‘দেশের গভীরে পচন ধরেছে’

অরিত্র দাস

দেশটা কি মগের মুল্লুক? যে যেখানে যেভাবে পারছে নিজের স্বার্থে টান পড়লেই খুন করছে, ধর্ষণ করছে, কুপিয়ে জখম করছে, জমি থেকে উচ্ছেদ করছে, অপহরণ করছে, সম্পত্তি লুট করছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন করছে। এসব করে আবার পার পেয়েও যাচ্ছে। কেননা আইন ও বিচার ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় অপরাধীরা। অতঃপর রাজপথে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়ায়। এতে অপরাধ করতে উৎসাহ পায় অপর অপরাধীরা। আর সরকারি নেতারা বলছেন- প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বসে তদারকি করছেন। বলছেন- অপরাধীকে ধরতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। মোদ্দাকথা বাংলাদেশে এখন খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, বাসায় ফেরা, বিয়ে করা, চিকিৎসাসেবা দেয়া, মামলা নেয়া, ছিঁচকে চোর থেকে সন্ত্রাসী গ্রেফতারসহ সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ যেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন মশা কামড় দিলেও প্রধানমন্ত্রী হস্তেক্ষেপ করবেন বলে দলীয় নেতাকর্মীরা বিশ্বোস করেন এবং সেইভাবে তারা প্রচার করেন। এর ফলে যে গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তা কি সরকার দলীয়রা বোঝেন না? তারা জানেন না সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের ধোয়া তোলা মানে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, প্রশাসন তাদের স্ব স্ব কাজে নিষ্ঠাবান নয়- এমন একটি ধারণা জনমনে তৈরি হয়। পাশাপাশি জনমনে ধারণা তৈরি হয়েছে, এ দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ আস্থাভাজন নয়।

অন্যদিকে ইদানীং আরও একটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে- আদালতকে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে একের পর এক রুল জারি করতে হচ্ছে। ওমুককে এখনও গ্রেফতার করা হলো না কেন জানতে চেয়ে আদালতের রুল, তমুককে অপসারণ করা হলো না কেন জানতে চেয়ে রুল। পিরোজপুরে যুবলীগ নেতার দখল-কান্ডে হাইকোর্টের রুল। রাইফা হত্যায় কেন ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয় কেন- জানতে চেয়ে হাইকোর্টের রুল। তরুণীর শ্লীলতাহানিতে পুলিশকে কেন শাস্তি নয়- হাইকোর্টের রুল জারি। রিফাত হত্যা, হাইকোর্ট আসামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে সীমান্তে অ্যালার্ট জারির নির্দেশ। বিমানবন্দরে মশার উৎপাত; হাইকোর্টের রুল জারি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্বের কারণ জানতে চেয়ে আদালতের রুল জারি। একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠের সব কিছু যখন আদালত নজরদারিতে রাখে তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র ভালো নেই। ভালো নেই রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা, সেই সঙ্গে সমাজে মানুষের কর্মকান্ড। রাষ্ট্রযন্ত্র রাষ্ট্র চালাতে বেগ পাচ্ছে, সরকার হিমশিম খাচ্ছে।

বরগুনার কলেজ সড়কের ক্যালিঙ কিন্ডার গার্টেনের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রী আয়েশার সামনে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে মাদকাসক্ত সন্ত্রাসীরা। রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা ঘটনার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ছিঁচকে চোর ছিল। মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করতে সে চুরি ও পরে ছিনতাইয়ের কাজে লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে শুরু করে মাদক ব্যবসা। এরপর বিভিন্ন মহলের যোগসাজশে হয়ে উঠে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী। নয়নের বিরুদ্ধে মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। তার একটি গ্রুপও আছে। যার নাম- ‘বন্ড ০০৭’। বিখ্যাত হলিউড সিরিজ জেমস বন্ডের কোড নম্বর ‘জিরো জিরো সেভেন’ এর সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়েছে তার গ্রুপের নাম। এমন অসংখ্য গ্রুপ আছে বাংলার জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, গ্রাম, পাড়া, মহল্লাজুড়ে। আমরা ক’টার খবর জানি। একটি করে অপরাধ সংঘটিত হয় আর বের হয়ে আসে গ্রুপের নাম। অপর আসামি খুনি রিফাত ফরাজী মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিল। অতীতে তরিকুল ইসলাম নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে সে। নানা ছুঁতোয় স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর করা ছিল রিফাতের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অথচ উক্ত এলাকার সংসদ সদস্য একটি বেসরকারি টেলিভিশনের লাইভ প্রোগ্রামে বলেন, নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজী যে মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী ছিল তা তিনি জানেন না। এর চেয়ে অবিশ্বাস্য এর চেয়ে হাস্যকর এর চেয়ে অসত্য বক্তব্য আর কী হতে পারে। যে কথাটি বরগুনার আবালবৃদ্ধবনিতা জানেন, সেই কথাটি সবচেয়ে আগে তার জানার কথা, কারণ তিনি জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদÑ তিনি নাকি জানেন না। মানুষ রাজনীতিবিদের ওপর বিশ্বাস রাখবে কীভাবে। আমার সন্দেহ- ভদ্রলোক এও জানেন না তার এলাকায় কতজন গরিব আছে, কতজন বেকার আছে, কতজন ভোটার আছে, কোন পরিবার অর্থাভাবে আছে, শিক্ষা-চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত কতজন মানুষ এবং সর্বোপরি তার বাড়ির লোকজন তাকে কোনদৃষ্টিতে দেখেন! রিফাতকে যেভাবে কুপিয়ে মারা হলো তাতে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড মনে পড়ে যায়। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে বিশ্বজিতকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কেউ ছুটে আসেনি তাকে বাঁচাতে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই হত্যাকান্ড দেখছিল। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ২১ আসামির মধ্যে মাত্র ৪ জন এখন কারাগারে আছে। বাকি ১৭ জন হয় পলাতক, নয় বেকসুর খালাস। টিএসসির সামনের রাস্তায় কোপ খেয়ে পড়েছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়। প্রায় এক দশক আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একইভাবে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। অভিজিতের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী রাফিদা আহমেদ। রাফিদা আহমেদ লেখালেখি করেন বন্যা আহমেদ নামে। বন্যা আহমেদ সেদিন পারেননি ঘাতকের হাত থেকে ভালোবাসার মানুষটাকে বাঁচাতে। খিলগাঁও গোরানের একটি পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির পঞ্চম তলায় স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে থাকতেন নিলয় যার আসল নাম নীলাদ্রি চ্যাটার্জি। নিলয় আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতেন। বাসায় ঢুকে স্ত্রীর সামনেই কুপিয়ে মারা হয়েছিল নিলয় নীলকে। স্ত্রী আশা মনি আহাজারি করে বলেছিলেন, ‘এত হাজার হাজার লোক। আর আমি তখন এত চিৎকার করলাম, সবাইকে এত ডাকলাম, কেউ আগায়া আসেনি। এই দেশ কি আমার না? আমি কি অন্য দেশ থেকে এইখানে এসেছি?’

ঠিক একইভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে একই কথাগুলো এখন বলেন নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা। বলেন, ‘আমার সামনেই সন্ত্রাসীরা আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমি শত চেষ্টা করেও তাকে রক্ষা করতে পারিনি। হামলার সময় কোন লোক এগিয়ে আসেনি।’ এতে বোঝা যায়, দেশের গভীরে পচন ধরে গেছে। এখন সবাই দাঁড়িয়ে থেকে হত্যার ঘটনা মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ছবি ও ভিডিও শেয়ার দেয়ার পর তাতে কয়টা লাইক কমেন্ট পড়ল তা দেখে ভীষণ উদ্বেলিত হয়। এ বঙ্গদেশে এখন আর কেউ বিপদে এগিয়ে আসে না বা এগিয়ে আসতে চায় না। বাঙালিরা পিঠ বাঁচিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা চিন্তা করে, আমি তো ভালো আছি। কোপ তো আমাকে দেয়নি। আগুন তো আমার ঘরে লাগেনি। অথচ আগামীকাল আগত কোপ যে তার ওপর তেড়ে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিয়েছে। সত্যি বলতে, বাঙালির আঁচলে যতক্ষণ আগুন না লাগে ততক্ষণ সে নড়েচড়ে বসে না। প্রকাশ্যে দিবালোকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজারে নূরানী আবাসিক এলাকায় অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর মায়ের চোখের সামনে চাপাতির আঘাতে খুন হন জুলহাস মান্নান। এর বিচার হয়নি! বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে একই অপরাধের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

পত্রিকা ঘেঁটে পাওয়া যায়, চলতি বছরের গত ২৬ দিনে ২২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় ঠাকুরগাঁওয়ে ভাতিজা জীবনের ছুরিকাঘাতে আহত ফুফু তানজিনা আক্তারের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয়। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় দুর্গানগর ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামে মা এবং ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যকে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ উপজেলায় ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেত্রী বিউটি আক্তার কুট্টিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজশাহীর মোহনপুরে পদ্ম বিলে ছাগল চরাতে গিয়ে দুই শিশু একটি লাশ দেখতে পায়। পরে জানা যায়, আসমা বেগম নামের এক গৃহবধূকে ধর্ষণের পর কুপিয়ে হত্যা করা লাশ ছিল ওটি। শায়েস্তাগঞ্জে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী মুক্তিরানী দাসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। এ যেন এক কোপাকুপির দেশ। বৃষ্টির মতো কোপ এসে পড়ছে মানুষের শরীরে। তা নিয়ে লেখালেখি, মিছিল-মিটিং-মানববন্ধন হয়, ঝড়ো তর্ক-বিতর্ক হয়। অল্প কিছুদিন পর এটি ভুলে নতুন কোন ইস্যু নিয়ে শাহবাগের রাস্তায়, পত্রিকার পাতায় কর্মসূচি লেখালেখি হয়। এতে ঢাকা পড়ে যায় পুরাতন সব অন্যায়-অপরাধ এবং এসবের বিচার। অপরাধীরা মুখ টিপে হেসে নতুন কোন অপরাধে নেমে পড়ে। নরসিংদীর বীরপুরে ফুলন বর্মণ নামে এক কলেজছাত্রী দোকান থেকে কেক নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন। বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছামাত্র পূর্ব থেকে ওতপেতে থাকা অজ্ঞাতনামা দুই দুর্বৃত্ত তার হাত ও মুখ চেপে পাশের নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। মৃত্যু হয় তার। এই মৃত্যুর মিছিলে আমরা সবাই একে একে করে পতিত হবো। কেননা এর জন্য আমরাই দায়ী। বিচারহীনতা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, গণনির্লিপ্ততা, নীরবতা, সিলেকটিভ মানবতা, দলীয়প্রীতি, গা বাঁচিয়ে চলা, ক্লীবতা বাংলাদেশকে আজ এ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরোতে না পারলে, এ ধরনের কোপাকুপি, অপরাধ, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন চলবেই।

মাঝে মাঝে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এত এত ত্বকী, তনু, রাজিব, ফুলন, নুসরাত, রিফাতের লাশের ওপর উন্নয়নের তকমা নিয়ে বাংলাদেশ তুমি কিভাবে দাঁড়িয়ে আছ?

[লেখক : প্রবন্ধ লেখক, কলামিস্ট

শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা, বাংলাদেশ]

a.adrianaritro@gmail.com

সোমবার, ০১ জুলাই ২০১৯ , ১৭ আষাঢ় ১৪২৫, ২৭ শাওয়াল ১৪৪০

‘দেশের গভীরে পচন ধরেছে’

অরিত্র দাস

দেশটা কি মগের মুল্লুক? যে যেখানে যেভাবে পারছে নিজের স্বার্থে টান পড়লেই খুন করছে, ধর্ষণ করছে, কুপিয়ে জখম করছে, জমি থেকে উচ্ছেদ করছে, অপহরণ করছে, সম্পত্তি লুট করছে, সংখ্যালঘু নির্যাতন করছে। এসব করে আবার পার পেয়েও যাচ্ছে। কেননা আইন ও বিচার ব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় অপরাধীরা। অতঃপর রাজপথে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে হেঁটে বেড়ায়। এতে অপরাধ করতে উৎসাহ পায় অপর অপরাধীরা। আর সরকারি নেতারা বলছেন- প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বসে তদারকি করছেন। বলছেন- অপরাধীকে ধরতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। মোদ্দাকথা বাংলাদেশে এখন খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, বাসায় ফেরা, বিয়ে করা, চিকিৎসাসেবা দেয়া, মামলা নেয়া, ছিঁচকে চোর থেকে সন্ত্রাসী গ্রেফতারসহ সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ যেন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন মশা কামড় দিলেও প্রধানমন্ত্রী হস্তেক্ষেপ করবেন বলে দলীয় নেতাকর্মীরা বিশ্বোস করেন এবং সেইভাবে তারা প্রচার করেন। এর ফলে যে গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তা কি সরকার দলীয়রা বোঝেন না? তারা জানেন না সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের ধোয়া তোলা মানে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, প্রশাসন তাদের স্ব স্ব কাজে নিষ্ঠাবান নয়- এমন একটি ধারণা জনমনে তৈরি হয়। পাশাপাশি জনমনে ধারণা তৈরি হয়েছে, এ দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ আস্থাভাজন নয়।

অন্যদিকে ইদানীং আরও একটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে- আদালতকে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে একের পর এক রুল জারি করতে হচ্ছে। ওমুককে এখনও গ্রেফতার করা হলো না কেন জানতে চেয়ে আদালতের রুল, তমুককে অপসারণ করা হলো না কেন জানতে চেয়ে রুল। পিরোজপুরে যুবলীগ নেতার দখল-কান্ডে হাইকোর্টের রুল। রাইফা হত্যায় কেন ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয় কেন- জানতে চেয়ে হাইকোর্টের রুল। তরুণীর শ্লীলতাহানিতে পুলিশকে কেন শাস্তি নয়- হাইকোর্টের রুল জারি। রিফাত হত্যা, হাইকোর্ট আসামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে সীমান্তে অ্যালার্ট জারির নির্দেশ। বিমানবন্দরে মশার উৎপাত; হাইকোর্টের রুল জারি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্বের কারণ জানতে চেয়ে আদালতের রুল জারি। একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠের সব কিছু যখন আদালত নজরদারিতে রাখে তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র ভালো নেই। ভালো নেই রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা, সেই সঙ্গে সমাজে মানুষের কর্মকান্ড। রাষ্ট্রযন্ত্র রাষ্ট্র চালাতে বেগ পাচ্ছে, সরকার হিমশিম খাচ্ছে।

বরগুনার কলেজ সড়কের ক্যালিঙ কিন্ডার গার্টেনের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে স্ত্রী আয়েশার সামনে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে মাদকাসক্ত সন্ত্রাসীরা। রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা ঘটনার প্রধান আসামি সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ছিঁচকে চোর ছিল। মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করতে সে চুরি ও পরে ছিনতাইয়ের কাজে লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে শুরু করে মাদক ব্যবসা। এরপর বিভিন্ন মহলের যোগসাজশে হয়ে উঠে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী। নয়নের বিরুদ্ধে মাদক, চুরি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে ১০টির বেশি মামলা রয়েছে। তার একটি গ্রুপও আছে। যার নাম- ‘বন্ড ০০৭’। বিখ্যাত হলিউড সিরিজ জেমস বন্ডের কোড নম্বর ‘জিরো জিরো সেভেন’ এর সঙ্গে মিল রেখে রাখা হয়েছে তার গ্রুপের নাম। এমন অসংখ্য গ্রুপ আছে বাংলার জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, গ্রাম, পাড়া, মহল্লাজুড়ে। আমরা ক’টার খবর জানি। একটি করে অপরাধ সংঘটিত হয় আর বের হয়ে আসে গ্রুপের নাম। অপর আসামি খুনি রিফাত ফরাজী মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন ও ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে যুক্ত ছিল। অতীতে তরিকুল ইসলাম নামে এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে সে। নানা ছুঁতোয় স্থানীয়দের ওপর হামলা, মারধর করা ছিল রিফাতের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অথচ উক্ত এলাকার সংসদ সদস্য একটি বেসরকারি টেলিভিশনের লাইভ প্রোগ্রামে বলেন, নয়ন বন্ড এবং রিফাত ফরাজী যে মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী ছিল তা তিনি জানেন না। এর চেয়ে অবিশ্বাস্য এর চেয়ে হাস্যকর এর চেয়ে অসত্য বক্তব্য আর কী হতে পারে। যে কথাটি বরগুনার আবালবৃদ্ধবনিতা জানেন, সেই কথাটি সবচেয়ে আগে তার জানার কথা, কারণ তিনি জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদÑ তিনি নাকি জানেন না। মানুষ রাজনীতিবিদের ওপর বিশ্বাস রাখবে কীভাবে। আমার সন্দেহ- ভদ্রলোক এও জানেন না তার এলাকায় কতজন গরিব আছে, কতজন বেকার আছে, কতজন ভোটার আছে, কোন পরিবার অর্থাভাবে আছে, শিক্ষা-চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত কতজন মানুষ এবং সর্বোপরি তার বাড়ির লোকজন তাকে কোনদৃষ্টিতে দেখেন! রিফাতকে যেভাবে কুপিয়ে মারা হলো তাতে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড মনে পড়ে যায়। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে বিশ্বজিতকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কেউ ছুটে আসেনি তাকে বাঁচাতে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই হত্যাকান্ড দেখছিল। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ২১ আসামির মধ্যে মাত্র ৪ জন এখন কারাগারে আছে। বাকি ১৭ জন হয় পলাতক, নয় বেকসুর খালাস। টিএসসির সামনের রাস্তায় কোপ খেয়ে পড়েছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়। প্রায় এক দশক আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একইভাবে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিলেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। অভিজিতের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার সময় তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী রাফিদা আহমেদ। রাফিদা আহমেদ লেখালেখি করেন বন্যা আহমেদ নামে। বন্যা আহমেদ সেদিন পারেননি ঘাতকের হাত থেকে ভালোবাসার মানুষটাকে বাঁচাতে। খিলগাঁও গোরানের একটি পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির পঞ্চম তলায় স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে থাকতেন নিলয় যার আসল নাম নীলাদ্রি চ্যাটার্জি। নিলয় আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতেন। বাসায় ঢুকে স্ত্রীর সামনেই কুপিয়ে মারা হয়েছিল নিলয় নীলকে। স্ত্রী আশা মনি আহাজারি করে বলেছিলেন, ‘এত হাজার হাজার লোক। আর আমি তখন এত চিৎকার করলাম, সবাইকে এত ডাকলাম, কেউ আগায়া আসেনি। এই দেশ কি আমার না? আমি কি অন্য দেশ থেকে এইখানে এসেছি?’

ঠিক একইভাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে একই কথাগুলো এখন বলেন নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা। বলেন, ‘আমার সামনেই সন্ত্রাসীরা আমার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমি শত চেষ্টা করেও তাকে রক্ষা করতে পারিনি। হামলার সময় কোন লোক এগিয়ে আসেনি।’ এতে বোঝা যায়, দেশের গভীরে পচন ধরে গেছে। এখন সবাই দাঁড়িয়ে থেকে হত্যার ঘটনা মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ছবি ও ভিডিও শেয়ার দেয়ার পর তাতে কয়টা লাইক কমেন্ট পড়ল তা দেখে ভীষণ উদ্বেলিত হয়। এ বঙ্গদেশে এখন আর কেউ বিপদে এগিয়ে আসে না বা এগিয়ে আসতে চায় না। বাঙালিরা পিঠ বাঁচিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তারা চিন্তা করে, আমি তো ভালো আছি। কোপ তো আমাকে দেয়নি। আগুন তো আমার ঘরে লাগেনি। অথচ আগামীকাল আগত কোপ যে তার ওপর তেড়ে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিয়েছে। সত্যি বলতে, বাঙালির আঁচলে যতক্ষণ আগুন না লাগে ততক্ষণ সে নড়েচড়ে বসে না। প্রকাশ্যে দিবালোকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজারে নূরানী আবাসিক এলাকায় অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর মায়ের চোখের সামনে চাপাতির আঘাতে খুন হন জুলহাস মান্নান। এর বিচার হয়নি! বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে একই অপরাধের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

পত্রিকা ঘেঁটে পাওয়া যায়, চলতি বছরের গত ২৬ দিনে ২২ জনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় ঠাকুরগাঁওয়ে ভাতিজা জীবনের ছুরিকাঘাতে আহত ফুফু তানজিনা আক্তারের রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয়। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় দুর্গানগর ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামে মা এবং ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যকে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ উপজেলায় ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেত্রী বিউটি আক্তার কুট্টিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজশাহীর মোহনপুরে পদ্ম বিলে ছাগল চরাতে গিয়ে দুই শিশু একটি লাশ দেখতে পায়। পরে জানা যায়, আসমা বেগম নামের এক গৃহবধূকে ধর্ষণের পর কুপিয়ে হত্যা করা লাশ ছিল ওটি। শায়েস্তাগঞ্জে স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী মুক্তিরানী দাসকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করার অভিযোগ উঠেছে। এ যেন এক কোপাকুপির দেশ। বৃষ্টির মতো কোপ এসে পড়ছে মানুষের শরীরে। তা নিয়ে লেখালেখি, মিছিল-মিটিং-মানববন্ধন হয়, ঝড়ো তর্ক-বিতর্ক হয়। অল্প কিছুদিন পর এটি ভুলে নতুন কোন ইস্যু নিয়ে শাহবাগের রাস্তায়, পত্রিকার পাতায় কর্মসূচি লেখালেখি হয়। এতে ঢাকা পড়ে যায় পুরাতন সব অন্যায়-অপরাধ এবং এসবের বিচার। অপরাধীরা মুখ টিপে হেসে নতুন কোন অপরাধে নেমে পড়ে। নরসিংদীর বীরপুরে ফুলন বর্মণ নামে এক কলেজছাত্রী দোকান থেকে কেক নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হামলার শিকার হন। বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছামাত্র পূর্ব থেকে ওতপেতে থাকা অজ্ঞাতনামা দুই দুর্বৃত্ত তার হাত ও মুখ চেপে পাশের নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। মৃত্যু হয় তার। এই মৃত্যুর মিছিলে আমরা সবাই একে একে করে পতিত হবো। কেননা এর জন্য আমরাই দায়ী। বিচারহীনতা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, গণনির্লিপ্ততা, নীরবতা, সিলেকটিভ মানবতা, দলীয়প্রীতি, গা বাঁচিয়ে চলা, ক্লীবতা বাংলাদেশকে আজ এ জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরোতে না পারলে, এ ধরনের কোপাকুপি, অপরাধ, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন চলবেই।

মাঝে মাঝে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে এত এত ত্বকী, তনু, রাজিব, ফুলন, নুসরাত, রিফাতের লাশের ওপর উন্নয়নের তকমা নিয়ে বাংলাদেশ তুমি কিভাবে দাঁড়িয়ে আছ?

[লেখক : প্রবন্ধ লেখক, কলামিস্ট

শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা, বাংলাদেশ]

a.adrianaritro@gmail.com