ব্যয় বৃদ্ধির বোঝা নিয়ে নতুন অর্থবছরে ভোক্তা

চাপে পড়বেন বিনিয়োগকারী

  • নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর
  • গ্যাসের দাম বৃদ্ধি
  • বাড়তি ফি দিতে হবে ট্রেড লাইসেন্সেও

ব্যয় বৃদ্ধির বোঝা নিয়ে শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষের নতুন অর্থবছর। বছরের শুরুতেই নতুন ভ্যাট আইনের চাপে পড়েছে ভোক্তা। কেননা নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই ভ্যাটের নতুন আইন কার্যকর হয়েছে। তার উপর বাজেটে ট্রেড লাইসেন্স ছয়গুণ বৃদ্ধি ও সঞ্চয়পত্রের উৎসেকর ৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ সরকারের কয়েকটি সিদ্ধান্ত নতুন উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষ উভয়েরই বাড়তি খরচের বোঝা বইতে হবে। অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর থেকেই সংসদের ভেতরে বাইরে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি উৎসে কর প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত তা কমানো হয়নি। এখানেই শেষ নয়, বাজেটের সিদ্ধান্ত অনুসারে নতুন বছরে টিআইএন ছাড়া সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিদ্যুৎ বিল দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গেলেও লাগবে ইলেকট্রনিক ট্যাক্সপেয়ার্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর)। জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে দলিলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের টিআইএন উল্লেখ করতে হবে। এসব সিদ্ধান্ত নতুন উদ্যোক্তাকে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে। এদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও গত তিন বছরের মতো একই রয়েছে করমুক্ত আয়সীমা। এতে মাসে ২০ হাজার ৮৩৪ টাকা নিট আয় থাকলেই একজন ব্যক্তিকে সরকারি কোষাগারে করের অর্থ জমা দিতে হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি ছিল বেসরকারি খাতের কিন্তু কমেনি। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। মোবাইল কলরেট ও স্মার্টফোনের ওপর বাড়তি কর আরোপে ইতোমধ্যেই মানুষকে গুনতে হচ্ছে পকেটের বাড়তি টাকা।

এতো কিছুর পর রোববার বাণিজ্যিক ও আবাসিক সবখাতের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করেছে সরকার। এ সিদ্ধান্ত শুধু ভোক্তার খরচের বোঝা বাড়িয়েছে তা নয় বরং নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতেও প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। বাড়বে পণ্যের দাম, পরিবহন খরচ, কৃষি পণ্যের খরচ। সার্বিকভাবে বাড়বে ব্যবসা পরিচালন খরচ। এতে শেষ পর্যন্ত খরচ বাড়বে সাধারণ মানুষেরই। কেননা এক দিকে সরাসরি গ্যাসের বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে অন্য দিকে পরোক্ষভাবে পরিবহন সেবা ও পণ্য কিনতেও গুনতে হবে বাড়তি খরচ। ফলে চলতি বছর দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ।

রোববার জাতীয় সংসদে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরে যে বাজেট পাস হয়েছে তার ৭২ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে পাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করছে সরকার। বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি। এই আয়ের সিংহ ভাগ ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে আদায় করা হবে এক লাখ ২৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৭ দশমিক ২১ শতাংশের মতো। এর মূলে রয়েছে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর। গতকাল থেকে সারাদেশে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইনে সব ধরনের কেনাবেচায় চার স্তরে ভ্যাট আদায় করা হবে। যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই দিতে হবে। অর্থাৎ ভ্যাটের বাড়তি চাপ শুরু হচ্ছে আজ থেকেই। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এছাড়া বড় বাজেট বাস্তাবায়নে বড় অঙ্কের টাকা শেষ পর্যন্ত ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদেরই যোগান দিতে হবে।

এদিকে বাজেটে ট্রেড লাইসেন্স করতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫ থেকে ৬ গুণ ফি বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ টাকার ফি ৫০০ টাকা আর ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব বাজেটে পাস হয়েছে। এটি ডুয়িং বিজনেস কস্ট (ব্যবসা শুরুর খরচ) বাড়িয়ে দিবে। যা নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, কিছু সিদ্ধান্ত বিবেচনা করে নিতে হয়। অনেক ছোট সিদ্ধান্ত বড় কিছু বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- ট্রেড লাইসেন্স ফি বৃদ্ধি। এটা করা হলে ডুয়িং বিজনেসে আরও পাঁচ ধাপ পিছিয়ে যাবে।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। এবারের বাজেটেও সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসরভোগীদের শেষ সম্বলের সুরক্ষা দেয়ার জন্য এটি সরকারের একটি বিশেষ উদ্যোগ। ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ আস্থার বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র। বাজেটে এর মুনাফা থেকে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়। শনিবার অর্থবিল পাস হয়ে গেলেও এটি কমানো হয়নি। ফলে বিনিয়োগের এ আস্থার জায়গাতেও ধাক্কা খেল স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসরভোগীদের পরিবার।

সরকারের নানা সিদ্ধান্তে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিবছরই বাড়ছে। বিশেষভাবে ঘরভাড়া, চিকিৎসা, খাবার, যাতায়াত, সন্তানের পড়ালেখার খরচ বেড়েই চলেছে। অথচ এসব খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আড়াই লাখ টাকা স্থির করা হয়েছিল, এবারও তাই। আয়কর আইন অনুযায়ী আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব মিলিয়ে বছরে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি প্রকৃত আয় থাকলে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই আয়কর পরিশোধ করতে হবে। আয়কর পরিশোধ বা রিটার্ন জমা না দিলে শাস্তি হিসেবে জেল-জরিমানার বিধান আছে। দুই লাখ ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয় আছে, এমন করদাতাদের বেশিরভাগই সাধারণ আয়ের মানুষ। বিভিন্ন রেয়াত ও সুবিধা বাদ দিয়ে তাদের নিট মাসিক আয় ২১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের চূড়ান্ত বাজেটেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী উপেক্ষিত হয়েছে। বাজেটের কর কাঠামো নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর নানাভাবে চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর সমাজের মধ্যবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর আঘাত করবে। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা। সঞ্চয়পত্র এবং বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে টিআইএন আদৌ কতটা প্রয়োজন আছে তা ভেবে দেখা দরকার ছিল। কারণ টিআইএন সবার থাকে না। বিত্তবান ও মধ্যবিত্তদের থাকে, গরিবদের থাকে না। এখন অনেক গরিব মানুষও বিদ্যুতের আওতায় আসছে। টিআইএন থাকলেই একটি ন্যূনতম আয়কর দেয়া লাগে। তারা আয়করের আওতায় আসার সক্ষমতা রাখে না। এটা যথাযথ বাস্তবায়ন হবে বলে আমি মনে করি না। এটা উদোর পি-ি বুদোর ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। বাজেটে মোবাইলফোনসহ ডিজিটাল সেবায় যেসব করারোপ করা হয়েছে তাতে শুধু মধ্যবিত্তেরই নয়, নিম্নবিত্তের ওপরও চাপ বাড়বে। এখন গৃহকর্মীরাও মোবাইলফোন ব্যবহার করে। তাদের ওপরও সারচার্জ বসানো কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখা দরকার ছিল। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি নানা মহল থেকে এসেছিল। কিন্তু তা অপরিবর্তিত থেকে গেল। মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও বাড়িভাড়া, পরিবহন ভাতা ও চিকিৎসা ভাতার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতির পরিমাণ আগের মতোই রাখা হয়েছে। খরচ বেড়ে গেলেও কর ছাড়ের হার একই থাকার কারণে দিন শেষে করদাতাদের উচ্চহারে কর পরিশোধ করতে হবে।

সমাজের বিভিন্ন অংশের আপত্তির মধ্যেই সব পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার, যা জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকেই কার্যকর হয়েছে। এক্ষেত্রে আবাসিকে বেড়েছে ১৭৫ টাকা এবং প্রতি ঘনমিটারে সড়ে ৩ টাকা। যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ টাকা থেকে বেড়ে ৪৩ টাকা হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প ও বাণিজ্যক খাতেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে, ব্যবসায়ীরাও তা তুলবেন দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে। শেষ বিচারে ভোক্তাদের পকেট থেকেই তা যাবে।

সার্বিক বিবেচনায় বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাবে ঘরে-বাইরে সবখানেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বা চাপের মধ্যে পড়বেন দেশের সাধারণ নাগরিকরা। কেননা, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের আয়ের বড় অংশই চলে যায় বাড়িভাড়া আর গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির মতো নাগরিক পরিষেবাগুলোর বিল দিতে দিতে। একদিকে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়া এবং এলপিজি গ্যাসের দাম না কমা দুইয়েরই প্রাথমিক শিকার হবে এই মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ। অন্যদিকে, যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়া এবং উৎপাদিত শিল্পপণ্যের দাম বাড়ার ধকলও বইতে হবে এই সাধারণ মানুষকেই। কারণ এ সবই সাধারণ নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। যা মূল্যস্ফীতিকে উষ্কে দেবে।

ইতোমধ্যেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে বিভিন্ন সচেতন মহল। আগামী রোববার এক দিনের হরতালও ডেকেছে বাম দল। গণফোরাম এক বিবৃতিতে বলেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে গণ-পরিবহনের ভাড়া বাড়বে, শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার প্রমাণ করল যে তারা জনগণের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করছে না। গ্যাসের যে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে তা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে গণফোরাম।

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০১৯ , ১৮ আষাঢ় ১৪২৫, ২৮ শাওয়াল ১৪৪০

ব্যয় বৃদ্ধির বোঝা নিয়ে নতুন অর্থবছরে ভোক্তা

চাপে পড়বেন বিনিয়োগকারী

রোকন মাহমুদ

  • নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর
  • গ্যাসের দাম বৃদ্ধি
  • বাড়তি ফি দিতে হবে ট্রেড লাইসেন্সেও

ব্যয় বৃদ্ধির বোঝা নিয়ে শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষের নতুন অর্থবছর। বছরের শুরুতেই নতুন ভ্যাট আইনের চাপে পড়েছে ভোক্তা। কেননা নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই ভ্যাটের নতুন আইন কার্যকর হয়েছে। তার উপর বাজেটে ট্রেড লাইসেন্স ছয়গুণ বৃদ্ধি ও সঞ্চয়পত্রের উৎসেকর ৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ সরকারের কয়েকটি সিদ্ধান্ত নতুন উদ্যোক্তা ও সাধারণ মানুষ উভয়েরই বাড়তি খরচের বোঝা বইতে হবে। অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর থেকেই সংসদের ভেতরে বাইরে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি উৎসে কর প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত তা কমানো হয়নি। এখানেই শেষ নয়, বাজেটের সিদ্ধান্ত অনুসারে নতুন বছরে টিআইএন ছাড়া সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিদ্যুৎ বিল দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গেলেও লাগবে ইলেকট্রনিক ট্যাক্সপেয়ার্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর)। জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে দলিলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের টিআইএন উল্লেখ করতে হবে। এসব সিদ্ধান্ত নতুন উদ্যোক্তাকে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে। এদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও গত তিন বছরের মতো একই রয়েছে করমুক্ত আয়সীমা। এতে মাসে ২০ হাজার ৮৩৪ টাকা নিট আয় থাকলেই একজন ব্যক্তিকে সরকারি কোষাগারে করের অর্থ জমা দিতে হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি ছিল বেসরকারি খাতের কিন্তু কমেনি। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। মোবাইল কলরেট ও স্মার্টফোনের ওপর বাড়তি কর আরোপে ইতোমধ্যেই মানুষকে গুনতে হচ্ছে পকেটের বাড়তি টাকা।

এতো কিছুর পর রোববার বাণিজ্যিক ও আবাসিক সবখাতের গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করেছে সরকার। এ সিদ্ধান্ত শুধু ভোক্তার খরচের বোঝা বাড়িয়েছে তা নয় বরং নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতেও প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। বাড়বে পণ্যের দাম, পরিবহন খরচ, কৃষি পণ্যের খরচ। সার্বিকভাবে বাড়বে ব্যবসা পরিচালন খরচ। এতে শেষ পর্যন্ত খরচ বাড়বে সাধারণ মানুষেরই। কেননা এক দিকে সরাসরি গ্যাসের বাড়তি মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে অন্য দিকে পরোক্ষভাবে পরিবহন সেবা ও পণ্য কিনতেও গুনতে হবে বাড়তি খরচ। ফলে চলতি বছর দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ।

রোববার জাতীয় সংসদে ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরে যে বাজেট পাস হয়েছে তার ৭২ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে পাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করছে সরকার। বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ১৯ শতাংশের বেশি। এই আয়ের সিংহ ভাগ ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে আদায় করা হবে এক লাখ ২৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৭ দশমিক ২১ শতাংশের মতো। এর মূলে রয়েছে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর। গতকাল থেকে সারাদেশে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইনে সব ধরনের কেনাবেচায় চার স্তরে ভ্যাট আদায় করা হবে। যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই দিতে হবে। অর্থাৎ ভ্যাটের বাড়তি চাপ শুরু হচ্ছে আজ থেকেই। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এছাড়া বড় বাজেট বাস্তাবায়নে বড় অঙ্কের টাকা শেষ পর্যন্ত ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদেরই যোগান দিতে হবে।

এদিকে বাজেটে ট্রেড লাইসেন্স করতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৫ থেকে ৬ গুণ ফি বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ টাকার ফি ৫০০ টাকা আর ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব বাজেটে পাস হয়েছে। এটি ডুয়িং বিজনেস কস্ট (ব্যবসা শুরুর খরচ) বাড়িয়ে দিবে। যা নতুন উদ্যোগের ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, কিছু সিদ্ধান্ত বিবেচনা করে নিতে হয়। অনেক ছোট সিদ্ধান্ত বড় কিছু বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন- ট্রেড লাইসেন্স ফি বৃদ্ধি। এটা করা হলে ডুয়িং বিজনেসে আরও পাঁচ ধাপ পিছিয়ে যাবে।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। এবারের বাজেটেও সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসরভোগীদের শেষ সম্বলের সুরক্ষা দেয়ার জন্য এটি সরকারের একটি বিশেষ উদ্যোগ। ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ আস্থার বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র। বাজেটে এর মুনাফা থেকে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়। শনিবার অর্থবিল পাস হয়ে গেলেও এটি কমানো হয়নি। ফলে বিনিয়োগের এ আস্থার জায়গাতেও ধাক্কা খেল স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসরভোগীদের পরিবার।

সরকারের নানা সিদ্ধান্তে জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিবছরই বাড়ছে। বিশেষভাবে ঘরভাড়া, চিকিৎসা, খাবার, যাতায়াত, সন্তানের পড়ালেখার খরচ বেড়েই চলেছে। অথচ এসব খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আড়াই লাখ টাকা স্থির করা হয়েছিল, এবারও তাই। আয়কর আইন অনুযায়ী আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব মিলিয়ে বছরে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি প্রকৃত আয় থাকলে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই আয়কর পরিশোধ করতে হবে। আয়কর পরিশোধ বা রিটার্ন জমা না দিলে শাস্তি হিসেবে জেল-জরিমানার বিধান আছে। দুই লাখ ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয় আছে, এমন করদাতাদের বেশিরভাগই সাধারণ আয়ের মানুষ। বিভিন্ন রেয়াত ও সুবিধা বাদ দিয়ে তাদের নিট মাসিক আয় ২১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা।

এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের চূড়ান্ত বাজেটেও মধ্যবিত্ত শ্রেণী উপেক্ষিত হয়েছে। বাজেটের কর কাঠামো নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর নানাভাবে চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর উৎসে কর সমাজের মধ্যবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর আঘাত করবে। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা। সঞ্চয়পত্র এবং বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে টিআইএন আদৌ কতটা প্রয়োজন আছে তা ভেবে দেখা দরকার ছিল। কারণ টিআইএন সবার থাকে না। বিত্তবান ও মধ্যবিত্তদের থাকে, গরিবদের থাকে না। এখন অনেক গরিব মানুষও বিদ্যুতের আওতায় আসছে। টিআইএন থাকলেই একটি ন্যূনতম আয়কর দেয়া লাগে। তারা আয়করের আওতায় আসার সক্ষমতা রাখে না। এটা যথাযথ বাস্তবায়ন হবে বলে আমি মনে করি না। এটা উদোর পি-ি বুদোর ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। বাজেটে মোবাইলফোনসহ ডিজিটাল সেবায় যেসব করারোপ করা হয়েছে তাতে শুধু মধ্যবিত্তেরই নয়, নিম্নবিত্তের ওপরও চাপ বাড়বে। এখন গৃহকর্মীরাও মোবাইলফোন ব্যবহার করে। তাদের ওপরও সারচার্জ বসানো কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখা দরকার ছিল। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর দাবি নানা মহল থেকে এসেছিল। কিন্তু তা অপরিবর্তিত থেকে গেল। মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও বাড়িভাড়া, পরিবহন ভাতা ও চিকিৎসা ভাতার ক্ষেত্রে কর অব্যাহতির পরিমাণ আগের মতোই রাখা হয়েছে। খরচ বেড়ে গেলেও কর ছাড়ের হার একই থাকার কারণে দিন শেষে করদাতাদের উচ্চহারে কর পরিশোধ করতে হবে।

সমাজের বিভিন্ন অংশের আপত্তির মধ্যেই সব পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার, যা জুলাইয়ের প্রথম দিন থেকেই কার্যকর হয়েছে। এক্ষেত্রে আবাসিকে বেড়েছে ১৭৫ টাকা এবং প্রতি ঘনমিটারে সড়ে ৩ টাকা। যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের (সিএনজি) দাম থেকে প্রতি ঘনমিটারে ৩৮ টাকা থেকে বেড়ে ৪৩ টাকা হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার, শিল্প ও বাণিজ্যক খাতেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে, ব্যবসায়ীরাও তা তুলবেন দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে। শেষ বিচারে ভোক্তাদের পকেট থেকেই তা যাবে।

সার্বিক বিবেচনায় বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাবে ঘরে-বাইরে সবখানেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বা চাপের মধ্যে পড়বেন দেশের সাধারণ নাগরিকরা। কেননা, মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের আয়ের বড় অংশই চলে যায় বাড়িভাড়া আর গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির মতো নাগরিক পরিষেবাগুলোর বিল দিতে দিতে। একদিকে আবাসিক সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়া এবং এলপিজি গ্যাসের দাম না কমা দুইয়েরই প্রাথমিক শিকার হবে এই মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষ। অন্যদিকে, যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়া এবং উৎপাদিত শিল্পপণ্যের দাম বাড়ার ধকলও বইতে হবে এই সাধারণ মানুষকেই। কারণ এ সবই সাধারণ নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। যা মূল্যস্ফীতিকে উষ্কে দেবে।

ইতোমধ্যেই গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে বিভিন্ন সচেতন মহল। আগামী রোববার এক দিনের হরতালও ডেকেছে বাম দল। গণফোরাম এক বিবৃতিতে বলেছে, গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে গণ-পরিবহনের ভাড়া বাড়বে, শিল্পোৎপাদনে খরচ বাড়বে। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার প্রমাণ করল যে তারা জনগণের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করছে না। গ্যাসের যে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে তা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে গণফোরাম।