শিশুর ডায়রিয়া : আমাদের করণীয়

সেলিনা আক্তার

ডায়রিয়া ভাইরাসজনিত রোগ। যে কোনো সময় মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। সব বয়সের মানুষের ডায়রিয়া হতে পারে, তবে শিশুরা খুব অল্পতেই এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়। প্রচ- গরম, মাঝে মধ্যে বৃষ্টি, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় নবজাতকসহ সব শিশুরই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে। গরম থেকে আস্তে আস্তে শীত পড়তে থাকলেও শিশুরা ডায়রিয়ার আক্রান্ত হয়। আবার শীতের প্রকোপ বেশি বাড়লেও শিশুদের ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। প্রতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু ডায়রিয়া ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত অপুষ্টিজনিত রোগে মারা যায়।

ডায়রিয়া হয়েছিল ভেবে এক বছরের শিশু অপর্ণাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। দু’দিন চিকিৎসা দেয়ার পর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখে চিকিৎসকরা তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর সে আবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যায়। রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে, জানিয়েছে ডিউটি ডাক্তার। কেবল অপর্ণা নয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর এমন বহু শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।

অহনা খেলার সাথীদের সঙ্গে সারক্ষণ মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। দু’দিনেই সর্দি-কাশি। হঠাৎ করে পাতলা পায়খানা ও বমি। সবার ধারণা ঠা-া লাগার কারণেই এমন হয়েছে। চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু অহনার অবস্থা বেশি খারাপ হতে লাগল। ঘন-ঘন পাতলা পায়খানা ও বমির কারণে শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। চিন্তায় পড়ে গেলেন অহনার মা-বাবা। দ্রুত স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়াতে অল্পের জন্য রক্ষা পায় অহনার জীবন। ঠা-া লাগার কারণে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ডায়রিয়া হতে পারে এমন ধারণা ছিল না অহনার মা-বাবার। তাই গরমের সময় শিশুকে ডায়রিয়া থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন বাড়তি যতেœর। গরমে শিশুদের সর্দি-কাশি হবে, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সর্দি-কাশির কারণে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ডায়রিয়ায় শিশুর মৃত্যু হতে পারে, তা অনেকেরই অজানা। গরম, শীত বা বছরের যে-কোনো সময় অনেক কারণেই শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। তবে বছরের গরম ও শীতের সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি থাকে। গ্রীষ্মকালে ঘরে ঘরে শিশুরা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয় এবং শিশুদের সর্দি-কাশি নিয়ে আর কোনো অবহেলা করার সুযোগ নেই।

রোটা ভাইরাস হলো বিশ্বব্যাপী শিশু ও নবজাতকের মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অত্যন্ত সাধারণ একটি কারণ। রোটা ভাইরাস অর্গানাইজেশন অব টেকনিক্যাল অ্যালাইজ (আরওটিএ) পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৪ লাখ শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এসব শিশুর অধিকাংশের বয়স তিন মাস থেকে দু’বছরের মধ্যে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ডায়রিয়াজনিত রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে রোটা ভাইরাস। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারলে তাদের মৃত্যু হতে পারে। গবেষকরা বলেছেন, ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যুহার ২০ শতাংশের বেশি কমলেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কমছে ধীরগতিতে। শিশুদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার কমেছে ৪৪ শতাংশ।

প্রতি বছর যেসব রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে তার প্রায় ৮০ ভাগই শিশু। এদের বয়স ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে। ৫ বছর বয়সের আগেই প্রতি বছর ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয় ডায়রিয়ার কারণে। খাবার স্যালাইনের সুবাদে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু তেমন না হলেও, কিন্তু সময়মতো এর চিকিৎসা করা না হলে ডায়রিয়া শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হতে পারে। অসাবধানতা ও অবহেলার কারণে প্রতিবছর অনেক শিশুর মৃত্যু হয় ডায়রিয়ায়। যদিও গবেষকরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যু কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমান সময়ে ডায়রিয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশ কমছে (বিবিসি)। ল্যানসেটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রাপ্তির কারণে এ হার কমেছে। তবে এখনও দুর্বল ও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতির উন্নয়নে নতুন প্রতিষেধকের অবদান রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এরপরও বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যুর জন্য ডায়রিয়া চতুর্থ বড়ো কারণ। শিশু যাতে গরমের দিনে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত না হয়, সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে শিশুর ডায়রিয়া হলে প্রাথমিক চিকিৎসা পরিবার থেকেই দিতে হবে। ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা দিলেই শিশুকে খাবার স্যালাইন ঘন ঘন খাওয়াতে হবে। স্যালাইন ঘরে না থাকলে হাতে তৈরি স্যালাইন প্রাথমিকভাবে শিশুকে দিতে হবে। এক চিমটি লবণ, ২০ গ্রাম বা এক মুঠো চিনি বা গুড়, এক লিটার পানিতে গুলিয়ে ভালোমানের খাবার স্যালাইন তৈরি করা যায়। এভাবে প্রাথমিকভাবে শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

রোটা ভাইরাস হচ্ছে নবজাতক ও শিশুদের ডায়রিয়াজনিত রোগ ও পানিশূন্যতার প্রধান কারণ। আক্রান্ত হওয়ার ২-৩ দিন পর সাধারণত এ রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর মারাত্মক ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, জ্বর ও পেট ব্যথা হয়। রোটা ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা না থাকলেও পানিশূন্যতা রোধে বারবার পানি খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। খাবার ও পানির মাধ্যমে এর জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। রোটা ভাইরাস নিয়ে সর্বশেষ গবেষণায় আরো দেখা যায়, ডায়রিয়াজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং ৬ থেকে ১১ মাস বয়সি শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশ রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিয়োলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে রোটা ভাইরাসের হুমকি রয়েছে এখনো অনেক বেশি। কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সাল থেকে সরকারি কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী সাতটি বিশেষায়িত হাসপাতালে মূলত এ রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দেয়া হয়। এসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৫১ শিশুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ১২৪ শিশু (৮২ শতাংশ) রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের অধিকাংশের বয়স ৬ থেকে ১৭ মাস।

ডায়রিয়া সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এরফলে সৃষ্ট সবচেয়ে বড়ো জটিলতা হলো পানিশূন্যতা। বারবার পায়খানা হয় বলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি এতে শিশু মারাও যেতে পারে। সাধারণত দূষিত খাবার, দূষিত পানি, রোগজীবাণু, কৃমির মাধ্যমে ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ায়। অপরিষ্কার হাত, গ্লাস, চামচ, বাসনপত্র বা সচরাচর ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র, মল, মাছি ইত্যাদির দ্বারা এ জীবাণুর বাহক।

ডায়রিয়া সাধারণত ৩ ধরনের হয়ে থাকে। তীব্র ডায়রিয়া, দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি। কতগুলো রোগজীবাণু খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে ডায়রিয়া ঘটায়। এগুলো রোটাভাইরাস, ই-কোলাই, সিগেলা, ভিবরিও কলেরা, প্যারাসাইট-এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা ও জিয়ারডিয়া প্রভৃতি।

পায়খানায় স্বাভাবিকের চেয়ে পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে বারবার পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বলে। এতে পানিশূন্যতা হওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে শিশুকে বারবার ডাবের পানি, চিরার পানি, ভাতের মাড়, টকদই ও লবণ-গুড়ের শরবত বেশি করে খেতে দিতে হয়। তরল খাবারের পাশাপাশি খাওয়ার স্যালাইন দিতে হবে। যেসব শিশু বুকের দুধ খায়, তাদের বারবার বুকের দুধ দিতে হবে। শিশু যদি বমি করে তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়া ভালো হয়ে গেলেও পরবর্তী ১ সপ্তাহ শিশুকে নিয়ম করে বাড়তি খাবার প্রতিদিন দিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো ওষুধ শিশুকে খাওয়ানো যাবে না। তাজা ফলের রস দিলে পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে।

ছোটো শিশুদের পায়খানা বড়োদের মতোই রোগ ছড়াতে পারে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি করতে হবে এবং বাড়ির ছোটো-বড়ো সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মলত্যাগে অভ্যস্ত করতে হবে। ডায়রিয়া এড়াতে পরিবারের সবাইকে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে খাওয়ার আগে। শিশুকে খাওয়ার আগে, পায়খানা করার পর অবশ্যই হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে। শিশুর পায়খানা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধোয়াতে হবে এবং পরবর্তীতে নিজে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্থ এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা তাই আবশ্যিক। শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে তাই সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

(পিআইডি শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

বৃহস্পতিবার, ২৭ জুন ২০১৯ , ১৩ আষাঢ় ১৪২৫, ২৩ শাওয়াল ১৪৪০

শিশুর ডায়রিয়া : আমাদের করণীয়

সেলিনা আক্তার

ডায়রিয়া ভাইরাসজনিত রোগ। যে কোনো সময় মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। সব বয়সের মানুষের ডায়রিয়া হতে পারে, তবে শিশুরা খুব অল্পতেই এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়। প্রচ- গরম, মাঝে মধ্যে বৃষ্টি, স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় নবজাতকসহ সব শিশুরই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে। গরম থেকে আস্তে আস্তে শীত পড়তে থাকলেও শিশুরা ডায়রিয়ার আক্রান্ত হয়। আবার শীতের প্রকোপ বেশি বাড়লেও শিশুদের ডায়রিয়ায় আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। প্রতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু ডায়রিয়া ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত অপুষ্টিজনিত রোগে মারা যায়।

ডায়রিয়া হয়েছিল ভেবে এক বছরের শিশু অপর্ণাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। দু’দিন চিকিৎসা দেয়ার পর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখে চিকিৎসকরা তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর সে আবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং হাসপাতালে নেয়ার আগেই মারা যায়। রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে, জানিয়েছে ডিউটি ডাক্তার। কেবল অপর্ণা নয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর এমন বহু শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।

অহনা খেলার সাথীদের সঙ্গে সারক্ষণ মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। দু’দিনেই সর্দি-কাশি। হঠাৎ করে পাতলা পায়খানা ও বমি। সবার ধারণা ঠা-া লাগার কারণেই এমন হয়েছে। চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু অহনার অবস্থা বেশি খারাপ হতে লাগল। ঘন-ঘন পাতলা পায়খানা ও বমির কারণে শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। চিন্তায় পড়ে গেলেন অহনার মা-বাবা। দ্রুত স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেয়াতে অল্পের জন্য রক্ষা পায় অহনার জীবন। ঠা-া লাগার কারণে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ডায়রিয়া হতে পারে এমন ধারণা ছিল না অহনার মা-বাবার। তাই গরমের সময় শিশুকে ডায়রিয়া থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজন বাড়তি যতেœর। গরমে শিশুদের সর্দি-কাশি হবে, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সর্দি-কাশির কারণে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ডায়রিয়ায় শিশুর মৃত্যু হতে পারে, তা অনেকেরই অজানা। গরম, শীত বা বছরের যে-কোনো সময় অনেক কারণেই শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। তবে বছরের গরম ও শীতের সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি থাকে। গ্রীষ্মকালে ঘরে ঘরে শিশুরা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয় এবং শিশুদের সর্দি-কাশি নিয়ে আর কোনো অবহেলা করার সুযোগ নেই।

রোটা ভাইরাস হলো বিশ্বব্যাপী শিশু ও নবজাতকের মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অত্যন্ত সাধারণ একটি কারণ। রোটা ভাইরাস অর্গানাইজেশন অব টেকনিক্যাল অ্যালাইজ (আরওটিএ) পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৪ লাখ শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এসব শিশুর অধিকাংশের বয়স তিন মাস থেকে দু’বছরের মধ্যে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ডায়রিয়াজনিত রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে রোটা ভাইরাস। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারলে তাদের মৃত্যু হতে পারে। গবেষকরা বলেছেন, ডায়রিয়ার কারণে মৃত্যুহার ২০ শতাংশের বেশি কমলেও এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার কমছে ধীরগতিতে। শিশুদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার কমেছে ৪৪ শতাংশ।

প্রতি বছর যেসব রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে তার প্রায় ৮০ ভাগই শিশু। এদের বয়স ২ থেকে ৫ বছরের মধ্যে। ৫ বছর বয়সের আগেই প্রতি বছর ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয় ডায়রিয়ার কারণে। খাবার স্যালাইনের সুবাদে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু তেমন না হলেও, কিন্তু সময়মতো এর চিকিৎসা করা না হলে ডায়রিয়া শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ হতে পারে। অসাবধানতা ও অবহেলার কারণে প্রতিবছর অনেক শিশুর মৃত্যু হয় ডায়রিয়ায়। যদিও গবেষকরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যু কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। বর্তমান সময়ে ডায়রিয়ার কারণে বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুহার এক-তৃতীয়াংশ কমছে (বিবিসি)। ল্যানসেটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিশুদ্ধ খাবার পানি প্রাপ্তির কারণে এ হার কমেছে। তবে এখনও দুর্বল ও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতির উন্নয়নে নতুন প্রতিষেধকের অবদান রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এরপরও বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যুর জন্য ডায়রিয়া চতুর্থ বড়ো কারণ। শিশু যাতে গরমের দিনে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত না হয়, সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে শিশুর ডায়রিয়া হলে প্রাথমিক চিকিৎসা পরিবার থেকেই দিতে হবে। ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা দিলেই শিশুকে খাবার স্যালাইন ঘন ঘন খাওয়াতে হবে। স্যালাইন ঘরে না থাকলে হাতে তৈরি স্যালাইন প্রাথমিকভাবে শিশুকে দিতে হবে। এক চিমটি লবণ, ২০ গ্রাম বা এক মুঠো চিনি বা গুড়, এক লিটার পানিতে গুলিয়ে ভালোমানের খাবার স্যালাইন তৈরি করা যায়। এভাবে প্রাথমিকভাবে শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

রোটা ভাইরাস হচ্ছে নবজাতক ও শিশুদের ডায়রিয়াজনিত রোগ ও পানিশূন্যতার প্রধান কারণ। আক্রান্ত হওয়ার ২-৩ দিন পর সাধারণত এ রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর মারাত্মক ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, জ্বর ও পেট ব্যথা হয়। রোটা ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা না থাকলেও পানিশূন্যতা রোধে বারবার পানি খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়। খাবার ও পানির মাধ্যমে এর জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। রোটা ভাইরাস নিয়ে সর্বশেষ গবেষণায় আরো দেখা যায়, ডায়রিয়াজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং ৬ থেকে ১১ মাস বয়সি শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশ রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিয়োলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে রোটা ভাইরাসের হুমকি রয়েছে এখনো অনেক বেশি। কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সাল থেকে সরকারি কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী সাতটি বিশেষায়িত হাসপাতালে মূলত এ রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দেয়া হয়। এসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৫১ শিশুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ১২৪ শিশু (৮২ শতাংশ) রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের অধিকাংশের বয়স ৬ থেকে ১৭ মাস।

ডায়রিয়া সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এরফলে সৃষ্ট সবচেয়ে বড়ো জটিলতা হলো পানিশূন্যতা। বারবার পায়খানা হয় বলে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি এতে শিশু মারাও যেতে পারে। সাধারণত দূষিত খাবার, দূষিত পানি, রোগজীবাণু, কৃমির মাধ্যমে ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ায়। অপরিষ্কার হাত, গ্লাস, চামচ, বাসনপত্র বা সচরাচর ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র, মল, মাছি ইত্যাদির দ্বারা এ জীবাণুর বাহক।

ডায়রিয়া সাধারণত ৩ ধরনের হয়ে থাকে। তীব্র ডায়রিয়া, দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, আমাশয় বা ডিসেন্ট্রি। কতগুলো রোগজীবাণু খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে ডায়রিয়া ঘটায়। এগুলো রোটাভাইরাস, ই-কোলাই, সিগেলা, ভিবরিও কলেরা, প্যারাসাইট-এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা ও জিয়ারডিয়া প্রভৃতি।

পায়খানায় স্বাভাবিকের চেয়ে পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে বারবার পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বলে। এতে পানিশূন্যতা হওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে শিশুকে বারবার ডাবের পানি, চিরার পানি, ভাতের মাড়, টকদই ও লবণ-গুড়ের শরবত বেশি করে খেতে দিতে হয়। তরল খাবারের পাশাপাশি খাওয়ার স্যালাইন দিতে হবে। যেসব শিশু বুকের দুধ খায়, তাদের বারবার বুকের দুধ দিতে হবে। শিশু যদি বমি করে তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার খাওয়াতে হবে। ডায়রিয়া ভালো হয়ে গেলেও পরবর্তী ১ সপ্তাহ শিশুকে নিয়ম করে বাড়তি খাবার প্রতিদিন দিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো ওষুধ শিশুকে খাওয়ানো যাবে না। তাজা ফলের রস দিলে পটাশিয়ামের ঘাটতি পূরণ করে।

ছোটো শিশুদের পায়খানা বড়োদের মতোই রোগ ছড়াতে পারে, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি করতে হবে এবং বাড়ির ছোটো-বড়ো সবাইকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মলত্যাগে অভ্যস্ত করতে হবে। ডায়রিয়া এড়াতে পরিবারের সবাইকে ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে খাওয়ার আগে। শিশুকে খাওয়ার আগে, পায়খানা করার পর অবশ্যই হাত সাবান দিয়ে ধুতে হবে। শিশুর পায়খানা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধোয়াতে হবে এবং পরবর্তীতে নিজে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুস্থ এবং স্বাস্থ্যসম্মত জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা তাই আবশ্যিক। শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে তাই সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

(পিআইডি শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)