সংসদে প্রধানমন্ত্রী

জনবান্ধব ও সুষম বাজেট উপকৃত হবেন প্রত্যেকে

  • কয়েকটি খাতে পরিবর্তনের সুপারিশ
  • অর্থ বিল পাস

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে জনবান্ধব, উন্নয়নমুখী ও সুষম বাজেট উল্লেখ করে বলেছেন, দেশের প্রত্যেক জনগণ এ বাজেট থেকে উপকৃত হবেন। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতিবিদদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজারের স্টক লভ্যাংশ ও রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত করারোপ, ভ্যাট, মূসকসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বাজেটে যে প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তা পরিবর্তনের সুপারিশ করেন তিনি। গতকাল একাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় (বাজেট) অধিবেশনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনার সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব সুপারিশ প্রস্তাব আনেন। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক চলছিল।

অর্থবিল পাস : বাজেট আলোচনা শেষে অর্থবিল ২০১৯ পাস হয়। এবার মোট ২৭০ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। বাজেট পাসের আগে রাজস্ব অংশের আলোচিত-সমালোচিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে প্রধানমন্ত্রী তা সংশোধন করতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। পরে অর্থমন্ত্রী তা সংশোধন করে নিলে অর্থবিল সংসদে পাস হয়। ‘সমৃদ্ধ আগামীর’ প্রত্যাশা সামনে রেখে আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ১৩ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৮ শতাংশ বেশি।

বাজেটে যেসব পরিবর্তনের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর : প্রধানমন্ত্রী সমাপনী বক্তব্যে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কোম্পানিগুলোকে ক্যাশ ডিভিডেন্ডে উৎসাহিত করার জন্য স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী সমাজের কেউ কেউ আপত্তি জানিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারে না। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এরূপ মন্তব্যের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ আমাদের ভাবতে হবে। কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীও নগদ লভ্যাংশ প্রত্যাশা করে। তাই নতুন প্রস্তাবে স্টক ডিভিডেন্ডের সঙ্গে সমান হারে নগদ লভ্যাংশও দেয়ার প্রস্তাব করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমি প্রস্তাব করছি যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি যে পরিমাণ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করবে, কমপক্ষে তার সমপরিমাণ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করতে হবে। যদি কোম্পানির ঘোষিত স্টক লভ্যাংশের পরিমাণ নগদ লভ্যাংশের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে স্টক লভ্যাংশে উপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রস্তাব করতে হবে। তিনি বলেন, নগদ লভ্যাংশ উৎসাহিত করায় আমরা আরও প্রস্তাব করেছিলাম যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি রিটেইন আর্নিং, রিজার্ভ থাকলে অতিরিক্ত রিটেইন আর্নিং, রিজার্ভের উপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। এ বিষয়েও ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা কেউ কেউ আপত্তি করেছেনÑ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই প্রেক্ষাপটে এই ধারাটির আংশিক সংশোধনপূর্বক আমি প্রস্তাব করছি যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি কোন অর্থবছরে কর পরবর্তী নিট লাভের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ রিটেইন আর্নিং, ফান্ড, রিজার্ভে স্থানান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে হবে। যদি কোন কোম্পানি এরূপ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে প্রতিবছরে রিটেইন আর্নিং, ফান্ড, রিজার্ভের মোট অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। তিনি বলেন, উপরোক্ত বিষয়গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত আয়কর আইনের প্রস্তাবিত ধারাগুলো আমরা বিবেচনা করব।

প্রধানমন্ত্রী ভ্যাটের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক মূসক হার প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৫ শতাংশের নিম্নহারের উপকরণ কর রেয়াত দেয়ার সুযোগ না থাকায় ব্যবসায়ীরা হ্রাসকৃত হারের পরিবর্তে উপকরণ কর গ্রহণ করে ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য দাবি করেছেন। হ্রাসকৃত হারের পাশাপাশি কেউ চাইলে যেন ১৫ শতাংশ কর দিয়ে রেয়াত পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে আইনে সেই বিধান আনার প্রস্তাব করছি।

প্রধানমন্ত্রী দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত সুতা শিল্পের উপর ৫ শতাংশ মূসকের পরিবর্তে প্রতি কেজি সুতায় ৪ টাকা হারে সুনির্দিষ্ট করের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, দেশীয় শিল্পের প্রতিরক্ষণ, প্রণোদনা প্রদানে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে শুল্কহার হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে এর ফলে দেশীয় কাগজ ও গ্যাস উৎপাদনকারী শিল্পসহ অন্য শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। দেশীয় মুদ্রণ শিল্পের প্রণোদনা প্রদান ও বন্ড ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধকল্পে দেশে উৎপন্ন হয় না এমন পেপারগুলোর শুল্কহার যৌক্তিক করা হবে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে শুল্কহার পুনর্নির্ধারণ করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এ বাজেট ভূমিকা রাখবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, এবারের বাজেট জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দেশে চলমান উন্নয়নের গতিধারাকে অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, আমাদের সরকার রূপকল্প-২০২১ সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষ্য পূরণ এবং আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার পূরণের এক কার্যকর মাধ্যম হবে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য পেশকৃত জনবান্ধব, উন্নয়নমুখী এই বাজেটটি। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ জাতির পিতার স্বপ্নের একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এটাই আমাদের প্রত্যয় এবং এই বাজেট এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটি উন্নত জীবন চায়, তাদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দু’বেলা বাজেট অধিবেশন চলেছে এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক সংসদ সদস্য এখানে উপস্থিত ছিলেন এবং সবথেকে অল্প সময়ের অধিবেশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক সংসদ সদস্যরা বক্তব্য রেখে একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। সেই সঙ্গে আমাদের বিরোধীদলের সংসদ সদস্যসহ অন্য সংসদ সদস্যদের আমি ধন্যবাদ জানাই। সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, আমি শুধু এইটুকুই বলব, ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আমরা এই প্রথম বাজেটটা পেশ করলাম। এ বাজেট আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের এই বাজেট আলোচনায় অনেক সংসদ সদস্য অনেক রকম আলোচনা করেছেন সেগুলো সব আমার কাছে ছিল। আমি মনে করি আমার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের সেই কথাগুলোর জবাব মোটামুটিভাবে তারা পেয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে বাজেটে ৮৭ হাজার ৬২০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা মোট বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম ঠিক করে মূল ধারায় আনা হয়েছে। এতে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে চাকরি পাবে। শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ২০২৩-২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করা, মাথা পিছু আয় ২ হাজার ৭৫০ ডলার, রপ্তানি ৭২ বিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৮ হাজার মেগাওয়াট ও অতি দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে। এবারের বাজেট এসব লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আরও সুদৃঢ় হয়েছে। তার প্রমাণ গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। মানুষ আস্থা রেখেছে বলেই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে।

অর্থবিলও উত্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সংসদে তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থবিল উত্থাপন করেছেন। গত ১৩ জুন অসুস্থ অর্থমন্ত্রী পুরোপুরি বাজেট বক্তৃতা পড়তে পারেননি। তখন প্রধানমন্ত্রী বাকি বক্তৃতা পড়ে দেন। দেশের ইতিহাসে যা ছিল নজিরবিহীন। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনও করেন শেখ হাসিনা। এরপর সংসদে বাজেটের উপর পুরো আলোচনায় অনুপস্থিত থাকলেও শনিবার অধিবেশনে যোগ দেন অর্থমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বাজেটের উপর তার সমাপনী ভাষণে অর্থমন্ত্রীর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, তারপরও তিনি অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। এরপর ড. স্পিকার শিরীন শারমিনের অনুমতি নিয়ে বসে বাজেট আলোচনায় কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। পরে স্পিকার জানান, অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন অর্থবিল সংসদে তোলার জন্য। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিলটি সংসদে উত্থাপন করার আহ্বান জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর পক্ষে সংসদে বিলটি উত্থাপন করেন।

বাজেট পাসের আগে বাজেটের রাজস্ব অংশের আলোচিত-সমালোচিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে প্রধানমন্ত্রী তা সংশোধন করতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। পরে অর্থমন্ত্রী তা সংশোধন করে নিলে অর্থ বিল সংসদে পাস হয়। বিলের ওপর জনমত যাচাই ও সংশোধনী নিয়ে বিরোধীদলের সদস্যদের বিভিন্ন কথার জবাবও দেন শেখ হাসিনা। তার আগে বাজেট আলোচনায় দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তব্যে দেশের উন্নয়নে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগানোর উপরও জোর দেন তিনি।

রবিবার, ৩০ জুন ২০১৯ , ১৬ আষাঢ় ১৪২৫, ২৬ শাওয়াল ১৪৪০

সংসদে প্রধানমন্ত্রী

জনবান্ধব ও সুষম বাজেট উপকৃত হবেন প্রত্যেকে

সংসদ বার্তা পরিবেশক

image

  • কয়েকটি খাতে পরিবর্তনের সুপারিশ
  • অর্থ বিল পাস

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে জনবান্ধব, উন্নয়নমুখী ও সুষম বাজেট উল্লেখ করে বলেছেন, দেশের প্রত্যেক জনগণ এ বাজেট থেকে উপকৃত হবেন। ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতিবিদদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাজারের স্টক লভ্যাংশ ও রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত করারোপ, ভ্যাট, মূসকসহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বাজেটে যে প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তা পরিবর্তনের সুপারিশ করেন তিনি। গতকাল একাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় (বাজেট) অধিবেশনে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনার সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব সুপারিশ প্রস্তাব আনেন। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক চলছিল।

অর্থবিল পাস : বাজেট আলোচনা শেষে অর্থবিল ২০১৯ পাস হয়। এবার মোট ২৭০ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। বাজেট পাসের আগে রাজস্ব অংশের আলোচিত-সমালোচিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে প্রধানমন্ত্রী তা সংশোধন করতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। পরে অর্থমন্ত্রী তা সংশোধন করে নিলে অর্থবিল সংসদে পাস হয়। ‘সমৃদ্ধ আগামীর’ প্রত্যাশা সামনে রেখে আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট ১৩ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০১৯-২০ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত এই ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৮ শতাংশ বেশি।

বাজেটে যেসব পরিবর্তনের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর : প্রধানমন্ত্রী সমাপনী বক্তব্যে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কোম্পানিগুলোকে ক্যাশ ডিভিডেন্ডে উৎসাহিত করার জন্য স্টক ডিভিডেন্ডের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ বিষয়ে ব্যবসায়ী সমাজের কেউ কেউ আপত্তি জানিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলো নগদ লভ্যাংশ দিতে পারে না। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের এরূপ মন্তব্যের পাশাপাশি পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ আমাদের ভাবতে হবে। কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীও নগদ লভ্যাংশ প্রত্যাশা করে। তাই নতুন প্রস্তাবে স্টক ডিভিডেন্ডের সঙ্গে সমান হারে নগদ লভ্যাংশও দেয়ার প্রস্তাব করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমি প্রস্তাব করছি যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি যে পরিমাণ স্টক লভ্যাংশ ঘোষণা করবে, কমপক্ষে তার সমপরিমাণ নগদ লভ্যাংশ প্রদান করতে হবে। যদি কোম্পানির ঘোষিত স্টক লভ্যাংশের পরিমাণ নগদ লভ্যাংশের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে স্টক লভ্যাংশে উপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রস্তাব করতে হবে। তিনি বলেন, নগদ লভ্যাংশ উৎসাহিত করায় আমরা আরও প্রস্তাব করেছিলাম যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি রিটেইন আর্নিং, রিজার্ভ থাকলে অতিরিক্ত রিটেইন আর্নিং, রিজার্ভের উপর অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। এ বিষয়েও ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা কেউ কেউ আপত্তি করেছেনÑ মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই প্রেক্ষাপটে এই ধারাটির আংশিক সংশোধনপূর্বক আমি প্রস্তাব করছি যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি কোন অর্থবছরে কর পরবর্তী নিট লাভের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ রিটেইন আর্নিং, ফান্ড, রিজার্ভে স্থানান্তর করতে পারবে। অর্থাৎ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে হবে। যদি কোন কোম্পানি এরূপ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে প্রতিবছরে রিটেইন আর্নিং, ফান্ড, রিজার্ভের মোট অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। তিনি বলেন, উপরোক্ত বিষয়গুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত আয়কর আইনের প্রস্তাবিত ধারাগুলো আমরা বিবেচনা করব।

প্রধানমন্ত্রী ভ্যাটের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক মূসক হার প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৫ শতাংশের নিম্নহারের উপকরণ কর রেয়াত দেয়ার সুযোগ না থাকায় ব্যবসায়ীরা হ্রাসকৃত হারের পরিবর্তে উপকরণ কর গ্রহণ করে ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য দাবি করেছেন। হ্রাসকৃত হারের পাশাপাশি কেউ চাইলে যেন ১৫ শতাংশ কর দিয়ে রেয়াত পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে আইনে সেই বিধান আনার প্রস্তাব করছি।

প্রধানমন্ত্রী দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে তাঁত শিল্পে ব্যবহৃত সুতা শিল্পের উপর ৫ শতাংশ মূসকের পরিবর্তে প্রতি কেজি সুতায় ৪ টাকা হারে সুনির্দিষ্ট করের প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, দেশীয় শিল্পের প্রতিরক্ষণ, প্রণোদনা প্রদানে প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে শুল্কহার হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে এর ফলে দেশীয় কাগজ ও গ্যাস উৎপাদনকারী শিল্পসহ অন্য শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। দেশীয় মুদ্রণ শিল্পের প্রণোদনা প্রদান ও বন্ড ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধকল্পে দেশে উৎপন্ন হয় না এমন পেপারগুলোর শুল্কহার যৌক্তিক করা হবে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে শুল্কহার পুনর্নির্ধারণ করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এ বাজেট ভূমিকা রাখবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত বাজেট আলোচনার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, এবারের বাজেট জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দেশে চলমান উন্নয়নের গতিধারাকে অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, আমাদের সরকার রূপকল্প-২০২১ সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছে। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষ্য পূরণ এবং আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার পূরণের এক কার্যকর মাধ্যম হবে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য পেশকৃত জনবান্ধব, উন্নয়নমুখী এই বাজেটটি। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশ জাতির পিতার স্বপ্নের একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এটাই আমাদের প্রত্যয় এবং এই বাজেট এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ একটি উন্নত জীবন চায়, তাদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় সংসদ সদস্যদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দু’বেলা বাজেট অধিবেশন চলেছে এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক সংসদ সদস্য এখানে উপস্থিত ছিলেন এবং সবথেকে অল্প সময়ের অধিবেশনে সর্বোচ্চ সংখ্যক সংসদ সদস্যরা বক্তব্য রেখে একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। সেই সঙ্গে আমাদের বিরোধীদলের সংসদ সদস্যসহ অন্য সংসদ সদস্যদের আমি ধন্যবাদ জানাই। সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, আমি শুধু এইটুকুই বলব, ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আমরা এই প্রথম বাজেটটা পেশ করলাম। এ বাজেট আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের এই বাজেট আলোচনায় অনেক সংসদ সদস্য অনেক রকম আলোচনা করেছেন সেগুলো সব আমার কাছে ছিল। আমি মনে করি আমার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাদের সেই কথাগুলোর জবাব মোটামুটিভাবে তারা পেয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীনে বাজেটে ৮৭ হাজার ৬২০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা মোট বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসার কারিকুলাম ঠিক করে মূল ধারায় আনা হয়েছে। এতে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে চাকরি পাবে। শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ২০২৩-২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত করা, মাথা পিছু আয় ২ হাজার ৭৫০ ডলার, রপ্তানি ৭২ বিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৮ হাজার মেগাওয়াট ও অতি দারিদ্র্যের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যস্থির করা হয়েছে। এবারের বাজেট এসব লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আরও সুদৃঢ় হয়েছে। তার প্রমাণ গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। মানুষ আস্থা রেখেছে বলেই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে।

অর্থবিলও উত্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী : ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সংসদে তার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থবিল উত্থাপন করেছেন। গত ১৩ জুন অসুস্থ অর্থমন্ত্রী পুরোপুরি বাজেট বক্তৃতা পড়তে পারেননি। তখন প্রধানমন্ত্রী বাকি বক্তৃতা পড়ে দেন। দেশের ইতিহাসে যা ছিল নজিরবিহীন। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনও করেন শেখ হাসিনা। এরপর সংসদে বাজেটের উপর পুরো আলোচনায় অনুপস্থিত থাকলেও শনিবার অধিবেশনে যোগ দেন অর্থমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বাজেটের উপর তার সমাপনী ভাষণে অর্থমন্ত্রীর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, তারপরও তিনি অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। এরপর ড. স্পিকার শিরীন শারমিনের অনুমতি নিয়ে বসে বাজেট আলোচনায় কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। পরে স্পিকার জানান, অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন অর্থবিল সংসদে তোলার জন্য। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বিলটি সংসদে উত্থাপন করার আহ্বান জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর পক্ষে সংসদে বিলটি উত্থাপন করেন।

বাজেট পাসের আগে বাজেটের রাজস্ব অংশের আলোচিত-সমালোচিত প্রস্তাবগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে পরিবর্তন প্রয়োজন হলে প্রধানমন্ত্রী তা সংশোধন করতে অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। পরে অর্থমন্ত্রী তা সংশোধন করে নিলে অর্থ বিল সংসদে পাস হয়। বিলের ওপর জনমত যাচাই ও সংশোধনী নিয়ে বিরোধীদলের সদস্যদের বিভিন্ন কথার জবাবও দেন শেখ হাসিনা। তার আগে বাজেট আলোচনায় দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তব্যে দেশের উন্নয়নে তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগানোর উপরও জোর দেন তিনি।