মানসিক স্বাস্থ্য : প্রেক্ষাপট নারী ও শিশু

চন্দ্রশিলা ছন্দা

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ নারী ও শিশু। নারীদের বাদ দিয়ে যেমন সুষ্ঠু সমাজ এবং উন্নয়নের কথা ভাবা যায় না, তেমনি শিশুদের অবহেলা করে একটি সুন্দর রাষ্ট্রের কথা চিন্তাও করা যায় না। মূলত শিশুরাই একটি দেশের ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্রের সম্পদ। বর্তমান সরকার নারীদের এগিয়ে নিতে নারী ও শিশুদের ব্যাপারে বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ নারী ভাতা, তালাকপ্রাপ্ত ভাতা, গর্ভকালীন ভাতা ইত্যাদি এসব উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম। মাতৃত্বকালীন ছুটিকে চার মাস থেকে ছয় মাসে উন্নীত করাও সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। সরকার ২০১০-১১ অর্থবছরে নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মা ও তাদের শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে রাজস্ব তহবিল থেকে দেশে প্রথমবারের মতো ‘কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার’ সহায়তা কর্মসূচি চালু করে। তবে এতো অর্জন আর সফলতার পারও দেশে এখনো নারী ও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি অবহেলিত।

এ কথা সত্য যে, মানসিক রোগ মানেই পাগল হয়ে যাওয়া নয়। এই রোগের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। ১৮০৮ সালে জার্মান চিকিৎসক জোহান ক্রিস্টিয়ান রেইল psychiatry শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগ নিরাময় হয়।

মানসিক রোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী। সম্প্রতি বিশ্বে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে বিষন্নতা রোগটি সমাজে বোঝার মত চেপে বসবে এবং এই রোগটি ব্যাধির তালিকায় দ্বিতীয় সারিতে উঠে আসবে। শিশু থেকে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ কেউই বাদ পড়বে না এই রোগের হাত থেকে। বিশে^ প্রায় ৪৫-৪৬ কোটি জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত, যা ঠিক ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি না হলেও বিরাট এক সমস্যা। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুযায়ী জরিপ অনুযায়ী, যে কোন দেশে গুরুতর মানসিক রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ এবং লঘু মানসিক রোগীর সংখ্যা দশ শতাংশ থাকা আবশ্যক। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ ১৯৯২ সাল থেকে ১০ অক্টোবরকে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করে প্রতি বছর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। আমাদের দেশে ১৬.০১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী ও ১৮.৪ শতাংশ শিশু কোন না কোন প্রকার মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত। অথচ জনসংখ্যার এই বৃহৎ অংশের সেবায় রয়েছে মাত্র ২১০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ৫০ জন চিকিৎসা বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে ৫০০ শয্যার একমাত্র সরকারি মানসিক হাসপাতাল পাবনাতে অবস্থিত। পাবনা হাসপাতালসহ সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ মানসিক রোগী আছে। এর ভেতর ২০ শতাংশ রোগীর বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর। ড. মেঘলা সরকারের একটি প্রবন্ধের তথ্যে জানা যায়, বিশে^ প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন কর্মজীবী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, যার ফলে বিশ্ব বছরে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ এই ক্ষতি দাঁড়াবে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে। একই কারণে বছরে ৩০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এই প্রবন্ধের আরেক তথ্যে জানানো হয়, বিশে^ ১০ শতাংশ কর্মজীবী ব্যক্তি বিষন্নতার কারণে ছুটি নেয়, যাদের ৫০ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে থাকছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ সিজোফ্রেনিয়া রোগী চিকিৎসা সেবা পায় না। এর প্রধান কারণই হলো সাধারণ মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তাদের উদাসীনতা এবং সচেতনতার অভাব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমাদের সচেতনতা বা উদাসীনতার দৃশ্য একই রকম।

সূত্রে জানা যায়, বিষণ্নতার মতো প্রচলিত মনস্তাত্ত্বিক সংক্রমণের কারণে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন, ডিমেনশিয়া দ্বারা ৩৫ মিলিয়ন এবং সিজোফ্রেনিয়া দ্বারা বিশ্বব্যাপী ২১ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মস্থলের চাপ নিতে না পেরে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করে। জার্মানির মিউনিখের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ডিজিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মানসিক অসুস্থতার কারণে বছরে ৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ইউরো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে এক সমীক্ষায় ড. মেঘলা সরকারের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপে থাকে। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি অনুদানহীন এবং এ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণাও নেই। এখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যটি ভুল ব্যাখ্যায় ভরা ও কুসংস্কারপূর্ণ। সরকারের পক্ষ থেকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ০.৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। মানসিক স্বাস্থ্যকে এখন পর্যন্ত অসুখ হিসেবে দেখা হয় না।

মানসিক সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন শিশু এবং নারীরাই। এর কারণ হলো- কর্মজীবী নারীদের পরিবার ও পেশার দায়িত্ব একই সঙ্গে সামলাতে হয়। বিজ্ঞান মতে, পুরুষের তুলনায় নারীর শরীরে সিরোটোনিন কম তৈরি হয় এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিও ধীর। হরমোনের তারতম্যের ফলে নারীরা দৈনন্দিন স্ট্রেস নিয়ে মানসিক জটিলতায় ভোগেন বেশি। এছাড়া পারিবারিক অশান্তি, অস্থিরতা, বিক্ষিপ্ত চিন্তা ভাবনা, হিংসা, সন্দেহ ইত্যাদির ফলে হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে বিষন্নতা। নারীরা সংসারের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপার্জনমূলক কাজ বেছে নিলেও ঘরের কাজে পুরুষরা এখনো পুরোপুরি উদার নয়। তারা ঘরের কাজকে নারীর কাজই মনে করে। ফলে ঘরে ও বাইরের চাপ নারীকেই নিতে হয়। আবার নারীর নিজস্ব আয় না থাকলেও অনেক সময় তাদের বিব্রতকর অবস্থার পড়তে হয়। ফলে সবদিকেই নারীকে মানসিক চাপ নিতে হয়। পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় বেশি। নিরাপত্তার অভাব থাকে বলে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও বেশি। জার্মান শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালের তুলনায় ২০১০ সালে দ্বিগুণ নারী মানসিক চাপের কারণে পেশায় কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন।

মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা এখনও সুস্পষ্ট নয়। এই রোগে আক্রান্ত নারী ও শিশুকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় এনে তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের মূল স্রোতোধারায় নিয়ে আসা উচিত। মাদকাসক্তি, নারী ও শিশু নির্যাতন, দারিদ্র্য, বেকারত্বের হতাশা ইত্যাদি কারণে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। তবে বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যমের চেষ্টায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষতির দিকটা সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও বোঝানো যাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের দিককে গুরুত্বের সঙ্গে জনগণের সামনে নিয়ে আসতে পারলে, সরকারি বেসরকারি অনুদান বাড়াতে পারলে, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। নারীর স্বস্তি ও সৃজনশীলতাকে সম্পদে এবং উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভাবতে পারলে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে ব্রিটেন কয়েক বছর আগেই দেশের নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ে এক বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ বৃদ্ধির ঘোষণা করেছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া, পরিবারের সহানুভূতি এবং সচেতনতা যদি এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দূরীকরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি বিষণ্নতা থেকে মুক্ত হতে মন প্রফুল্ল্য রাখতে হবে। যে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে আপজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এছাড়া, মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম বা নিজের ভালো লাগে এমন কিছু কাজ বা বিনোদনে সময় দিতে হবে। মেডিটেশন এবং ধর্মচর্চা মনকে শান্ত রাখে। মন শান্ত থাকলে মনের ওপর চাপও কম পড়ে। মনের জড়তা কাটিয়ে যে কোন মানসিক সমস্যা সমাধানে মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। দেশের নারী, শিশু ও জনগণ সুস্থ থাকলে সুস্থ থাকবে পরিবার, সুস্থ থাকবে সমাজ। গড়ে উঠবে সুস্থ জাতি, সুস্থ দেশ। এ ক্ষেত্রে তাই সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।

(পিআইডি শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০১৯ , ১৮ আষাঢ় ১৪২৫, ২৮ শাওয়াল ১৪৪০

মানসিক স্বাস্থ্য : প্রেক্ষাপট নারী ও শিশু

চন্দ্রশিলা ছন্দা

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ নারী ও শিশু। নারীদের বাদ দিয়ে যেমন সুষ্ঠু সমাজ এবং উন্নয়নের কথা ভাবা যায় না, তেমনি শিশুদের অবহেলা করে একটি সুন্দর রাষ্ট্রের কথা চিন্তাও করা যায় না। মূলত শিশুরাই একটি দেশের ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্রের সম্পদ। বর্তমান সরকার নারীদের এগিয়ে নিতে নারী ও শিশুদের ব্যাপারে বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ নারী ভাতা, তালাকপ্রাপ্ত ভাতা, গর্ভকালীন ভাতা ইত্যাদি এসব উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম। মাতৃত্বকালীন ছুটিকে চার মাস থেকে ছয় মাসে উন্নীত করাও সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। সরকার ২০১০-১১ অর্থবছরে নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মা ও তাদের শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিমান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে রাজস্ব তহবিল থেকে দেশে প্রথমবারের মতো ‘কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার’ সহায়তা কর্মসূচি চালু করে। তবে এতো অর্জন আর সফলতার পারও দেশে এখনো নারী ও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি অবহেলিত।

এ কথা সত্য যে, মানসিক রোগ মানেই পাগল হয়ে যাওয়া নয়। এই রোগের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। ১৮০৮ সালে জার্মান চিকিৎসক জোহান ক্রিস্টিয়ান রেইল psychiatry শব্দটি ব্যবহার করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা নিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ রোগ নিরাময় হয়।

মানসিক রোগ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী। সম্প্রতি বিশ্বে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে বিষন্নতা রোগটি সমাজে বোঝার মত চেপে বসবে এবং এই রোগটি ব্যাধির তালিকায় দ্বিতীয় সারিতে উঠে আসবে। শিশু থেকে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ কেউই বাদ পড়বে না এই রোগের হাত থেকে। বিশে^ প্রায় ৪৫-৪৬ কোটি জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত, যা ঠিক ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি না হলেও বিরাট এক সমস্যা। অথচ মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুযায়ী জরিপ অনুযায়ী, যে কোন দেশে গুরুতর মানসিক রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ এবং লঘু মানসিক রোগীর সংখ্যা দশ শতাংশ থাকা আবশ্যক। তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ ১৯৯২ সাল থেকে ১০ অক্টোবরকে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করে প্রতি বছর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। আমাদের দেশে ১৬.০১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠী ও ১৮.৪ শতাংশ শিশু কোন না কোন প্রকার মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত। অথচ জনসংখ্যার এই বৃহৎ অংশের সেবায় রয়েছে মাত্র ২১০ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ৫০ জন চিকিৎসা বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে ৫০০ শয্যার একমাত্র সরকারি মানসিক হাসপাতাল পাবনাতে অবস্থিত। পাবনা হাসপাতালসহ সারা দেশে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ মানসিক রোগী আছে। এর ভেতর ২০ শতাংশ রোগীর বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর। ড. মেঘলা সরকারের একটি প্রবন্ধের তথ্যে জানা যায়, বিশে^ প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন কর্মজীবী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, যার ফলে বিশ্ব বছরে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ এই ক্ষতি দাঁড়াবে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে। একই কারণে বছরে ৩০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এই প্রবন্ধের আরেক তথ্যে জানানো হয়, বিশে^ ১০ শতাংশ কর্মজীবী ব্যক্তি বিষন্নতার কারণে ছুটি নেয়, যাদের ৫০ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে থাকছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ সিজোফ্রেনিয়া রোগী চিকিৎসা সেবা পায় না। এর প্রধান কারণই হলো সাধারণ মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তাদের উদাসীনতা এবং সচেতনতার অভাব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে আমাদের সচেতনতা বা উদাসীনতার দৃশ্য একই রকম।

সূত্রে জানা যায়, বিষণ্নতার মতো প্রচলিত মনস্তাত্ত্বিক সংক্রমণের কারণে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন, ডিমেনশিয়া দ্বারা ৩৫ মিলিয়ন এবং সিজোফ্রেনিয়া দ্বারা বিশ্বব্যাপী ২১ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মস্থলের চাপ নিতে না পেরে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করে। জার্মানির মিউনিখের টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ডিজিজ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মানসিক অসুস্থতার কারণে বছরে ৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ইউরো ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে এক সমীক্ষায় ড. মেঘলা সরকারের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপে থাকে। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি অনুদানহীন এবং এ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণাও নেই। এখনও সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যটি ভুল ব্যাখ্যায় ভরা ও কুসংস্কারপূর্ণ। সরকারের পক্ষ থেকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মোট স্বাস্থ্য বাজেটের ০.৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। মানসিক স্বাস্থ্যকে এখন পর্যন্ত অসুখ হিসেবে দেখা হয় না।

মানসিক সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন শিশু এবং নারীরাই। এর কারণ হলো- কর্মজীবী নারীদের পরিবার ও পেশার দায়িত্ব একই সঙ্গে সামলাতে হয়। বিজ্ঞান মতে, পুরুষের তুলনায় নারীর শরীরে সিরোটোনিন কম তৈরি হয় এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিও ধীর। হরমোনের তারতম্যের ফলে নারীরা দৈনন্দিন স্ট্রেস নিয়ে মানসিক জটিলতায় ভোগেন বেশি। এছাড়া পারিবারিক অশান্তি, অস্থিরতা, বিক্ষিপ্ত চিন্তা ভাবনা, হিংসা, সন্দেহ ইত্যাদির ফলে হতাশা বাড়ছে, বাড়ছে বিষন্নতা। নারীরা সংসারের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে উপার্জনমূলক কাজ বেছে নিলেও ঘরের কাজে পুরুষরা এখনো পুরোপুরি উদার নয়। তারা ঘরের কাজকে নারীর কাজই মনে করে। ফলে ঘরে ও বাইরের চাপ নারীকেই নিতে হয়। আবার নারীর নিজস্ব আয় না থাকলেও অনেক সময় তাদের বিব্রতকর অবস্থার পড়তে হয়। ফলে সবদিকেই নারীকে মানসিক চাপ নিতে হয়। পুরুষের তুলনায় নারীদের মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় বেশি। নিরাপত্তার অভাব থাকে বলে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও বেশি। জার্মান শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালের তুলনায় ২০১০ সালে দ্বিগুণ নারী মানসিক চাপের কারণে পেশায় কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়েন।

মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা এখনও সুস্পষ্ট নয়। এই রোগে আক্রান্ত নারী ও শিশুকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় এনে তাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের মূল স্রোতোধারায় নিয়ে আসা উচিত। মাদকাসক্তি, নারী ও শিশু নির্যাতন, দারিদ্র্য, বেকারত্বের হতাশা ইত্যাদি কারণে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়তে পারে। তবে বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যমের চেষ্টায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষতির দিকটা সাধারণ মানুষকে কিছুটা হলেও বোঝানো যাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের দিককে গুরুত্বের সঙ্গে জনগণের সামনে নিয়ে আসতে পারলে, সরকারি বেসরকারি অনুদান বাড়াতে পারলে, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। নারীর স্বস্তি ও সৃজনশীলতাকে সম্পদে এবং উন্নয়নের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভাবতে পারলে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে ব্রিটেন কয়েক বছর আগেই দেশের নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ে এক বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ বৃদ্ধির ঘোষণা করেছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া, পরিবারের সহানুভূতি এবং সচেতনতা যদি এ ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দূরীকরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি বিষণ্নতা থেকে মুক্ত হতে মন প্রফুল্ল্য রাখতে হবে। যে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে আপজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এছাড়া, মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম বা নিজের ভালো লাগে এমন কিছু কাজ বা বিনোদনে সময় দিতে হবে। মেডিটেশন এবং ধর্মচর্চা মনকে শান্ত রাখে। মন শান্ত থাকলে মনের ওপর চাপও কম পড়ে। মনের জড়তা কাটিয়ে যে কোন মানসিক সমস্যা সমাধানে মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। দেশের নারী, শিশু ও জনগণ সুস্থ থাকলে সুস্থ থাকবে পরিবার, সুস্থ থাকবে সমাজ। গড়ে উঠবে সুস্থ জাতি, সুস্থ দেশ। এ ক্ষেত্রে তাই সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।

(পিআইডি শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার)