ঐতিহাসিক মহান সান্তাল হুলের (বিদ্রোহ) চেতনা বিকশিত হোক

সুবোধ এম বাস্কে

সান্তাল হুল অবিভক্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগান্তকারী প্রথম স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন। আদিবাসীরাই প্রথম বিদেশি শক্তির বিরদ্ধে লড়াই সংগ্রাম ও যুদ্ধ করেছিল। তাদের দেখানো পথ ধরে অন্যান্য জনজাতির মানুষ লড়াই শুরু করে। শত শত বছর ধরে চলে আসা সান্তালসহ আদিবাসীদের ওপর মহাজন, সুদখোর, জমিদার ও বর্বর ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা ও স্বাধীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুনা মুরমু ছয় সন্তান সিদো-কানহু-চাঁদ-ভাইরো-ফুলোমনি-ঝানো মুরমুর নেতৃত্বে অসংখ্য আদিবাসী ও অ-আদিবাসীরা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের স্থান ভগনাডিহি গ্রাম, আজ থেকে ১৬৪ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। হুলের দিন সিদো কানহুর নেতৃত্বে আদিবাসীরা ঐতিহ্য অনুযায়ী পাতাসহ ছোট শালের ডাল পাঠিয়ে কাছের ও দূরের মানুষদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনেক দিন থেকেই সান্তালসহ আদিবাসীরা জমিদার, মহাজনদের অত্যাচার, অপমান ও লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে আসছিলেন। তাই এই আহ্বান ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সে সমাবেশে প্রায় দশ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন এবং সভা থেকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে-

এখন থেকে কেউ আর জমির জন্য খাজনা প্রদান করবে না।

যার যে রকম খুশি ইচ্ছেমতো জমি চাষাবাদ করতে পারবে

এখন থেকে সান্তালদের সমস্ত ধরনের ঋণ মওকুফ করা হলো

সান্তালরা ভারতবর্ষের কৃষি সভ্যতার জনক। তারাই বিস্তীর্ণ অরণ্য, পাহাড় কেটে কৃষি ও বাসযোগ্য ভূমি তৈরি করেছিল। কিন্তু তাদের চাষযোগ্য জমিতে দিকুসহ অন্যদের চোখ পড়ল। তাই দেখা গেল বারংবার সান্তালরা নিজ জমি হতেই প্রতারিত ও অত্যাচারিত হতে লাগল। নিজেদের জমি থেকেই তারা উচ্ছেদ হতে লাগল। অন্যদিকে অভাব-অনটনের কারণে মহাজনদের কাছ থেকে চড়াসুদে টাকা ধার নিতে হতো কিন্তু কখনও সেই ঋণ শোধ হতো না বরং উল্টো ঋণের পরিমাণ বেড়ে যেত। সান্তালদের সাথে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মহাজন, জমিদার ও সুদখোররা দুই ধরনের বাটখারা ব্যবহার করত। একটির নাম ‘কেনারাম বা বড় বউ’ অন্যটি ‘বেচারাম বা ছোট বউ’। কেনার সময় ব্যবহার হতো কেনারাম অর্থাৎ বেশি কিনতো কিন্তু বিক্রির সময় ব্যবহৃত হতো বেচারাম; যা দিয়ে ওজনে কম দেয়া হতো। এভাবেই অসদুপায়ে মুনাফালোভীরা সান্তালদের ঠকিয়ে বিপুল লাভ করত। এছাড়াও বিদ্রোহের জন্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সেই সভা থেকে। সেগুলো হচ্ছে, জমি চাই, মুক্তি চাই, অত্যাচারী জমিদার ও মহাজনদের জুলুমের চির অবসান, সরকারি অত্যাচার ও নিপীড়নের অবসান। কোন দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় সান্তালদের নেতৃত্বে নিপীড়িত জনগণ- অসান্তাল, বিহারি, হিন্দু, মুসলমানসহ নিপীড়িত মানুষ সে দিন অর্থাৎ ৩০ জুন ১৮৫৫ সালে সর্বাত্মক সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এই হুল বা আন্দোলন ভারতবর্ষের ইতিহাসকে বদলে দেয়। এর দুই বছর পর সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য মুক্তির স্বপ্ন সান্তালরা প্রথম দেখেছিল। এই যুদ্ধে সান্তালসহ অন্যান্য জাতির মানুষও নিহত হন। পরে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় সান্তালসহ আদিবাসীদের জন্য সান্তাল পরগণা নামক নন-রেগুলেটেড এলাকা নির্ধারণ করে।

আদিবাসীরাই প্রথম এ অরণ্য জনপদ, শ্বাপদ সংকুল পাহাড়, বন জঙ্গল কেটে চাষাবাদযোগ্য করে তুলেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের ফসলি জমিতে চোখ পড়তো মহাজন, সুদখোর ও দেকোদের (আদিবাসী বাদে অন্যদের দেকো বলা হয়)। ফলে থেকে সেখান তাদের উচ্ছেদ হতে হতো। আবার নতুন জনপদ বসবাস ও চাষযোগ্য করে তুলতো। কিন্তু কোথাও তাদের শোষণ উৎপীড়নের প্রতিকার ছিল না। উপায়ন্তর না দেখে তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার মনোভাব জেগে ওঠে।

সান্তাল হুলের দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে গেলেও সান্তালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের দেশে সান্তাল হুলসহ অন্যান্য আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রতিবছর আদিবাসীদের ভূমি হারানোর ঘটনা, উচ্ছেদ, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ, হুমকি ও হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। সান্তাল হুলের পর ভারতে আদিবাসীদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের দেশে সেটা সম্ভব হয়নি। পূর্ববঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ মোতাবেক ভূমি রক্ষার বিধান থাকলেও নানা উপায়ে আদিবাসীদের জমিজমা জাল দলিল, হামলা, মামলা করে দখল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমির জন্য আলফ্রেড সরেনকে ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট হত্যা, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর বাগদা ফার্মে নিজ ভূমিতে আদিবাসী হত্যা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, পাবর্তীপুরের চিড়াকুটা গ্রামে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, কোনটারই সুবিচার পায়নি আদিবাসীরা। শুধু তাই নয়, আদিবাসীরা আজ সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত। ভাষার প্রশ্নে ৫টি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় পুস্তক প্রণীত হলেও সান্তালদের জন্য পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঈর্ষণীয় হলেও উন্নয়নের সুফল থেকে আদিবাসীরা বঞ্চিত থাকছেন। সমতলের আদিবাসীদের ভূমি রক্ষায় পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

আমাদের দেশে বাঙালি ভিন্ন পঞ্চাশের অধিক ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করছে। তাদের রং, চেহারা, ভাষা, উৎসব, ধর্ম, কৃষ্টি, শারীরিক কাঠামো, সমাজ গঠন সবকিছুই আলাদা। জাতিগতভাবে প্রত্যেকের নাম আলাদা হলেও সামষ্টিক পরিচয়ে নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আদিবাসী ও বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ভাষা, উৎসব, ধর্ম, বর্ণ, প্রথা, বিশ্বাস, যাপিত জীবন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় করেছে। কিন্তু আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালির মনোযোগ বরাবরই কম। ফলে তাদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি বিশেষত নতুন প্রজন্মের কাছে এক ধরনের উন্নাসিকতা তৈরি হয়েছে। নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই আদিবাসীদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা, ঐতিহ্য, তাদের লড়াই-সংগ্রামের প্রতি কম আগ্রহী। ফলে পারস্পরিক জানা ও বোঝার অভাবে আদিবাসী বাঙালির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। বাঙালি নতুন প্রজন্ম যত বেশি আদিবাসীর সংবেদনশীল, আগ্রহী হবে এবং জানা-বোঝার পরিধি বাড়বে ততই সার্বিক মঙ্গল। বাংলাদেশের আদিবাসীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের সংখ্যা আমাদের মোট জনসংখ্যার ২% কাছাকাছি। সামষ্টিক পরিচয় আদিবাসী হলেও প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ আলাদা। তাই সবার সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়াও আলাদা হওয়া উচিত। সরকার, সুধীজন, নাগরিক সমাজ সবাই আদিবাসীদের সমস্যাগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবিলা ও উত্তরণের উপায় খুঁজবেন- এটিই সবার প্রত্যাশা। প্রতিনিয়ত দেশের আদিবাসীরা নানামুখী আতঙ্কের মধ্যে থাকে। উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৯৫% আদিবাসী এখন ভূমিহীন। শুধু ভূমিই নয়, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উৎসব, খাদ্যাভাস, পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুই আজ হুমকির মুখে। অনেক আদিবাসীর ভাষা চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। এখনই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বাকি আদিবাসীরাও বিলীন হবে চিরদিনের মতো। সান্তাল হুল থেকে চেতনা নিয়ে সরকার, রাষ্ট্র আদিবাসীদের রক্ষা, উন্নয়ন ও বিকশিত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেবে। ২০২০ সাল থেকে সান্তাল শিশুরা সান্তালি হরফে (রোমান লিপি) পাঠ্যপুস্তক পড়তে পারবে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠিত হবে। আদিবাসীদের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের প্রাক্কালে তাদের মতামত গ্রহণ করা হবে। সান্তাল হুল, উলগুলান, তিলকা মুরমু প্রথম লড়াই, টংক আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, খাসি বিদ্রোহ, গারো বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহসহ সব লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস জাতীয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক গবেষণা হবে। তবেই সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ গড়ে উঠা সম্ভব হবে। বাঙালি শিশু ও শিক্ষার্থীরা আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রাম ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবে- এমন সুন্দর প্রত্যাশা আমরা দেখতেই পারি। সবাইকে সান্তাল হুলের বিপ্লবী শুভেচ্ছা।

[লেখক : আদিবাসী লেখক ও উন্নয়নকর্মী]

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০১৯ , ২০ আষাঢ় ১৪২৫, ৩০ শাওয়াল ১৪৪০

ঐতিহাসিক মহান সান্তাল হুলের (বিদ্রোহ) চেতনা বিকশিত হোক

সুবোধ এম বাস্কে

সান্তাল হুল অবিভক্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে যুগান্তকারী প্রথম স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন। আদিবাসীরাই প্রথম বিদেশি শক্তির বিরদ্ধে লড়াই সংগ্রাম ও যুদ্ধ করেছিল। তাদের দেখানো পথ ধরে অন্যান্য জনজাতির মানুষ লড়াই শুরু করে। শত শত বছর ধরে চলে আসা সান্তালসহ আদিবাসীদের ওপর মহাজন, সুদখোর, জমিদার ও বর্বর ব্রিটিশ শাসকদের অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা ও স্বাধীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুনা মুরমু ছয় সন্তান সিদো-কানহু-চাঁদ-ভাইরো-ফুলোমনি-ঝানো মুরমুর নেতৃত্বে অসংখ্য আদিবাসী ও অ-আদিবাসীরা আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের স্থান ভগনাডিহি গ্রাম, আজ থেকে ১৬৪ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন। হুলের দিন সিদো কানহুর নেতৃত্বে আদিবাসীরা ঐতিহ্য অনুযায়ী পাতাসহ ছোট শালের ডাল পাঠিয়ে কাছের ও দূরের মানুষদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনেক দিন থেকেই সান্তালসহ আদিবাসীরা জমিদার, মহাজনদের অত্যাচার, অপমান ও লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে আসছিলেন। তাই এই আহ্বান ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সে সমাবেশে প্রায় দশ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন এবং সভা থেকে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে-

এখন থেকে কেউ আর জমির জন্য খাজনা প্রদান করবে না।

যার যে রকম খুশি ইচ্ছেমতো জমি চাষাবাদ করতে পারবে

এখন থেকে সান্তালদের সমস্ত ধরনের ঋণ মওকুফ করা হলো

সান্তালরা ভারতবর্ষের কৃষি সভ্যতার জনক। তারাই বিস্তীর্ণ অরণ্য, পাহাড় কেটে কৃষি ও বাসযোগ্য ভূমি তৈরি করেছিল। কিন্তু তাদের চাষযোগ্য জমিতে দিকুসহ অন্যদের চোখ পড়ল। তাই দেখা গেল বারংবার সান্তালরা নিজ জমি হতেই প্রতারিত ও অত্যাচারিত হতে লাগল। নিজেদের জমি থেকেই তারা উচ্ছেদ হতে লাগল। অন্যদিকে অভাব-অনটনের কারণে মহাজনদের কাছ থেকে চড়াসুদে টাকা ধার নিতে হতো কিন্তু কখনও সেই ঋণ শোধ হতো না বরং উল্টো ঋণের পরিমাণ বেড়ে যেত। সান্তালদের সাথে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মহাজন, জমিদার ও সুদখোররা দুই ধরনের বাটখারা ব্যবহার করত। একটির নাম ‘কেনারাম বা বড় বউ’ অন্যটি ‘বেচারাম বা ছোট বউ’। কেনার সময় ব্যবহার হতো কেনারাম অর্থাৎ বেশি কিনতো কিন্তু বিক্রির সময় ব্যবহৃত হতো বেচারাম; যা দিয়ে ওজনে কম দেয়া হতো। এভাবেই অসদুপায়ে মুনাফালোভীরা সান্তালদের ঠকিয়ে বিপুল লাভ করত। এছাড়াও বিদ্রোহের জন্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সেই সভা থেকে। সেগুলো হচ্ছে, জমি চাই, মুক্তি চাই, অত্যাচারী জমিদার ও মহাজনদের জুলুমের চির অবসান, সরকারি অত্যাচার ও নিপীড়নের অবসান। কোন দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় সান্তালদের নেতৃত্বে নিপীড়িত জনগণ- অসান্তাল, বিহারি, হিন্দু, মুসলমানসহ নিপীড়িত মানুষ সে দিন অর্থাৎ ৩০ জুন ১৮৫৫ সালে সর্বাত্মক সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। এই হুল বা আন্দোলন ভারতবর্ষের ইতিহাসকে বদলে দেয়। এর দুই বছর পর সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য মুক্তির স্বপ্ন সান্তালরা প্রথম দেখেছিল। এই যুদ্ধে সান্তালসহ অন্যান্য জাতির মানুষও নিহত হন। পরে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয় সান্তালসহ আদিবাসীদের জন্য সান্তাল পরগণা নামক নন-রেগুলেটেড এলাকা নির্ধারণ করে।

আদিবাসীরাই প্রথম এ অরণ্য জনপদ, শ্বাপদ সংকুল পাহাড়, বন জঙ্গল কেটে চাষাবাদযোগ্য করে তুলেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের ফসলি জমিতে চোখ পড়তো মহাজন, সুদখোর ও দেকোদের (আদিবাসী বাদে অন্যদের দেকো বলা হয়)। ফলে থেকে সেখান তাদের উচ্ছেদ হতে হতো। আবার নতুন জনপদ বসবাস ও চাষযোগ্য করে তুলতো। কিন্তু কোথাও তাদের শোষণ উৎপীড়নের প্রতিকার ছিল না। উপায়ন্তর না দেখে তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার মনোভাব জেগে ওঠে।

সান্তাল হুলের দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে গেলেও সান্তালসহ অন্যান্য আদিবাসীদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের দেশে সান্তাল হুলসহ অন্যান্য আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রতিবছর আদিবাসীদের ভূমি হারানোর ঘটনা, উচ্ছেদ, হামলা, হত্যা, ধর্ষণ, হুমকি ও হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। সান্তাল হুলের পর ভারতে আদিবাসীদের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের দেশে সেটা সম্ভব হয়নি। পূর্ববঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ মোতাবেক ভূমি রক্ষার বিধান থাকলেও নানা উপায়ে আদিবাসীদের জমিজমা জাল দলিল, হামলা, মামলা করে দখল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমির জন্য আলফ্রেড সরেনকে ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট হত্যা, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর বাগদা ফার্মে নিজ ভূমিতে আদিবাসী হত্যা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, পাবর্তীপুরের চিড়াকুটা গ্রামে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, কোনটারই সুবিচার পায়নি আদিবাসীরা। শুধু তাই নয়, আদিবাসীরা আজ সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকেও বঞ্চিত। ভাষার প্রশ্নে ৫টি আদিবাসীদের মাতৃভাষায় পুস্তক প্রণীত হলেও সান্তালদের জন্য পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হয়নি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঈর্ষণীয় হলেও উন্নয়নের সুফল থেকে আদিবাসীরা বঞ্চিত থাকছেন। সমতলের আদিবাসীদের ভূমি রক্ষায় পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

আমাদের দেশে বাঙালি ভিন্ন পঞ্চাশের অধিক ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ সুদীর্ঘকাল থেকে বসবাস করছে। তাদের রং, চেহারা, ভাষা, উৎসব, ধর্ম, কৃষ্টি, শারীরিক কাঠামো, সমাজ গঠন সবকিছুই আলাদা। জাতিগতভাবে প্রত্যেকের নাম আলাদা হলেও সামষ্টিক পরিচয়ে নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আদিবাসী ও বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ভাষা, উৎসব, ধর্ম, বর্ণ, প্রথা, বিশ্বাস, যাপিত জীবন আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময় করেছে। কিন্তু আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালির মনোযোগ বরাবরই কম। ফলে তাদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি বিশেষত নতুন প্রজন্মের কাছে এক ধরনের উন্নাসিকতা তৈরি হয়েছে। নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই আদিবাসীদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা, ঐতিহ্য, তাদের লড়াই-সংগ্রামের প্রতি কম আগ্রহী। ফলে পারস্পরিক জানা ও বোঝার অভাবে আদিবাসী বাঙালির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। বাঙালি নতুন প্রজন্ম যত বেশি আদিবাসীর সংবেদনশীল, আগ্রহী হবে এবং জানা-বোঝার পরিধি বাড়বে ততই সার্বিক মঙ্গল। বাংলাদেশের আদিবাসীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের সংখ্যা আমাদের মোট জনসংখ্যার ২% কাছাকাছি। সামষ্টিক পরিচয় আদিবাসী হলেও প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ আলাদা। তাই সবার সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়াও আলাদা হওয়া উচিত। সরকার, সুধীজন, নাগরিক সমাজ সবাই আদিবাসীদের সমস্যাগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিকভাবে মোকাবিলা ও উত্তরণের উপায় খুঁজবেন- এটিই সবার প্রত্যাশা। প্রতিনিয়ত দেশের আদিবাসীরা নানামুখী আতঙ্কের মধ্যে থাকে। উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৯৫% আদিবাসী এখন ভূমিহীন। শুধু ভূমিই নয়, ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, উৎসব, খাদ্যাভাস, পোশাক পরিচ্ছদ সবকিছুই আজ হুমকির মুখে। অনেক আদিবাসীর ভাষা চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। এখনই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বাকি আদিবাসীরাও বিলীন হবে চিরদিনের মতো। সান্তাল হুল থেকে চেতনা নিয়ে সরকার, রাষ্ট্র আদিবাসীদের রক্ষা, উন্নয়ন ও বিকশিত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেবে। ২০২০ সাল থেকে সান্তাল শিশুরা সান্তালি হরফে (রোমান লিপি) পাঠ্যপুস্তক পড়তে পারবে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠিত হবে। আদিবাসীদের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের প্রাক্কালে তাদের মতামত গ্রহণ করা হবে। সান্তাল হুল, উলগুলান, তিলকা মুরমু প্রথম লড়াই, টংক আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, খাসি বিদ্রোহ, গারো বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহসহ সব লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস জাতীয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হবে। জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক গবেষণা হবে। তবেই সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের বৈচিত্র্যময় বাংলাদেশ গড়ে উঠা সম্ভব হবে। বাঙালি শিশু ও শিক্ষার্থীরা আদিবাসীদের লড়াই সংগ্রাম ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবে- এমন সুন্দর প্রত্যাশা আমরা দেখতেই পারি। সবাইকে সান্তাল হুলের বিপ্লবী শুভেচ্ছা।

[লেখক : আদিবাসী লেখক ও উন্নয়নকর্মী]