অভিবাসনে নারীর ক্ষমতায়ন

চিত্ত ফ্রান্সিস রিবেরু

গ্রামের সহজ-সরল কিশোরী মরিয়ম। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। বর্গাচাষী বাবার সামান্য উপার্জনে চলে পাঁচজনের সংসার। মরিয়ম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। লেখাপড়ায় সে অত্যন্ত ভালো। মরিয়মের স্বপ্ন লেখাপড়া শিখে একদিন চাকরি করবে, পরিবারের অভাব ঘুচাবে। হঠাৎ একদিন মরিয়মের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে পাশের গ্রামের হুমায়ুন মিয়া। পাত্র ঢাকায় ভালো চাকরি করে। মেয়ে সুখেশান্তিতে থাকবে বলে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে মরিয়মের বাবা-মাকে বিয়েতে রাজি করে ফেলে সে। গরীব বাবা এ প্রস্তাব ফেলতে পারেনি। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে ফেলে। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় মরিয়মের। স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে অজানা ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তায় মরিয়ম চিন্তিত হয়ে পড়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা-মার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নতুন জীবনের পথে পা বাড়ায় সে। বিয়ের কিছুদিন পরই মরিয়ম জানতে পারে তার স্বামী একজন প্রতারক। মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের ভয়ে মাঝে মাঝেই নিরুদ্দেশ থাকে।

এ অবস্থায় বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই কিশোরী মরিয়ম বাবার বাড়িতে চলে আসে। কিছুদিন বাড়িতে থাকার পর দরিদ্র বাবার আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে মরিয়ম আবার ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। নিজের একটি কর্মসংস্থান হয়। একদিন তার এক সহকর্মীর কাছে সরকারিভাবে বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি জানতে পারে। সরকার বিনা খরচে বিদেশে নারীকর্মী পাঠাবে। বিদেশে বেতন বেশি, আর অভাব-অনটন থাকবে না। এ স্বপ্নে বিভোর মরিয়ম। স্বপ্ন একদিন সত্যিই পূরণ হয় তার। বৈধভাবে ভিসা, পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে যায় সে। জর্ডানে গিয়েই একটি কাজও পেয়ে যায়। দেশে বাবা-মার নামে টাকা পাঠানো শুরু করে। পরিবারে অভাব দূর হয়। ছোট ভাই, বোন এখন লেখাপড়া করে। অনেক নারীই বিদেশ গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়, সব হারিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরতে হয় তাদের। এক্ষেত্রে মরিয়মের ভাগ্য ভালো, তাকে এ ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। মরিয়মের মাধ্যমে তার পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে। এখন গ্রামের অনেক নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিদেশ থেকে টাকা দেশে পাঠাচ্ছে।

বর্তমান সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মকান্ডের অন্যতম হলো দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীসমাজকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করা এবং প্রশিক্ষিত নারীকর্মী বিদেশে প্রেরণ করা। নারীরা আজ হংকং, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, লেবানন, জর্ডান, মরিশাস, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। এদেশের নারীরা কৃষিকাজে সাফল্য দেখিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংস্বম্পূর্ণ করেছে। তৈরি পোশাক শিল্পে নারীর মেধা আর শ্রম দিয়ে এ খাতকে বিশ্বায়নের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও বিশ্বে তৃতীয় শীর্ষ রফতানিকারক দেশের তালিকায় নিয়ে গেছে। সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত বিদেশে কর্মী প্রেরণেও বাংলাদেশ একদিন সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যাবে, সে দিন বেশি দূরে নয়।

বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলাতে বিদেশ যান। দেশের জন্য বয়ে আনেন বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু অনেকে আবার দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। অনেকে যৌন, শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকারও হন। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের কর্মস্থলে এভাবেই নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজ করতে হয়। এরপরও তারা শ্রমের মূল্য অনুযায়ী মজুরি পান না। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে সম-অধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সিডও সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করতে পারে। সনদে স্বাক্ষরকারী সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারীকর্মীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক অভিবাসী নারীকর্মী বিদেশে চাকরিকালে নানাধরনের হয়রানির শিকার হন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগের মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে সত্যি, কিন্তু নারীদের মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ার ঘটনাও কম নয়। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার কারণে তারা জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হন।

যে দেশে অভিবাসী নারী শ্রমিকরা গৃহকর্মী হিসেবে যাচ্ছেন তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা না থাকায় সমস্যায় পড়ছেন। তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিবাসনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশ হিসেবে পৃথিবীতে বাংলাদেশের স্থান সপ্তম। অভিবাসী নারী শ্রমিকরা পুরুষ অভিবাসী শ্রমিকদের চেয়ে কম উপার্জন করলেও তারা আয়ের ৯০ শতাংশ টাকা দেশে পাঠান। সেখানে পুরুষ শ্রমিক পাঠান ৫০ শতাংশ।

‘প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০১৬’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ (সুযোগের সমতা), ২০ (অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম) ও ৪০ (পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা) অনুচ্ছেদসমূহের আলোকে প্রণীত হয়েছে। সংবিধানের এই বিধানাবলী অনুযায়ী মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ ও পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতির ধারা ২.৪ এবং ধারা ২.৪.৮ তে উল্লেখ রয়েছে- নারীকর্মীদের শ্রম অভিবাসনে যেসব গন্তব্য দেশে বাংলাদেশি নারী অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বেশি, সেসব দেশের শ্রমকল্যাণ উইংগুলোতে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়াতে হবে। নারী কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারী অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা, কাজের পরিবেশ পর্যবেক্ষণসহ প্রয়োজনীয় আইনি, মনস্তাত্ত্বিক, স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। ধারা ২.৪.৯ উল্লেখ রয়েছে- নারীদের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র ও পেশার সম্প্রসারণ, দক্ষতার উন্নয়ন এবং অভিবাসী নারীকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদানে ওয়েজ আনার্স কল্যাণ তহবিলের আওতায় বিভিন্ন লিঙ্গ-সংবেদনশীল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিদেশে কর্মরত বা প্রত্যাগত নারীকর্মীদের মধ্যে যারা সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ সহায়তামূলক কর্মসূচিসহ সেবা ও পরামর্শ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এর আওতায় পরিচালিত সারা দেশে ৬৮টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক এসোসিয়েশনের পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সি অভিবাসী নারী শ্রমিকদের ত্রিশ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এছাড়া তিন দিনের ওরিয়েন্টেশন কোর্স করানো হয়। এই ওরিয়েন্টেশনগুলোর মাধ্যমে তাদের পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট, রিএন্টিগ্রেশন সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। এর মাধ্যমে তারা নিজস্ব দক্ষতা, পেশাগত দক্ষতা, ভিন্ন সংস্কৃতি, পরিবেশ, খাবার ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ থেকে নব্বইয়ে দশকে বিদেশে নারীকর্মী প্রেরণ শুরু হয়। বিএমইটির দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭২৬ জন নারী বিভিন্ন দেশে কর্মী হিসেবে গেছেন। গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য সবচেয়ে বেশি। অভিবাসী নারীদের কাজের ধরনের মধ্যে রয়েছে গৃহকর্মী, গার্মেন্টসকর্মী, ক্লিনার, দোকানের বিক্রয়কর্মী, কেয়ার গিভার, নার্স, পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী ইত্যাদি। ১৮ বছরের বেশি যেকোনো নারীকর্মী হিসেবে বিদেশ যেতে পারেন। গৃহকর্মীদের বয়সসীমা ২৫ থেকে ৪৫ বছর হতে হয়। নারী কর্মীদের বিদেশ গমনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ২০১৫ সালে সৌদি আরব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে নারীদের সৌদি শ্রমবাজারের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হয়। ২০১৫ সালে বিভিন্ন দেশে মোট ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জন নারীকর্মী গমন করেন এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই ২০ হাজার ৯৫১ জন যান। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে নারীকর্মী গমনের সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যায়। ওই বছর মোট এক লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন নারীকর্মী বিভিন্ন দেশে গমন করেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে যান ৬৮ হাজার ২৮৬ জন। ২০১৭ সালে মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন নারীকর্মীর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই যান ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন। ২০১৮ সালের ৮০ হাজারের বেশি নারীকর্মী বিভিন্ন দেশে গেছেন। দেখা যাচ্ছে, লাখ লাখ নারীকর্মী আজ বিভিন্ন দেশে শ্রমঅভিবাসী হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছেন। সরকারের গতিশীল নীতির কারণে জি টু জি পদ্ধতিতে নতুন নতুন দেশে নারীকর্মী প্রেরণ করা হচ্ছে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে কর্মসংস্থান শুধু দেশের বেকারত্ব হ্রাসই করে না, একই সঙ্গে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের প্রেরণকৃত রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং দেশের সকল অঞ্চল থেকে কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সকল অভিবাসী কর্মীর কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের শুধু নির্যাতন বিষয়ে নয়, ইতিবাচক ঘটনাগুলো তুলে ধরতে হবে। কোনো সমস্যায় পড়লে টোল ফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ নাম্বারে ফোন করতে পারেন। এছাড়া নির্যাতিত নারীকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের জন্যে সৌদি আরবের রিয়াদে একটি, জেদ্দায় দুটি এবং ওমানে একটি সেইফ হোম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেইফ হোমে তাদের খাবার, চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দেওয়া হয় এবং দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশে নারী শ্রমিকরা যাতে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার না হন এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

রবিবার, ৩০ জুন ২০১৯ , ১৬ আষাঢ় ১৪২৫, ২৬ শাওয়াল ১৪৪০

অভিবাসনে নারীর ক্ষমতায়ন

চিত্ত ফ্রান্সিস রিবেরু

গ্রামের সহজ-সরল কিশোরী মরিয়ম। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার বড়। বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে। বর্গাচাষী বাবার সামান্য উপার্জনে চলে পাঁচজনের সংসার। মরিয়ম স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। লেখাপড়ায় সে অত্যন্ত ভালো। মরিয়মের স্বপ্ন লেখাপড়া শিখে একদিন চাকরি করবে, পরিবারের অভাব ঘুচাবে। হঠাৎ একদিন মরিয়মের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে পাশের গ্রামের হুমায়ুন মিয়া। পাত্র ঢাকায় ভালো চাকরি করে। মেয়ে সুখেশান্তিতে থাকবে বলে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে মরিয়মের বাবা-মাকে বিয়েতে রাজি করে ফেলে সে। গরীব বাবা এ প্রস্তাব ফেলতে পারেনি। বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে ফেলে। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় মরিয়মের। স্কুলের বন্ধুদের ছেড়ে অজানা ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তায় মরিয়ম চিন্তিত হয়ে পড়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবা-মার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নতুন জীবনের পথে পা বাড়ায় সে। বিয়ের কিছুদিন পরই মরিয়ম জানতে পারে তার স্বামী একজন প্রতারক। মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। পুলিশের ভয়ে মাঝে মাঝেই নিরুদ্দেশ থাকে।

এ অবস্থায় বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই কিশোরী মরিয়ম বাবার বাড়িতে চলে আসে। কিছুদিন বাড়িতে থাকার পর দরিদ্র বাবার আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে মরিয়ম আবার ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। নিজের একটি কর্মসংস্থান হয়। একদিন তার এক সহকর্মীর কাছে সরকারিভাবে বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি জানতে পারে। সরকার বিনা খরচে বিদেশে নারীকর্মী পাঠাবে। বিদেশে বেতন বেশি, আর অভাব-অনটন থাকবে না। এ স্বপ্নে বিভোর মরিয়ম। স্বপ্ন একদিন সত্যিই পূরণ হয় তার। বৈধভাবে ভিসা, পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে যায় সে। জর্ডানে গিয়েই একটি কাজও পেয়ে যায়। দেশে বাবা-মার নামে টাকা পাঠানো শুরু করে। পরিবারে অভাব দূর হয়। ছোট ভাই, বোন এখন লেখাপড়া করে। অনেক নারীই বিদেশ গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়, সব হারিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরতে হয় তাদের। এক্ষেত্রে মরিয়মের ভাগ্য ভালো, তাকে এ ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। মরিয়মের মাধ্যমে তার পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়েছে। এখন গ্রামের অনেক নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। বিদেশ থেকে টাকা দেশে পাঠাচ্ছে।

বর্তমান সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মকান্ডের অন্যতম হলো দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীসমাজকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তর করা এবং প্রশিক্ষিত নারীকর্মী বিদেশে প্রেরণ করা। নারীরা আজ হংকং, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, লেবানন, জর্ডান, মরিশাস, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। এদেশের নারীরা কৃষিকাজে সাফল্য দেখিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংস্বম্পূর্ণ করেছে। তৈরি পোশাক শিল্পে নারীর মেধা আর শ্রম দিয়ে এ খাতকে বিশ্বায়নের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও বিশ্বে তৃতীয় শীর্ষ রফতানিকারক দেশের তালিকায় নিয়ে গেছে। সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত বিদেশে কর্মী প্রেরণেও বাংলাদেশ একদিন সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যাবে, সে দিন বেশি দূরে নয়।

বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদলাতে বিদেশ যান। দেশের জন্য বয়ে আনেন বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু অনেকে আবার দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়ে হয়েছেন নিঃস্ব। অনেকে যৌন, শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকারও হন। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের কর্মস্থলে এভাবেই নানারকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাজ করতে হয়। এরপরও তারা শ্রমের মূল্য অনুযায়ী মজুরি পান না। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে সম-অধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সিডও সনদ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করতে পারে। সনদে স্বাক্ষরকারী সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারীকর্মীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক অভিবাসী নারীকর্মী বিদেশে চাকরিকালে নানাধরনের হয়রানির শিকার হন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের অবারিত সুযোগের মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়েছে সত্যি, কিন্তু নারীদের মানবাধিকার এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ার ঘটনাও কম নয়। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার কারণে তারা জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হন।

যে দেশে অভিবাসী নারী শ্রমিকরা গৃহকর্মী হিসেবে যাচ্ছেন তাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা না থাকায় সমস্যায় পড়ছেন। তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিবাসনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী দেশ হিসেবে পৃথিবীতে বাংলাদেশের স্থান সপ্তম। অভিবাসী নারী শ্রমিকরা পুরুষ অভিবাসী শ্রমিকদের চেয়ে কম উপার্জন করলেও তারা আয়ের ৯০ শতাংশ টাকা দেশে পাঠান। সেখানে পুরুষ শ্রমিক পাঠান ৫০ শতাংশ।

‘প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০১৬’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ (সুযোগের সমতা), ২০ (অধিকার ও কর্তব্যরূপে কর্ম) ও ৪০ (পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা) অনুচ্ছেদসমূহের আলোকে প্রণীত হয়েছে। সংবিধানের এই বিধানাবলী অনুযায়ী মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান সুযোগ ও পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। প্রবাসী কল্যাণ এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতির ধারা ২.৪ এবং ধারা ২.৪.৮ তে উল্লেখ রয়েছে- নারীকর্মীদের শ্রম অভিবাসনে যেসব গন্তব্য দেশে বাংলাদেশি নারী অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা বেশি, সেসব দেশের শ্রমকল্যাণ উইংগুলোতে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা বাড়াতে হবে। নারী কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারী অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা, কাজের পরিবেশ পর্যবেক্ষণসহ প্রয়োজনীয় আইনি, মনস্তাত্ত্বিক, স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। ধারা ২.৪.৯ উল্লেখ রয়েছে- নারীদের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র ও পেশার সম্প্রসারণ, দক্ষতার উন্নয়ন এবং অভিবাসী নারীকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সামাজিক সুরক্ষা প্রদানে ওয়েজ আনার্স কল্যাণ তহবিলের আওতায় বিভিন্ন লিঙ্গ-সংবেদনশীল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। বিদেশে কর্মরত বা প্রত্যাগত নারীকর্মীদের মধ্যে যারা সামাজিক ও মানসিক ক্ষতি ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ সহায়তামূলক কর্মসূচিসহ সেবা ও পরামর্শ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এর আওতায় পরিচালিত সারা দেশে ৬৮টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক এসোসিয়েশনের পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, সরকার ও রিক্রুটিং এজেন্সি অভিবাসী নারী শ্রমিকদের ত্রিশ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এছাড়া তিন দিনের ওরিয়েন্টেশন কোর্স করানো হয়। এই ওরিয়েন্টেশনগুলোর মাধ্যমে তাদের পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট, রিএন্টিগ্রেশন সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। এর মাধ্যমে তারা নিজস্ব দক্ষতা, পেশাগত দক্ষতা, ভিন্ন সংস্কৃতি, পরিবেশ, খাবার ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ থেকে নব্বইয়ে দশকে বিদেশে নারীকর্মী প্রেরণ শুরু হয়। বিএমইটির দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৭২৬ জন নারী বিভিন্ন দেশে কর্মী হিসেবে গেছেন। গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য সবচেয়ে বেশি। অভিবাসী নারীদের কাজের ধরনের মধ্যে রয়েছে গৃহকর্মী, গার্মেন্টসকর্মী, ক্লিনার, দোকানের বিক্রয়কর্মী, কেয়ার গিভার, নার্স, পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী ইত্যাদি। ১৮ বছরের বেশি যেকোনো নারীকর্মী হিসেবে বিদেশ যেতে পারেন। গৃহকর্মীদের বয়সসীমা ২৫ থেকে ৪৫ বছর হতে হয়। নারী কর্মীদের বিদেশ গমনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ২০১৫ সালে সৌদি আরব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে নারীদের সৌদি শ্রমবাজারের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হয়। ২০১৫ সালে বিভিন্ন দেশে মোট ১ লাখ ৩ হাজার ৭১৮ জন নারীকর্মী গমন করেন এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই ২০ হাজার ৯৫১ জন যান। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে নারীকর্মী গমনের সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে যায়। ওই বছর মোট এক লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন নারীকর্মী বিভিন্ন দেশে গমন করেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে যান ৬৮ হাজার ২৮৬ জন। ২০১৭ সালে মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৮ জন নারীকর্মীর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই যান ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন। ২০১৮ সালের ৮০ হাজারের বেশি নারীকর্মী বিভিন্ন দেশে গেছেন। দেখা যাচ্ছে, লাখ লাখ নারীকর্মী আজ বিভিন্ন দেশে শ্রমঅভিবাসী হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট অবদান রাখছেন। সরকারের গতিশীল নীতির কারণে জি টু জি পদ্ধতিতে নতুন নতুন দেশে নারীকর্মী প্রেরণ করা হচ্ছে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে কর্মসংস্থান শুধু দেশের বেকারত্ব হ্রাসই করে না, একই সঙ্গে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের প্রেরণকৃত রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং দেশের সকল অঞ্চল থেকে কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সকল অভিবাসী কর্মীর কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের শুধু নির্যাতন বিষয়ে নয়, ইতিবাচক ঘটনাগুলো তুলে ধরতে হবে। কোনো সমস্যায় পড়লে টোল ফ্রি হেল্পলাইন ১০৯ নাম্বারে ফোন করতে পারেন। এছাড়া নির্যাতিত নারীকর্মীদের নিরাপদ আশ্রয় প্রদানের জন্যে সৌদি আরবের রিয়াদে একটি, জেদ্দায় দুটি এবং ওমানে একটি সেইফ হোম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেইফ হোমে তাদের খাবার, চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দেওয়া হয় এবং দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশে নারী শ্রমিকরা যাতে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার না হন এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

(পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)