চাকরি, ব্যবসার সঙ্গে পান চাষে ১০ বছরে আবাদ বেড়ে দ্বিগুণ
“আসুন করি পান চাষ, সুখে কাটাই বার মাস”। নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষের প্রধান অর্থকরী ফসল পান। পান চাষে সাফল্যও পেয়েছেন তারা। মনোহরদী উপজেলার লেবুতলা, খিদিরপুর দুটি ইউনিয়নের সকল গ্রামেই পানের বরজ আছে ৯৫% মানুষের। এছাড়াও চালাকচর, অর্জুনচর, দৌলতপুর ইউনিয়নেও কমবেশি পানের চাষ হয়। চাকরি বা ব্যবসা করছেন সঙ্গে একটু পানের বরজ থাকলে মন্দ কি? পরিবারে বাড়তি আয়ের পথও সুগম হলো। অনেক মহিলারাও পরিবারের গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে চাষ করতে পারেন পানের। বাংলাদেশে ঔষধি গাছ হিসেবে পানের চাহিদা ব্যাপক। এছাড়াও অনেকে আবার খাবার পরে একটু পান- সুপারি না খেলে মনেহয় খাবারটাই অপূর্ণ থেকে গেল। এলাকায় পানের বরজকে বলা হয় টাকার ব্যাংক। মনোহরদী উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পান চাষ বাড়ছে। এ পান চাষ করে ঘুরেছে অনেকর ভাগ্যের চাকা। উপজেলায় উৎপাদিত পান এলাকার চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদনের ৮৫ ভাগ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরাও ঝুঁকছেন পান চাষে। ১০ বছর পূর্ব থেকে বর্তমানে উপজেলায় পানের আবাদ বেড়েছেু দ্বিগুণ। পান চাষি গোলাম মোস্তফা খসরু মাস্টার বলেন, এই উপজেলায় দুই প্রকার পান চাষ হয়, গয়ালস্বর ও লালডিঙ্গি তবে কিছু মিষ্টি পান এবং ছাঁচি পানও পাওয়া যায়। উপজেলায় মোট চাষের ৮০ ভাগই গয়ালস¦র পান। পান চাষি এমদাদুল জানান, পান চাষ করেই আমার সংসার চলে। আমি এবং আমার পরিবার দুজনেই পানের বরজে কাজ করি। ২৭ বছর ধরে পানের বরজ করে আসছি। বর্তমানে ২৩ শতক জমিতে পানের বরজ রয়েছে। প্রতিহাটে সপ্তাহে (দুই দিন) ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার পান বিক্রি করি। এখান থেকেই আয় করে সংসারের খরচসহ সন্তানদের লেখাপড়া করানো হয়। বিভিন্ন স্থান হতে পান কিনতে আসা এক পান ব্যবসায়ীরা বলেন, এখানকার পান অনেক পুরু ও সুস্বাদু হওয়ায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং লাভও হয় ভালো। মনোহরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আয়েশা আক্তার, লেবুতলা ইউনিয়নের উপসহকারী কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. ফারুক হোসেন ও রেবা সুলতানা জানান, এ বছর উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ৩০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৫ টন পানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে উপজেলার ২টি ইউনিয়নের ৯৫% পরিবার এই পান চাষের সঙ্গে জড়িত। মনোহরদীর মাটি পান চাষের জন্য বেশ উপযুক্ত হওয়ায় এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রজাতির পানের চাষ করে চাষিরা। তবে গয়াস¦র ও লাল ডিঙ্গি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের চাষিরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অনেক পানের চাষ করায় প্রতিবছর পানের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সব প্রকার পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
এলাকার সচেতন মহল মনে করেন, সরকারের নজরদারি থাকলে পান চাষে আগ্রহী এসব পরিবার আর্থিক লাভবানের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন এবং অনেকেই পান চাষে সফলতার মুখ ও দেখেছেন বলে জানান তারা। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে দোঁ-আশ মাটিতে আগাছা পরিষ্কার করে তিনবার চাষ দিয়ে প্রতি এক শতক জমিতে ২ কেজি ফসফেট, ১ কেজি চুন ও ২০০ গ্রাম লিজেন্ট মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে দেড় ফুট দূরত্বে সারি বেঁধে মাটি উঁচু করে ১ ফুট দূরত্বে পানের গাছ লাগিয়ে দিতে হয়। প্রতিটি পানের লতা থেকে ১২-১৫টি চারা লাগানো যায় এবং বাঁশের শলা, পাটকাঠি, জিআই তার, কাশবন, সুপারি পাতা ও সুতা দিয়ে পানের বরজ বানাতে হয়। জমির চারদিকে বাঁশ ও সুপারি পাতা দিয়ে বেড়া দিতে হয় এবং জমির উপরে জিআই তার ও কাশবন দিয়ে চাল বানানো হয়। মাটি থেকে পানের লতা যখন ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা হয় তখন পাশে ১টি ৫-৬ ফুট লম্বা বাঁশ বা পাটকাঠি পুঁতে দেয়া হয়। পানের লতাটি ধীরে ধীরে বড় হয় এবং কাঠি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ৫-৬ মাস পর থেকে পান বিক্রির উপযোগী হয় এবং এরপর প্রতি ৮-১০ দিন পরপর পান বাজারে নেয়া যায়। ১টি বরজ থেকে সর্বনিম্ন ১৫ বছর একাধারে পান পাওয়া যায়। যদি পানের ফাপ পচা রোগ না হয় তাহলে বরজটি ২০-৩০ বছর থাকে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পানের ফাপ পচা রোগ হয়। এটি পানের সবচেয়ে বড় রোগ। এ রোগ দমনে ফ্লোরি, এডমা ও কাফেডার- এ তিনটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। শীতের সময় এক প্রকার বিষাক্ত কুয়াশা পান গাছে লাগলে পান পাতা ঝরে যায়। এতে চাষিদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এটা প্রতিরোধে কোনো ওষুধ না থাকায় বিপাকে পড়েন চাষিরা। অনেক চাষি কুয়াশা ঠেকানোর জন্য বরজের চারপাশ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়।
বুধবার, ০৩ জুলাই ২০১৯ , ১৯ আষাঢ় ১৪২৫, ২৯ শাওয়াল ১৪৪০
চাকরি, ব্যবসার সঙ্গে পান চাষে ১০ বছরে আবাদ বেড়ে দ্বিগুণ
মাহবুবুর রহমান, মনোহরদী (নরসিংদী)
“আসুন করি পান চাষ, সুখে কাটাই বার মাস”। নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষের প্রধান অর্থকরী ফসল পান। পান চাষে সাফল্যও পেয়েছেন তারা। মনোহরদী উপজেলার লেবুতলা, খিদিরপুর দুটি ইউনিয়নের সকল গ্রামেই পানের বরজ আছে ৯৫% মানুষের। এছাড়াও চালাকচর, অর্জুনচর, দৌলতপুর ইউনিয়নেও কমবেশি পানের চাষ হয়। চাকরি বা ব্যবসা করছেন সঙ্গে একটু পানের বরজ থাকলে মন্দ কি? পরিবারে বাড়তি আয়ের পথও সুগম হলো। অনেক মহিলারাও পরিবারের গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে চাষ করতে পারেন পানের। বাংলাদেশে ঔষধি গাছ হিসেবে পানের চাহিদা ব্যাপক। এছাড়াও অনেকে আবার খাবার পরে একটু পান- সুপারি না খেলে মনেহয় খাবারটাই অপূর্ণ থেকে গেল। এলাকায় পানের বরজকে বলা হয় টাকার ব্যাংক। মনোহরদী উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পান চাষ বাড়ছে। এ পান চাষ করে ঘুরেছে অনেকর ভাগ্যের চাকা। উপজেলায় উৎপাদিত পান এলাকার চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদনের ৮৫ ভাগ যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরাও ঝুঁকছেন পান চাষে। ১০ বছর পূর্ব থেকে বর্তমানে উপজেলায় পানের আবাদ বেড়েছেু দ্বিগুণ। পান চাষি গোলাম মোস্তফা খসরু মাস্টার বলেন, এই উপজেলায় দুই প্রকার পান চাষ হয়, গয়ালস্বর ও লালডিঙ্গি তবে কিছু মিষ্টি পান এবং ছাঁচি পানও পাওয়া যায়। উপজেলায় মোট চাষের ৮০ ভাগই গয়ালস¦র পান। পান চাষি এমদাদুল জানান, পান চাষ করেই আমার সংসার চলে। আমি এবং আমার পরিবার দুজনেই পানের বরজে কাজ করি। ২৭ বছর ধরে পানের বরজ করে আসছি। বর্তমানে ২৩ শতক জমিতে পানের বরজ রয়েছে। প্রতিহাটে সপ্তাহে (দুই দিন) ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার পান বিক্রি করি। এখান থেকেই আয় করে সংসারের খরচসহ সন্তানদের লেখাপড়া করানো হয়। বিভিন্ন স্থান হতে পান কিনতে আসা এক পান ব্যবসায়ীরা বলেন, এখানকার পান অনেক পুরু ও সুস্বাদু হওয়ায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং লাভও হয় ভালো। মনোহরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আয়েশা আক্তার, লেবুতলা ইউনিয়নের উপসহকারী কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. ফারুক হোসেন ও রেবা সুলতানা জানান, এ বছর উপজেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ৩০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৫ টন পানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে উপজেলার ২টি ইউনিয়নের ৯৫% পরিবার এই পান চাষের সঙ্গে জড়িত। মনোহরদীর মাটি পান চাষের জন্য বেশ উপযুক্ত হওয়ায় এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রজাতির পানের চাষ করে চাষিরা। তবে গয়াস¦র ও লাল ডিঙ্গি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের চাষিরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অনেক পানের চাষ করায় প্রতিবছর পানের আবাদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সব প্রকার পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।
এলাকার সচেতন মহল মনে করেন, সরকারের নজরদারি থাকলে পান চাষে আগ্রহী এসব পরিবার আর্থিক লাভবানের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন এবং অনেকেই পান চাষে সফলতার মুখ ও দেখেছেন বলে জানান তারা। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে দোঁ-আশ মাটিতে আগাছা পরিষ্কার করে তিনবার চাষ দিয়ে প্রতি এক শতক জমিতে ২ কেজি ফসফেট, ১ কেজি চুন ও ২০০ গ্রাম লিজেন্ট মাটির সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে দিয়ে দেড় ফুট দূরত্বে সারি বেঁধে মাটি উঁচু করে ১ ফুট দূরত্বে পানের গাছ লাগিয়ে দিতে হয়। প্রতিটি পানের লতা থেকে ১২-১৫টি চারা লাগানো যায় এবং বাঁশের শলা, পাটকাঠি, জিআই তার, কাশবন, সুপারি পাতা ও সুতা দিয়ে পানের বরজ বানাতে হয়। জমির চারদিকে বাঁশ ও সুপারি পাতা দিয়ে বেড়া দিতে হয় এবং জমির উপরে জিআই তার ও কাশবন দিয়ে চাল বানানো হয়। মাটি থেকে পানের লতা যখন ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা হয় তখন পাশে ১টি ৫-৬ ফুট লম্বা বাঁশ বা পাটকাঠি পুঁতে দেয়া হয়। পানের লতাটি ধীরে ধীরে বড় হয় এবং কাঠি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ৫-৬ মাস পর থেকে পান বিক্রির উপযোগী হয় এবং এরপর প্রতি ৮-১০ দিন পরপর পান বাজারে নেয়া যায়। ১টি বরজ থেকে সর্বনিম্ন ১৫ বছর একাধারে পান পাওয়া যায়। যদি পানের ফাপ পচা রোগ না হয় তাহলে বরজটি ২০-৩০ বছর থাকে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পানের ফাপ পচা রোগ হয়। এটি পানের সবচেয়ে বড় রোগ। এ রোগ দমনে ফ্লোরি, এডমা ও কাফেডার- এ তিনটি ওষুধ ব্যবহার করা হয়। শীতের সময় এক প্রকার বিষাক্ত কুয়াশা পান গাছে লাগলে পান পাতা ঝরে যায়। এতে চাষিদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এটা প্রতিরোধে কোনো ওষুধ না থাকায় বিপাকে পড়েন চাষিরা। অনেক চাষি কুয়াশা ঠেকানোর জন্য বরজের চারপাশ পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়।