ইয়েমেন সংকট আর কতদিন

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন বসতি ইয়েমেন। প্রাচীন শক্তিশালী সাবাহ রাজ্যের বর্তমান অবয়ব এ দেশটি। এটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ, যা আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। প্রাচীনকালে ইয়েমেনে অনেকগুলো সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল। বর্তমানে দেশটির আয়তন ৫,২৭,৯৭০ বর্গ মিটার। কিন্তু দেশটির অর্ধেকেরও বেশি অংশ বসবাসের অযোগ্য। বড় বড় পর্বতগুলো ইয়েমেনের সমভূমি এবং মরুভূমিকে পৃথক করে রেখেছে। ইয়েমেনে প্রায় আড়াই কোটি লোক বসবাস করে, যাদের মাথাপিছু আয় মাত্র ১২০০ মার্কিন ডলার। ইয়েমেনের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান, পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং দক্ষিণে এডেন উপসাগর। দেশটি বাব-আল-মান্দেব প্রণালীর দ্বারা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। এ প্রণালীটি লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করে। এখান থেকে বিশ্বের সব থেকে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে। তাই এলাকাটি বাণিজ্যিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইয়েমেন ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৬৭ সালে তারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তখন উত্তর ইয়েমেন এবং দক্ষিণ ইয়েমেন নামে পৃথক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৯০ সালের দিকে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানি একীভূত হওয়ার পর পরই উত্তর ইয়েমেন (আরব প্রজাতন্ত্র) এবং দক্ষিণ ইয়েমেন (গণপ্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন) দেশ দুটি একত্রিত হয়ে ইয়েমেন গণতন্ত্র গঠন করে। কিন্তু তাই বলে দেশটিতে বিভক্তি এড়ানো যায়নি। এখানে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল; যা দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দেয়। দেশটিতে ৬০ ভাগ সুন্নি ও ৪০ ভাগ শিয়ার বসবাস। ইয়েমেনের উত্তরে শিয়া ধর্মাবলম্বী জাইদি সম্প্রদায়ের লোক বাস করে, যারা হুতি নামে পরিচিত। অন্যদিকে বরাবরের মতো দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল সুন্নি গোষ্ঠী; যা শিয়ারা কখনই ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলস্বরূপ ১৯৯৪ সালে ইয়েমেনে একটি গৃহযুদ্ধও সংঘটিত হয়।

১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ইয়েমেনের ক্ষমতায় আসেন আলি আবদুল্লাহ সালেহ। দীর্ঘ ৩৩ বছর দেশ শাসনের পর ২০১১ সালে তিনি আবদারাবুহ মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়েমেনের সংকট শুরু হয় মূলত তখন থেকেই। এরপর আরব বিশ্বের সব থেকে গরিব দেশটি আরও গরিব হতে থাকে। হাদি যখন দেশ পরিচালনায় মনোযোগ দেয়া শুরু করেন তখনই তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন। যেই হুতিরা এক সময় সালেহর বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তারাই সালেহর পক্ষ নিয়ে হাদির বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এছাড়া হাদির প্রশাসনের এক অংশ তখনও সালেহর অনুগত ছিল। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীও সালেহর অনুগত। তাই হাদি প্রসাশন কার্যত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং হাদি ও তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন।

২০১৪ সালে হুতিরা দেশটির রাজধানী সানাসহ উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু দক্ষিণের ৪টি সুন্নি প্রধান প্রদেশ হুতিদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি। এমন অবস্থায় হাদি সানা থেকে পালিয়ে গিয়ে এডেনে অবস্থান নেন এবং পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে আবার নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে দেশটি আবার দু’ভাগে বিভিক্ত হয়ে পড়ে। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরের নিয়ন্ত্রণ থাকল হুতিদের হাতে আর সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ থাকল বৈধ প্রেসিডেন্ট হাদির হাতে। এখন হুতিরা চাচ্ছে দেশটিতে শিয়াদের আধিপত্য বিস্তার করতে আর সুন্নিরা চাচ্ছে হাদি সরকারকে।

আর দেশটির এ অস্থিতিশীল অবস্থার সুযোগ নিয়ে দুটি ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী (আল কায়দা ইন দ্য এরাবিয়ানা পেনিনসুলা ও ইসলামী স্টেট) দেশটিতে ঢুকে পড়ে। ইয়েমেনের আল কায়দা বিশ্বের সব থেকে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন বলে ধারণা করা হয়। পুরো বিশ্বও এখন মোটামুটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে এক দল হুতিদের পক্ষে আর এক দল হাদির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এখানে আসলে সবাই সবার স্বার্থ দেখছে। পশ্চিমা বিশ্বও যাতে তাদের ভূরাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্বার্থ বজায় থাকে সেদিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। দেশটির অসহায় জনগণের কথা কেউ ভাবছে না। সৌদি আরবসহ আটটি সুন্নি দেশ (বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, জর্ডান, মরোক্ক ও সুদান) ইয়েমেনের বৈধ সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর এক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স তাদের সমর্থন করে। অন্যদিকে শিয়াপ্রধান দেশ ইরান অবস্থান নেয় বিদ্রোহী হুতিদের পক্ষে। এমনিতেই সুন্নিপ্রধান সৌদি আরব এবং শিয়াপ্রধান ইরানের মধ্যে বর্তমানে একটি শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই ইয়েমেনে তাদের বিপরীতমুখী অবস্থানকে অনেকে আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের লড়াই হিসেবেও দেখছে। ২০১৫ সালে মার্চে হাদির সমর্থনে সৌদি আরব ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করে। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর সানায় সৌদি জোটের হামলায় ১৪০ জন নিহত, আহত হন আরও ৬০০ জন। সৌদি আরব বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে ইরান হোদাইদা বন্দর ব্যবহার করে হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবারহ করে আসছে। ইরান শুরু থেকেই সৌদি আরবের এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বরং সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি করায় পশ্চিমা দেশগুলো সমালোচনার স্বীকার হচ্ছে।

ইয়েমেনে ২০১১ সালে শুরু হওয়া সংকট ৮ বছরেও কমেনি। গত ১৭ মার্চ হুতি সমর্থিত সেনাদের হামালায় সৌদি আরব ও সুদানের ৩৭ সেনা নিহত হয়েছেন। খুব শিগগিরই এ সংকট কাটবে বলেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশটির যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। দেশটির পুরো একটি প্রজন্ম আজ হুমকির মুখে। তারা বেড়ে উঠছে কোন ধরনের মানবিক সুযোগ সুবিধা ছাড়াই। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী ইয়েমেনের যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, যার দুই-তৃতীয়াংশই বেসামরিক। জাতিসংঘ একে বিশ্বের সবথেকে বড় মানব সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মকর্তার মতে খুব শিগগিরি ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ইয়েমেনে বর্তমানে মোট ৫২ লাখ শিশু দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন বলে জানিয়েছে। গত ২০ বছরে সারা বিশ্বে মাত্র দুটি দুর্ভিক্ষের ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ। এর একটি সোমালিয়ায় ২০১১ সালে অন্যটি ২০১৭ সালে দক্ষিণ সুদানে। ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ আগের দুটিকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত আট বছরেও ইয়েমেন তার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ইয়েমেনের বৈধ সরকারের পক্ষে। বাংলাদেশও নৈতিকভাবে সৌদি আরবকেই সমর্থন দেয়। কারণ একটি নির্বাচিত বৈধ সরকারকে এভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বিশ্বের বেশির ভাগ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যখন ইয়েমেনের বৈধ সরকারের পক্ষে তখন বিশ্বের অন্যতম দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও চীন এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে; যা পরোক্ষভাবে ইরানকেই সমর্থন করে। তাই সবদিক থেকে মনে হচ্ছে সুবিধাবাদী আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ইয়েমেনের সমস্যার কোন সমাধান করতে পারবে না। ইয়েমেনকে তার সমস্যা নিজে থেকেই সমাধান করতে হবে। তা না হলে এ অচলাবস্থা আরও দীর্ঘয়িত হবে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে তাদের নিজে থেকে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছাতে হবে। আর সেটি সম্ভব না হলে বিশ্ববাসী আর একটি ধ্বংসযজ্ঞ দেখবে।

[লেখক : কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০১৯ , ১৯ আষাঢ় ১৪২৫, ২৯ শাওয়াল ১৪৪০

ইয়েমেন সংকট আর কতদিন

আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা

image

মানব ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন বসতি ইয়েমেন। প্রাচীন শক্তিশালী সাবাহ রাজ্যের বর্তমান অবয়ব এ দেশটি। এটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ, যা আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। প্রাচীনকালে ইয়েমেনে অনেকগুলো সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল। বর্তমানে দেশটির আয়তন ৫,২৭,৯৭০ বর্গ মিটার। কিন্তু দেশটির অর্ধেকেরও বেশি অংশ বসবাসের অযোগ্য। বড় বড় পর্বতগুলো ইয়েমেনের সমভূমি এবং মরুভূমিকে পৃথক করে রেখেছে। ইয়েমেনে প্রায় আড়াই কোটি লোক বসবাস করে, যাদের মাথাপিছু আয় মাত্র ১২০০ মার্কিন ডলার। ইয়েমেনের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান, পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং দক্ষিণে এডেন উপসাগর। দেশটি বাব-আল-মান্দেব প্রণালীর দ্বারা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। এ প্রণালীটি লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সংযোগস্থল হিসেবে কাজ করে। এখান থেকে বিশ্বের সব থেকে বেশি তেলের সরবরাহ হয়ে থাকে। তাই এলাকাটি বাণিজ্যিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ইয়েমেন ১৮৩৯ সালে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৬৭ সালে তারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তখন উত্তর ইয়েমেন এবং দক্ষিণ ইয়েমেন নামে পৃথক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৯০ সালের দিকে পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানি একীভূত হওয়ার পর পরই উত্তর ইয়েমেন (আরব প্রজাতন্ত্র) এবং দক্ষিণ ইয়েমেন (গণপ্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন) দেশ দুটি একত্রিত হয়ে ইয়েমেন গণতন্ত্র গঠন করে। কিন্তু তাই বলে দেশটিতে বিভক্তি এড়ানো যায়নি। এখানে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল; যা দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দেয়। দেশটিতে ৬০ ভাগ সুন্নি ও ৪০ ভাগ শিয়ার বসবাস। ইয়েমেনের উত্তরে শিয়া ধর্মাবলম্বী জাইদি সম্প্রদায়ের লোক বাস করে, যারা হুতি নামে পরিচিত। অন্যদিকে বরাবরের মতো দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল সুন্নি গোষ্ঠী; যা শিয়ারা কখনই ভালোভাবে মেনে নেয়নি। ফলস্বরূপ ১৯৯৪ সালে ইয়েমেনে একটি গৃহযুদ্ধও সংঘটিত হয়।

১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে ইয়েমেনের ক্ষমতায় আসেন আলি আবদুল্লাহ সালেহ। দীর্ঘ ৩৩ বছর দেশ শাসনের পর ২০১১ সালে তিনি আবদারাবুহ মনসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়েমেনের সংকট শুরু হয় মূলত তখন থেকেই। এরপর আরব বিশ্বের সব থেকে গরিব দেশটি আরও গরিব হতে থাকে। হাদি যখন দেশ পরিচালনায় মনোযোগ দেয়া শুরু করেন তখনই তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হন। যেই হুতিরা এক সময় সালেহর বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তারাই সালেহর পক্ষ নিয়ে হাদির বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এছাড়া হাদির প্রশাসনের এক অংশ তখনও সালেহর অনুগত ছিল। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীও সালেহর অনুগত। তাই হাদি প্রসাশন কার্যত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং হাদি ও তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন।

২০১৪ সালে হুতিরা দেশটির রাজধানী সানাসহ উত্তরাঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু দক্ষিণের ৪টি সুন্নি প্রধান প্রদেশ হুতিদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি। এমন অবস্থায় হাদি সানা থেকে পালিয়ে গিয়ে এডেনে অবস্থান নেন এবং পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে আবার নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে দেশটি আবার দু’ভাগে বিভিক্ত হয়ে পড়ে। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরের নিয়ন্ত্রণ থাকল হুতিদের হাতে আর সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ থাকল বৈধ প্রেসিডেন্ট হাদির হাতে। এখন হুতিরা চাচ্ছে দেশটিতে শিয়াদের আধিপত্য বিস্তার করতে আর সুন্নিরা চাচ্ছে হাদি সরকারকে।

আর দেশটির এ অস্থিতিশীল অবস্থার সুযোগ নিয়ে দুটি ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠী (আল কায়দা ইন দ্য এরাবিয়ানা পেনিনসুলা ও ইসলামী স্টেট) দেশটিতে ঢুকে পড়ে। ইয়েমেনের আল কায়দা বিশ্বের সব থেকে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন বলে ধারণা করা হয়। পুরো বিশ্বও এখন মোটামুটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে এক দল হুতিদের পক্ষে আর এক দল হাদির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এখানে আসলে সবাই সবার স্বার্থ দেখছে। পশ্চিমা বিশ্বও যাতে তাদের ভূরাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক স্বার্থ বজায় থাকে সেদিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। দেশটির অসহায় জনগণের কথা কেউ ভাবছে না। সৌদি আরবসহ আটটি সুন্নি দেশ (বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, জর্ডান, মরোক্ক ও সুদান) ইয়েমেনের বৈধ সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর এক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স তাদের সমর্থন করে। অন্যদিকে শিয়াপ্রধান দেশ ইরান অবস্থান নেয় বিদ্রোহী হুতিদের পক্ষে। এমনিতেই সুন্নিপ্রধান সৌদি আরব এবং শিয়াপ্রধান ইরানের মধ্যে বর্তমানে একটি শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই ইয়েমেনে তাদের বিপরীতমুখী অবস্থানকে অনেকে আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের লড়াই হিসেবেও দেখছে। ২০১৫ সালে মার্চে হাদির সমর্থনে সৌদি আরব ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করে। ২০১৬ সালের ৮ অক্টোবর সানায় সৌদি জোটের হামলায় ১৪০ জন নিহত, আহত হন আরও ৬০০ জন। সৌদি আরব বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে ইরান হোদাইদা বন্দর ব্যবহার করে হুতি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবারহ করে আসছে। ইরান শুরু থেকেই সৌদি আরবের এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বরং সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি করায় পশ্চিমা দেশগুলো সমালোচনার স্বীকার হচ্ছে।

ইয়েমেনে ২০১১ সালে শুরু হওয়া সংকট ৮ বছরেও কমেনি। গত ১৭ মার্চ হুতি সমর্থিত সেনাদের হামালায় সৌদি আরব ও সুদানের ৩৭ সেনা নিহত হয়েছেন। খুব শিগগিরই এ সংকট কাটবে বলেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু ইতিমধ্যে দেশটির যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। দেশটির পুরো একটি প্রজন্ম আজ হুমকির মুখে। তারা বেড়ে উঠছে কোন ধরনের মানবিক সুযোগ সুবিধা ছাড়াই। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী ইয়েমেনের যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে, যার দুই-তৃতীয়াংশই বেসামরিক। জাতিসংঘ একে বিশ্বের সবথেকে বড় মানব সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মকর্তার মতে খুব শিগগিরি ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ইয়েমেনে বর্তমানে মোট ৫২ লাখ শিশু দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন বলে জানিয়েছে। গত ২০ বছরে সারা বিশ্বে মাত্র দুটি দুর্ভিক্ষের ঘোষণা করেছিল জাতিসংঘ। এর একটি সোমালিয়ায় ২০১১ সালে অন্যটি ২০১৭ সালে দক্ষিণ সুদানে। ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ আগের দুটিকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গত আট বছরেও ইয়েমেন তার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ইয়েমেনের বৈধ সরকারের পক্ষে। বাংলাদেশও নৈতিকভাবে সৌদি আরবকেই সমর্থন দেয়। কারণ একটি নির্বাচিত বৈধ সরকারকে এভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বিশ্বের বেশির ভাগ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যখন ইয়েমেনের বৈধ সরকারের পক্ষে তখন বিশ্বের অন্যতম দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও চীন এক্ষেত্রে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে; যা পরোক্ষভাবে ইরানকেই সমর্থন করে। তাই সবদিক থেকে মনে হচ্ছে সুবিধাবাদী আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ইয়েমেনের সমস্যার কোন সমাধান করতে পারবে না। ইয়েমেনকে তার সমস্যা নিজে থেকেই সমাধান করতে হবে। তা না হলে এ অচলাবস্থা আরও দীর্ঘয়িত হবে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে তাদের নিজে থেকে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছাতে হবে। আর সেটি সম্ভব না হলে বিশ্ববাসী আর একটি ধ্বংসযজ্ঞ দেখবে।

[লেখক : কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]