেন শিক্ষিকা, লেখিকা। এবারে তিনি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে গঠিত এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিলেন। দিনরাত কাজ করে গেলেও অক্লান্ত। শক্তি তার মনোবল, দেশপ্রেম ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। একাত্তরের ঘাতক দালালদের তথা মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই হবে এদেশের মাটিতে। সেই আন্দোলনের পথ ধরেই অবশেষে দেশে ঘাতক দালালদের বিচারকাজ শুরু হয়েছে।

এই আন্দোলন করার সময় বায়তুল মোকাররমের সামনে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পুলিশের লাঠির আঘাত পড়েছে এই সাহসী মানুষটির ওপর। তখন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতাসীন।

খালেদা জিয়ার সরকার জাহানারা ইমামদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। মামলা করেছিল তার বিরুদ্ধে। মৃত্যুর পূর্বে সেই মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। দেশদ্রোহী খেতাব নিয়েই মৃত্যু হয় এ দেশপ্রেমী মানুষটির।

বায়তুল মোকাররমে পুলিশি নির্যাতনে আক্রান্ত হওয়ার পর জাহানারা ইমামকে দেখতে গিয়েছিলাম এলিফ্যান্ট রোডের ক্ষণিকা বাড়িটিতে। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে যেতাম তার কাছে। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি রয়েছে অনেক ¯েœহ পেয়েছি, উপদেশ পেয়েছি তার কাছে।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনের সময়ে তিনি নিজে আমাকে যুক্ত করেছিলেন এই কাজে। তার সঙ্গে সঙ্গী হয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে একাত্তরের দিনগুলো নিয়ে আলোচনা সভায় গিয়েছি। তার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো মূল্যবান স্মৃতি হয়ে রয়েছে হৃদয়ের মণিকোঠায়। তিনি যখন মহিলা পরিষদের সহ-সভানেত্রী তখনও তার সঙ্গে একই কমিটিতে কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

রূপান্তর (অধুনা বিলুপ্ত) পত্রিকার জন্য তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। তার বাড়িতে বসেই লেখিকা ও দার্শনিক গৌরী আয়ুবের সাক্ষাৎকার নিয়েছি তারই উৎসাহে। এ মহান মানুষটির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম এ আমার পরম সৌভাগ্য।

সারা দেশে যখন সংগঠনের কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এমনই এক সময়ে ক্যান্সার আবার বেড়ে গেলে তাকে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ছোট ছেলের কাছে চলে যেতে হয়। সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তার মৃত্যু হয়। শেষের দিকে তিনি আর কথা বলতে পারতেন না। লিখে লিখে নিজেকে প্রকাশ করতে হতো।

মৃত্যুর আগে লেখা দেশবাসীর উদ্দেশে শেষ চিঠিতে তিনি তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব দেশবাসীর কাছে অর্পণ করে গেছেন।

তার গড়ে তোলা সেই আন্দোলনের পথ ধরেই দেশে জোরালো দাবি উঠেছে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের।

অবশেষে দেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকজনের বিচারকাজ শেষ হয়েছে। ফাঁসির সাজাসহ দ- ঘোষণা হয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। সেসব সাজা কার্যকরও হয়েছে। এ বিচারকাজ তিনি দেখে যেতে পারেননি তবু এটাই তার আন্দোলনের সার্থকতা।

তার দেয়া সে দায়িত্বের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশ যেন বেপথু হতে না পারে। শহীদদের স্বপ্ন সাধ পূরণের লক্ষ্য অর্জনের পথ থেকে আমরা যেন কখনও সরে না যাই। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুদিন উপলক্ষে এ কথাটাই সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। জননী সাহসিকা জাহানারা ইমামকে জানাই গভীর শ্রদ্ধ।