প্রতিদিনই বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা

সাহাদাৎ রানা

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। পুরো পৃথিবীর অনেক সত্যের মধ্যে অন্যতম বড় সত্য এটি। এই ধ্রুব সত্য সব রাষ্ট্রের পাঠ্যসূচিতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। আর তা রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই এজন্য শিশুদের দেখা হয় আলাদা দৃষ্টিতে। তাদের ভাবা হয় রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে। বিশেষ করে শিশুর গড়ে ওঠার দিকে সর্তক দৃষ্টি রাখাও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবেই পালন করে থাকে অনেক রাষ্ট্র। কিন্তু দেশে এ বিষয় কতটা মানা হয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ দিনকে দিন আমাদের দেশে শিশুরা তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। বাড়ছে শিশুদের নির্যাতনের চিত্রও।

১১ জুন ছিল বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশে এবারও গুরুত্বের সঙ্গে দিনটি পালিত হয়েছে। তবে তা কাগজপত্র আর সভা সেমিনারে। কারণ এমন দিবস প্রতিবছর পালন করার ফলে যে পরিমাণ উপকৃত হওয়ার কথা তা দৃশ্যত অনুপস্থিত। কারণ দিন দিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আমাদের দেশে বাড়ছেই। যেখানে এমন দিবসগুলো প্রতিনিয়ত পালন করার কারণে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমার কথা। কিন্তু হচ্ছে এর উল্টো। কারণ বছরের এই একটি দিনকে টার্গেট করে আলোচনায় আমরা সবাই মেতে উঠি। বিভিন্ন উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেই। কিন্তু এরপর সব ভুলে যাই। তাই কাজের কাজ কিছুই হয় না বাস্তব কার্যক্ষেত্রে।

এবার মূল প্রসঙ্গে আলোচনা করার পূর্বে জেনে নেয়া প্রয়োজন আইনের ভাষায় আমাদের দেশে কারা শিশু। আর শিশুশ্রম বিষয়টি কী? সাধারণত পৃথিবীজুড়ে আঠারো বছরের কমবয়সী সবাইকে শিশুর সংজ্ঞায় ফেলা হয়। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটেও কাগজপত্রে বিষয়টি মানা হয়। মূলত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। শৈশবকাল বলা হয়েছে ১ থেকে ৫ বছরকে। যাদের বয়স ৬ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত তাদের বিবেচনা করা হয় বাল্যকাল হিসেবে। আর ১১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় কৈশোরকাল। অবাক করা তথ্য হলোÑ এই তিন শ্রেণী বিবেচনা করলে আমাদের দেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু। তাই সহজ কথায় বলা যায় আমাদের দেশের অর্ধেক সম্পদ এই শিশুরা। কিন্তু এই শিশুদের আমরা নানা কারণে সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারছি না। বরং শিশুরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা কারণে তাদের বঞ্চিতও করছি আমরাই। তাই এর দায় এককভাবে কারও ওপর নয়। দায় আমাদের সবার।

ভয়ের তথ্য হলো দিন দিন আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। কিন্তু তা প্রতিরোধে নেই তেমন কোন উদ্যোগ। অথচ আমাদের দেশে আইনে স্পষ্টভাবে লিখিত আছেÑ শিশু শ্রম একটি মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু আইনে থাকলেও প্রতিনিয়ত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এটাই শঙ্কার কারণ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সরকারি পর্যায়ের ছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে এমন কোনো কর্মক্ষেত্র নেই যেখানে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। শিশুদের শ্রমের মূল্য তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায় তাদের প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিকদের পদচারণা বাড়ছেই। অবাক করা বিষয় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এতটাই বেশি যে, তা কল্পানাতীত।

অথচ আমাদের দেশে জাতীয় শ্রম আইন ২০১৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কোন প্রকার কাজে লাগানো যাবে না এবং ১৪ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সী শিশুদের কিছু নির্দিষ্ট কাছে ব্যবহার করা যাবে বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে তা হতে হবে নিয়ম মেনে। সর্বোচ্চ দৈনিক ৫ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ করা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর কোনটাই শিশু শ্রমিকের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। বরং তাদের দিয়ে বাড়তি কাজ করিয়ে লাভবান হচ্ছে মালিকপক্ষ।

শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার মূল কারণ হলো দেশের প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মালিকপক্ষ। বলা যায়, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবের পাশাপাশি নিজ স্বার্থের কারণে আইনকে তোয়াক্কা করেন না মালিক শ্রেণী। এছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির পেছনে। অন্যতম কারণ আমাদের দেশের দারিদ্র্যতা। আমাদের দেশে প্রায় মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ ভাগের বেশি লোক দরিদ্র। যাদের অধিকাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয় দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য। তাই দরিদ্র এসব লোকেরা সংসার চালানোর জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজের শিশু সন্তানকে পাঠান কর্মক্ষেত্রে। বাবা-মার সঙ্গে অপরিপক্ব শিশুরা হয়ে উঠেন উপার্জনের আরেকটি উৎস। এতে ঐসব পরিবার তাদের প্রয়োজনে সাময়িক লাভবান হলেও ভবিষ্যতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবারের। বৃহত্তর বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রের। কারণ এসব শিশুরা নিজ পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ছেড়ে দিতে হচ্ছে স্কুল। বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে। আর রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে পুরোপুরি শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে। আর এদের থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মেধাবীরাও।

আমাদের দেশে শিশু শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তির খবর হলো যেসব শিশু কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার উপযোগী নয়, সেই শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দেশে সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোতেই শিশুদের যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ইটভাটা, ইলেকট্রিকের কাজ, গাড়ির ড্রাইভার, নির্মাণ খাত, গাড়ির হেলপার, গ্যারেজ, শিল্প-কারখানা, বাসা-বাড়িসহ অসংখ্য কাজে শিশুরা শ্রমিক হিসেবে যুক্ত। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখের বেশি শিশু শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১০ লাখের বেশি শিশু। এসব শিশুরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নানারকম বৈষম্যের শিকারও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা। বিশেষ করে যেসব শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করে তারা সারা দিনই কাজের মধ্যে থাকেন। আর শিল্প-কারখানায়ও নেই নির্দিষ্ট সময়। মালিকের ইচ্ছায় তাদের কাজ করতে হয়। বলা যায়, মালিকের ইচ্ছায় বাধ্য হন তারা। এছাড়া রয়েছে কাজের একটু ব্যতিক্রম হলে চরম নির্যাতনের শিকার হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ। মাঝে মধ্যে শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আরও দুঃখের বিষয়Ñ অনেক কষ্ট করে এসব শিশু তাদের কর্মক্ষেত্রে রাত-দিন পরিশ্রম করলেও পায় না ন্যায্য মজুরি। তাদের কাজের বিনিময়ে যা দেয়া হয় তা নেহায়েত একেবারে অল্প। আমাদের দেশে শিশুদের দিয়ে কিছু অসাধু মানুষ আরও একটি বিপজ্জনক কাজ করান। কোমলমতি শিশুদের দিয়ে মাদক পাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কিন্তু যারা এর সঙ্গে যুক্ত তারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এখন প্রশ্ন হলোÑ এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? উত্তরণের পথ অবশ্যই রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এছাড়া দায়িত্ব রয়েছে পরিবার ও সমাজের সচেতন মানুষের। বিশেষ করে রাষ্ট্র ও যারা বিত্তশালী তারা যদি দরিদ্র শিশুদের বিশেষ তহবিলের আওতায় আনে, তবে অনেকাংশে কমানো যেতে পারে শিশুশ্রম। তাহলে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস সত্যিকার অর্থে তার বাস্তবিক অর্থ ফিরে পাবে আমাদের জীবন ব্যবস্থায়।

[লেখক : সাংবাদিক]

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০১৯ , ১৩ আষাঢ় ১৪২৫, ২৩ শাওয়াল ১৪৪০

প্রসঙ্গ শিশুশ্রম

প্রতিদিনই বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা

সাহাদাৎ রানা

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। পুরো পৃথিবীর অনেক সত্যের মধ্যে অন্যতম বড় সত্য এটি। এই ধ্রুব সত্য সব রাষ্ট্রের পাঠ্যসূচিতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। আর তা রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই এজন্য শিশুদের দেখা হয় আলাদা দৃষ্টিতে। তাদের ভাবা হয় রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে। বিশেষ করে শিশুর গড়ে ওঠার দিকে সর্তক দৃষ্টি রাখাও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবেই পালন করে থাকে অনেক রাষ্ট্র। কিন্তু দেশে এ বিষয় কতটা মানা হয় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ দিনকে দিন আমাদের দেশে শিশুরা তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। বাড়ছে শিশুদের নির্যাতনের চিত্রও।

১১ জুন ছিল বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশে এবারও গুরুত্বের সঙ্গে দিনটি পালিত হয়েছে। তবে তা কাগজপত্র আর সভা সেমিনারে। কারণ এমন দিবস প্রতিবছর পালন করার ফলে যে পরিমাণ উপকৃত হওয়ার কথা তা দৃশ্যত অনুপস্থিত। কারণ দিন দিন শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আমাদের দেশে বাড়ছেই। যেখানে এমন দিবসগুলো প্রতিনিয়ত পালন করার কারণে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমার কথা। কিন্তু হচ্ছে এর উল্টো। কারণ বছরের এই একটি দিনকে টার্গেট করে আলোচনায় আমরা সবাই মেতে উঠি। বিভিন্ন উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেই। কিন্তু এরপর সব ভুলে যাই। তাই কাজের কাজ কিছুই হয় না বাস্তব কার্যক্ষেত্রে।

এবার মূল প্রসঙ্গে আলোচনা করার পূর্বে জেনে নেয়া প্রয়োজন আইনের ভাষায় আমাদের দেশে কারা শিশু। আর শিশুশ্রম বিষয়টি কী? সাধারণত পৃথিবীজুড়ে আঠারো বছরের কমবয়সী সবাইকে শিশুর সংজ্ঞায় ফেলা হয়। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটেও কাগজপত্রে বিষয়টি মানা হয়। মূলত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিশুদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। শৈশবকাল বলা হয়েছে ১ থেকে ৫ বছরকে। যাদের বয়স ৬ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত তাদের বিবেচনা করা হয় বাল্যকাল হিসেবে। আর ১১ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় কৈশোরকাল। অবাক করা তথ্য হলোÑ এই তিন শ্রেণী বিবেচনা করলে আমাদের দেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু। তাই সহজ কথায় বলা যায় আমাদের দেশের অর্ধেক সম্পদ এই শিশুরা। কিন্তু এই শিশুদের আমরা নানা কারণে সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারছি না। বরং শিশুরা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নানা কারণে তাদের বঞ্চিতও করছি আমরাই। তাই এর দায় এককভাবে কারও ওপর নয়। দায় আমাদের সবার।

ভয়ের তথ্য হলো দিন দিন আমাদের দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা। কিন্তু তা প্রতিরোধে নেই তেমন কোন উদ্যোগ। অথচ আমাদের দেশে আইনে স্পষ্টভাবে লিখিত আছেÑ শিশু শ্রম একটি মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু আইনে থাকলেও প্রতিনিয়ত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। এটাই শঙ্কার কারণ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সরকারি পর্যায়ের ছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে এমন কোনো কর্মক্ষেত্র নেই যেখানে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। শিশুদের শ্রমের মূল্য তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায় তাদের প্রায় সব কর্মক্ষেত্রেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এ সহজলভ্যতার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিকদের পদচারণা বাড়ছেই। অবাক করা বিষয় কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এতটাই বেশি যে, তা কল্পানাতীত।

অথচ আমাদের দেশে জাতীয় শ্রম আইন ২০১৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কমবয়সী শিশুদের কোন প্রকার কাজে লাগানো যাবে না এবং ১৪ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সী শিশুদের কিছু নির্দিষ্ট কাছে ব্যবহার করা যাবে বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে তা হতে হবে নিয়ম মেনে। সর্বোচ্চ দৈনিক ৫ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ করা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে। কিন্তু এর কোনটাই শিশু শ্রমিকের ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। বরং তাদের দিয়ে বাড়তি কাজ করিয়ে লাভবান হচ্ছে মালিকপক্ষ।

শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করার মূল কারণ হলো দেশের প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছে মালিকপক্ষ। বলা যায়, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবের পাশাপাশি নিজ স্বার্থের কারণে আইনকে তোয়াক্কা করেন না মালিক শ্রেণী। এছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে শিশু শ্রমিক বৃদ্ধির পেছনে। অন্যতম কারণ আমাদের দেশের দারিদ্র্যতা। আমাদের দেশে প্রায় মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ ভাগের বেশি লোক দরিদ্র। যাদের অধিকাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয় দিয়ে সংসার চালানো কষ্টসাধ্য। তাই দরিদ্র এসব লোকেরা সংসার চালানোর জন্য অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজের শিশু সন্তানকে পাঠান কর্মক্ষেত্রে। বাবা-মার সঙ্গে অপরিপক্ব শিশুরা হয়ে উঠেন উপার্জনের আরেকটি উৎস। এতে ঐসব পরিবার তাদের প্রয়োজনে সাময়িক লাভবান হলেও ভবিষ্যতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবারের। বৃহত্তর বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রের। কারণ এসব শিশুরা নিজ পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ছেড়ে দিতে হচ্ছে স্কুল। বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার আলো থেকে। আর রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে পুরোপুরি শিক্ষিত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে। আর এদের থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মেধাবীরাও।

আমাদের দেশে শিশু শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তির খবর হলো যেসব শিশু কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার উপযোগী নয়, সেই শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দেশে সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোতেই শিশুদের যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ইটভাটা, ইলেকট্রিকের কাজ, গাড়ির ড্রাইভার, নির্মাণ খাত, গাড়ির হেলপার, গ্যারেজ, শিল্প-কারখানা, বাসা-বাড়িসহ অসংখ্য কাজে শিশুরা শ্রমিক হিসেবে যুক্ত। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখের বেশি শিশু শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ১০ লাখের বেশি শিশু। এসব শিশুরা তাদের কর্মক্ষেত্রে নানারকম বৈষম্যের শিকারও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাদের জন্য নেই কোনো নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা। বিশেষ করে যেসব শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করে তারা সারা দিনই কাজের মধ্যে থাকেন। আর শিল্প-কারখানায়ও নেই নির্দিষ্ট সময়। মালিকের ইচ্ছায় তাদের কাজ করতে হয়। বলা যায়, মালিকের ইচ্ছায় বাধ্য হন তারা। এছাড়া রয়েছে কাজের একটু ব্যতিক্রম হলে চরম নির্যাতনের শিকার হওয়ার অসংখ্য উদাহরণ। মাঝে মধ্যে শিশু শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। আরও দুঃখের বিষয়Ñ অনেক কষ্ট করে এসব শিশু তাদের কর্মক্ষেত্রে রাত-দিন পরিশ্রম করলেও পায় না ন্যায্য মজুরি। তাদের কাজের বিনিময়ে যা দেয়া হয় তা নেহায়েত একেবারে অল্প। আমাদের দেশে শিশুদের দিয়ে কিছু অসাধু মানুষ আরও একটি বিপজ্জনক কাজ করান। কোমলমতি শিশুদের দিয়ে মাদক পাচার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কিন্তু যারা এর সঙ্গে যুক্ত তারা থেকে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এখন প্রশ্ন হলোÑ এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? উত্তরণের পথ অবশ্যই রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এছাড়া দায়িত্ব রয়েছে পরিবার ও সমাজের সচেতন মানুষের। বিশেষ করে রাষ্ট্র ও যারা বিত্তশালী তারা যদি দরিদ্র শিশুদের বিশেষ তহবিলের আওতায় আনে, তবে অনেকাংশে কমানো যেতে পারে শিশুশ্রম। তাহলে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস সত্যিকার অর্থে তার বাস্তবিক অর্থ ফিরে পাবে আমাদের জীবন ব্যবস্থায়।

[লেখক : সাংবাদিক]