মহান সাঁওতাল বিদ্রোহে মিশনারিদের অবদান

মিথুশিলাক মুরমু

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার অ্যাক্ট ঘোষণার পরই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে মিশনারিদের আগমনের তালিকা দীর্ঘায়িত হয়েছে। আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে মিশনারিদের উপস্থিতি বা সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের পরিচিতির সূত্রপাত ঘটে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে। ‘আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মিশন’ই প্রথম সাঁওতাল জীবন-মান উন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই মিশনের মিশনারি রেভারেন্ড জিরিমিয়া ফিলিপস ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সাঁওতালী বর্ণমালায় বই প্রকাশ করেছিলেন; অতঃপর ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা’র বই প্রণয়ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সাঁওতালদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন যে, সাঁওতালী ভাষাকে আত্মস্থ করতে ব্যাকরণেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে; সে লক্ষ্যেই ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে উপহার দেন ‘এ্যান ইনট্রোড্রাকশন টু দ্য সানতালি ল্যাঙ্গুয়েজ’। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর আত্মিক উন্নয়নের পাশাপাশি বেঁচে থাকার মানসে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শিক্ষার আলোর আবশ্যকতা। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশার বালেশ্বরে প্রথম সাঁওতালী মিশন স্কুল স্থাপন করে অমর হয়েছেন। বর্তমান মেদিনীপুর জেলাটি ওড়িশার বালেশ্বরেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তীকালেও ১৮৬২ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অজস্র বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। আর এ সময়কালে মিশনের দায়িত্ব পালন করেছেন রেভারেন্ড ওটিস বেচলার।

‘ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড এ লেসলি রাজমহল পাহাড় অঞ্চলে থাকতেন। তিনিই সর্বপ্রথম সাঁওতালদের মধ্যে কাজকর্ম করার প্রচেষ্টা করেন বলে জানা যায়। তিনি সাঁওতালদের ভাষা, রীতিনীতি ও আচার-আচরণ আয়ত্ত করেছিলেন এবং একজন ধর্মান্তরিত যুবককে সঙ্গে নিয়ে ঘন ঘন সাঁওতালদের গ্রাম পরিদর্শনে যেতেন। দুর্ভাগ্যবশত, স্বাস্থ্যগত কারণে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে লেসলি ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।’১ রেভারেন্ড লেসলি ভারত বর্ষে আগমন ও সাঁওতালদের মধ্যে অবস্থানের প্রথম দিনগুলো আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। ১৮২৪ থেকে ১৮৪১ পর্যন্ত লেসলি এবং টি. ক্রিশ্চিয়ানকে সাঁওতালদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতে পাঠানো হয় কিন্তু এক বছরের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ানের মৃত্যু ঘটে এবং জঙ্গল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে লেসলিও তাঁর কর্মক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন।

‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি ১৮৫০ সালের প্রথম দিকে সাঁওতাল পরগনার উত্তরাংশে কাজ শুরু করে। পরে আস্তে আস্তে মালদা ও দিনাজপুর জেলাতেও মিশন খোলা হয়। সাঁওতালী ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে ও মিশনের অবদান কম নয়।২ রেভারেন্ড এ লেসলি’র পরবর্তীকালে রেভারেন্ড আর জি. এলিস মিশনারি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সুসমাচার প্রচারযাত্রাকে সচল রেখেছিলেন। ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির পক্ষে তিনি মাঝে মধ্যে মিশন স্টেশন স্থাপনের চেতনা থেকেই বীরভূম জেলার সিউড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন।’ মোটামুটি বলা যায় যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তৎকালীন বীরভূম জেলার সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন। এখানে উল্লেখযোগ্য বর্তমান সাঁওতাল পরগনা ১৮৫৫ সালের ‘হুল’ পর্যন্ত বীরভূম জেলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাঁওতাল অভ্যুত্থানের পর বর্তমান সাঁওতাল পরগনার বিভিন্ন এলাকা নিয়ে এক নন রেগুলেটেড জেলা তৈরি হয়। কাজেই ওই মিশনারি বর্তমান সাঁওতাল পরগনা নামক বিভগের দক্ষিণাংশেও তার কাজের পরিধি বিস্তার করেন। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত ছিলেন।৩

ইংরেজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে সময় ছোটনাগপুরের আদিবাসী অঞ্চলে রাজনৈতিক বিধাতারূপে আবির্ভূত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; সেই সময় সুদূর জার্মানির বার্লিনে তৎকালীন বিখ্যাত ইভ্যানজেলিস্ট ধর্মযাজক জন গসনার (John Gossner) হিদেন উদ্ধারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতে উদ্যোগ প্রসারের সংকল্প করবেন। অর্থাৎ ইংরেজ ভারতে রাজ্য জয় করেছেন, তিনি ভারতের আত্মা জয় করবেন। ১৮৪৪ খৃঃ অব্দে তিনি কলকাতায় চারজন জার্মান মিশনারিকে পাঠালেন। জার্মান পাদরীরা কলকাতায় এসে দেশীয় লোকের মনোভাব দেখে নিরুৎসাহ হলেন, কারণ তাদের প্রচারিত বাণীর প্রতি কলকাতার নেটিভ সমাজ কোন আগ্রহই দেখালেন না।’৪ পরবর্তীকালে এরাই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল রাঁচিকে বেছে নিয়েছিলেন ‘Ranchire Gossnar mison do 1845 salre ehopena ar bai baite pasnao idiyena. Hazaribaghre misonariko berelena 1853 salre, menkhan sipahi hulre onde khon dar hoyentakoa. Enho Hazaribahg nangraha purubre mitten dumar atore pahil Hor hoponko Kristanena 1864 salre....5(বঙ্গানুবাদ- রাঁচিতে Gossnar মিশনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ক্রমশই বিস্তৃতি লাভ করে। হাজারীবাগে মিশনারিদের উপস্থিতি চোখে পড়ে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের কারণে ছেড়ে আসতে হয়েছিল। তারপর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে হাজারীবাগ শহরের পূর্বদিকে দুমার নামক গ্রামের সাঁওতালগণ প্রথম খ্রিস্ট বিশ্বাসী হন)।

১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রান্ট, ব্রাউন ও চেম্বারস একত্রে দীর্ঘদিন আলোচনা করার পর একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং এর নাম দেয়া হয় ‘বাংলা ও বিহারে একটি সুসংহত প্রটেস্ট্যান্ট মিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব।’ তাদের এ পরিকল্পনায় ছিল বাংলা ও বিহারকে কয়েকটি ধর্মীয় অঞ্চলে ভাগ করা হবে। প্রত্যেক ধর্মীয় অঞ্চলে একজন অ্যাংলিকান চার্চের ধর্মযাজক থাকবেন। এ ধর্মযাজকরা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন, গির্জা নির্মাণ করবেন, ধর্মশিক্ষকদের (Caechists) শিক্ষাদান করবেন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচার করবেন। এ পরিকল্পনা সার্থকভাবে রূপায়নে কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন একান্ত প্রয়োজন।৬’ ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিলেতের সিএমএসের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের ভাগলপুরে মিশন স্টেশন স্থাপন করে। জার্মান নাগরিক Ernest Droese সাহেবই ছিলেন প্রথম মিশনারি হিসেবে। ইতোপূর্বে গঙ্গার উত্তরে অবস্থিত এ স্থানেই Gossner mission-এর মিশনারি দায়িত্ব পালন করেছেন। J. Gausdal উল্লেখ করেছেন,‘Bhagalpur khon raban dinkore Rajmahal buru sece dara tiokketa ar ondege pahariako tuluc helmel hoyentaete onko motore Kristan dhorom do atanena. Ar buru sec khon gidrako do Bhagalpurre mison iskulreko parhao dareata. Droese saheb do onko Pahariako reak rore cetwana, ar dhorom puthiye benaoatkoa. Rajmahal burukore nonka lekae dara barakette Santalko rean ho Janice badae namketa, ar Santal korako ho janic parhaokko akat tahekana hul aurire. Menkhan hul reak maran dorloete burukore ehoplen mison kami do esetena. Disom arho rophayen khan Santalko modre kami lagit mitten Hallett saheb Bhagalpurteye seterena, menkhan eken bar bochor dine taheyena (1859-60). Enho uniak laiak lekate badae akana je 1860 salre Santalko modre 12 misson iskul tahekana ar rolre 422 korako tahekana. Onko modre lahanok akanko do Bhagalpurteko kol ocolena trening nam lagit.’7 (বঙ্গানুবাদ- শীতকালে ভাগলপুর থেকে রাজমহল পাহাড়ের দিকে পরিভ্রমণ করলেন এবং সেখানেই পাহাড়িয়াদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে এবং তারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। পাহাড়ের পাদদেশের ছেলেমেয়েরা ভাগলপুরে অবস্থিত মিশন স্কুলে অধ্যয়ন করেছিল। Droese সাহেব প্রয়োজনের তাগিদেই পাহাড়িয়াদের ভাষা শিখেছিলেন এবং ধর্মগ্রন্থও সংগ্রহ করেছিলেন। রাজমহল পাহাড়ের আশপাশে পর্যবেক্ষণ করার ফলস্বরূপ তিনি সাঁওতালদের বিষয়টিও সম্ভবত অবহিত হয়েছিলেন। সম্ভবত হুল সংঘটিত হওয়ার পূর্বে সাঁওতাল যুবকরাও বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। হুলের দামামাই পাহাড়ঞ্চলে শুরু হওয়া মিশন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। হুল পরবর্তীতে সমগ্র এলাকা শান্ত হলে সাঁওতালদের মধ্যে কাজের জন্য ভাগলপুরে উপস্থিত হন Hallett সাহেব। তিনি মাত্র দুই বছর সাঁওতালদের মধ্যে অবস্থান করেছিলেন। তার ভাষ্যানুযায়ী, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালদের মধ্যে ১২টি মিশন স্কুল এবং ৪১২ জন যুবক অধ্যয়নে যুক্ত ছিলেন; এদের মধ্যে যারা বেশ অগ্রসরমান ছিলো, তাদেরকে ভাগলপুরে প্রশিক্ষণে প্রেরণ করা হয়েছিল)। ‘Hul bochorre 1855 sal September cando 4 tarik khon 7 tarik dhabic adha sae misonariko kol pharenaketa Kolkatare. Chapa akanak kathakore Santalko reak jahanak ban rakap akanre ho enho khatige noko reak hoko gandon baraketgea. Ente disom ropha ruaren tayomte Hor hoponko modre mison kami janam ocoe lagit khara mon namena Kolkatere ho ar etak nangrahare ho.8 (বঙ্গানুবাদÑ হুল বছর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মিশনারি কলকাতায় আশ্রিত হয়েছিলেন। প্রিন্টিং কোনো জায়গায় সাঁওতালদের বিষয়াদি না থাকলেও নিশ্চয়ই মিশনারিরা এদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। কারণ সমস্ত কিছুর সমাপ্তির পর স্বাভাবিক হলে সাঁওতালদের মধ্যে মিশন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না কলকাতায় কিংবা অন্যান্যা শহরাঞ্চলে)।

‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যারাকপুরের ভারতীয় সৈন্য শিবিরে মঙ্গল পান্ডে কর্তৃক বিদ্রোহ শুরু হয়। ভারতীয় সিপাহীরা ব্যাপকভাবে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। এই সঙ্গে তারা সকল ইউরোপীয় এবং বিদেশী মিশনারিদের বিরুদ্ধেও অভিযান করে।৯’ ‘১২৬১ সালে (ইংরেজি ১৮৫৪-৫৫) বীরভূমের সাঁওতালরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে; কিন্তু বর্ধমানের রাজা ও বর্ধমান বিভাগের কমিশনার মি. ইলিয়টের সক্রিয় তৎপরতায় কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দমন করা সম্ভব হয়। এই বিদ্রোহ দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করায় বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্নরের আদেশক্রমে দারোগা মোহাম্মদ হামিদ, জমাদার হিমাত আলি, গোলাম আলি খান, মীর খান, সাহেব খান ও সুখলালকে ১৮৫৬ সালের ২০ জানুয়ারি পুরস্কার দেয়া হয়।’১০

সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তীকালে ‘শিক্ষার চরম অভাব’ ও ‘সাঁওতাল ধর্মীয় বিশ্বাসের অযৌক্তিকতা’ বিদ্রোহের জন্য দায়ী করা হয়। চার্চ মিশনারি সোসাইটিকে বাংলার সরকার সাঁওতালদের শিক্ষিত করে তুলতে একটি বৃহৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে চার্চ মিশনারি সোসাইটিকে উদ্বুদ্ধ ও অনুরোধ করেন। চার্চ মিশনারি সোসাইটি এমন সুযোগ পেয়ে নিজেদের ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করে তোলেন এবং আর্থিক সহযোগিতা প্রদানেও সম্মত হন। কলকাতায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি কর্মপদ্ধতি উপস্থাপন করা হয়, এটিতে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাসহ বৃত্তিগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। উপস্থাপিত কর্ম-পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু পরবর্তী বছরই অর্থাৎ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হলে গৃহীত কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়। অতঃপরও চার্চ মিশনারি সোসাইটি হতোদ্যম না হয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুরে মিশন স্টেশনের কার্যক্রম শুরু করে। ই.এল পাক্সলির অধীনে একটি স্বতন্ত্র একক হিসেবে সাঁওতাল মিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ‘১৮৫৬ সালে বাংলার কিছু এলাকাসহ নতুন সৃষ্ট সাঁওতাল পরগনার কিছু কিছু অংশে মিশনের কয়েকটি নতুন আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাঁওতাল মাঝিদের (প্রধান ব্যক্তি) সহযোগিতা নিয়ে পাক্সলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘সাঁওতালীকরণের’ প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দিয়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে তিনি সাঁওতাল ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।... ১৮৬২ সালে ১০টি ‘অকোজ’ স্কুল নিয়ে শুরু করে ১৮৬৮ সালে তাঁর প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ৩৪৮ ছাত্রছাত্রীসহ ৩৬টি স্কুল রেখে যান।১১

সাঁওতাল বিদ্রোহের পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘটনা অবলোকন ও পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে-

মিশনারিরা সাঁওতালদের অশিক্ষা ও ভ্রান্তি বিশ্বাসকে হুলের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

মিশনারিরা সাঁওতালদের পক্ষে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে হোমবোর্ড/ ইংরেজ সরকারকে সত্যিকার তথ্যাদি সরবরাহ করেছেন।

একজন খ্রিস্ট বিশ্বাসী হিসেবে মিশনারিগণ অবশ্যই সাঁওতালদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় মিশনারিদেরও দোষারোপ করা হয়েছে।

ভারত সরকার সাঁওতালদের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা উন্নয়নের প্রস্তাবকে সহজেই গ্রহণ করে; এতে বোঝা যায়, সাঁওতালদের প্রতি তাদের মমত্ববোধ, দরদ ও ভালোবাসা ছিল।

সাঁওতালদের সঙ্গে বসবাস, কাজ ও উন্নয়নের স্বার্থে ভাষা শিক্ষা, ভাষা উন্নয়ন, সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন; মিশনারিরা অমৃত্যু সাঁওতালদের সঙ্গে থেকে ভারতের মাটিতেই কবরস্থ হয়েছেন।

‘১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের আগেই পূর্ব ভারতে বিদেশি ভারতবন্ধুরা এসে গিয়েছিলেন। ইংরেজ শাসক ছাড়া আরও দুই শ্রেণীর বিদেশি সাঁওতাল বন্ধুরা সাঁওতাল পরগনাকে কেন্দ্র করে বাইবেল প্রচার করেছিল। প্রথমত, মিশনারি হিসেবে এক হাতে বাইবেল, অন্য হাতে স্কুল-হাসপাতাল নিয়ে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজ প্রশাসকদের কেউ কেউ রাইফেল হাতে এলেও সাঁওতালদের জনজীবনের সঙ্গে সংলিপ্ত হয়ে সাঁওতাল উন্নয়নের শরিক হয়ে গিয়েছিলেন।’১২ ‘শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়, রাজনৈতিক অধিকারের আলোয়-মিশনারিদের অবদান প্রাতঃস্মরণীয়। মুন্ডা বিপ্লবী বিরসা (১৮৭৪-১৯০০) চাইবাসার মিশনারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে হাজারীবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র জে. বারথলসেন, প্রথম ঝাড়খ- রাজ্যের দাবি করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ছোটনাগপুর খ্রিস্টান সভা’ নির্বাচনে সব আসন দখল করে। আলাদা আদিবাসী রাজ্য গঠনের দাবিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন- খ্রিস্টান আদিবাসী নেতৃত্ব। অবশেষে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার জন্মদিন (১৫ নভেম্বর) নতুন আদিবাসী রাজ্য ঝাড়খন্ড গঠিত হয়; যা বিশ্বেও আদিবাসী চর্চার ভুবনে এক মাইলস্টোন।’১৩

স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কায়োবাক্যে বলি, ‘আমার কাতরোক্তি তোমা হইতে গুপ্ত নয়।’ ১৬৪তম মহান সাঁওতাল হুল দিবস উদযাপনের মাধ্যমে আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী জাগরিত ও উদ্বুদ্ধ হোক নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। মহান হুল দিবসের সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানাই।

১. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ১০৮

২. সাঁওতালী ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, পৃষ্ঠা- ১০৮

৩. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ১৫০

৪. ভারতের আদিবাসী, সুবোধ ঘোষ, পৃষ্ঠা- ১২৩

৫ Ebeneser Evangelical Lutheran Church, J. Gausdal; page-16

৬. বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়, (১৫৭৬-১৯৬০) লুইস প্রভাত সরকার, পৃষ্ঠা- ৯৫

৭. Ebeneser Evangelical Lutheran Church, J. Gausdal; page-14

৮. Ebeneser Evangelical Lutheran Church, J. Gausdal; page-16

৯. বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়, (১৫৭৬-১৯৬০) লুইস প্রভাত সরকার, পৃষ্ঠা- ২০৮

১০. পল্লী বাংলার ইতিহাস, ডব্লিউ ডব্লিউ হাণ্টার, (অনুবাদ- ওসমান গনি); পৃষ্ঠা- ২৯৮

১১ . বাংলা পিডিয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রধান সম্পাদক- অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

১২. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ১৪

১৩. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ২২

রবিবার, ৩০ জুন ২০১৯ , ১৬ আষাঢ় ১৪২৫, ২৬ শাওয়াল ১৪৪০

মহান সাঁওতাল বিদ্রোহে মিশনারিদের অবদান

মিথুশিলাক মুরমু

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার অ্যাক্ট ঘোষণার পরই পশ্চিমা দেশগুলো থেকে মিশনারিদের আগমনের তালিকা দীর্ঘায়িত হয়েছে। আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে মিশনারিদের উপস্থিতি বা সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের পরিচিতির সূত্রপাত ঘটে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে। ‘আমেরিকান ব্যাপ্টিস্ট মিশন’ই প্রথম সাঁওতাল জীবন-মান উন্নয়নে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই মিশনের মিশনারি রেভারেন্ড জিরিমিয়া ফিলিপস ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সাঁওতালী বর্ণমালায় বই প্রকাশ করেছিলেন; অতঃপর ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘সাঁওতালী ভাষা শিক্ষা’র বই প্রণয়ন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সাঁওতালদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন যে, সাঁওতালী ভাষাকে আত্মস্থ করতে ব্যাকরণেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে; সে লক্ষ্যেই ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে উপহার দেন ‘এ্যান ইনট্রোড্রাকশন টু দ্য সানতালি ল্যাঙ্গুয়েজ’। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর আত্মিক উন্নয়নের পাশাপাশি বেঁচে থাকার মানসে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শিক্ষার আলোর আবশ্যকতা। তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশার বালেশ্বরে প্রথম সাঁওতালী মিশন স্কুল স্থাপন করে অমর হয়েছেন। বর্তমান মেদিনীপুর জেলাটি ওড়িশার বালেশ্বরেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহান সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তীকালেও ১৮৬২ থেকে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অজস্র বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। আর এ সময়কালে মিশনের দায়িত্ব পালন করেছেন রেভারেন্ড ওটিস বেচলার।

‘ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড এ লেসলি রাজমহল পাহাড় অঞ্চলে থাকতেন। তিনিই সর্বপ্রথম সাঁওতালদের মধ্যে কাজকর্ম করার প্রচেষ্টা করেন বলে জানা যায়। তিনি সাঁওতালদের ভাষা, রীতিনীতি ও আচার-আচরণ আয়ত্ত করেছিলেন এবং একজন ধর্মান্তরিত যুবককে সঙ্গে নিয়ে ঘন ঘন সাঁওতালদের গ্রাম পরিদর্শনে যেতেন। দুর্ভাগ্যবশত, স্বাস্থ্যগত কারণে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে লেসলি ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।’১ রেভারেন্ড লেসলি ভারত বর্ষে আগমন ও সাঁওতালদের মধ্যে অবস্থানের প্রথম দিনগুলো আমাদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। ১৮২৪ থেকে ১৮৪১ পর্যন্ত লেসলি এবং টি. ক্রিশ্চিয়ানকে সাঁওতালদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতে পাঠানো হয় কিন্তু এক বছরের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ানের মৃত্যু ঘটে এবং জঙ্গল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে লেসলিও তাঁর কর্মক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন।

‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি ১৮৫০ সালের প্রথম দিকে সাঁওতাল পরগনার উত্তরাংশে কাজ শুরু করে। পরে আস্তে আস্তে মালদা ও দিনাজপুর জেলাতেও মিশন খোলা হয়। সাঁওতালী ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে ও মিশনের অবদান কম নয়।২ রেভারেন্ড এ লেসলি’র পরবর্তীকালে রেভারেন্ড আর জি. এলিস মিশনারি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সুসমাচার প্রচারযাত্রাকে সচল রেখেছিলেন। ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির পক্ষে তিনি মাঝে মধ্যে মিশন স্টেশন স্থাপনের চেতনা থেকেই বীরভূম জেলার সিউড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন।’ মোটামুটি বলা যায় যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তৎকালীন বীরভূম জেলার সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হন। এখানে উল্লেখযোগ্য বর্তমান সাঁওতাল পরগনা ১৮৫৫ সালের ‘হুল’ পর্যন্ত বীরভূম জেলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাঁওতাল অভ্যুত্থানের পর বর্তমান সাঁওতাল পরগনার বিভিন্ন এলাকা নিয়ে এক নন রেগুলেটেড জেলা তৈরি হয়। কাজেই ওই মিশনারি বর্তমান সাঁওতাল পরগনা নামক বিভগের দক্ষিণাংশেও তার কাজের পরিধি বিস্তার করেন। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে কর্মরত ছিলেন।৩

ইংরেজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে সময় ছোটনাগপুরের আদিবাসী অঞ্চলে রাজনৈতিক বিধাতারূপে আবির্ভূত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; সেই সময় সুদূর জার্মানির বার্লিনে তৎকালীন বিখ্যাত ইভ্যানজেলিস্ট ধর্মযাজক জন গসনার (John Gossner) হিদেন উদ্ধারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতে উদ্যোগ প্রসারের সংকল্প করবেন। অর্থাৎ ইংরেজ ভারতে রাজ্য জয় করেছেন, তিনি ভারতের আত্মা জয় করবেন। ১৮৪৪ খৃঃ অব্দে তিনি কলকাতায় চারজন জার্মান মিশনারিকে পাঠালেন। জার্মান পাদরীরা কলকাতায় এসে দেশীয় লোকের মনোভাব দেখে নিরুৎসাহ হলেন, কারণ তাদের প্রচারিত বাণীর প্রতি কলকাতার নেটিভ সমাজ কোন আগ্রহই দেখালেন না।’৪ পরবর্তীকালে এরাই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল রাঁচিকে বেছে নিয়েছিলেন ‘Ranchire Gossnar mison do 1845 salre ehopena ar bai baite pasnao idiyena. Hazaribaghre misonariko berelena 1853 salre, menkhan sipahi hulre onde khon dar hoyentakoa. Enho Hazaribahg nangraha purubre mitten dumar atore pahil Hor hoponko Kristanena 1864 salre....5(বঙ্গানুবাদ- রাঁচিতে Gossnar মিশনের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ক্রমশই বিস্তৃতি লাভ করে। হাজারীবাগে মিশনারিদের উপস্থিতি চোখে পড়ে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে, কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহের কারণে ছেড়ে আসতে হয়েছিল। তারপর ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে হাজারীবাগ শহরের পূর্বদিকে দুমার নামক গ্রামের সাঁওতালগণ প্রথম খ্রিস্ট বিশ্বাসী হন)।

১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রান্ট, ব্রাউন ও চেম্বারস একত্রে দীর্ঘদিন আলোচনা করার পর একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন এবং এর নাম দেয়া হয় ‘বাংলা ও বিহারে একটি সুসংহত প্রটেস্ট্যান্ট মিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব।’ তাদের এ পরিকল্পনায় ছিল বাংলা ও বিহারকে কয়েকটি ধর্মীয় অঞ্চলে ভাগ করা হবে। প্রত্যেক ধর্মীয় অঞ্চলে একজন অ্যাংলিকান চার্চের ধর্মযাজক থাকবেন। এ ধর্মযাজকরা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন, গির্জা নির্মাণ করবেন, ধর্মশিক্ষকদের (Caechists) শিক্ষাদান করবেন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচার করবেন। এ পরিকল্পনা সার্থকভাবে রূপায়নে কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন একান্ত প্রয়োজন।৬’ ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিলেতের সিএমএসের যাত্রা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের ভাগলপুরে মিশন স্টেশন স্থাপন করে। জার্মান নাগরিক Ernest Droese সাহেবই ছিলেন প্রথম মিশনারি হিসেবে। ইতোপূর্বে গঙ্গার উত্তরে অবস্থিত এ স্থানেই Gossner mission-এর মিশনারি দায়িত্ব পালন করেছেন। J. Gausdal উল্লেখ করেছেন,‘Bhagalpur khon raban dinkore Rajmahal buru sece dara tiokketa ar ondege pahariako tuluc helmel hoyentaete onko motore Kristan dhorom do atanena. Ar buru sec khon gidrako do Bhagalpurre mison iskulreko parhao dareata. Droese saheb do onko Pahariako reak rore cetwana, ar dhorom puthiye benaoatkoa. Rajmahal burukore nonka lekae dara barakette Santalko rean ho Janice badae namketa, ar Santal korako ho janic parhaokko akat tahekana hul aurire. Menkhan hul reak maran dorloete burukore ehoplen mison kami do esetena. Disom arho rophayen khan Santalko modre kami lagit mitten Hallett saheb Bhagalpurteye seterena, menkhan eken bar bochor dine taheyena (1859-60). Enho uniak laiak lekate badae akana je 1860 salre Santalko modre 12 misson iskul tahekana ar rolre 422 korako tahekana. Onko modre lahanok akanko do Bhagalpurteko kol ocolena trening nam lagit.’7 (বঙ্গানুবাদ- শীতকালে ভাগলপুর থেকে রাজমহল পাহাড়ের দিকে পরিভ্রমণ করলেন এবং সেখানেই পাহাড়িয়াদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে এবং তারা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। পাহাড়ের পাদদেশের ছেলেমেয়েরা ভাগলপুরে অবস্থিত মিশন স্কুলে অধ্যয়ন করেছিল। Droese সাহেব প্রয়োজনের তাগিদেই পাহাড়িয়াদের ভাষা শিখেছিলেন এবং ধর্মগ্রন্থও সংগ্রহ করেছিলেন। রাজমহল পাহাড়ের আশপাশে পর্যবেক্ষণ করার ফলস্বরূপ তিনি সাঁওতালদের বিষয়টিও সম্ভবত অবহিত হয়েছিলেন। সম্ভবত হুল সংঘটিত হওয়ার পূর্বে সাঁওতাল যুবকরাও বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। হুলের দামামাই পাহাড়ঞ্চলে শুরু হওয়া মিশন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। হুল পরবর্তীতে সমগ্র এলাকা শান্ত হলে সাঁওতালদের মধ্যে কাজের জন্য ভাগলপুরে উপস্থিত হন Hallett সাহেব। তিনি মাত্র দুই বছর সাঁওতালদের মধ্যে অবস্থান করেছিলেন। তার ভাষ্যানুযায়ী, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালদের মধ্যে ১২টি মিশন স্কুল এবং ৪১২ জন যুবক অধ্যয়নে যুক্ত ছিলেন; এদের মধ্যে যারা বেশ অগ্রসরমান ছিলো, তাদেরকে ভাগলপুরে প্রশিক্ষণে প্রেরণ করা হয়েছিল)। ‘Hul bochorre 1855 sal September cando 4 tarik khon 7 tarik dhabic adha sae misonariko kol pharenaketa Kolkatare. Chapa akanak kathakore Santalko reak jahanak ban rakap akanre ho enho khatige noko reak hoko gandon baraketgea. Ente disom ropha ruaren tayomte Hor hoponko modre mison kami janam ocoe lagit khara mon namena Kolkatere ho ar etak nangrahare ho.8 (বঙ্গানুবাদÑ হুল বছর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মিশনারি কলকাতায় আশ্রিত হয়েছিলেন। প্রিন্টিং কোনো জায়গায় সাঁওতালদের বিষয়াদি না থাকলেও নিশ্চয়ই মিশনারিরা এদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। কারণ সমস্ত কিছুর সমাপ্তির পর স্বাভাবিক হলে সাঁওতালদের মধ্যে মিশন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না কলকাতায় কিংবা অন্যান্যা শহরাঞ্চলে)।

‘১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যারাকপুরের ভারতীয় সৈন্য শিবিরে মঙ্গল পান্ডে কর্তৃক বিদ্রোহ শুরু হয়। ভারতীয় সিপাহীরা ব্যাপকভাবে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। এই সঙ্গে তারা সকল ইউরোপীয় এবং বিদেশী মিশনারিদের বিরুদ্ধেও অভিযান করে।৯’ ‘১২৬১ সালে (ইংরেজি ১৮৫৪-৫৫) বীরভূমের সাঁওতালরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে; কিন্তু বর্ধমানের রাজা ও বর্ধমান বিভাগের কমিশনার মি. ইলিয়টের সক্রিয় তৎপরতায় কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দমন করা সম্ভব হয়। এই বিদ্রোহ দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করায় বাংলার লেফটেন্যান্ট-গভর্নরের আদেশক্রমে দারোগা মোহাম্মদ হামিদ, জমাদার হিমাত আলি, গোলাম আলি খান, মীর খান, সাহেব খান ও সুখলালকে ১৮৫৬ সালের ২০ জানুয়ারি পুরস্কার দেয়া হয়।’১০

সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তীকালে ‘শিক্ষার চরম অভাব’ ও ‘সাঁওতাল ধর্মীয় বিশ্বাসের অযৌক্তিকতা’ বিদ্রোহের জন্য দায়ী করা হয়। চার্চ মিশনারি সোসাইটিকে বাংলার সরকার সাঁওতালদের শিক্ষিত করে তুলতে একটি বৃহৎ পরিকল্পনা প্রণয়নে চার্চ মিশনারি সোসাইটিকে উদ্বুদ্ধ ও অনুরোধ করেন। চার্চ মিশনারি সোসাইটি এমন সুযোগ পেয়ে নিজেদের ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত করে তোলেন এবং আর্থিক সহযোগিতা প্রদানেও সম্মত হন। কলকাতায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি কর্মপদ্ধতি উপস্থাপন করা হয়, এটিতে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাসহ বৃত্তিগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। উপস্থাপিত কর্ম-পরিকল্পনা সরকার গ্রহণ ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু পরবর্তী বছরই অর্থাৎ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হলে গৃহীত কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়। অতঃপরও চার্চ মিশনারি সোসাইটি হতোদ্যম না হয়ে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুরে মিশন স্টেশনের কার্যক্রম শুরু করে। ই.এল পাক্সলির অধীনে একটি স্বতন্ত্র একক হিসেবে সাঁওতাল মিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ‘১৮৫৬ সালে বাংলার কিছু এলাকাসহ নতুন সৃষ্ট সাঁওতাল পরগনার কিছু কিছু অংশে মিশনের কয়েকটি নতুন আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাঁওতাল মাঝিদের (প্রধান ব্যক্তি) সহযোগিতা নিয়ে পাক্সলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘সাঁওতালীকরণের’ প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দিয়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে তিনি সাঁওতাল ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।... ১৮৬২ সালে ১০টি ‘অকোজ’ স্কুল নিয়ে শুরু করে ১৮৬৮ সালে তাঁর প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ৩৪৮ ছাত্রছাত্রীসহ ৩৬টি স্কুল রেখে যান।১১

সাঁওতাল বিদ্রোহের পূর্ববর্তী কিংবা পরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘটনা অবলোকন ও পর্যালোচনা করে মনে হয়েছে-

মিশনারিরা সাঁওতালদের অশিক্ষা ও ভ্রান্তি বিশ্বাসকে হুলের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

মিশনারিরা সাঁওতালদের পক্ষে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে হোমবোর্ড/ ইংরেজ সরকারকে সত্যিকার তথ্যাদি সরবরাহ করেছেন।

একজন খ্রিস্ট বিশ্বাসী হিসেবে মিশনারিগণ অবশ্যই সাঁওতালদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় মিশনারিদেরও দোষারোপ করা হয়েছে।

ভারত সরকার সাঁওতালদের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষা উন্নয়নের প্রস্তাবকে সহজেই গ্রহণ করে; এতে বোঝা যায়, সাঁওতালদের প্রতি তাদের মমত্ববোধ, দরদ ও ভালোবাসা ছিল।

সাঁওতালদের সঙ্গে বসবাস, কাজ ও উন্নয়নের স্বার্থে ভাষা শিক্ষা, ভাষা উন্নয়ন, সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন; মিশনারিরা অমৃত্যু সাঁওতালদের সঙ্গে থেকে ভারতের মাটিতেই কবরস্থ হয়েছেন।

‘১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের আগেই পূর্ব ভারতে বিদেশি ভারতবন্ধুরা এসে গিয়েছিলেন। ইংরেজ শাসক ছাড়া আরও দুই শ্রেণীর বিদেশি সাঁওতাল বন্ধুরা সাঁওতাল পরগনাকে কেন্দ্র করে বাইবেল প্রচার করেছিল। প্রথমত, মিশনারি হিসেবে এক হাতে বাইবেল, অন্য হাতে স্কুল-হাসপাতাল নিয়ে। দ্বিতীয়ত, ইংরেজ প্রশাসকদের কেউ কেউ রাইফেল হাতে এলেও সাঁওতালদের জনজীবনের সঙ্গে সংলিপ্ত হয়ে সাঁওতাল উন্নয়নের শরিক হয়ে গিয়েছিলেন।’১২ ‘শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে নয়, রাজনৈতিক অধিকারের আলোয়-মিশনারিদের অবদান প্রাতঃস্মরণীয়। মুন্ডা বিপ্লবী বিরসা (১৮৭৪-১৯০০) চাইবাসার মিশনারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে হাজারীবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র জে. বারথলসেন, প্রথম ঝাড়খ- রাজ্যের দাবি করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ‘ছোটনাগপুর খ্রিস্টান সভা’ নির্বাচনে সব আসন দখল করে। আলাদা আদিবাসী রাজ্য গঠনের দাবিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন- খ্রিস্টান আদিবাসী নেতৃত্ব। অবশেষে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বিরসা মুন্ডার জন্মদিন (১৫ নভেম্বর) নতুন আদিবাসী রাজ্য ঝাড়খন্ড গঠিত হয়; যা বিশ্বেও আদিবাসী চর্চার ভুবনে এক মাইলস্টোন।’১৩

স্রষ্টার উদ্দেশ্যে কায়োবাক্যে বলি, ‘আমার কাতরোক্তি তোমা হইতে গুপ্ত নয়।’ ১৬৪তম মহান সাঁওতাল হুল দিবস উদযাপনের মাধ্যমে আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী জাগরিত ও উদ্বুদ্ধ হোক নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। মহান হুল দিবসের সংগ্রামী শুভেচ্ছা জানাই।

১. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ১০৮

২. সাঁওতালী ভাষা সাহিত্যের ইতিহাস, ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, পৃষ্ঠা- ১০৮

৩. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ১৫০

৪. ভারতের আদিবাসী, সুবোধ ঘোষ, পৃষ্ঠা- ১২৩

৫ Ebeneser Evangelical Lutheran Church, J. Gausdal; page-16

৬. বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়, (১৫৭৬-১৯৬০) লুইস প্রভাত সরকার, পৃষ্ঠা- ৯৫

৭. Ebeneser Evangelical Lutheran Church, J. Gausdal; page-14

৮. Ebeneser Evangelical Lutheran Church, J. Gausdal; page-16

৯. বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়, (১৫৭৬-১৯৬০) লুইস প্রভাত সরকার, পৃষ্ঠা- ২০৮

১০. পল্লী বাংলার ইতিহাস, ডব্লিউ ডব্লিউ হাণ্টার, (অনুবাদ- ওসমান গনি); পৃষ্ঠা- ২৯৮

১১ . বাংলা পিডিয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রধান সম্পাদক- অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

১২. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ১৪

১৩. সাঁওতাল ও মিশনারী, সম্পাদনা- সুরঞ্জন মিদ্দে, নান্দনিক ১০/২এ, টেমার লেন, কলকাতা; পৃষ্ঠা- ২২