সুশাসন নির্বাসনে

শঙ্কর প্রসাদ দে

বর্তমান বাজেট যথারীতি পাস হবে। যথারীতি কিছু ব্যর্থতা, কিছু সাফল্য নিয়ে পার করে দেবে ২০১৯Ñ২০। গতানুগতিক এই ধারার বাইরে এবারের বাজেটে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার অন্যতম সুফলভোগীদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল অন্যতম। এমনিতে তিনি ঝানু ব্যবসায়ী, করিৎকর্মা শিল্পপতি ও তুখোড় লেখাপড়া জানাওয়ালা লোক। টকশোতে দেশের নাম করা প্রফেসররাও পেরে উঠেন না। অর্থনীতির একেবারে হালনাগাদ সংবাদ নখদর্পণে। তার বাজেট উপস্থাপনায় ঋণখেলাপিদের ব্ল্যাঙ্ক চেক, ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে তোয়াক্কা না করে ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে সরকার কর্তৃক এক তরফা এক অঙ্কের সুদহার নির্ধারণ, সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশের ওপর উৎসে কর হার বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দে বেশ কিছু প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম আমলা অর্থনীতিবিদ বা পেশাদার অর্থনীতিবিদের বাইরে গিয়ে একজন ব্যবসায়ী শিল্পপতিকে অর্থমন্ত্রী নিয়োগ মনে হচ্ছে যুক্তিযুক্ত হয়নি। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি বাজেট তৈরির সুযোগ পেয়েছেন এবং বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে শিল্পপতি মোস্তফা কামাল ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। খেলাপি ঋণ নিয়ে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, সেগুলো শেষতক সুপ্রিমকোর্টে গিয়ে আটকে গেছে। অর্থ দাঁড়ায় জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে ঋণখেলাপিদের ব্ল্যাঙ্ক চেক দেয়াটা গ্রহণযোগ্য হয়নি।

আমার অভিজ্ঞতা বলছে ঋণখেলাপি প্রবণতার একটি বড় কারণ হলো ব্যাঙ্ক গ্রাহকের মধ্যস্থতার দুর্বলতা। ব্যাংক ঋণ দেয় সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক নিয়মে। অথচ গ্রহীতা ঋণ ব্যবহার করে উন্মুক্ত বাজারে। উন্মুক্ত বাজারে ঋণ বহুক্ষেত্রেই লোকসানের মুখোমুখি হয়। সে জন্য ঋণগ্রহীতাকে বুকে টেনে নিয়ে কিছু সুদ মওকুফ করে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় না। একটি উন্নয়নশীল দেশের ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতি ব্যাংক বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার পরিবর্তে কার্যত আগেকার দিনের সুদখোর মহাজনদের মতো আচরণ করে।

আজ পর্যন্ত এ দেশে ব্যাংক কমিশন কাজ করার সুযোগ পায়নি। কমিশনকে একটা সুপারিশ করার জন্য এখনই মাঠে ছেড়ে দেয়া উচিত। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়েছে আমাদের ব্যাংকগুলোকে উদ্যোক্তার ভূমিকায় আসতে দেয়া উচিত। ঋণের সমস্ত টাকা কোন ব্যক্তি ঋণগ্রহীতার হাতে না দিয়ে গ্রাহকÑব্যাংক যৌথ উদ্যোক্তা হওয়ার আইনি সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। ধরুন ১০০ কোটি টাকা দিয়ে একজন উদ্যোক্তা একটি স্টিল মিল স্থাপন করতে চায়। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার ঝুঁকি থাকবে ৮০ শতাংশ আর ব্যাংকের ঝুঁকি থাকা উচিত ২০ শতাংশ। ব্যাংক তার এক বা একাধিক কর্মচারীকে ওই শিল্প প্রজেক্টে প্রেষণে নিয়োগ দেবে দেখভালের জন্য। দেখবেন সুনসান মেরে দেয়ার জন্য যারা ঋণ নেয় ওরা ধারে কাছেও আসবে না। যাই হোক এটি ভবিষ্যতের বিষয়।

অর্থমন্ত্রী ঢালাওভাবে শতকরা ২ ভাগ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে রিসিডিউলের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা যথাযথ হয়নি বলেই মনে হয়। পানির দর আর কাকে বলে। এটি অন্তত ৫ ভাগ হওয়া উচিত ছিল। এতে যে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বইছে তা হতো না। তাছাড়া সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার একতরফা সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত হয়নি। তাহলে তো সঞ্চয়ীদের ৫-৬ পার্সেন্টের বেশি সুদ দেয়া যাবে না। মানুষ তাহলে চলবে কি করে। বহু মানুষ আছে যারা জমানো টাকার সুদের ওপর জীবন চালিয়ে থাকেন।

সবাই বলাবলি করছেন যে, শিল্পপতি হিসেবে অর্থমন্ত্রী শিল্পপতিদের পক্ষেই কাজ করেছেন। শিল্পপতিদের অসুবিধাগুলোকেই তিনি এড্রেস করেছেন। ব্যাংকের কাঠামো, সঞ্চয়কারীদের সুযোগ সুবিধা ও ভালোমন্দের দিকটি এমনকি রাষ্ট্রের লাইফলাইন হিসেবে ব্যাংকের যে অবস্থান সেটিকে মূল্যায়ন করেননি। মোদ্দাকথায়, ব্যাংকে আর যে কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে সেগুলো দিয়ে দেয়ার জন্য তো অর্থমন্ত্রীর দরকার নেই। ব্যাংকের মালিকরা নিজেরাই তো ভল্ট খুলে নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারেন। আমাদের আশঙ্কা যারা সরকার চালান তারাও ব্যাংক খাতের প্রকৃত সংকট বুঝতে সক্ষম নন। অদূর ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়ার চরম ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।

এরপরের অবিবেচনামূলক কাজটি হলো সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বৃদ্ধি। এতদিন সুদের ওপর ৫ ভাগ অর্থাৎ ১০০ টাকা সুদ পেলে ৫ টাকা উৎসে কর কাটা হতো। এখন ১০ টাকা কাটার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে মনে হচ্ছে প্রস্তাবনাটি বাতিল হবে। কিন্তু মাঝখানে অর্থমন্ত্রীর জনদরদ ও জনমুখিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ সমাজে কারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তা অর্থমন্ত্রীর জানা থাকার কথা। বহু মানুষের অবসর জীবনে সংসার চলে এ টাকার সুদ দিয়ে। মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি গণ্য করলে কয় টাকাই বা হাতে আসে।

বাজেট আর সুশাসন একটি সম্পর্কিত বিষয়। ঋণ সংক্রান্ত ঢালাও কনসেনশন সমাজে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। মানুষের মনে ধারণা জন্মেছে যে, এদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ফাঁকি দেয়া সহজ। কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যদি পার পাওয়া যায় তবে ফাঁকিবাজির সংস্কৃতি মাথাচাড়া দেয়াই স্বাভাবিক। ইচ্ছে করলেই যা ইচ্ছা তা করার এ যে প্রবণতা তা একটি খারাপ লক্ষণ। গোটা সমাজটাই একটা সংস্কৃতির বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মেনে নেয়াই ভালো যে, মানুষের অধিকার প্রয়োগের সীমা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। ভোট দিতে এখন মানুষ উৎসাহ পায় না। ভোট দেয়া একটা দায়িত্ববোধের বিষয়। এ বিষয়টি যখন মানুষের মন থেকে উঠে গেছে তখন এর প্রভাব গোটা সমাজ জীবনে পড়ছে।

মানুষ দেখছে গায়ের জোরে নেতা হওয়া যায়। ক্ষমতায় থাকা যায়। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তাদের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখাই জরুরি কর্ম। শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিসহ সমস্ত ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে মানুষের সঙ্গে যে অমানবিক ব্যবহার করছে তা সীমাহীন ঔদ্ধত্বে পরিণত হয়েছে। ওষুধে ভেজাল, খাদ্যে ভেজালÑ এ যেন মগের মুল্লুকের সাজ সাজ রব। বাজেট ধনী থেকে বেশি কর নেবে আর গরিব থেকে কম কর নেবে। পারলে গরিবকে সহায়তা করবে। আমাদের এবারের বাজেট দেখিয়ে দিল আমজনতার ওপর নানা ধরনের বোঝা চাপিয়ে দিলেও কিছু যায় আসে না। এটি সুশাসনের সহায়ক নয়। যে হারে সরকারি কর্মচারীদের বেতনসহ সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তা ভারসাম্যহীন রাষ্ট্রীয় বণ্টন। রাষ্ট্র যদি বণ্টনের সময় শিক্ষিত আর ধনীদের প্রতি আনুকূল্য দেখায় আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি মমত্ববোধ না দেখায় এবং রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর আমজনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে তবে সুশাসন নির্বাসনে যায়। এবারের বাজেট তত্ত্বগতভাবে সুশাসনকে নিরুৎসাহিত করবে। জানি না অদূর ভবিষ্যতে এই সুশাসনহীনতার সংস্কৃতি সমাজকে কোথায় নিয়ে যায়।

[লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট]

spdey2011@gmail.com

শনিবার, ০৬ জুলাই ২০১৯ , ২২ আষাঢ় ১৪২৫, ২ জ্বিলকদ ১৪৪০

সুশাসন নির্বাসনে

শঙ্কর প্রসাদ দে

বর্তমান বাজেট যথারীতি পাস হবে। যথারীতি কিছু ব্যর্থতা, কিছু সাফল্য নিয়ে পার করে দেবে ২০১৯Ñ২০। গতানুগতিক এই ধারার বাইরে এবারের বাজেটে কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বিশেষ করে স্বাধীনতার অন্যতম সুফলভোগীদের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল অন্যতম। এমনিতে তিনি ঝানু ব্যবসায়ী, করিৎকর্মা শিল্পপতি ও তুখোড় লেখাপড়া জানাওয়ালা লোক। টকশোতে দেশের নাম করা প্রফেসররাও পেরে উঠেন না। অর্থনীতির একেবারে হালনাগাদ সংবাদ নখদর্পণে। তার বাজেট উপস্থাপনায় ঋণখেলাপিদের ব্ল্যাঙ্ক চেক, ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে তোয়াক্কা না করে ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে সরকার কর্তৃক এক তরফা এক অঙ্কের সুদহার নির্ধারণ, সঞ্চয়পত্রের লভ্যাংশের ওপর উৎসে কর হার বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের জন্য বিপুল অর্থ বরাদ্দে বেশ কিছু প্রশ্নের অবতারণা হয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম আমলা অর্থনীতিবিদ বা পেশাদার অর্থনীতিবিদের বাইরে গিয়ে একজন ব্যবসায়ী শিল্পপতিকে অর্থমন্ত্রী নিয়োগ মনে হচ্ছে যুক্তিযুক্ত হয়নি। ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি বাজেট তৈরির সুযোগ পেয়েছেন এবং বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে শিল্পপতি মোস্তফা কামাল ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। খেলাপি ঋণ নিয়ে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, সেগুলো শেষতক সুপ্রিমকোর্টে গিয়ে আটকে গেছে। অর্থ দাঁড়ায় জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে ঋণখেলাপিদের ব্ল্যাঙ্ক চেক দেয়াটা গ্রহণযোগ্য হয়নি।

আমার অভিজ্ঞতা বলছে ঋণখেলাপি প্রবণতার একটি বড় কারণ হলো ব্যাঙ্ক গ্রাহকের মধ্যস্থতার দুর্বলতা। ব্যাংক ঋণ দেয় সম্পূর্ণ আমলাতান্ত্রিক নিয়মে। অথচ গ্রহীতা ঋণ ব্যবহার করে উন্মুক্ত বাজারে। উন্মুক্ত বাজারে ঋণ বহুক্ষেত্রেই লোকসানের মুখোমুখি হয়। সে জন্য ঋণগ্রহীতাকে বুকে টেনে নিয়ে কিছু সুদ মওকুফ করে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় না। একটি উন্নয়নশীল দেশের ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতি ব্যাংক বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার পরিবর্তে কার্যত আগেকার দিনের সুদখোর মহাজনদের মতো আচরণ করে।

আজ পর্যন্ত এ দেশে ব্যাংক কমিশন কাজ করার সুযোগ পায়নি। কমিশনকে একটা সুপারিশ করার জন্য এখনই মাঠে ছেড়ে দেয়া উচিত। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার মনে হয়েছে আমাদের ব্যাংকগুলোকে উদ্যোক্তার ভূমিকায় আসতে দেয়া উচিত। ঋণের সমস্ত টাকা কোন ব্যক্তি ঋণগ্রহীতার হাতে না দিয়ে গ্রাহকÑব্যাংক যৌথ উদ্যোক্তা হওয়ার আইনি সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। ধরুন ১০০ কোটি টাকা দিয়ে একজন উদ্যোক্তা একটি স্টিল মিল স্থাপন করতে চায়। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার ঝুঁকি থাকবে ৮০ শতাংশ আর ব্যাংকের ঝুঁকি থাকা উচিত ২০ শতাংশ। ব্যাংক তার এক বা একাধিক কর্মচারীকে ওই শিল্প প্রজেক্টে প্রেষণে নিয়োগ দেবে দেখভালের জন্য। দেখবেন সুনসান মেরে দেয়ার জন্য যারা ঋণ নেয় ওরা ধারে কাছেও আসবে না। যাই হোক এটি ভবিষ্যতের বিষয়।

অর্থমন্ত্রী ঢালাওভাবে শতকরা ২ ভাগ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে রিসিডিউলের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা যথাযথ হয়নি বলেই মনে হয়। পানির দর আর কাকে বলে। এটি অন্তত ৫ ভাগ হওয়া উচিত ছিল। এতে যে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বইছে তা হতো না। তাছাড়া সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনার একতরফা সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত হয়নি। তাহলে তো সঞ্চয়ীদের ৫-৬ পার্সেন্টের বেশি সুদ দেয়া যাবে না। মানুষ তাহলে চলবে কি করে। বহু মানুষ আছে যারা জমানো টাকার সুদের ওপর জীবন চালিয়ে থাকেন।

সবাই বলাবলি করছেন যে, শিল্পপতি হিসেবে অর্থমন্ত্রী শিল্পপতিদের পক্ষেই কাজ করেছেন। শিল্পপতিদের অসুবিধাগুলোকেই তিনি এড্রেস করেছেন। ব্যাংকের কাঠামো, সঞ্চয়কারীদের সুযোগ সুবিধা ও ভালোমন্দের দিকটি এমনকি রাষ্ট্রের লাইফলাইন হিসেবে ব্যাংকের যে অবস্থান সেটিকে মূল্যায়ন করেননি। মোদ্দাকথায়, ব্যাংকে আর যে কিছু টাকা অবশিষ্ট আছে সেগুলো দিয়ে দেয়ার জন্য তো অর্থমন্ত্রীর দরকার নেই। ব্যাংকের মালিকরা নিজেরাই তো ভল্ট খুলে নিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারেন। আমাদের আশঙ্কা যারা সরকার চালান তারাও ব্যাংক খাতের প্রকৃত সংকট বুঝতে সক্ষম নন। অদূর ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়ার চরম ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে।

এরপরের অবিবেচনামূলক কাজটি হলো সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর বৃদ্ধি। এতদিন সুদের ওপর ৫ ভাগ অর্থাৎ ১০০ টাকা সুদ পেলে ৫ টাকা উৎসে কর কাটা হতো। এখন ১০ টাকা কাটার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে মনে হচ্ছে প্রস্তাবনাটি বাতিল হবে। কিন্তু মাঝখানে অর্থমন্ত্রীর জনদরদ ও জনমুখিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ সমাজে কারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে তা অর্থমন্ত্রীর জানা থাকার কথা। বহু মানুষের অবসর জীবনে সংসার চলে এ টাকার সুদ দিয়ে। মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি গণ্য করলে কয় টাকাই বা হাতে আসে।

বাজেট আর সুশাসন একটি সম্পর্কিত বিষয়। ঋণ সংক্রান্ত ঢালাও কনসেনশন সমাজে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে। মানুষের মনে ধারণা জন্মেছে যে, এদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ফাঁকি দেয়া সহজ। কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যদি পার পাওয়া যায় তবে ফাঁকিবাজির সংস্কৃতি মাথাচাড়া দেয়াই স্বাভাবিক। ইচ্ছে করলেই যা ইচ্ছা তা করার এ যে প্রবণতা তা একটি খারাপ লক্ষণ। গোটা সমাজটাই একটা সংস্কৃতির বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মেনে নেয়াই ভালো যে, মানুষের অধিকার প্রয়োগের সীমা দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। ভোট দিতে এখন মানুষ উৎসাহ পায় না। ভোট দেয়া একটা দায়িত্ববোধের বিষয়। এ বিষয়টি যখন মানুষের মন থেকে উঠে গেছে তখন এর প্রভাব গোটা সমাজ জীবনে পড়ছে।

মানুষ দেখছে গায়ের জোরে নেতা হওয়া যায়। ক্ষমতায় থাকা যায়। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তাদের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখাই জরুরি কর্ম। শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিসহ সমস্ত ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে মানুষের সঙ্গে যে অমানবিক ব্যবহার করছে তা সীমাহীন ঔদ্ধত্বে পরিণত হয়েছে। ওষুধে ভেজাল, খাদ্যে ভেজালÑ এ যেন মগের মুল্লুকের সাজ সাজ রব। বাজেট ধনী থেকে বেশি কর নেবে আর গরিব থেকে কম কর নেবে। পারলে গরিবকে সহায়তা করবে। আমাদের এবারের বাজেট দেখিয়ে দিল আমজনতার ওপর নানা ধরনের বোঝা চাপিয়ে দিলেও কিছু যায় আসে না। এটি সুশাসনের সহায়ক নয়। যে হারে সরকারি কর্মচারীদের বেতনসহ সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তা ভারসাম্যহীন রাষ্ট্রীয় বণ্টন। রাষ্ট্র যদি বণ্টনের সময় শিক্ষিত আর ধনীদের প্রতি আনুকূল্য দেখায় আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি মমত্ববোধ না দেখায় এবং রাষ্ট্রের সম্পদের ওপর আমজনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে তবে সুশাসন নির্বাসনে যায়। এবারের বাজেট তত্ত্বগতভাবে সুশাসনকে নিরুৎসাহিত করবে। জানি না অদূর ভবিষ্যতে এই সুশাসনহীনতার সংস্কৃতি সমাজকে কোথায় নিয়ে যায়।

[লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট]

spdey2011@gmail.com