প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে বেঁচে থাক সুন্দরবন

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বিশ্ব প্রকৃতির বিরলতম সম্পদ বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের অস্তিত্ব-ঝুঁকি আবার বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এসেছে। সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনায় সুন্দরবনের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ সচেতন মহলের শুরু থেকেই রয়েছে নানা আশঙ্কা। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের বিষাক্ত গ্যাস সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে তুলবে- এ নিয়ে সোচ্চার রয়েছেন পরিবেশবাদীরা। এছাড়া রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে জাহাজডুবির আশঙ্কাও। সুন্দরবনের আশেপাশের নদীতে ঘটবে পানিদূষণ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতির সম্ভাবনা দিন দিন বেড়ে যাবে। এই ঝুঁকির মধ্যে সুন্দরবনের সাড়ে চার কিলোমিটারের মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের পরিবেশ-ঝুঁকি বাড়বে বৈ কমবে না। আজারবাইজানের বাকুতে ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম অধিবেশনের জন্য প্রস্তাবিত এজেন্ডায় সুন্দরবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব-ঐতিহ্য’-এর তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। ৩০ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত আজারবাইজানের রাজধানীতে বাকুতে বিশ্ব-ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সুন্দরবন বিশ্ব-ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

বিগত ৩ বছরে সুন্দরবনের আশেপাশের নদীতে অনেকগুলো জাহাজডুবিতে বিপন্ন হয়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বাগেরহাটের মংলা বন্দর চ্যানেলে সুন্দরবনের মধ্যে পশুর নদের হারবাড়িয়ায় ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই একটি লাইটার জাহাজ ডুবে কয়লার ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কারণে নদীর পানি, জলজ প্রাণী ও সুন্দরবনের গাছপালার শ্বাসমূলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। হিরণ পয়েন্টের অদূরে ১ হাজার মেট্রিক টন কয়লাসহ কার্গো জাহাজটি ডুবে উচ্চমাত্রার সালফার সমুদ্র-মোহনায় নদীর পানিদূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০১৪ সালে সুন্দরবনের মংলা পশুর চ্যানেলের শেওলা নদীতে তেলের ট্যাংকার জাহাজ ও ২০১৫ সালে কয়লা বোঝাই কার্গো ডুবে বন ও পরিবেশের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারবার ডুবে যাওয়া জাহাজে পরিবেশ দূষণকারী নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ও কয়লা থাকায় কয়লামধ্যস্থ সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক নদীর পানি ও বায়ুমন্ডলকে দূষিত করে। আর মিথেন গ্যাস বনের শ্বাসমূল উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীর প্রজননকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদীতে যে সব জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে এর মধ্যে থাকে ফার্নেসওয়েল, ফ্লাই গ্যাস, কয়লা অথবা সার। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার নদীর পানিদূষণের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলছে। ধীরে ধীরে জীবনঝুঁকির মধ্যে পড়ছে এখানকার বনজ সম্পদ ও প্রাণিকূল। জাহাজডুবি ছাড়াও প্রায়ই আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। পুড়ে ছারখার হচ্ছে বিপুল বনরাজি। সুন্দরবনে সাধারণত আগুন এমনিতেই লাগে না। এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে সুন্দরবনে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় বন। বনখেকোরা কখনও কেটে উজাড় করে গাছপালা। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার অনুসঙ্গ সুন্দরবনের দুর্লভ প্রাণী বাঘ হত্যায় লিপ্ত এক শ্রেণীর কুচক্র। ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বন্যপ্রাণী হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটার দূরে স্থাপিত হওয়ার কথা থাকলেও তা সুন্দরবনের জন্য কতখানি নিরাপদ হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে পরিবেশবাদীদের। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জ্বালানি দহনে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে ও আশেপাশের নদীর পানিদূষণ কতখানি এড়ানো সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। জাতীয় পরিবেশ কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক সুন্দরবন পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) মধ্যে লাল শ্রেণীর যেমন ট্যানারি, ডাইং, সিমেন্ট, তামাক, ইট, টায়ার ও বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন নিষিদ্ধ। এছাড়া সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় আটটি টেলিটক মোবাইল ফোনের টাওয়ার নির্মাণের কারণেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় পাঁচটি সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্তে সুন্দরবনের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। অথচ সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের বাইরের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। এ এলাকায় কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সিমেন্ট কারখানাগুলো স্থাপিত হতে যাচ্ছে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে। আর সিমেন্ট ফ্যাক্টরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হবে সুন্দরবনেরই নদীপথ। আগের মতো সিমেন্টের কাঁচামালবাহী জাহাজ ডুবে গেলে ক্লিংকারের প্রধান উপাদান চুনাপাথর পানিতে ছড়িয়ে পড়ে নদীর পানি তথা সুন্দরবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও সিমেন্ট উৎপাদনের সময় চুনাপাথর, গ্যাস, জিপসাম জাতীয় উপাদানের সূক্ষ্মকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকার বাতাস দূষিত করবে। সুন্দরবনের শ্যামল বনরাজির ওপর ধুলার আস্তরণ পড়ে বাধাগ্রস্ত করবে গাছপালার বৃদ্ধি। সিমেন্ট কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাড়িঘর, রাস্তাঘাট নষ্ট করবে সুন্দনবনের সামগ্রিক পরিবেশ।

উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য নিয়ে আপন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। প্রায় ২৩০০ বর্গমাইল এলাকা বিস্তৃত সুন্দরবনে সময়ের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বসতি স্থাপন, আবাদি জমি তৈরি, গৃহ নির্মাণ ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের তাগিদে নির্বিচারে কাটা হয়েছে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছসহ নানা প্রজাতির গাছপালা। প্রাকৃতিক ঝড়-বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও প্রায় প্রতি বছর প্রচুর গাছপালা ও পশুপাখি মারা যায়। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা এবং ঝড়, বন্যা, সিডর ও আইলার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এলাকাকে বাঁচাতে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনাঞ্চলের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সুন্দরবনের ছিল এক নিবিড় সম্পর্ক। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও আকর্ষণীয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এবং এর জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। সুন্দরবনের কাছাকাছি নদীতে কয়লা ও তেল বোঝাই ট্যাংকারডুবির ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সুন্দরবনের গাছপালা কাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। বন পুড়িয়ে দেয়া দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে নিতে হবে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ যে কোন বন্যপ্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।

বন অধিদফতরের ‘বাংলাদেশ ফরেস্ট্রি মাস্টার প্ল্যান-২০১৭-৩৬’ খসরা মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশ রয়েছে ধ্বংস ঝুঁকিতে। জনবল সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের অনুপস্থিতির পাশাপাশি বনভূমি দখল, বন বিভাগের অদক্ষতা, জনসচেতনতার অভাব, সর্বোপরি আইনের যথাযথ প্রয়োগের ব্যর্থতা বনভূমি সুরক্ষায় প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বাধা কাটিয়ে উঠে সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য ছোটছোট বনাঞ্চল রক্ষা, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। জীবিকা, আবাসনসহ অন্যান্য প্রয়োজনে বনভূমির ওপর মানুষের চাপ হ্রাস করা অত্যাবশ্যক। সুন্দরবনসহ দেশের যে কোনা বনভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের কাছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে এর পরিবেশগত প্রভাবের দিকগুলো বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারসহ জনবল সংকট ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা দূর করা অত্যাবশ্যক। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ দেশের সব বনভূমি রক্ষাকে দিতে হবে অন্যতম অগ্রাধিকার। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। দেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্যও শিল্পায়ন অপরিহার্য। কিন্তু অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে কোন উন্নয়নই কাম্য হতে পারে না। শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে পরিবেশকে বিপন্ন না করে দেশের এমন যে কোন সুবিধাজনক এলাকায়। ভয়াবহ ঝড়ঝঞ্ঝার সময় পাহাড়ের মতো উপকূলীয় এলাকার রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে প্রাকৃতিক বনের মতোই। ১৯৯৯ সালে ইউনেসস্কো কর্তৃক জাতীয় ঐতিহ্য হিসাবে তালিকাভুক্ত সুন্দরবন যেন কোনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব-ঐতিহ্যের মধ্যে না পড়ে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০১৯ , ২০ আষাঢ় ১৪২৫, ৩০ শাওয়াল ১৪৪০

প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে বেঁচে থাক সুন্দরবন

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

বিশ্ব প্রকৃতির বিরলতম সম্পদ বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের অস্তিত্ব-ঝুঁকি আবার বিশ্বব্যাপী আলোচনায় এসেছে। সুন্দরবনের কাছাকাছি রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনায় সুন্দরবনের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ সচেতন মহলের শুরু থেকেই রয়েছে নানা আশঙ্কা। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের বিষাক্ত গ্যাস সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে তুলবে- এ নিয়ে সোচ্চার রয়েছেন পরিবেশবাদীরা। এছাড়া রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে জাহাজডুবির আশঙ্কাও। সুন্দরবনের আশেপাশের নদীতে ঘটবে পানিদূষণ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম ও প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতির সম্ভাবনা দিন দিন বেড়ে যাবে। এই ঝুঁকির মধ্যে সুন্দরবনের সাড়ে চার কিলোমিটারের মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবনের পরিবেশ-ঝুঁকি বাড়বে বৈ কমবে না। আজারবাইজানের বাকুতে ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম অধিবেশনের জন্য প্রস্তাবিত এজেন্ডায় সুন্দরবনকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব-ঐতিহ্য’-এর তালিকাভুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। ৩০ জুন থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত আজারবাইজানের রাজধানীতে বাকুতে বিশ্ব-ঐতিহ্য কমিটির ৪৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সুন্দরবন বিশ্ব-ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

বিগত ৩ বছরে সুন্দরবনের আশেপাশের নদীতে অনেকগুলো জাহাজডুবিতে বিপন্ন হয়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। বাগেরহাটের মংলা বন্দর চ্যানেলে সুন্দরবনের মধ্যে পশুর নদের হারবাড়িয়ায় ৭৭৫ মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই একটি লাইটার জাহাজ ডুবে কয়লার ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কারণে নদীর পানি, জলজ প্রাণী ও সুন্দরবনের গাছপালার শ্বাসমূলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। হিরণ পয়েন্টের অদূরে ১ হাজার মেট্রিক টন কয়লাসহ কার্গো জাহাজটি ডুবে উচ্চমাত্রার সালফার সমুদ্র-মোহনায় নদীর পানিদূষণ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০১৪ সালে সুন্দরবনের মংলা পশুর চ্যানেলের শেওলা নদীতে তেলের ট্যাংকার জাহাজ ও ২০১৫ সালে কয়লা বোঝাই কার্গো ডুবে বন ও পরিবেশের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বারবার ডুবে যাওয়া জাহাজে পরিবেশ দূষণকারী নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ও কয়লা থাকায় কয়লামধ্যস্থ সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন-ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো বিষাক্ত রাসায়নিক নদীর পানি ও বায়ুমন্ডলকে দূষিত করে। আর মিথেন গ্যাস বনের শ্বাসমূল উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীর প্রজননকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সুন্দরবনের পাশে বয়ে চলা নদীতে যে সব জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে এর মধ্যে থাকে ফার্নেসওয়েল, ফ্লাই গ্যাস, কয়লা অথবা সার। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার নদীর পানিদূষণের মাত্রা ক্রমশ বেড়ে চলছে। ধীরে ধীরে জীবনঝুঁকির মধ্যে পড়ছে এখানকার বনজ সম্পদ ও প্রাণিকূল। জাহাজডুবি ছাড়াও প্রায়ই আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে সুন্দরবনে। পুড়ে ছারখার হচ্ছে বিপুল বনরাজি। সুন্দরবনে সাধারণত আগুন এমনিতেই লাগে না। এক শ্রেণীর দুর্বৃত্ত তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে সুন্দরবনে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় বন। বনখেকোরা কখনও কেটে উজাড় করে গাছপালা। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণসহ অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার অনুসঙ্গ সুন্দরবনের দুর্লভ প্রাণী বাঘ হত্যায় লিপ্ত এক শ্রেণীর কুচক্র। ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বন্যপ্রাণী হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটার দূরে স্থাপিত হওয়ার কথা থাকলেও তা সুন্দরবনের জন্য কতখানি নিরাপদ হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে পরিবেশবাদীদের। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জ্বালানি দহনে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যে ও আশেপাশের নদীর পানিদূষণ কতখানি এড়ানো সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। জাতীয় পরিবেশ কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক সুন্দরবন পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) মধ্যে লাল শ্রেণীর যেমন ট্যানারি, ডাইং, সিমেন্ট, তামাক, ইট, টায়ার ও বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন নিষিদ্ধ। এছাড়া সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় আটটি টেলিটক মোবাইল ফোনের টাওয়ার নির্মাণের কারণেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। সম্প্রতি সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় পাঁচটি সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্তে সুন্দরবনের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। অথচ সুন্দরবন রিজার্ভ ফরেস্টের বাইরের চতুর্দিকে ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। এ এলাকায় কোন ধরনের স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু সিমেন্ট কারখানাগুলো স্থাপিত হতে যাচ্ছে ৬ কিলোমিটারের মধ্যে। আর সিমেন্ট ফ্যাক্টরির প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হবে সুন্দরবনেরই নদীপথ। আগের মতো সিমেন্টের কাঁচামালবাহী জাহাজ ডুবে গেলে ক্লিংকারের প্রধান উপাদান চুনাপাথর পানিতে ছড়িয়ে পড়ে নদীর পানি তথা সুন্দরবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এছাড়াও সিমেন্ট উৎপাদনের সময় চুনাপাথর, গ্যাস, জিপসাম জাতীয় উপাদানের সূক্ষ্মকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকার বাতাস দূষিত করবে। সুন্দরবনের শ্যামল বনরাজির ওপর ধুলার আস্তরণ পড়ে বাধাগ্রস্ত করবে গাছপালার বৃদ্ধি। সিমেন্ট কারখানাকে ঘিরে গড়ে ওঠা বাড়িঘর, রাস্তাঘাট নষ্ট করবে সুন্দনবনের সামগ্রিক পরিবেশ।

উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য নিয়ে আপন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। প্রায় ২৩০০ বর্গমাইল এলাকা বিস্তৃত সুন্দরবনে সময়ের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বসতি স্থাপন, আবাদি জমি তৈরি, গৃহ নির্মাণ ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের তাগিদে নির্বিচারে কাটা হয়েছে সুন্দরবনের সুন্দরী গাছসহ নানা প্রজাতির গাছপালা। প্রাকৃতিক ঝড়-বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগেও প্রায় প্রতি বছর প্রচুর গাছপালা ও পশুপাখি মারা যায়। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা এবং ঝড়, বন্যা, সিডর ও আইলার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এলাকাকে বাঁচাতে সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনাঞ্চলের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সুন্দরবনের ছিল এক নিবিড় সম্পর্ক। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও আকর্ষণীয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন এবং এর জীববৈচিত্র্য বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। সুন্দরবনের কাছাকাছি নদীতে কয়লা ও তেল বোঝাই ট্যাংকারডুবির ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে সুন্দরবনের গাছপালা কাটা সম্পূর্ণ বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। বন পুড়িয়ে দেয়া দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে নিতে হবে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ যে কোন বন্যপ্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।

বন অধিদফতরের ‘বাংলাদেশ ফরেস্ট্রি মাস্টার প্ল্যান-২০১৭-৩৬’ খসরা মতে, বাংলাদেশের প্রায় ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশ রয়েছে ধ্বংস ঝুঁকিতে। জনবল সংকট, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগের অনুপস্থিতির পাশাপাশি বনভূমি দখল, বন বিভাগের অদক্ষতা, জনসচেতনতার অভাব, সর্বোপরি আইনের যথাযথ প্রয়োগের ব্যর্থতা বনভূমি সুরক্ষায় প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বাধা কাটিয়ে উঠে সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য ছোটছোট বনাঞ্চল রক্ষা, নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। জীবিকা, আবাসনসহ অন্যান্য প্রয়োজনে বনভূমির ওপর মানুষের চাপ হ্রাস করা অত্যাবশ্যক। সুন্দরবনসহ দেশের যে কোনা বনভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের কাছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে এর পরিবেশগত প্রভাবের দিকগুলো বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারসহ জনবল সংকট ও দুর্বল ব্যবস্থাপনা দূর করা অত্যাবশ্যক। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ দেশের সব বনভূমি রক্ষাকে দিতে হবে অন্যতম অগ্রাধিকার। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। দেশের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্যও শিল্পায়ন অপরিহার্য। কিন্তু অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে কোন উন্নয়নই কাম্য হতে পারে না। শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে পরিবেশকে বিপন্ন না করে দেশের এমন যে কোন সুবিধাজনক এলাকায়। ভয়াবহ ঝড়ঝঞ্ঝার সময় পাহাড়ের মতো উপকূলীয় এলাকার রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে প্রাকৃতিক বনের মতোই। ১৯৯৯ সালে ইউনেসস্কো কর্তৃক জাতীয় ঐতিহ্য হিসাবে তালিকাভুক্ত সুন্দরবন যেন কোনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব-ঐতিহ্যের মধ্যে না পড়ে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক]