কাজ ফেলে চলে যাচ্ছে সকার

বাপেক্সের গ্যাস উত্তোলনে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা

গ্যাসের কূপ খননের কাজ শেষ না করেই বাপেক্সের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করার আবেদন জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে চাইছে আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি সকার (দ্য স্টেট অয়েল কোম্পানি অব দ্য আজারবাইজান রিপাবলিক)। বাপেক্সের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সকারের তিনটি কূপ খননের কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় করে তারা মাত্র একটি কূপ (খাগড়াছড়ির সেমুতাং গ্যাস ক্ষেত্রে) খনন করেছে। তবে সেখানে গ্যাসের সন্ধান পায়নি। এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও জামালপুরের মাদারগঞ্জে দুটি কূপ খননের জন্য কোম্পানিটি চুক্তিবদ্ধ ছিল। এই মুহূর্তে সকারের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন হলে বাপেক্সের গ্যাস আহরণ কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হবে।

বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের (জিডিএফ) অর্থায়নে বাপেক্স ১০টি প্রকল্পে অধীন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০’-এর আওতায় ২০১৮ সালের মধ্যে ২৮টি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৩টি অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য বিভাজিত তিনটি গ্রুপের মধ্যে গ্রুপ ১-এর অধীন সেমুতাং সাউথ-১, বেগমগঞ্জ-৪ ও মাদারগঞ্জ ১- এ ৩টি কূপ খননের লক্ষ্যে সকার এবং বাপেক্সের মধ্যে ২০১৭ সালের জুলাইতে চুক্তি হয়।

জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, তুলনামূলকভাবে সকারের তেল-গ্যাস উত্তোলনের খরচ কম হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা সকারকে কাজ দিতে আগহী হয়। ওই সময় সংসদ সচিবালয়ের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হকের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আজারবাইজান সফর করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন তৎকালীন জ্বালানি সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরীসহ বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলাম, লেজিসলেটিভ ও সংসদ, অর্থ, জ্বালানি বিভাগ ও বাপেক্সের কর্মকর্তারা।

‘সকার’ যখন তিনটি কূপ খননের কাজ পায়, তখন সেটি সরকারি-বেসরকারি কোন কোন মহলে ব্যাপক আলোচনা ও প্রশংসার বিষয় হয়েছিল। কারণ এ দেশে কর্মরত অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির তুলনায় সকারের চুক্তিমূল্য ছিল দৃশ্যত কম। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অন্যান্য বিদেশি কোম্পনি যেখানে প্রতিটি কূপ খননের জন্য গড়ে ১৫ থেকে ১৮ মিলিয়ন ডলার নেয়, সেখানে সকার চেয়েছে ১১ মিলিয়ন ডলার। তবে ওই দামে যখন বাপেক্স সকারের সঙ্গে চুক্তি করে, তখন অভিজ্ঞ মহলের অনেকে বলেছিলেন, এই দামে কোন বিদেশি কোম্পানির পক্ষে কূপ খনন করা সম্ভব নয়। কারণ এই দামে কাজ করলে হয় লোকসান গুনতে হবে, অন্যথায় কাজ ফেলে চলে যাবে। কার্যত হলোও তা-ই।

সকার অবশ্য চুক্তি বাতিল করার আবেদনে কারণ হিসেবে তাদের পাওনা পরিশোধে বাপেক্সের বিলম্বের অজুহাত দেখিয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় সংবাদের।

একাধিক কর্মকর্তার মতে, এটি নিছকই অজুহাত। তারা বলেন, সরকারি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক কোম্পানির বিল পরিশোধেই কোন কোন ক্ষেত্রে বিলম্ব হতে পারে। সেটি দু’পক্ষই বোঝে এবং সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করে। সকার আসলে কাজটি করতে চায় না বলেই অজুহাত খাড়া করেছে। এক কর্মকর্তা জানান, সেমুতাং কূপের জন্য সকারকে ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গ্যাস পাওয়া, না পাওয়া বিষয় নয়। চুক্তি অনুয়ায়ী টাকা দিতেই হয়।

বাপেক্সের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি সকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাপেক্সের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। বাকি কাজ করার জন্য তাদের অনুরোধ জানিয়েছে বাপেক্স। তবে আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানি তাদের কথায় অনড় রয়েছে। সূত্র বলছে, সকার বেগমগঞ্জও কিছু কাজ করেছে। এ বাবদ ৫০ কোটি টাকা দাবি করছেন তারা।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চুক্তি বাতিল করে চলে যাওয়ার আগে সকার বেগমগঞ্জ কূপের প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য যে ব্যয় দাবি করেছে, এর কতটা তাদের প্রাপ্যÑ তা অবশ্যই হিসাব-নিকাশ করে দেখতে হবে। তাছাড়া সেমুতাং কূপটি খননের জন্য তাদের সময় নির্ধারিত ছিল ১২০ দিন। কিন্তু তারা লাগিয়েছেন প্রায় ২৫০ দিন। কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিও তারা সরবরাহ করতে পারেননি। খননযন্ত্রের (রিগ) ‘টপ ড্রাইভ’সহ কিছু অপরিহার্য় যন্ত্রপাতি বাপেক্স তাদের সরবরাহ করেছে। এখন এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেনা-পাওনার হিসাব চূড়ান্ত করতে হবে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্র মতে, সেমুতাং একটি চলমান গ্যাস ক্ষেত্র। সেখানে অন্য কূপ থেকে গ্যাস তোলা হচ্ছে। এ রকম একটি ক্ষেত্রে কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়ার ঘটনা প্রায় অস্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও কেন গ্যাস পাওয়া গেল না, এক্ষেত্রে কোম্পানিটির কাজে কোন কারিগরি ত্রুটি ছিল কিনাÑ এসবও খতিয়ে দেখতে হবে।

জ্বালানি খাতের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, এমনকি সকারের ওয়েবসাইটেও দেখা গেছে, কূপ খননকার্যে কোম্পানিটির রেকর্ড তেমন ভালো নয়। কাস্পিয়ান সাগরে কূপ খনন করতে গিয়ে তিন বছরে (২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬) সকার ৫টি দুর্ঘটনা (ব্লো-আউট) ঘটিয়েছে। এতে তাদের কয়েক কর্মী মারা গেছেন এবং অনেকে আহত হয়েছেন।

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০১৯ , ১৮ আষাঢ় ১৪২৫, ২৮ শাওয়াল ১৪৪০

কাজ ফেলে চলে যাচ্ছে সকার

বাপেক্সের গ্যাস উত্তোলনে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা

ফয়েজ আহমেদ তুষার

গ্যাসের কূপ খননের কাজ শেষ না করেই বাপেক্সের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করার আবেদন জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিতে চাইছে আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি সকার (দ্য স্টেট অয়েল কোম্পানি অব দ্য আজারবাইজান রিপাবলিক)। বাপেক্সের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সকারের তিনটি কূপ খননের কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সময় ব্যয় করে তারা মাত্র একটি কূপ (খাগড়াছড়ির সেমুতাং গ্যাস ক্ষেত্রে) খনন করেছে। তবে সেখানে গ্যাসের সন্ধান পায়নি। এরপর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও জামালপুরের মাদারগঞ্জে দুটি কূপ খননের জন্য কোম্পানিটি চুক্তিবদ্ধ ছিল। এই মুহূর্তে সকারের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন হলে বাপেক্সের গ্যাস আহরণ কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হবে।

বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের (জিডিএফ) অর্থায়নে বাপেক্স ১০টি প্রকল্পে অধীন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০’-এর আওতায় ২০১৮ সালের মধ্যে ২৮টি কূপ খননের উদ্যোগ নেয়। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৩টি অনুসন্ধান কূপ খননের জন্য বিভাজিত তিনটি গ্রুপের মধ্যে গ্রুপ ১-এর অধীন সেমুতাং সাউথ-১, বেগমগঞ্জ-৪ ও মাদারগঞ্জ ১- এ ৩টি কূপ খননের লক্ষ্যে সকার এবং বাপেক্সের মধ্যে ২০১৭ সালের জুলাইতে চুক্তি হয়।

জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, তুলনামূলকভাবে সকারের তেল-গ্যাস উত্তোলনের খরচ কম হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা সকারকে কাজ দিতে আগহী হয়। ওই সময় সংসদ সচিবালয়ের সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হকের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আজারবাইজান সফর করে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন তৎকালীন জ্বালানি সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরীসহ বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলাম, লেজিসলেটিভ ও সংসদ, অর্থ, জ্বালানি বিভাগ ও বাপেক্সের কর্মকর্তারা।

‘সকার’ যখন তিনটি কূপ খননের কাজ পায়, তখন সেটি সরকারি-বেসরকারি কোন কোন মহলে ব্যাপক আলোচনা ও প্রশংসার বিষয় হয়েছিল। কারণ এ দেশে কর্মরত অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির তুলনায় সকারের চুক্তিমূল্য ছিল দৃশ্যত কম। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অন্যান্য বিদেশি কোম্পনি যেখানে প্রতিটি কূপ খননের জন্য গড়ে ১৫ থেকে ১৮ মিলিয়ন ডলার নেয়, সেখানে সকার চেয়েছে ১১ মিলিয়ন ডলার। তবে ওই দামে যখন বাপেক্স সকারের সঙ্গে চুক্তি করে, তখন অভিজ্ঞ মহলের অনেকে বলেছিলেন, এই দামে কোন বিদেশি কোম্পানির পক্ষে কূপ খনন করা সম্ভব নয়। কারণ এই দামে কাজ করলে হয় লোকসান গুনতে হবে, অন্যথায় কাজ ফেলে চলে যাবে। কার্যত হলোও তা-ই।

সকার অবশ্য চুক্তি বাতিল করার আবেদনে কারণ হিসেবে তাদের পাওনা পরিশোধে বাপেক্সের বিলম্বের অজুহাত দেখিয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় সংবাদের।

একাধিক কর্মকর্তার মতে, এটি নিছকই অজুহাত। তারা বলেন, সরকারি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক কোম্পানির বিল পরিশোধেই কোন কোন ক্ষেত্রে বিলম্ব হতে পারে। সেটি দু’পক্ষই বোঝে এবং সমঝোতার মাধ্যমে কাজ করে। সকার আসলে কাজটি করতে চায় না বলেই অজুহাত খাড়া করেছে। এক কর্মকর্তা জানান, সেমুতাং কূপের জন্য সকারকে ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। গ্যাস পাওয়া, না পাওয়া বিষয় নয়। চুক্তি অনুয়ায়ী টাকা দিতেই হয়।

বাপেক্সের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি সকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাপেক্সের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। বাকি কাজ করার জন্য তাদের অনুরোধ জানিয়েছে বাপেক্স। তবে আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানি তাদের কথায় অনড় রয়েছে। সূত্র বলছে, সকার বেগমগঞ্জও কিছু কাজ করেছে। এ বাবদ ৫০ কোটি টাকা দাবি করছেন তারা।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চুক্তি বাতিল করে চলে যাওয়ার আগে সকার বেগমগঞ্জ কূপের প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য যে ব্যয় দাবি করেছে, এর কতটা তাদের প্রাপ্যÑ তা অবশ্যই হিসাব-নিকাশ করে দেখতে হবে। তাছাড়া সেমুতাং কূপটি খননের জন্য তাদের সময় নির্ধারিত ছিল ১২০ দিন। কিন্তু তারা লাগিয়েছেন প্রায় ২৫০ দিন। কূপ খননের জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতিও তারা সরবরাহ করতে পারেননি। খননযন্ত্রের (রিগ) ‘টপ ড্রাইভ’সহ কিছু অপরিহার্য় যন্ত্রপাতি বাপেক্স তাদের সরবরাহ করেছে। এখন এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেনা-পাওনার হিসাব চূড়ান্ত করতে হবে।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্র মতে, সেমুতাং একটি চলমান গ্যাস ক্ষেত্র। সেখানে অন্য কূপ থেকে গ্যাস তোলা হচ্ছে। এ রকম একটি ক্ষেত্রে কূপ খনন করে গ্যাস না পাওয়ার ঘটনা প্রায় অস্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও কেন গ্যাস পাওয়া গেল না, এক্ষেত্রে কোম্পানিটির কাজে কোন কারিগরি ত্রুটি ছিল কিনাÑ এসবও খতিয়ে দেখতে হবে।

জ্বালানি খাতের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, এমনকি সকারের ওয়েবসাইটেও দেখা গেছে, কূপ খননকার্যে কোম্পানিটির রেকর্ড তেমন ভালো নয়। কাস্পিয়ান সাগরে কূপ খনন করতে গিয়ে তিন বছরে (২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬) সকার ৫টি দুর্ঘটনা (ব্লো-আউট) ঘটিয়েছে। এতে তাদের কয়েক কর্মী মারা গেছেন এবং অনেকে আহত হয়েছেন।