গ্যাসের দাম বাড়ল

  • গড় বৃদ্ধি ৩২.৮ শতাংশ
  • আজ থেকে কার্যকর

দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও রাজনৈতিক সংগঠনের আপত্তির মধ্যেই সব শ্রেণীর (বাণিজ্যিক শ্রেণীতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বাদে) গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার; যা আজ থেকেই কার্যকর হবে।

অথচ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া বেশিরভাগ বিতরণ কোম্পানিই লাভে আছে। আবার অধিকাংশ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ। সম্প্রতি এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত বলেছেন, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতি ৫০ শতাংশ কমালেই এলএনজি আমদানির কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তে আবাসিক খাতে রান্নার চুলার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব প্রায় ৩৮ লাখ চুলার গ্রাহকের ওপর পড়বে সরাসরি।

পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, সিএনজি, শিল্প ও বাণিজ্যক খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে। বাড়বে যানবাহনে পণ্য পরিবহন ব্যয়। ব্যবসায়ীরাও দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তা ভোক্তাদের পকেট থেকেই আদায় করবেন। গ্যাসচালিত গণপরিবহন ভাড়াও ইচ্ছামতো বাড়াবে যানবাহন মালিকরা। গতকাল বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিইআরসি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এক গণবিজ্ঞপ্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা দেয়। বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামের সভাপতিত্বে এতে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভূঁইয়া ও মো. মিজানুর রহমান।

আমদানি করা তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ সংস্থাগুলো গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়; যার ওপর গত ১১ থেকে ১৪ মার্চ গণশুনানি করে বিইআরসি। বিতরণকারী কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম গড়ে ১০২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করলেও ওই প্রস্তাব অযৌক্তিক হিসেবে বর্ণনা করে কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন সে সময় শুনানিতে বলেন, বাস্তবতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতেই গ্যাসের নতুন মূল্য ঠিক করা হবে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম জানান, ভারিত গড়ে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৩৮ থেকে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। গণশুনানি থেকে গ্রাহক তাহলে কী পেল- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিইআরসির চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, গ্যাস সেক্টর একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন বিতরণ চ্যানেলে গ্যাস দেয়া যাচ্ছিল না। এলএনজি আসার পর সেই সমস্যাটা কেটে যাচ্ছে। ‘কস্ট অব এনার্জি’ এবং ‘কস্ট অব নো এনার্জির’ হিসাবটা আপনাদের করতে হবে। তাহলে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা বুঝতে সহজ হবে। তিনি বলেন, আমরা একটা নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছি। জাপানের মতো দেশ ৮৫ শতাংশ জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করে চলছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও ভালো আছে।

৩৮ লাখ চুলার গ্রাহকের মাসিক বিল বাড়ল : বর্ধিত মূল্য অনুযায়ী জুলাই থেকে আবাসিক গ্রাহকদের রান্নায় এক চুলার (সিঙ্গেল বার্নার) জন্য মাসে ৯২৫ ও দুই চুলার (ডাবল বার্নার) জন্য ৯৭৫ টাকা দিতে হবে, যা এতদিন ছিল যথাক্রমে ৭৫০ ও ৮০০ টাকা। উভয় ক্ষেত্রে মাসিক বিল ১৭৫ টাকা বাড়ানো হলেও শতকরা হারে এক চুলা ও দুই চুলায় যথাক্রমে বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রাজধানীসহ সারাদেশের প্রায় ৩৮ লাখ আবাসিক গ্রাহক এই মুল্যবৃদ্ধির আওতায় পড়বেন।

বিইআরসির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গৃহস্থালিতে মিটারে যারা গ্যাসের বিল দেন, তাদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহারের জন্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা করে দিতে হবে। এতদিন প্রতি ঘনমিটারে তাদের বিল হতো ৯ টাকা ১০ পয়সা।

যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম আজ সোমবার থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ থেকে বেড়ে ৪৩ টাকা হবে। এই হিসাবে গাড়ির গ্যাসের জন্য মালিকদের খরচ বাড়বে সাড়ে ৭ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই গণপরিবহনে এর প্রভাব পড়বে। এর মাশুল দিতে হবে যাত্রীদের। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ উৎপাদন (ক্যাপটিভ পাওয়ার), সার কারখানা, শিল্প, হোটেল রেস্তোরাঁ এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ বাণিজ্যিক, চা বাগান- প্রতিটি খাতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে। আর ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকেই তা আদায় করবেন।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস প্রতি ঘনমিটার ৪ টাকা ৪৫ পয়সা। আগে তা ছিল ৩ টাকা ১৬ পয়সা- বেড়েছে ৪১ শতাংশ। ক্যাপটিভ পাওয়ারে প্রতি ঘনমিটারে ৯ টাকা ৬২ থেকে ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়েছে। সার কারখানায় প্রতি ঘনমিটারে ২ টাকা ৭১ থেকে ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৪ টাকা ৪৫, শিল্প কারখানায় ৭ টাকা ৭৬ থেকে ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১০ টাকা ৭০ ও চা বাগানে ৭ টাকা ৪২ থেকে ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১০ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হোটেল ও রেস্টুরেন্টের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ১৭ টাকা ৪ থেকে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ২৩ টাকা করা হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার ১৭ টাকা ৪ পয়সাই রাখা হয়েছে।

বিইআরসির এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিইআরসি আইন ২০০৩-এর ধারা ২২ (খ) ও ৩৪ অনুযায়ী তিতাস, বাখরাবাদ, জালালাবাদ, কর্ণফুলী, সুন্দরবন ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির ভোক্তা পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহার বাড়ানো হলো। প্রজ্ঞাপনে আরও জানানো হয়, বাণিজ্যিক গ্রাহকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গ্রাহকদের মূল্যহার অপরিবর্তিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে। গৃহস্থালি ছাড়া অন্য গ্রাহকশ্রেণীর ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার মাসিক অনুমোদিত লোডের বিপরীতে ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা হয়েছে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়। মার্চ ও জুলাই থেকে দুই ধাপে তা বাস্তবায়িত হওয়ার কথা থাকলেও আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় ধাপের দাম বৃদ্ধি আটকে যায়। গত বছর এলএনজি আমদানির প্রেক্ষাপটে আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগ বাদে অন্য ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ওই আবেদনের ওপর শুনানি করে বিইআরসির সিদ্ধান্তে বলা হয়, গ্যাসের উৎপাদন, এলএনজি আমদানি, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যমান মূল্যহার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গ্যাসের দাম বাড়ানার পথ থেকে সরে আসে সরকার।

ভোটের পর বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে বিইআরসি গণশুনানি করে; যার সবটিতেই দাম বাড়ানোর বিরোধিতা আসে। বিষয়টি আদালতেও গড়ায়। এ বিষয়ে ক্যাবের (কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে বলা হয়, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতি ৫০ শতাংশ কমালেই এলএনজি আমদানির কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে না। তবে গ্যাসের দাম সমন্বয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গত ৯ জুন বলেন, গ্যাসের দামটা সমন্বয় করা দরকার আমি বারবার বলে আসছি। বিইআরসিকে আমরা গ্যাসের দামের বিষয়টি সাবমিট করেছি। প্রাইস সমন্বয়ের জন্য আমরা গত বছর থেকে অপেক্ষায় আছি। শিল্প ও গৃহস্থালি উভয় ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয় দিয়েছে জানিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, সব জায়গায় কিছুটা সমন্বয়ের জন্য বলেছি। তিনি বলেন, আমরা গত বছরের আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করেছি। ১০০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট), ২০০ এমএমসিএফ, ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি করেছি। এই গ্যাসের মূল্য আমাদের নিজস্ব গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার নিজস্ব গ্যাসের ওপর প্রচুর সাবসিডি (ভর্তুকি) দেয়। গ্যাসে বছরে ছয় হাজার কোটি টাকার মতো সাবসিডি দেয়া হয়।

এদিকে ১ জুলাই থেকে গ্যাসের মুল্যবৃদ্ধির ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ভোক্তা সংগঠন। অবিলম্বে এই ঘোষণা স্থগিত করে গ্যাসের পূর্বমূল্য বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে এসব সংগঠন।

(ক্রমিক নং) (গ্রাহক শ্রেণী) (আগের মূল্যহার) (টাকায়) (১ জুলাই থেকে নতুন মূল্যহার) (টাকায়) (শতকরা মূল্যবৃদ্ধি)

১. বিদ্যুৎ ৩.১৬ ৪.৪৫ ৪১%

২. ক্যাপটিভ পাওয়ার ৯.৬২ ১৩.৮৫ ৪৪%

৩. সার ২.৭১ ৪.৪৫ ৬৫%

৪. শিল্প ৭.৭৬ ১০.৭০ ৩৮%

৫. চা বাগান ৭.৪২ ১০.৭০ ৪৪%

৬. বাণিজ্যিক

ক) হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ১৭.০৪ ২৩.০০ ৩৫%

খ) ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ১৭.০৪ ১৭.০৪ ০০%

৭. সিএনজি ৪০.০০ ৪৩.০০ ৭.৫%

৮. গৃহস্থালি

ক) মিটারভিত্তিক ৯.১০ ১২.৬০ ৩৮%

খ) এক বার্নার (মাসিক) ৭৫০ ৯২৫ ২৩%

গ) দুই বার্নার (মাসিক) ৮০০ ৯৭৫ ২২%

সোমবার, ০১ জুলাই ২০১৯ , ১৭ আষাঢ় ১৪২৫, ২৭ শাওয়াল ১৪৪০

গ্যাসের দাম বাড়ল

ফয়েজ আহমেদ তুষার

image

  • গড় বৃদ্ধি ৩২.৮ শতাংশ
  • আজ থেকে কার্যকর

দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, ব্যবসায়ী, ভোক্তা ও রাজনৈতিক সংগঠনের আপত্তির মধ্যেই সব শ্রেণীর (বাণিজ্যিক শ্রেণীতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বাদে) গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার; যা আজ থেকেই কার্যকর হবে।

অথচ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া বেশিরভাগ বিতরণ কোম্পানিই লাভে আছে। আবার অধিকাংশ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ। সম্প্রতি এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত বলেছেন, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতি ৫০ শতাংশ কমালেই এলএনজি আমদানির কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে না। সরকারের এই সিদ্ধান্তে আবাসিক খাতে রান্নার চুলার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রভাব প্রায় ৩৮ লাখ চুলার গ্রাহকের ওপর পড়বে সরাসরি।

পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, সিএনজি, শিল্প ও বাণিজ্যক খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে। বাড়বে যানবাহনে পণ্য পরিবহন ব্যয়। ব্যবসায়ীরাও দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তা ভোক্তাদের পকেট থেকেই আদায় করবেন। গ্যাসচালিত গণপরিবহন ভাড়াও ইচ্ছামতো বাড়াবে যানবাহন মালিকরা। গতকাল বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিইআরসি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এক গণবিজ্ঞপ্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই ঘোষণা দেয়। বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলামের সভাপতিত্বে এতে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভূঁইয়া ও মো. মিজানুর রহমান।

আমদানি করা তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পর থেকে ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তি দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে পেট্রোবাংলা এবং বিতরণ সংস্থাগুলো গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়; যার ওপর গত ১১ থেকে ১৪ মার্চ গণশুনানি করে বিইআরসি। বিতরণকারী কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম গড়ে ১০২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করলেও ওই প্রস্তাব অযৌক্তিক হিসেবে বর্ণনা করে কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন সে সময় শুনানিতে বলেন, বাস্তবতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতেই গ্যাসের নতুন মূল্য ঠিক করা হবে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম জানান, ভারিত গড়ে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭ টাকা ৩৮ থেকে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। গণশুনানি থেকে গ্রাহক তাহলে কী পেল- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিইআরসির চেয়ারম্যান ও বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, গ্যাস সেক্টর একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন বিতরণ চ্যানেলে গ্যাস দেয়া যাচ্ছিল না। এলএনজি আসার পর সেই সমস্যাটা কেটে যাচ্ছে। ‘কস্ট অব এনার্জি’ এবং ‘কস্ট অব নো এনার্জির’ হিসাবটা আপনাদের করতে হবে। তাহলে দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা বুঝতে সহজ হবে। তিনি বলেন, আমরা একটা নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছি। জাপানের মতো দেশ ৮৫ শতাংশ জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করে চলছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও ভালো আছে।

৩৮ লাখ চুলার গ্রাহকের মাসিক বিল বাড়ল : বর্ধিত মূল্য অনুযায়ী জুলাই থেকে আবাসিক গ্রাহকদের রান্নায় এক চুলার (সিঙ্গেল বার্নার) জন্য মাসে ৯২৫ ও দুই চুলার (ডাবল বার্নার) জন্য ৯৭৫ টাকা দিতে হবে, যা এতদিন ছিল যথাক্রমে ৭৫০ ও ৮০০ টাকা। উভয় ক্ষেত্রে মাসিক বিল ১৭৫ টাকা বাড়ানো হলেও শতকরা হারে এক চুলা ও দুই চুলায় যথাক্রমে বেড়েছে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রাজধানীসহ সারাদেশের প্রায় ৩৮ লাখ আবাসিক গ্রাহক এই মুল্যবৃদ্ধির আওতায় পড়বেন।

বিইআরসির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী গৃহস্থালিতে মিটারে যারা গ্যাসের বিল দেন, তাদের প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহারের জন্য ১২ টাকা ৬০ পয়সা করে দিতে হবে। এতদিন প্রতি ঘনমিটারে তাদের বিল হতো ৯ টাকা ১০ পয়সা।

যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম আজ সোমবার থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ থেকে বেড়ে ৪৩ টাকা হবে। এই হিসাবে গাড়ির গ্যাসের জন্য মালিকদের খরচ বাড়বে সাড়ে ৭ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই গণপরিবহনে এর প্রভাব পড়বে। এর মাশুল দিতে হবে যাত্রীদের। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্র, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ উৎপাদন (ক্যাপটিভ পাওয়ার), সার কারখানা, শিল্প, হোটেল রেস্তোরাঁ এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ বাণিজ্যিক, চা বাগান- প্রতিটি খাতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৩৫ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে। আর ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকেই তা আদায় করবেন।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস প্রতি ঘনমিটার ৪ টাকা ৪৫ পয়সা। আগে তা ছিল ৩ টাকা ১৬ পয়সা- বেড়েছে ৪১ শতাংশ। ক্যাপটিভ পাওয়ারে প্রতি ঘনমিটারে ৯ টাকা ৬২ থেকে ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা করা হয়েছে। সার কারখানায় প্রতি ঘনমিটারে ২ টাকা ৭১ থেকে ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৪ টাকা ৪৫, শিল্প কারখানায় ৭ টাকা ৭৬ থেকে ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১০ টাকা ৭০ ও চা বাগানে ৭ টাকা ৪২ থেকে ৪৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১০ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হোটেল ও রেস্টুরেন্টের জন্য প্রতি ঘনমিটারে ১৭ টাকা ৪ থেকে ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে ২৩ টাকা করা হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার ১৭ টাকা ৪ পয়সাই রাখা হয়েছে।

বিইআরসির এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিইআরসি আইন ২০০৩-এর ধারা ২২ (খ) ও ৩৪ অনুযায়ী তিতাস, বাখরাবাদ, জালালাবাদ, কর্ণফুলী, সুন্দরবন ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির ভোক্তা পর্যায়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যহার বাড়ানো হলো। প্রজ্ঞাপনে আরও জানানো হয়, বাণিজ্যিক গ্রাহকশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গ্রাহকদের মূল্যহার অপরিবর্তিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে। গৃহস্থালি ছাড়া অন্য গ্রাহকশ্রেণীর ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার মাসিক অনুমোদিত লোডের বিপরীতে ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা হয়েছে।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়। মার্চ ও জুলাই থেকে দুই ধাপে তা বাস্তবায়িত হওয়ার কথা থাকলেও আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় ধাপের দাম বৃদ্ধি আটকে যায়। গত বছর এলএনজি আমদানির প্রেক্ষাপটে আবাসিক ও বাণিজ্যিক সংযোগ বাদে অন্য ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য আবেদন করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ওই আবেদনের ওপর শুনানি করে বিইআরসির সিদ্ধান্তে বলা হয়, গ্যাসের উৎপাদন, এলএনজি আমদানি, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যমান মূল্যহার পরিবর্তন না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গ্যাসের দাম বাড়ানার পথ থেকে সরে আসে সরকার।

ভোটের পর বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে বিইআরসি গণশুনানি করে; যার সবটিতেই দাম বাড়ানোর বিরোধিতা আসে। বিষয়টি আদালতেও গড়ায়। এ বিষয়ে ক্যাবের (কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট থেকে বলা হয়, পেট্রোবাংলা ও তিতাসের দুর্নীতি ৫০ শতাংশ কমালেই এলএনজি আমদানির কারণ দেখিয়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে না। তবে গ্যাসের দাম সমন্বয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গত ৯ জুন বলেন, গ্যাসের দামটা সমন্বয় করা দরকার আমি বারবার বলে আসছি। বিইআরসিকে আমরা গ্যাসের দামের বিষয়টি সাবমিট করেছি। প্রাইস সমন্বয়ের জন্য আমরা গত বছর থেকে অপেক্ষায় আছি। শিল্প ও গৃহস্থালি উভয় ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয় দিয়েছে জানিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, সব জায়গায় কিছুটা সমন্বয়ের জন্য বলেছি। তিনি বলেন, আমরা গত বছরের আগস্ট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করেছি। ১০০ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘনফুট), ২০০ এমএমসিএফ, ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি করেছি। এই গ্যাসের মূল্য আমাদের নিজস্ব গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার নিজস্ব গ্যাসের ওপর প্রচুর সাবসিডি (ভর্তুকি) দেয়। গ্যাসে বছরে ছয় হাজার কোটি টাকার মতো সাবসিডি দেয়া হয়।

এদিকে ১ জুলাই থেকে গ্যাসের মুল্যবৃদ্ধির ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ভোক্তা সংগঠন। অবিলম্বে এই ঘোষণা স্থগিত করে গ্যাসের পূর্বমূল্য বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে এসব সংগঠন।

(ক্রমিক নং) (গ্রাহক শ্রেণী) (আগের মূল্যহার) (টাকায়) (১ জুলাই থেকে নতুন মূল্যহার) (টাকায়) (শতকরা মূল্যবৃদ্ধি)

১. বিদ্যুৎ ৩.১৬ ৪.৪৫ ৪১%

২. ক্যাপটিভ পাওয়ার ৯.৬২ ১৩.৮৫ ৪৪%

৩. সার ২.৭১ ৪.৪৫ ৬৫%

৪. শিল্প ৭.৭৬ ১০.৭০ ৩৮%

৫. চা বাগান ৭.৪২ ১০.৭০ ৪৪%

৬. বাণিজ্যিক

ক) হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট ১৭.০৪ ২৩.০০ ৩৫%

খ) ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ১৭.০৪ ১৭.০৪ ০০%

৭. সিএনজি ৪০.০০ ৪৩.০০ ৭.৫%

৮. গৃহস্থালি

ক) মিটারভিত্তিক ৯.১০ ১২.৬০ ৩৮%

খ) এক বার্নার (মাসিক) ৭৫০ ৯২৫ ২৩%

গ) দুই বার্নার (মাসিক) ৮০০ ৯৭৫ ২২%