শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষক এবং চিকিৎসক

মীর আবদুল আলীম

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য বিষয়টি ন্যস্ত শিক্ষক এবং ডাক্তারে হাতে। শিক্ষকরা মানুষ গড়েন আর চিকিৎসকরা মানুষ মেরামত করেন। দুটিই মহান পেশা। এ পেশার লোকদের নিয়ে কারণে অকারণে বিতর্ক হয় প্রায় সময়ই। শিক্ষকরা ছাত্রদের শাসন করেছেন তো দেশে হৈ চৈ পড়ে যায়। পিতার আসনে থাকা শিক্ষকরা নাজেহাল আর শারীরিক লাঞ্ছনার শিকারও হন প্রায়ই। দেশের সব শিক্ষক পিতার মতো মহান বলব না। অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক আছেন; শিক্ষক নামে অমানুষও আছেন অনেক। যারা মহান এ পেশাকে কলুষিত করছেন। তাদের কারণেই গোটা শিক্ষক সমাজ আজ অপবাদের বোঝা কাঁধে নিচ্ছেন। বলতেই হয় এখনও অধিকাংশ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সন্তানের মতোই আগলে রাখেন। মনপ্রাণ উজাড় করে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করেন। মানুষ গড়ার কাজ করেন। এখনও এ পেশাটা মহান পেশা হিসাবেই আছে। থাকবেও অনন্তকাল।

এ তো গেল মানুষ গড়ার কারিগরদের কথা। আর যারা মানুষ মেরামত করেন। সেই ডাক্তার! চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপচিকিৎসা আর মানুষ মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে মাঝে মধ্যেই। হাসপাতালে রোগী মারা গেলে সোজা খুনের দায় চাপে ডাক্তারের ওপর। কথায় কথায় বলা হয় ভুল চিকিৎসার কথা। পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয় ‘ওমুক হাসপাতালের ওমুক ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার রোগীর মৃত্যু’। ভুল চিকিৎসার নিশ্চিত কিভাবে হন একজন সাংবাদিক কিংবা রোগীর লোকজন। এটা তো প্রমাণসাপেক্ষ বিষয়। অসুস্থ মানুষই ডাক্তারের কাছে কিংবা হাসপাতালে আসেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মুমূর্ষু রোগীদের আনা হয় হাসপাতালে। সৃষ্টিকর্তাই জীবনের মালিক। মানুষ কেবল চেষ্টা করে মাত্র। প্রায় ক্ষেত্রেই অসুস্থ মানুষটি মারা গেলে বলা হয় ভুল চিকিসৎসার কথা। ব্রেইন স্ট্রোক, হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষতো সব সময়ই মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকেন। হাজারো সমস্যার বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসা, অপচিকিৎসা নেই তা কিন্তু না। কোন কোন ডাক্তারও অবহেলা করেন, রোগীদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করেন। এমন অনেক হচ্ছে। তবে সব ডাক্তার কি এমন বাজে কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত? ভালোগুণের এবং মানবিক সম্পন্ন ডাক্তারের সংখ্যাই এখনও অনেক বেশি।

রাত-দিন একজন ডাক্তারকে পরিশ্রম করতে হয়। রোগীর ডাক পড়লেই তার ঘুম হারাম। আর তাকে যদি কথায় কথায় অপচিকিৎসা কিংবা খুনের অপবাদ কাঁধে নিয়ে চলতে হয় তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ায়? ভালো কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে তো মানুষ। প্লিজ অপবাদ দিবেন না। অভিযোগ করতে হলে ভেবে করবেন। সঠিকটা করবেন। একথা কিন্তু সত্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া সকল সুবিধাদী ছাড়া আমাদের ডাক্তারগণ যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তা কম নয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু এখনও সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে ঘরে ফিরছেন। সিট সংকুলান না হলে সেখানে ডাক্তারের দোষ কোথায়। যারা বারান্দায় থাকেন তারাও কিন্তু চিকিৎসা পান। এখনও আস্থার জায়গা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

এ লেখায় দুটি বিষয় রয়েছে শিক্ষক এবং চিকিৎসক। শিক্ষক প্রসঙ্গে পরে আসছি। চিকিৎসা বিষয়ে কিছু ধারণা দিতে চাই পাঠক আপনাদের। হুজুগে বাঙালি আমরা, বুঝেও লড়ি না বুঝেও লড়ি। কথা বলতে তো সীমা-পরিসীমা হারিয়ে ফেলতে ওস্তাদ সবাই। পাঠক বলেন তো, কতজন মানুষের জন্য কতজন ডাক্তার নিয়োজিত আছেন এদেশে। কত রোগীর চিকিৎসার সঙ্গতি আছে এ দেশের হাসপাতালগুলোর। ঢাল তলোয়ার (ডাক্তার ওষুধ) না দিয়ে চিকিৎসা করতে বলবেন তা কি করে হয়?

এক পরিসংখ্যানে এভাবেই উল্লেখ আছেÑ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ডিপার্টমেন্টে প্রায় সকল প্রকার সার্জারি হয়। মোট ডাক্তারের সংখ্যা ১০০ জন। গত এক বছরে অপারেশন হয়েছে প্রায় ৬৮ হাজারের মতো। ছুটিছাঁটা বাদ দিয়ে ২৭০ দিন কর্মদিবস থাকলে প্রতিদিন অপারেশন হয়েছে প্রায় ২৫০টা। তার মানে, প্রতিটা সার্জন দিনে অপারেশন করেছেন ২.৫টার মতো। অন্যদিকে সার্জারির আউটডোরে মোট রোগী দেখা হয়েছে প্রায় ৬ লাখ। প্রতিদিন প্রায় ২২০০ এর মতো। একজন ডাক্তার দেখেছেন প্রতিদিন ২২টা রোগী। লাখ লাখ গরিব মানুষকে সুচিকিৎসা দিয়ে তারা তাদের আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ পান বেতন হিসেবে। আর এত ঝুঁকি নিয়ে ইনফেকশনের মধ্যেও কাজ করেন, তবুও পুলিশ র‌্যাবের মতো মূল বেতনের ৭০% ঝুঁকিভাতা পান না। অথচ লোকজন কিছু ঘটলেই ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলে, হাসপাতাল ভাংচুর করে। অথচ পরিসংখ্যান বলে যে, ৯৯% সুচিকিৎসা হলেও বছরে প্রায় ১০০০ জন রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু ২-৪ জন মারা গেলেই শুরু হয়ে যায় আমাদের হিংস্রপনা। অথচ আমরা একবারও ভাবি না যে, একজন ডাক্তার ৭ দিন অসুস্থ থাকলে তিনি প্রায় ১৪০ জন রোগীর চিকিৎসা ও ১৫ জন রোগীর অপারেশন করতে পারবেন না।

স্কুল-কলেজে যিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন তারাই একদিন ডাক্তার হয়ে আসেন। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিই আজ সমাজে সম্মান পাচ্ছেন কম। বিবিএস করা একজন চিকিৎসক যে মর্যাদা পান কম মেধাবী সম্পন্ন বিসিএস অন্য প্রশাসনের লোক অনেক বেশি মর্যাদা পান। ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করেও অসম্মানিত হন একজন ডাক্তার। এভাবে চলতে থাকলে ডাক্তাররা আর ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। চিকিৎসা সেবায় ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি না নিলে মুমূর্ষু রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়। কথায় কথায় গায়ে হাত তুললে, মামলা হামলা করলে, ভুল চিকিৎসার অপবাদ দিলে ডাক্তাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এটা রোগী কিংবা রোগীর পরিবারের জন্য দুঃসংবাদ বটে!

প্রিয় লেখক গোলাম মর্তুজা তার লেখায় এ বিষয়টি কিছুদিন আগে বিষদ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তার লেখায় বলেছেন- চিকিৎসাসেবা ও ডাক্তার প্রসঙ্গ উঠলেই শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। রোগী, রোগীর পরিজন, বন্ধু কেউ খুশি নন ডাক্তার-হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে। প্রায় সব ডাক্তারের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ। তীব্র অভিযোগ। মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে সংবাদ আসে, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার। বাস্তবতা কি আসলেও এমনই? হাসপাতালে কি কোন চিকিৎসাসেবা নেই? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ করা হয়, এর সবই কি সত্যি? অত্যন্ত স্পর্শকাতর এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের লেখা। একজন খ্যাতিমান ডাক্তার। ডাক্তারিটা তার কাছে ধর্ম পালনের মতো পবিত্র। তিনি বললেন, ‘সম্প্রতি তিনজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ প্রায় বিনাচিকিৎসায় মারা গেলেন। কারণ কী জানেন?’ উত্তর না দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। নিজেই বলতে শুরু করলেন, ‘এই তিনজনের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ। কোন হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু হলেই রোগীর আত্মীয়স্বজন, পরিচিতরা অভিযোগ করেন, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল ভাংচুর করেন। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের জীবনশঙ্কা তৈরি হয়। গণমাধ্যম কোন যাচাই-বাছাই না করে, রোগীর আত্মীয়-পরিজনের বক্তব্য ভিত্তি করে, ডাক্তার এবং হাসপাতালের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করে। ফলে এখন আর মানসম্পন্ন কোন বেসরকারি হাসপাতালে পরিচিত রোগী ভর্তি করেন না। সিট নাই, অমুক হাসপাতালে নিয়ে যানÑ এ ধরনের কথা বলে ফিরিয়ে দেন। এখানে-সেখানে নিতে নিতে রোগী বিনাচিকিৎসায় মারা যান। সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে হয়ত তিনি বেঁচে যেতেন। আর হাসপাতালে ভর্তির পর মারা গেলে, আত্মীয়স্বজন ডাক্তারকে মারতে আসতেন, হাসপাতাল ভাংচুর করতেন। আগে সব সিনিয়র ডাক্তারই হাসপাতাল থেকে যাওয়ার সময় জরুরি বিভাগের ভেতর দিয়ে যেতেন। ক্রিটিক্যাল রোগী থাকলে, দেখে পরামর্শ দিয়ে যেতেন। এখন আর কেউ জরুরি বিভাগের কাছেও যান না। আমি দেখলাম রোগী যখন মারা গেল, দোষ আমার, হাসপাতাল ভাংচুর। গণমাধ্যমে সেই সংবাদ ফলাও করে প্রচার হলো। আমার সারাজীবনের সেবা, অধ্যাবসায়ের কোন মূল্য নেই। মুহূর্তেই আমি ভিলেন, আমি হত্যাকারী।’

পাঠক আপনাদেরই বিচারক বানিয়ে দিতে চাই। ভেবে দেখুন কত ক্ষতি হচ্ছে আমাদের। কোন কিছু না ভেবে, না বুঝে করলে তো ক্ষতি হবেই। সবাইকে এক পাল্লায় মাপছি আমরা। সবাইকে দুষছি। সবাইকে এভাবে ভিলেন বানিয়ে একটা জাতি এগোবে কী করে? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা কি সত্যি? কতটা সত্যি? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে চিকিৎসাসেবা না দেয়ার যে ঢালাও অভিযোগ, তা ষোলোআনা সত্যি নয়। একেবারেই সত্যতা নেই তা বলছি না। বলছি অভিযোগের অনেকটাই অসত্য। তবে রোগীর পেটে ব্যান্ডেজ রেখে সেলাই করে দেয়াসহ নানা রকমের ভুল চিকিৎসার সংবাদ মাঝে মধ্যেই জানা যায়। সংবাদগুলো মিথ্যা নয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দেশে অনেক ডাক্তার আছেন দেবতুল্যের মতো। ডাক্তার ধর্ম পালনের মতো করে মনপ্রাণ দিয়ে রোগীর সেবা করেন। এমন সব ডাক্তারকেও যখন আশঙ্কায় থাকতে হয়, রোগী মারা গেলে তার ওপর আক্রমণ হতে পারে, হতে পারে হাসপাতাল ভাংচুর।

এ কথা সত্য যে, আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবার মান কিন্তু অনেক বেড়েছে। কথায় কথায় আমরা ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ছুটে যাই। মস্তিস্ক, হৃদরোগসহ জটিল অপারেশনে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, ইউরোপ সব জায়গায় রোগী মারা যায়। আমাদের ডাক্তারদের সাফল্যের হার অন্য যেকোন দেশের ডাক্তারের চেয়ে কম নয়। তাহলে আমাদের ডাক্তারের ক্ষেত্রে কেন শরীরিক আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হবে? ভুল চিকিৎসার দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে কেন? অনেক ভালো ডাক্তার আছেন দেশে। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতিও রয়েছে। পাশের দেশ ভারতে এক্সরে মেশিন ও ফিল্মে তাদের তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় বেশি। আমাদের দেশে তা হয় জাপান, জার্মান, কিংবা থাইল্যান্ডের। ভারেতে র মেটিরিয়েল ব্যবহৃত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতেরই। আর আমরা ব্যবহার করি জার্মানি, আমেরিকা, জাপানের। মানের দিক থেকে আমরা পিছিয়ে নেই মোটেও; মানসিকতায় পিছিয়ে আছি আমরা।

আমাদের স্বভাব এমন- বিদেশ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিয়ে এসে বলেন কি ভালো ডাক্তার কত ভালো রিপোর্ট, কত সেবা যতœ। গাঁটের টাকা খরচ হয়ে গেলেও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন আমাদের রোগীরা। বাংলাদেশে অনেক ডাক্তার ভালো চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাতে তাদের মুখে সুনাম শোনা যায় না কখনও। অনেক ভালো, মানবিক ডাক্তার আছেন সারা দেশে। কিছু খারাপ ডাক্তার যারা অনৈতিক বাণিজ্য করছেন। কিন্তু তাদের তুলনায় ভালো ও নৈতিকতাসম্পন্ন ডাক্তারের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি। মন্দের জন্য ঘৃণা করেন, সাজার ব্যবস্থা করেন এটা সমর্থন করি। ভালো যারা করছেন তাদের প্রশংসাও কিন্তু করা দরকার।

পরিশেষে এটাই বলব- শিক্ষক এবং চিকিৎসকের এ মহান পেশা যেন কোনভাবে কলুষিত না হয়। দেশে শিক্ষার মান উন্নয়নে, চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে এ পেশাকে আগলে রাখতে হবে; কারণ শিক্ষা এবং চিকিৎসা দুটিই আমাদের জন্য জরুরি বিষয়।

[লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক]

newsstore13@gmail.com

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০১৯ , ২০ আষাঢ় ১৪২৫, ৩০ শাওয়াল ১৪৪০

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষক এবং চিকিৎসক

মীর আবদুল আলীম

শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য বিষয়টি ন্যস্ত শিক্ষক এবং ডাক্তারে হাতে। শিক্ষকরা মানুষ গড়েন আর চিকিৎসকরা মানুষ মেরামত করেন। দুটিই মহান পেশা। এ পেশার লোকদের নিয়ে কারণে অকারণে বিতর্ক হয় প্রায় সময়ই। শিক্ষকরা ছাত্রদের শাসন করেছেন তো দেশে হৈ চৈ পড়ে যায়। পিতার আসনে থাকা শিক্ষকরা নাজেহাল আর শারীরিক লাঞ্ছনার শিকারও হন প্রায়ই। দেশের সব শিক্ষক পিতার মতো মহান বলব না। অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষক আছেন; শিক্ষক নামে অমানুষও আছেন অনেক। যারা মহান এ পেশাকে কলুষিত করছেন। তাদের কারণেই গোটা শিক্ষক সমাজ আজ অপবাদের বোঝা কাঁধে নিচ্ছেন। বলতেই হয় এখনও অধিকাংশ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সন্তানের মতোই আগলে রাখেন। মনপ্রাণ উজাড় করে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দান করেন। মানুষ গড়ার কাজ করেন। এখনও এ পেশাটা মহান পেশা হিসাবেই আছে। থাকবেও অনন্তকাল।

এ তো গেল মানুষ গড়ার কারিগরদের কথা। আর যারা মানুষ মেরামত করেন। সেই ডাক্তার! চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অপচিকিৎসা আর মানুষ মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে মাঝে মধ্যেই। হাসপাতালে রোগী মারা গেলে সোজা খুনের দায় চাপে ডাক্তারের ওপর। কথায় কথায় বলা হয় ভুল চিকিৎসার কথা। পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয় ‘ওমুক হাসপাতালের ওমুক ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার রোগীর মৃত্যু’। ভুল চিকিৎসার নিশ্চিত কিভাবে হন একজন সাংবাদিক কিংবা রোগীর লোকজন। এটা তো প্রমাণসাপেক্ষ বিষয়। অসুস্থ মানুষই ডাক্তারের কাছে কিংবা হাসপাতালে আসেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মুমূর্ষু রোগীদের আনা হয় হাসপাতালে। সৃষ্টিকর্তাই জীবনের মালিক। মানুষ কেবল চেষ্টা করে মাত্র। প্রায় ক্ষেত্রেই অসুস্থ মানুষটি মারা গেলে বলা হয় ভুল চিকিসৎসার কথা। ব্রেইন স্ট্রোক, হৃদরোগে আক্রান্ত মানুষতো সব সময়ই মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকেন। হাজারো সমস্যার বাংলাদেশে ভুল চিকিৎসা, অপচিকিৎসা নেই তা কিন্তু না। কোন কোন ডাক্তারও অবহেলা করেন, রোগীদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করেন। এমন অনেক হচ্ছে। তবে সব ডাক্তার কি এমন বাজে কাজগুলোর সঙ্গে জড়িত? ভালোগুণের এবং মানবিক সম্পন্ন ডাক্তারের সংখ্যাই এখনও অনেক বেশি।

রাত-দিন একজন ডাক্তারকে পরিশ্রম করতে হয়। রোগীর ডাক পড়লেই তার ঘুম হারাম। আর তাকে যদি কথায় কথায় অপচিকিৎসা কিংবা খুনের অপবাদ কাঁধে নিয়ে চলতে হয় তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ায়? ভালো কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে তো মানুষ। প্লিজ অপবাদ দিবেন না। অভিযোগ করতে হলে ভেবে করবেন। সঠিকটা করবেন। একথা কিন্তু সত্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া সকল সুবিধাদী ছাড়া আমাদের ডাক্তারগণ যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তা কম নয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। কিন্তু এখনও সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়ে ভালো হয়ে ঘরে ফিরছেন। সিট সংকুলান না হলে সেখানে ডাক্তারের দোষ কোথায়। যারা বারান্দায় থাকেন তারাও কিন্তু চিকিৎসা পান। এখনও আস্থার জায়গা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

এ লেখায় দুটি বিষয় রয়েছে শিক্ষক এবং চিকিৎসক। শিক্ষক প্রসঙ্গে পরে আসছি। চিকিৎসা বিষয়ে কিছু ধারণা দিতে চাই পাঠক আপনাদের। হুজুগে বাঙালি আমরা, বুঝেও লড়ি না বুঝেও লড়ি। কথা বলতে তো সীমা-পরিসীমা হারিয়ে ফেলতে ওস্তাদ সবাই। পাঠক বলেন তো, কতজন মানুষের জন্য কতজন ডাক্তার নিয়োজিত আছেন এদেশে। কত রোগীর চিকিৎসার সঙ্গতি আছে এ দেশের হাসপাতালগুলোর। ঢাল তলোয়ার (ডাক্তার ওষুধ) না দিয়ে চিকিৎসা করতে বলবেন তা কি করে হয়?

এক পরিসংখ্যানে এভাবেই উল্লেখ আছেÑ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ডিপার্টমেন্টে প্রায় সকল প্রকার সার্জারি হয়। মোট ডাক্তারের সংখ্যা ১০০ জন। গত এক বছরে অপারেশন হয়েছে প্রায় ৬৮ হাজারের মতো। ছুটিছাঁটা বাদ দিয়ে ২৭০ দিন কর্মদিবস থাকলে প্রতিদিন অপারেশন হয়েছে প্রায় ২৫০টা। তার মানে, প্রতিটা সার্জন দিনে অপারেশন করেছেন ২.৫টার মতো। অন্যদিকে সার্জারির আউটডোরে মোট রোগী দেখা হয়েছে প্রায় ৬ লাখ। প্রতিদিন প্রায় ২২০০ এর মতো। একজন ডাক্তার দেখেছেন প্রতিদিন ২২টা রোগী। লাখ লাখ গরিব মানুষকে সুচিকিৎসা দিয়ে তারা তাদের আয়ের মাত্র ১০ শতাংশ পান বেতন হিসেবে। আর এত ঝুঁকি নিয়ে ইনফেকশনের মধ্যেও কাজ করেন, তবুও পুলিশ র‌্যাবের মতো মূল বেতনের ৭০% ঝুঁকিভাতা পান না। অথচ লোকজন কিছু ঘটলেই ডাক্তারদের গায়ে হাত তোলে, হাসপাতাল ভাংচুর করে। অথচ পরিসংখ্যান বলে যে, ৯৯% সুচিকিৎসা হলেও বছরে প্রায় ১০০০ জন রোগী ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু ২-৪ জন মারা গেলেই শুরু হয়ে যায় আমাদের হিংস্রপনা। অথচ আমরা একবারও ভাবি না যে, একজন ডাক্তার ৭ দিন অসুস্থ থাকলে তিনি প্রায় ১৪০ জন রোগীর চিকিৎসা ও ১৫ জন রোগীর অপারেশন করতে পারবেন না।

স্কুল-কলেজে যিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন তারাই একদিন ডাক্তার হয়ে আসেন। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিই আজ সমাজে সম্মান পাচ্ছেন কম। বিবিএস করা একজন চিকিৎসক যে মর্যাদা পান কম মেধাবী সম্পন্ন বিসিএস অন্য প্রশাসনের লোক অনেক বেশি মর্যাদা পান। ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করেও অসম্মানিত হন একজন ডাক্তার। এভাবে চলতে থাকলে ডাক্তাররা আর ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। চিকিৎসা সেবায় ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি না নিলে মুমূর্ষু রোগীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়। কথায় কথায় গায়ে হাত তুললে, মামলা হামলা করলে, ভুল চিকিৎসার অপবাদ দিলে ডাক্তাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এটা রোগী কিংবা রোগীর পরিবারের জন্য দুঃসংবাদ বটে!

প্রিয় লেখক গোলাম মর্তুজা তার লেখায় এ বিষয়টি কিছুদিন আগে বিষদ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি তার লেখায় বলেছেন- চিকিৎসাসেবা ও ডাক্তার প্রসঙ্গ উঠলেই শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। রোগী, রোগীর পরিজন, বন্ধু কেউ খুশি নন ডাক্তার-হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে। প্রায় সব ডাক্তারের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ। তীব্র অভিযোগ। মাঝে মধ্যেই গণমাধ্যমে সংবাদ আসে, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার। বাস্তবতা কি আসলেও এমনই? হাসপাতালে কি কোন চিকিৎসাসেবা নেই? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ করা হয়, এর সবই কি সত্যি? অত্যন্ত স্পর্শকাতর এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের লেখা। একজন খ্যাতিমান ডাক্তার। ডাক্তারিটা তার কাছে ধর্ম পালনের মতো পবিত্র। তিনি বললেন, ‘সম্প্রতি তিনজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ প্রায় বিনাচিকিৎসায় মারা গেলেন। কারণ কী জানেন?’ উত্তর না দিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। নিজেই বলতে শুরু করলেন, ‘এই তিনজনের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ। কোন হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু হলেই রোগীর আত্মীয়স্বজন, পরিচিতরা অভিযোগ করেন, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল ভাংচুর করেন। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের জীবনশঙ্কা তৈরি হয়। গণমাধ্যম কোন যাচাই-বাছাই না করে, রোগীর আত্মীয়-পরিজনের বক্তব্য ভিত্তি করে, ডাক্তার এবং হাসপাতালের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রচার করে। ফলে এখন আর মানসম্পন্ন কোন বেসরকারি হাসপাতালে পরিচিত রোগী ভর্তি করেন না। সিট নাই, অমুক হাসপাতালে নিয়ে যানÑ এ ধরনের কথা বলে ফিরিয়ে দেন। এখানে-সেখানে নিতে নিতে রোগী বিনাচিকিৎসায় মারা যান। সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে হয়ত তিনি বেঁচে যেতেন। আর হাসপাতালে ভর্তির পর মারা গেলে, আত্মীয়স্বজন ডাক্তারকে মারতে আসতেন, হাসপাতাল ভাংচুর করতেন। আগে সব সিনিয়র ডাক্তারই হাসপাতাল থেকে যাওয়ার সময় জরুরি বিভাগের ভেতর দিয়ে যেতেন। ক্রিটিক্যাল রোগী থাকলে, দেখে পরামর্শ দিয়ে যেতেন। এখন আর কেউ জরুরি বিভাগের কাছেও যান না। আমি দেখলাম রোগী যখন মারা গেল, দোষ আমার, হাসপাতাল ভাংচুর। গণমাধ্যমে সেই সংবাদ ফলাও করে প্রচার হলো। আমার সারাজীবনের সেবা, অধ্যাবসায়ের কোন মূল্য নেই। মুহূর্তেই আমি ভিলেন, আমি হত্যাকারী।’

পাঠক আপনাদেরই বিচারক বানিয়ে দিতে চাই। ভেবে দেখুন কত ক্ষতি হচ্ছে আমাদের। কোন কিছু না ভেবে, না বুঝে করলে তো ক্ষতি হবেই। সবাইকে এক পাল্লায় মাপছি আমরা। সবাইকে দুষছি। সবাইকে এভাবে ভিলেন বানিয়ে একটা জাতি এগোবে কী করে? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা কি সত্যি? কতটা সত্যি? ডাক্তারদের বিরুদ্ধে চিকিৎসাসেবা না দেয়ার যে ঢালাও অভিযোগ, তা ষোলোআনা সত্যি নয়। একেবারেই সত্যতা নেই তা বলছি না। বলছি অভিযোগের অনেকটাই অসত্য। তবে রোগীর পেটে ব্যান্ডেজ রেখে সেলাই করে দেয়াসহ নানা রকমের ভুল চিকিৎসার সংবাদ মাঝে মধ্যেই জানা যায়। সংবাদগুলো মিথ্যা নয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। দেশে অনেক ডাক্তার আছেন দেবতুল্যের মতো। ডাক্তার ধর্ম পালনের মতো করে মনপ্রাণ দিয়ে রোগীর সেবা করেন। এমন সব ডাক্তারকেও যখন আশঙ্কায় থাকতে হয়, রোগী মারা গেলে তার ওপর আক্রমণ হতে পারে, হতে পারে হাসপাতাল ভাংচুর।

এ কথা সত্য যে, আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবার মান কিন্তু অনেক বেড়েছে। কথায় কথায় আমরা ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ছুটে যাই। মস্তিস্ক, হৃদরোগসহ জটিল অপারেশনে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, ইউরোপ সব জায়গায় রোগী মারা যায়। আমাদের ডাক্তারদের সাফল্যের হার অন্য যেকোন দেশের ডাক্তারের চেয়ে কম নয়। তাহলে আমাদের ডাক্তারের ক্ষেত্রে কেন শরীরিক আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি হবে? ভুল চিকিৎসার দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে কেন? অনেক ভালো ডাক্তার আছেন দেশে। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতিও রয়েছে। পাশের দেশ ভারতে এক্সরে মেশিন ও ফিল্মে তাদের তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় বেশি। আমাদের দেশে তা হয় জাপান, জার্মান, কিংবা থাইল্যান্ডের। ভারেতে র মেটিরিয়েল ব্যবহৃত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারতেরই। আর আমরা ব্যবহার করি জার্মানি, আমেরিকা, জাপানের। মানের দিক থেকে আমরা পিছিয়ে নেই মোটেও; মানসিকতায় পিছিয়ে আছি আমরা।

আমাদের স্বভাব এমন- বিদেশ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে চিকিৎসা নিয়ে এসে বলেন কি ভালো ডাক্তার কত ভালো রিপোর্ট, কত সেবা যতœ। গাঁটের টাকা খরচ হয়ে গেলেও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন আমাদের রোগীরা। বাংলাদেশে অনেক ডাক্তার ভালো চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাতে তাদের মুখে সুনাম শোনা যায় না কখনও। অনেক ভালো, মানবিক ডাক্তার আছেন সারা দেশে। কিছু খারাপ ডাক্তার যারা অনৈতিক বাণিজ্য করছেন। কিন্তু তাদের তুলনায় ভালো ও নৈতিকতাসম্পন্ন ডাক্তারের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি। মন্দের জন্য ঘৃণা করেন, সাজার ব্যবস্থা করেন এটা সমর্থন করি। ভালো যারা করছেন তাদের প্রশংসাও কিন্তু করা দরকার।

পরিশেষে এটাই বলব- শিক্ষক এবং চিকিৎসকের এ মহান পেশা যেন কোনভাবে কলুষিত না হয়। দেশে শিক্ষার মান উন্নয়নে, চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে এ পেশাকে আগলে রাখতে হবে; কারণ শিক্ষা এবং চিকিৎসা দুটিই আমাদের জন্য জরুরি বিষয়।

[লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক]

newsstore13@gmail.com