নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে

মোহাম্মদ শাহজাহান

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে নানামুখী বিতর্ক শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন মহাজোটের একজন নেতা বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি মসজিদ থেকে ঘোষণা দিয়েও ভোটারদের কেন্দ্রে নেয়া যায়নি।’ এ ব্যাপারে সবচেয়ে কঠিন মন্তব্যটি করেছেন একজন নির্বাচন কমিশনার। স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত লেখক ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার ৫ ধাপের উপজেলা নির্বাচন শেষে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতাকে অশনিসংকেত হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এই প্রবণতা জাতিকে গভীর খাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।’ ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিএনপির একজন সদস্য ওই নির্বাচনকে ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সংসদ নির্বাচনের অল্প কিছুদিন পর সারা দেশে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ৩০টির বেশি উপজেলায় উল্লেখ করার মতো কোন ভোটই হয়নি। এ বছর প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ফলে এ নির্বাচন মোটেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি। ৫ ধাপের এ নির্বাচনে ৪৮০টি উপজেলার মধ্যে অন্তত ৩৩টিতে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের সব পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতি ধাপেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কম। এই ৩৩টি উপজেলায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ভোটাররা তাদের মূল্যবান রায় দিতে বঞ্চিত থাকলেন। তবে চতুর্থ ধাপে সর্বোচ্চ ১৫টি উপজেলায় এই তিন গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি। তাছাড়া প্রথম ধাপে ৩টি, দ্বিতীয় ধাপে ৬টি, তৃতীয় ধাপে ৬টি এবং সর্বশেষ ৫ম ধাপে উপজেলায় ওই শীর্ষ ৩ পদে দল মনোনীত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এই ৩৩টি উপজেলার মধ্যে নাটোর সদর, নওগাঁ সদর, পাবনা সদর, ফরিদপুর সদর, ভোলা সদর, কুমিল্লার সদর আদর্শ উপজেলা এবং সদর দক্ষিণ অন্যতম।

শত বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশ তথা এ ভারত উপমহাদেশের মানুষ আগা-গোড়াই গণতন্ত্রপ্রিয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬ এর গণভোটে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পক্ষেই ভোট দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পরে বাঙালিরা বুঝে যায় শাসক বদল হলেও শোষণ বদলে যায়নি। ব্রিটিশদের উপনিবেশ থেকে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠী ও সামরিক জান্তা পাকিস্তানের দুই যুগে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হতে দেয়নি। পাকিস্তানের ইতিহাসে ২৩ বছরের মাথায় ১৯৭০ সালে মাত্র একবারই জাতীয়ভিত্তিক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও বিজয়ী দলের কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার ওপর সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ ’৭২-এর সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৫ আগস্ট ’৭৫ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাভাবিক রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়া হয়। প্রায় ১৫ বছর জিয়া-এরশাদের স্বৈরশাসন কায়েম থাকার পর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু। বিএনপি ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। ওই সময় মাগুরা-বগুড়া উপনির্বাচনে বিএনপি কারচুপির মাধ্যমে বিজয়ী হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ শেষে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

আওয়ামী লীগ জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। একদলীয় ও একতরফা নির্বাচনে বিএনপি সংসদের সব আসনে জয়ী হয়। নির্বাচনের ৮ দিন পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দেয়ার দাবিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৮ মার্চ থেকে সর্বাত্মক লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অসহযোগের একাদশ দিন ১৯ মার্চ নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত এবং সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। ওই দিন শেখ হাসিনার বাসভবনকে লক্ষ্য করে কে বা কারা গুলি চালায়। ২২ মার্চ সেনাবাহিনী নামিয়েও খালেদা সরকার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। আন্দোলনের সময়ে প্রায় প্রতিদিন কয়েকজন করে লোক নিহত হয়। ২৯ মার্চ ছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। অবশেষে অসহযোগের ২৩তম দিনে ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। শেখ হাসিনা প্রত্যাহার করেন অসহযোগ আন্দোলন। রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দেন এবং বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। ৫ এপ্রিল পদত্যাগ করেন সিইসি একেএম সাদেক। ১২ জুনের ভোটে ১৪৬ আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিএনপি ১১৬, জাতীয় পার্টি ৩২ ও জামায়াত পায় ৩ আসন। ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জাতির জনক হত্যার ২১ বছর পর।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে নিয়ে খালেদা জিয়ার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ৫ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সংবিধান লঙ্ঘন করে খালেদা জিয়া বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহাম্মদকেই একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে বারবার সংবিধান লঙ্ঘনসহ যত অপকর্ম এদেশে হয়েছে এর সবগুলোর মূলে কোন না কোনভাবে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া যুক্ত রয়েছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নেন শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি এবং একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি ইয়াজউদ্দিন পুনরায় খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় বসাতে অপতৎপরতা শুরু করেন। ২১ জানুয়ারি (২০০৭) অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নিজ দল বিএনপিকে পুনরায় ক্ষমতায় নেয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ২০০৬ এর ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত ৪ উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। এত কিছুর পরেও শুধু দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার স্বার্থে শেখ হাসিনা ২১ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়ার সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু বিএনপিকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি সেনা মোতায়েন, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়াসহ কতগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যেটা আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল মেনে নেয়নি। অবশেষে শেখ হাসিনা পল্টনের বিশাল জনসভায় ‘ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচন নয়’ ঘোষণা করে ১৪ জানুয়ারি বঙ্গভবন লাগাতার ঘেরাও শুরু, ১৪-১৫ বঙ্গভবনসহ সারা দেশে অবরোধ, ১৭-১৮ সর্বাত্মক হরতাল এবং ২১-২২ সর্বাত্মক হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন-ভার্সেস আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনড় পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দেশ নিশ্চিতভাবেই অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হয়। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সেনাবাহিনী প্রধান পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়তে রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করেন। নির্বাচন স্থগিত এবং রাতে কার্ফু জারির ঘোষণা দেন রাষ্ট্রপতি। পরদিন ১২ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমদ প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর স্মরণকালের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী মহাজোট সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন চক্র পশ্চাদপসরণ করে। মহাজোট সরকারের ৫ বছর মেয়াদের পর নির্বাচন হয় ২০১৪ সােেলর ৫ জানুয়ারি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ক্ষ্যান্ত ছিলেন না। ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে ম্যাডাম আন্দোলনের নামে পৈশাচিক ও হিংসাশ্রয়ী পথ বেছে নেন। মানুষ দেখেছে নির্বাচনের আগে রাজপথে নিরীহ মানুষকে হত্যাসহ জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে কীভাবে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি-জামায়াতের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যা করেও নির্বাচন বন্ধ রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ওই সময় মহাজোটের অন্যতম শরীক দল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক এরশাদ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যথাযথভাবে না হতে কলকাঠি নাড়েন। ওই অবস্থায় বহুরূপী এরশাদকে সিএমএইচ-এ এক প্রকার বন্দি রেখে খালেদার সন্ত্রাসী অপতৎপরতার মধ্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আয়োজন করা হয়।

সর্বশেষ ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারেও বিএনপি টালবাহানা করে। এই নির্বাচনে না গেলে বিএনপি খ-বিখ- হয়ে এমন দুরবস্থায় পতিত হতো, যেখান থেকে ফিরে আসার কোন সুযোগ থাকত না। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও সংস্থা নানামুখী অভিযোগ করে আসছে। সংসদে যোগ দেয়া বিএনপির এমপিরা বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো কোন নির্বাচন অতীতে হয়নি। এটি ছিল রাতের নির্বাচন। যে কারণে এই সংসদকে বলা হচ্ছে মধ্যরাতের সংসদ।’ ২৫ জুন বিএনপি দলীয় এমপি হারুনুর রশিদ সংসদে বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতিসংঘ, টিআইবি, যুক্তরাষ্ট্র, নিউইয়র্ক টাইমস, দিল্লির গবেষক-বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। যে সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেই সংসদ নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট ভর্তি করা হয়, আর পরদিন তা গণনা করা হয়।’

সর্বশেষ ৩০ জুন একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬১ শতাংশ কেন্দ্রে ৮০-শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েছে। অন্তত ২১১ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে শত ভাগ। ৩০০ আসনের ৪০ হাজার ১৫৫ কেন্দ্রের মধ্যে ২৪ হাজার ৪৩৭টি কেন্দ্রে ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে।’ ২৭ জুন ইসির ওয়েবসাইটে এ ফল প্রকাশ করা হয়। এদিকে মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ১৯ জুন সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। উপজেলা নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অনুপস্থিতি থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ, রোগ এখন উপজেলা নির্বাচন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। নির্বাচন ও সামগ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে জনমনে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ মেনন বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ দেশের নির্বাচনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে রাজনৈতিক দল শুধু নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবে। এটা সবার জন্য যেমন, আওয়ামী লীগের জন্যও প্রযোজ্য।

জনগণের নির্বাচনের প্রতি চরম অনাগ্রহকে অশনিসংকেত হিসেবে মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘নির্বাচনবিমুখতা জাতিকে গভীর খাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের অনিশ্চিত গন্তব্যে এখন বাংলাদেশ। এ অবস্থা কখনও কারও কাম্য হতে পারে না। এবারের উপজেলা নির্বাচনে সবচেয়ে আশঙ্কার দিক হচ্ছে ভোটের ব্যাপারে জনগণের চরম অনাগ্রহ। একটি গণতান্ত্রিক দেশ ও জাতির জন্য এটা অশনিসংকেত। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। আমরা ক্রমাগত একতরফা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যা গণতন্ত্রের জন্য অনভিপ্রেত।’ ৫ ধাপের উপজেলা নির্বাচন শেষে ১৯ জুন ইসি কার্যালয়ে মাহবুব তালুকদার ‘উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে আমার কথা’ শীর্ষক একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের পড়ে শোনান। নির্বাচন কেমন হয়েছে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে পূর্বে আমি যা বলেছিলাম, এখনও তা-ই বলব। আপনারা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞেস করলে এর উত্তর পেয়ে যাবেন। সাংবিধানিক পদে থেকে এভাবে বক্তব্য দিতে পারেন কি-নাÑ এর জবাবে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমি সংবিধান রক্ষা করার শপথ নিয়েছি। আমি যদি দেখি, সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে তাহলে আমি চুপ করে থাকব কেন? আমি শুধু চিত্র তুলে ধরেছি।’

নির্বাচন বিষয়ে রাশেদ খান মেনন এবং মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্যই সংগ্রাম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার প্রতি লোভ থাকলে বঙ্গবন্ধুকে ১২ বছর জেলে থাকতে হতো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০ সালের নির্বাচনের বিজয়ী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করলে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৪ মাস পর ১৯৭২-এর ৭ মার্চ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। সংকট ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য সাময়িক সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধু দেশের সব দল নিয়ে জাতীয় দল বাকশাল গঠন করেছিলেন। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করেন। স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালে দুদিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু দেশে সংসদীয় পদ্ধতি কায়েম করেন। ১৯৯১ সালে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যেতে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বাধ্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ২০০৭ সালে লড়াই করে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না এলে সেনাসমর্থিত সরকার ৫/১০ বছর ক্ষমতা দখল করে রাখতে পারত। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচন না করলে দেশে আবার অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা দখল করত। নির্বাচনকে আবার যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে জননেত্রীর কোন বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে দেশে আগামী দিনগুলোতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

৩০ জুন ২০১৯

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com

সম্পাদক, বাংলাবার্তা

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০১৯ , ১৮ আষাঢ় ১৪২৫, ২৮ শাওয়াল ১৪৪০

নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে

মোহাম্মদ শাহজাহান

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে নানামুখী বিতর্ক শুরু হয়েছে। ক্ষমতাসীন মহাজোটের একজন নেতা বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি মসজিদ থেকে ঘোষণা দিয়েও ভোটারদের কেন্দ্রে নেয়া যায়নি।’ এ ব্যাপারে সবচেয়ে কঠিন মন্তব্যটি করেছেন একজন নির্বাচন কমিশনার। স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত লেখক ও পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার ৫ ধাপের উপজেলা নির্বাচন শেষে ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতাকে অশনিসংকেত হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এই প্রবণতা জাতিকে গভীর খাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।’ ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিএনপির একজন সদস্য ওই নির্বাচনকে ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’ বলে উল্লেখ করেছেন।

সংসদ নির্বাচনের অল্প কিছুদিন পর সারা দেশে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ৩০টির বেশি উপজেলায় উল্লেখ করার মতো কোন ভোটই হয়নি। এ বছর প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপিসহ নিবন্ধিত বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ফলে এ নির্বাচন মোটেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি। ৫ ধাপের এ নির্বাচনে ৪৮০টি উপজেলার মধ্যে অন্তত ৩৩টিতে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের সব পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতি ধাপেই ভোটারদের উপস্থিতি ছিল কম। এই ৩৩টি উপজেলায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ভোটাররা তাদের মূল্যবান রায় দিতে বঞ্চিত থাকলেন। তবে চতুর্থ ধাপে সর্বোচ্চ ১৫টি উপজেলায় এই তিন গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচনের প্রয়োজন পড়েনি। তাছাড়া প্রথম ধাপে ৩টি, দ্বিতীয় ধাপে ৬টি, তৃতীয় ধাপে ৬টি এবং সর্বশেষ ৫ম ধাপে উপজেলায় ওই শীর্ষ ৩ পদে দল মনোনীত প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এই ৩৩টি উপজেলার মধ্যে নাটোর সদর, নওগাঁ সদর, পাবনা সদর, ফরিদপুর সদর, ভোলা সদর, কুমিল্লার সদর আদর্শ উপজেলা এবং সদর দক্ষিণ অন্যতম।

শত বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশ তথা এ ভারত উপমহাদেশের মানুষ আগা-গোড়াই গণতন্ত্রপ্রিয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬ এর গণভোটে পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পক্ষেই ভোট দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিন পরে বাঙালিরা বুঝে যায় শাসক বদল হলেও শোষণ বদলে যায়নি। ব্রিটিশদের উপনিবেশ থেকে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠী ও সামরিক জান্তা পাকিস্তানের দুই যুগে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হতে দেয়নি। পাকিস্তানের ইতিহাসে ২৩ বছরের মাথায় ১৯৭০ সালে মাত্র একবারই জাতীয়ভিত্তিক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও বিজয়ী দলের কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার ওপর সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা হয়।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ ’৭২-এর সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৫ আগস্ট ’৭৫ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাভাবিক রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়া হয়। প্রায় ১৫ বছর জিয়া-এরশাদের স্বৈরশাসন কায়েম থাকার পর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু। বিএনপি ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। ওই সময় মাগুরা-বগুড়া উপনির্বাচনে বিএনপি কারচুপির মাধ্যমে বিজয়ী হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি সরকারের ৫ বছরের মেয়াদ শেষে ১৯৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি একদলীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

আওয়ামী লীগ জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। একদলীয় ও একতরফা নির্বাচনে বিএনপি সংসদের সব আসনে জয়ী হয়। নির্বাচনের ৮ দিন পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দেয়ার দাবিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৮ মার্চ থেকে সর্বাত্মক লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অসহযোগের একাদশ দিন ১৯ মার্চ নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত এবং সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। ওই দিন শেখ হাসিনার বাসভবনকে লক্ষ্য করে কে বা কারা গুলি চালায়। ২২ মার্চ সেনাবাহিনী নামিয়েও খালেদা সরকার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। আন্দোলনের সময়ে প্রায় প্রতিদিন কয়েকজন করে লোক নিহত হয়। ২৯ মার্চ ছিল সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। অবশেষে অসহযোগের ২৩তম দিনে ৩০ মার্চ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন। শেখ হাসিনা প্রত্যাহার করেন অসহযোগ আন্দোলন। রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ সংসদ ভেঙে দেন এবং বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। ৫ এপ্রিল পদত্যাগ করেন সিইসি একেএম সাদেক। ১২ জুনের ভোটে ১৪৬ আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিএনপি ১১৬, জাতীয় পার্টি ৩২ ও জামায়াত পায় ৩ আসন। ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জাতির জনক হত্যার ২১ বছর পর।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে নিয়ে খালেদা জিয়ার বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ৫ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সংবিধান লঙ্ঘন করে খালেদা জিয়া বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহাম্মদকেই একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বানিয়ে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে বারবার সংবিধান লঙ্ঘনসহ যত অপকর্ম এদেশে হয়েছে এর সবগুলোর মূলে কোন না কোনভাবে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া যুক্ত রয়েছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নেন শেখ হাসিনা।

রাষ্ট্রপতি এবং একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি ইয়াজউদ্দিন পুনরায় খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় বসাতে অপতৎপরতা শুরু করেন। ২১ জানুয়ারি (২০০৭) অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নিজ দল বিএনপিকে পুনরায় ক্ষমতায় নেয়ার পক্ষে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ২০০৬ এর ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত ৪ উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। এত কিছুর পরেও শুধু দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার স্বার্থে শেখ হাসিনা ২১ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়ার সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু বিএনপিকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি সেনা মোতায়েন, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়াসহ কতগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যেটা আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল মেনে নেয়নি। অবশেষে শেখ হাসিনা পল্টনের বিশাল জনসভায় ‘ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচন নয়’ ঘোষণা করে ১৪ জানুয়ারি বঙ্গভবন লাগাতার ঘেরাও শুরু, ১৪-১৫ বঙ্গভবনসহ সারা দেশে অবরোধ, ১৭-১৮ সর্বাত্মক হরতাল এবং ২১-২২ সর্বাত্মক হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

বিএনপি দলীয় রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন-ভার্সেস আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অনড় পাল্টাপাল্টি অবস্থানে দেশ নিশ্চিতভাবেই অস্থিতিশীলতার দিকে ধাবিত হয়। ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সেনাবাহিনী প্রধান পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার পদ ছাড়তে রাষ্ট্রপতিকে বাধ্য করেন। নির্বাচন স্থগিত এবং রাতে কার্ফু জারির ঘোষণা দেন রাষ্ট্রপতি। পরদিন ১২ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমদ প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর স্মরণকালের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী মহাজোট সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিন চক্র পশ্চাদপসরণ করে। মহাজোট সরকারের ৫ বছর মেয়াদের পর নির্বাচন হয় ২০১৪ সােেলর ৫ জানুয়ারি।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ক্ষ্যান্ত ছিলেন না। ওই নির্বাচন প্রতিহত করতে ম্যাডাম আন্দোলনের নামে পৈশাচিক ও হিংসাশ্রয়ী পথ বেছে নেন। মানুষ দেখেছে নির্বাচনের আগে রাজপথে নিরীহ মানুষকে হত্যাসহ জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে কীভাবে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু জনসমর্থন না থাকায় বিএনপি-জামায়াতের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা মানুষ হত্যা করেও নির্বাচন বন্ধ রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ওই সময় মহাজোটের অন্যতম শরীক দল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক এরশাদ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যথাযথভাবে না হতে কলকাঠি নাড়েন। ওই অবস্থায় বহুরূপী এরশাদকে সিএমএইচ-এ এক প্রকার বন্দি রেখে খালেদার সন্ত্রাসী অপতৎপরতার মধ্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আয়োজন করা হয়।

সর্বশেষ ২০১৮-এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারেও বিএনপি টালবাহানা করে। এই নির্বাচনে না গেলে বিএনপি খ-বিখ- হয়ে এমন দুরবস্থায় পতিত হতো, যেখান থেকে ফিরে আসার কোন সুযোগ থাকত না। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও সংস্থা নানামুখী অভিযোগ করে আসছে। সংসদে যোগ দেয়া বিএনপির এমপিরা বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো কোন নির্বাচন অতীতে হয়নি। এটি ছিল রাতের নির্বাচন। যে কারণে এই সংসদকে বলা হচ্ছে মধ্যরাতের সংসদ।’ ২৫ জুন বিএনপি দলীয় এমপি হারুনুর রশিদ সংসদে বলেন, ‘একাদশ সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জাতিসংঘ, টিআইবি, যুক্তরাষ্ট্র, নিউইয়র্ক টাইমস, দিল্লির গবেষক-বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন। যে সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেই সংসদ নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট ভর্তি করা হয়, আর পরদিন তা গণনা করা হয়।’

সর্বশেষ ৩০ জুন একটি জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে বলা হয়, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬১ শতাংশ কেন্দ্রে ৮০-শতাংশ বা তার বেশি ভোট পড়েছে। অন্তত ২১১ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে শত ভাগ। ৩০০ আসনের ৪০ হাজার ১৫৫ কেন্দ্রের মধ্যে ২৪ হাজার ৪৩৭টি কেন্দ্রে ৮০ থেকে ৯৯ শতাংশ ভোট পড়েছে।’ ২৭ জুন ইসির ওয়েবসাইটে এ ফল প্রকাশ করা হয়। এদিকে মহাজোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ১৯ জুন সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। উপজেলা নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অনুপস্থিতি থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ, রোগ এখন উপজেলা নির্বাচন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। নির্বাচন ও সামগ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা সম্পর্কে জনমনে অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ মেনন বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশ দেশের নির্বাচনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে রাজনৈতিক দল শুধু নির্বাচন নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলবে। এটা সবার জন্য যেমন, আওয়ামী লীগের জন্যও প্রযোজ্য।

জনগণের নির্বাচনের প্রতি চরম অনাগ্রহকে অশনিসংকেত হিসেবে মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘নির্বাচনবিমুখতা জাতিকে গভীর খাদের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের অনিশ্চিত গন্তব্যে এখন বাংলাদেশ। এ অবস্থা কখনও কারও কাম্য হতে পারে না। এবারের উপজেলা নির্বাচনে সবচেয়ে আশঙ্কার দিক হচ্ছে ভোটের ব্যাপারে জনগণের চরম অনাগ্রহ। একটি গণতান্ত্রিক দেশ ও জাতির জন্য এটা অশনিসংকেত। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। আমরা ক্রমাগত একতরফা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, যা গণতন্ত্রের জন্য অনভিপ্রেত।’ ৫ ধাপের উপজেলা নির্বাচন শেষে ১৯ জুন ইসি কার্যালয়ে মাহবুব তালুকদার ‘উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে আমার কথা’ শীর্ষক একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের পড়ে শোনান। নির্বাচন কেমন হয়েছে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে পূর্বে আমি যা বলেছিলাম, এখনও তা-ই বলব। আপনারা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞেস করলে এর উত্তর পেয়ে যাবেন। সাংবিধানিক পদে থেকে এভাবে বক্তব্য দিতে পারেন কি-নাÑ এর জবাবে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘আমি সংবিধান রক্ষা করার শপথ নিয়েছি। আমি যদি দেখি, সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে তাহলে আমি চুপ করে থাকব কেন? আমি শুধু চিত্র তুলে ধরেছি।’

নির্বাচন বিষয়ে রাশেদ খান মেনন এবং মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্যই সংগ্রাম করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন। মন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার প্রতি লোভ থাকলে বঙ্গবন্ধুকে ১২ বছর জেলে থাকতে হতো না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭০ সালের নির্বাচনের বিজয়ী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করলে ৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৪ মাস পর ১৯৭২-এর ৭ মার্চ সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। সংকট ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য সাময়িক সময়ের জন্য বঙ্গবন্ধু দেশের সব দল নিয়ে জাতীয় দল বাকশাল গঠন করেছিলেন। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করেন। স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালে দুদিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু দেশে সংসদীয় পদ্ধতি কায়েম করেন। ১৯৯১ সালে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যেতে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বাধ্য করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদেশের গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ২০০৭ সালে লড়াই করে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না এলে সেনাসমর্থিত সরকার ৫/১০ বছর ক্ষমতা দখল করে রাখতে পারত। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচন না করলে দেশে আবার অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতা দখল করত। নির্বাচনকে আবার যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে জননেত্রীর কোন বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে দেশে আগামী দিনগুলোতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

৩০ জুন ২০১৯

[লেখক : সাপ্তাহিক বাংলাবার্তা সম্পাদক]

bandhu.ch77@yahoo.com

সম্পাদক, বাংলাবার্তা