ক্ষমার অযোগ্য বর্বরতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বরগুনায় রিফাত নামের এক যুবককে নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে এক দল সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সিনেমার মতো প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে কোপানো হলেও তার বউ আয়েশা ছাড়া আর কেউ রিফাতকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। এই নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তুলাধুনো করা হচ্ছে। বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিনের আমলে আমার বাসার নিচে কয়েকজন সন্ত্রাসী আরেক সন্ত্রাসীকে ইট দিয়ে তুলাধুনো করার সময় মৃত্য পথযাত্রী সন্ত্রাসীর মা তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য দর্শকদের সবার পা ধরেছে, কেউ মায়ের অনুরোধ শুনেনি। এই স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর আমলেই এক বৃদ্ধা মহিলা তার পুরান বাসা ছেড়ে দিয়ে আমার বাসার পাশে নতুন বস্তিতে বাসা ভাড়া নেয়ায় সন্ত্রাসীরা অমানুষিক নির্যাতন করল, আমি আমার বাসার দোতলা থেকে বৃদ্ধ মহিলাটির শুধু চিৎকারই শুনলাম, উদ্ধার করতে নিচে নামিনি। এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমলেই দুই সন্ত্রাসী রাস্তা থেকে শত শত লোকের সম্মুখ থেকে এক গার্মেন্টস মহিলা কর্মীকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল, মেয়েটির কত চিৎকার, কত আকুতি- আমরা কেউই এগিয়ে যাইনি। বর্তমান সরকারের প্রথমদিকে মোটরসাইকেল আরোহী এক যুবককে কিছু সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি মারা শুরু করলে যুবকটি দৌড়ে আমার বাসার কলাপসিবল গেটের ভেতরে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে, কিন্তু এতগুলো সন্ত্রাসীর সাথে একলা পেরে না উঠে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করলেও আমার মেয়ে ঐশীর কান্না ছাড়া আর কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যায়নি। এমন ঘটনার অভিজ্ঞতা কমবেশি সবার আছে, কোন সরকারের আমলেই এগুলো থামেনি।

সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজাকে যখন এভাবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বদরুল নামের এক বহিষ্কৃত ছাত্র কোপালো সেই দিনও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ভিডিও করা ছাড়া কোন লোক খাদিজাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিওতে কোপানোর এই দৃশ্য দেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দর্শকদের এমন ভাবলেশহীন নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, এতজন দর্শক খালি হাতে ছুটে গেলেও সন্ত্রাসী যুবক ভয়ে পালাতো। কিন্তু আমরা সবাই সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভীত, ওদের দেখলে মুখের থুতু মুখেই শুকিয়ে যায়। কারণ এদের ক্ষমতা সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। সন্ত্রাসীদের অধিকাংশই বস্তিতে বসবাস করে, এরা মা-বাবার তোয়াক্কা করে না, সমাজের লোকজন তাদের সমীহ করে অথবা এড়িয়ে চলে; এদের নেতৃত্বে থাকে রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্মী-নেতা। দলীয় অফিসে এরা সারাদিন আড্ডা দেয়, দলের নেতাদের সাথে কথা বলতে, চলাফেরা করতে সবাই দেখেÑ তাই এদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারও থাকে না। তবুও সন্ত্রাসী কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু সাহসী লোক সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে মরেছে। এছাড়াও অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য থানা আর আদালতে দৌড়াদৌড়ির যে হেনস্তা তা সন্ত্রাসীর হাতে মরার চেয়ে কম নয়। গৃহকর্মী মেয়েটিকে খুঁজে না পেয়ে আমার এক বন্ধু থানায় জিডি করতে গেলে থানার কর্মকর্তার প্রথম কথা, ‘নিজে ধর্ষণ ও গর্ভবতী করে মেয়েটিকে গুম করে ফেলেননি তো?’ এ কারণেই কৌতুক অভিনেতা এটিএম শামছুজ্জমান একবার বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসীরা আমাকে কুপিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেললেও আমার পরিবারের কোন সদস্যকে থানায় যেতে নিষেধ করে যাব।’ উপরন্তু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাউকে উদ্ধার করতে গিয়ে সাক্ষী হওয়ার ঝামেলা কেউ কাঁধে তুলে নিতে চায় না- পুলিশ আর উকিলদের জেরায় ব্যক্তিগত জীবনের উলঙ্গ উন্মোচন ছাড়াও আদালত প্রাঙ্গণে বছরব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা ধুলাবালির মেঝেতে বসে বসে গড়াগড়ি খাওয়ার কষ্ট অসহনীয়। তবুও বিপদে-আপদে এই থানা, পুলিশ ও আদালতের অপরিহার্যতা অস্বীকার করা যাবে না।

মানুষের এমন অসহায়ত্ব একদিনে সৃষ্টি হয়নি- সব সরকারের আমলে সন্ত্রাসীদের এমন দৌরাত্ম্য সবাই দেখেছে। প্রকাশ্যে এমন খুনখারাবি করে রাজনৈতিক দলকে বিব্রত না করলে এসব সন্ত্রাসী দলের সম্পদÑ দলের নেতারা এদের খোঁজখবর রাখেন বেশি। ভোটের সময় সাধারণ নিরীহ টাইপের কর্মীর কদর কমÑ এখন ভোট সংগ্রহে মাস্তান দরকার। থানা এবং রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের সম্পর্ক যত মধুর হবে সন্ত্রাসীরা তত সাহসী হবে। হরিহর আত্মার এই সম্পর্কের জন্য সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য থানা অপেক্ষা করতে থাকে; ক্ষমতাসীন দলীয় লোকদের গ্রেফতার করে থানা থেকে কেউ বদলী হতে চায় না। থানায় চাকরি করার একটা আলাদা জৌলুস রয়েছে। থানার এই লোভাতুর লোকগুলোর জন্য জনগণও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। সভ্য দেশগুলোতে পুলিশের অন্যায় আচারণের প্রতিবাদ করা যায়, কিন্তু আমাদের দেশে পুলিশের সাথে তর্ক করবে এমন বুকের পাটা ক্ষমতাসীন দলের ডাকসাইট নেতাকর্মী ছাড়া আর কারো নেই।একটা বিষয় আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি যে, খুনের ঘটনার পর ঘাতক সম্পর্কে থানা থেকে বলা হয়, এই যুবকের বিরুদ্ধে দশটি ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে, তিনটি খুন, পঁচাটি ধর্ষণ ও ছয়টি ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এতগুলো অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও লোকটি নির্ভয়ে পুলিশের সম্মুখে সমাজে চলাফেরা করেছে। রাজনৈতিক কর্মী ব্যতীত কোন সন্ত্রাসীর দশ/বারোটি মামলায় জামিন পাওয়ার কথা নয়।

প্রতিকারহীন সমাজ ব্যবস্থায় বাধ্য হয়ে তাই ফেসবুকে সবাই সন্ত্রাসী নয়ন বন্ডের মৃত্যু কামনা করছিল। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষÑ সেই মানুষই আরেকজন মানুষের ক্রসফায়ারে মৃত্যু কামনা করে। খালেদা জিয়ার আমলে র‌্যাবের সৃষ্টি না হলে এ দেশটি এতদিনে নরকে পরিণত হতো। তার আমলে ক্রসফায়ারে বিএনপি নামধারী মস্তান মরেছে বেশি। এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া দলীয় কর্মী বলে সন্ত্রাসীদের রক্ষা করার চেষ্টা করেননি। সন্ত্রাসীরা সর্বদা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিনের মতো এমন মেরুদন্ডহীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেন বাংলাদেশে আর না জন্মায়; তার আমলে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীর ব্যাপকতায় সমাজে একটা অরাজকতা বিরাজ করছিল। ক্রসফায়ারে মৃত্যু নিয়ে প্রচুর সমালোচনা রয়েছে, বিচারবহির্ভূত এমন হত্যাকান্ড কোন সচেতন লোক সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা মানুষকে মারাত্মকভাবে হতাশ করছে। ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসী নয়ন বন্ডের মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষ নিজের পয়সা দিয়ে মিষ্টি কিনে তা বিতরণ করেছে। মানুষ প্রশাসনে আবেদন করে কাক্সিক্ষত প্রতিকার পায় না, মানুষ বিচার প্রার্থনা করে আইনজীবীদের কারসাজিতে জমিজমা সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়।এমন দুর্বিষহ অবস্থায় মানুষ মনে মনে দগ্ধ হতে থাকে; মানসিক যন্ত্রণায় কাতর থাকা অবস্থায় যখন শুনতে পায় তাকে নির্যাতনকারী সন্ত্রাসীর মতো একজন সন্ত্রাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তখন তার লুকায়িত ব্যথা-বেদনা আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে সুনামির সৃষ্টি করে, মিষ্টি কিনে এবং তা বিতরণ করে। জনগণের এ মানসিক স্বস্তি সরকার ও সরকারের ব্যবস্থাপনার প্রতি তাদের অনাস্থারই বহির্প্রকাশ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রিফাত হত্যাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। এ কথাটি তিনিই প্রথম বলেননি, যুগ যুগ ধরে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এমন কথা শুনে আসছি। ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ শব্দ দুইটি ব্যবহার করে রাজনীতিবিদেরা জনগণকে কী ম্যাসেজ দিতে চান তা কখনো আমার বোধগম্য হয়নি। অবশ্য সব শব্দের অর্থ যে আমি বুঝি তা কিন্তু নয়। কতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা পরপর হলে অবিচ্ছিন্ন হিসেবে বিবেচিত হবে তার ব্যাখ্যা আমি কোথাও পাইনি। পৃথিবীতে সংঘটিত বেশিরভাগ ঘটনাই পারষ্পরিক সম্পর্কহীন, এতদিন আমাদের দেশে যত হত্যাকান্ড হয়েছে তার অর্ধেক হয়েছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, কলহে। রিফাতের হত্যার পেছনেও রয়েছে ব্যক্তিগত কলহ। তাই বলে এই সকল হত্যাকান্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হাল্কা করার প্রয়াসকে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে না। বাসের হেলপার কর্তৃক ধাক্কা মেরে যাত্রীকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে তার উপর দিয়ে বাসের চাকা তুলে দেয়া, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে গণধর্ষণ, অভাবের তাড়ায় সন্তানদের হত্যা করে মা-বাবার আত্মহত্যা, মাদকাসক্ত মেয়ের হাতে পিতার খুন, মুক্তিপণের জন্য শিশু অপহরণ, চোর সন্দেহে সিলেটের শিশু রাজন, খুলনার রাকিব, ময়মনসিংহের কিশোর সাগরকে খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা, নির্যাতন করা, ভ্যান চুরির জন্য যাত্রীবেশী দুর্বৃত্ত দ্বারা সাতক্ষীরার কিশোর শাহীনকে কোপানো, যৌতুকের মামলা করায় জামালপুরের গৃহবধূকে গাছে বেঁধে স্বামী কর্তৃক নির্যাতন, উটপাখির ডিম চুরির অভিযোগে নরসিংদীর তেরো বছরের কিশোর রিয়াদের হাত-পা ভেঙে দেয়া, নাস্তিকের অভিযোগে হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাশকে কোপানোও তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ব্যক্তিগত কারণে সংঘটিত হত্যাকা-ের ঘাতক নয়ন বন্ড বহুদিন পূর্ব থেকেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল; পুলিশ দুয়েকবার তাকে ধরেছেও, কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আবার সন্ত্রাস করেছে, ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ইংলিশ মুভি জেমসবন্ডের মতো সন্ত্রাসী দল তৈরি করে সে বিএনপির কর্মী হয়েও কুকর্মের আশ্রয় লাভের সুবিধার্থে বিএনপির আদর্শ ত্যাগ করে এক লহমায় আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়ে গিয়েছিল।

রিফাতের এই হত্যাকান্ডের ভিডিও ক্লিপ ও কিছু স্থির চিত্র ফেসবুকে দেয়াতে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়; কিন্তু ঘাতকদের প্রতিহত না করে যারা শুধু ভিডিও করেছেন বা ছবি তুলেছেন তাদের প্রচুর ভর্ৎসনাও করা হয়েছে। কারো বিপদে নীরব দর্শক হয়ে থাকা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ১৯৮৫ সনে ফ্রান্সের একটি হোটেলে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ছেলে শাহনেওয়াজ ভুট্টোর অত্যধিক মদ পানে মৃত্যুকালীন তার বউ রেহানার নির্লিপ্ত ও নির্বিকার থাকার জন্য তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো।এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো চিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টারের তোলা হৃদয়বিদারক ও সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি ছবির ক্ষেত্রে, যে ছবিটির জন্য কেভিন কার্টার পুলিৎজার পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সনে সুদানে দুর্ভিক্ষপীড়িত এক অনাহারি কঙ্কালসার শিশু খাবারের প্রত্যাশায় জাতিসংঘের লঙ্গরখানার দিকে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছিল, দীর্ঘদিন খাবার না পেয়ে শিশুটি এত দুর্বল ছিল যে, হামাগুড়ি দিতে গিয়েও বারবার কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। একটি শকুন শিশুটির পেছনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছিল কখন শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে এবং তার দেহটি ছিন্নভিন্ন করে খাওয়া যাবে। কেভিন কার্টার শিশুটিকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা না করে স্থান ত্যাগ করে চলে যান; শিশুটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা পরে আর জানা যায়নি। পরবর্তীতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি কেভিন কার্টারের মনে এত গভীর রেখাপাত করে যে, শিশুটিকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা না করে তাকে পরিত্যাগ করে চলে আসার অনুশোচনা থেকে নিষ্কৃতি নিতে তিনি আত্মহত্যা করেন। তাই বলে তার তোলা ছবিটির গুরুত্ব কম বলা যাবে না, সুদানে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র অনুধাবনে এই একটি ছবিই যথেষ্ট ছিলো। ঠিক তেমনি রিফাতের খুনের দৃশ্যের ছবি তোলারও প্রয়োজন ছিল। রিফাতের হত্যাকান্ডের ভিডিও ক্লিপ ও ছবি ফেসবুকে আলোড়ন সৃষ্টি না করলে সরকার ও পুলিশ প্রশাসন এমন ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতো কী না সন্দেহ।

বিগত কিছুদিন যাবত প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে ছুরি-রামদা দিয়ে কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিগত কয়েক দিনে ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক কোন্দল, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, চুরি, ডাকাতি, মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণে অনেক নৃশংস হত্যাকান্ডের কাহিনী বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে এসব হত্যাকান্ড আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারেনি বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উল্লেখ করেছেন। এসব হত্যাকান্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নিÑ এমন ধারণা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বর্তমান সরকারের স্বার্থে পরিত্যাগ করতে হবে। তাকে বুঝতে হবে যে, দেশের আনাচে-কানাচে আগে যেসব ঘটনা ঘটতো তা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেত, এখন ফেসবুক সাংবাদিকতায় মুহূর্তে সবাই জেনে যায়। জনগণ সব অপরাধ জানতে পারছে বলেই এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়বদ্ধতা বেড়ে গেছে। সমাজে মানুষের জীবনের অস্থিরতাজনিত এই অনিশ্চয়তা রোধে সরকারকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে, সরকারের ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট লোকগুলোকে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণে তৎপর হতে হবে। সাগর-রুনী এবং নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যাকান্ডের রহস্য কেন উদ্ঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না তা, পরিষ্কারভাবে জনগণকে না জানালে এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগবেই। এসব হত্যাকান্ড রাজনৈতিক না হলেও সরকারের ভূমিকার অস্পষ্টতা সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন করছে। এত বছর ক্ষমতায় থাকার পর গুণগত পরিবর্তনে কোন ঝামেলার জন্য এখনও বিএনপিকে দায়ী করে আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মতুষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকতে পারবেন, জনগণ কিন্তু তা বিশ্বাস করবে না। প্রধানমন্ত্রীকে উপলব্ধি করতে হবে যে, রাজনৈতিক কর্মী নামের এই বীরবল সন্ত্রাসীরা ক্ষমতার প্রশ্রয় না থাকায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কারও গায়ে একটু থুতু মারার সাহসও করেনি। তাই মস্তাননির্ভর রাজনীতির পরিবর্তন না হলে আমাদের মতো নিরীহ সাধারণ দর্শকরা কখনও চাপাতির নিচে প্রাণ দিতে যাবে না; আধুনিক মানুষের মনোবৃত্তি হচ্ছে এড়িয়ে চলা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ত্যাগ করে কেউ সামাজিক দায় কাঁধে নেবে না। সব কিছু নষ্টদের দখলে যাওয়ার আগেই দেশ, সরকার ও জনগণকে সতর্ক হতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

zeauddinahmed@gmail.com

রবিবার, ০৭ জুলাই ২০১৯ , ২৩ আষাঢ় ১৪২৫, ৩ জ্বিলকদ ১৪৪০

ক্ষমার অযোগ্য বর্বরতা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বরগুনায় রিফাত নামের এক যুবককে নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে এক দল সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সিনেমার মতো প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে কোপানো হলেও তার বউ আয়েশা ছাড়া আর কেউ রিফাতকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। এই নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তুলাধুনো করা হচ্ছে। বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিনের আমলে আমার বাসার নিচে কয়েকজন সন্ত্রাসী আরেক সন্ত্রাসীকে ইট দিয়ে তুলাধুনো করার সময় মৃত্য পথযাত্রী সন্ত্রাসীর মা তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য দর্শকদের সবার পা ধরেছে, কেউ মায়ের অনুরোধ শুনেনি। এই স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর আমলেই এক বৃদ্ধা মহিলা তার পুরান বাসা ছেড়ে দিয়ে আমার বাসার পাশে নতুন বস্তিতে বাসা ভাড়া নেয়ায় সন্ত্রাসীরা অমানুষিক নির্যাতন করল, আমি আমার বাসার দোতলা থেকে বৃদ্ধ মহিলাটির শুধু চিৎকারই শুনলাম, উদ্ধার করতে নিচে নামিনি। এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আমলেই দুই সন্ত্রাসী রাস্তা থেকে শত শত লোকের সম্মুখ থেকে এক গার্মেন্টস মহিলা কর্মীকে জোর করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল, মেয়েটির কত চিৎকার, কত আকুতি- আমরা কেউই এগিয়ে যাইনি। বর্তমান সরকারের প্রথমদিকে মোটরসাইকেল আরোহী এক যুবককে কিছু সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি মারা শুরু করলে যুবকটি দৌড়ে আমার বাসার কলাপসিবল গেটের ভেতরে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে, কিন্তু এতগুলো সন্ত্রাসীর সাথে একলা পেরে না উঠে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করলেও আমার মেয়ে ঐশীর কান্না ছাড়া আর কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যায়নি। এমন ঘটনার অভিজ্ঞতা কমবেশি সবার আছে, কোন সরকারের আমলেই এগুলো থামেনি।

সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজাকে যখন এভাবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বদরুল নামের এক বহিষ্কৃত ছাত্র কোপালো সেই দিনও নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ভিডিও করা ছাড়া কোন লোক খাদিজাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যায়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিওতে কোপানোর এই দৃশ্য দেখে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে দর্শকদের এমন ভাবলেশহীন নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, এতজন দর্শক খালি হাতে ছুটে গেলেও সন্ত্রাসী যুবক ভয়ে পালাতো। কিন্তু আমরা সবাই সন্ত্রাসীদের ভয়ে ভীত, ওদের দেখলে মুখের থুতু মুখেই শুকিয়ে যায়। কারণ এদের ক্ষমতা সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। সন্ত্রাসীদের অধিকাংশই বস্তিতে বসবাস করে, এরা মা-বাবার তোয়াক্কা করে না, সমাজের লোকজন তাদের সমীহ করে অথবা এড়িয়ে চলে; এদের নেতৃত্বে থাকে রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট সন্ত্রাসী কর্মী-নেতা। দলীয় অফিসে এরা সারাদিন আড্ডা দেয়, দলের নেতাদের সাথে কথা বলতে, চলাফেরা করতে সবাই দেখেÑ তাই এদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারও থাকে না। তবুও সন্ত্রাসী কাজের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহু সাহসী লোক সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে মরেছে। এছাড়াও অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য থানা আর আদালতে দৌড়াদৌড়ির যে হেনস্তা তা সন্ত্রাসীর হাতে মরার চেয়ে কম নয়। গৃহকর্মী মেয়েটিকে খুঁজে না পেয়ে আমার এক বন্ধু থানায় জিডি করতে গেলে থানার কর্মকর্তার প্রথম কথা, ‘নিজে ধর্ষণ ও গর্ভবতী করে মেয়েটিকে গুম করে ফেলেননি তো?’ এ কারণেই কৌতুক অভিনেতা এটিএম শামছুজ্জমান একবার বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসীরা আমাকে কুপিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেললেও আমার পরিবারের কোন সদস্যকে থানায় যেতে নিষেধ করে যাব।’ উপরন্তু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাউকে উদ্ধার করতে গিয়ে সাক্ষী হওয়ার ঝামেলা কেউ কাঁধে তুলে নিতে চায় না- পুলিশ আর উকিলদের জেরায় ব্যক্তিগত জীবনের উলঙ্গ উন্মোচন ছাড়াও আদালত প্রাঙ্গণে বছরব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা ধুলাবালির মেঝেতে বসে বসে গড়াগড়ি খাওয়ার কষ্ট অসহনীয়। তবুও বিপদে-আপদে এই থানা, পুলিশ ও আদালতের অপরিহার্যতা অস্বীকার করা যাবে না।

মানুষের এমন অসহায়ত্ব একদিনে সৃষ্টি হয়নি- সব সরকারের আমলে সন্ত্রাসীদের এমন দৌরাত্ম্য সবাই দেখেছে। প্রকাশ্যে এমন খুনখারাবি করে রাজনৈতিক দলকে বিব্রত না করলে এসব সন্ত্রাসী দলের সম্পদÑ দলের নেতারা এদের খোঁজখবর রাখেন বেশি। ভোটের সময় সাধারণ নিরীহ টাইপের কর্মীর কদর কমÑ এখন ভোট সংগ্রহে মাস্তান দরকার। থানা এবং রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের সম্পর্ক যত মধুর হবে সন্ত্রাসীরা তত সাহসী হবে। হরিহর আত্মার এই সম্পর্কের জন্য সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের জন্য থানা অপেক্ষা করতে থাকে; ক্ষমতাসীন দলীয় লোকদের গ্রেফতার করে থানা থেকে কেউ বদলী হতে চায় না। থানায় চাকরি করার একটা আলাদা জৌলুস রয়েছে। থানার এই লোভাতুর লোকগুলোর জন্য জনগণও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস করে না। সভ্য দেশগুলোতে পুলিশের অন্যায় আচারণের প্রতিবাদ করা যায়, কিন্তু আমাদের দেশে পুলিশের সাথে তর্ক করবে এমন বুকের পাটা ক্ষমতাসীন দলের ডাকসাইট নেতাকর্মী ছাড়া আর কারো নেই।একটা বিষয় আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি যে, খুনের ঘটনার পর ঘাতক সম্পর্কে থানা থেকে বলা হয়, এই যুবকের বিরুদ্ধে দশটি ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে, তিনটি খুন, পঁচাটি ধর্ষণ ও ছয়টি ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এতগুলো অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও লোকটি নির্ভয়ে পুলিশের সম্মুখে সমাজে চলাফেরা করেছে। রাজনৈতিক কর্মী ব্যতীত কোন সন্ত্রাসীর দশ/বারোটি মামলায় জামিন পাওয়ার কথা নয়।

প্রতিকারহীন সমাজ ব্যবস্থায় বাধ্য হয়ে তাই ফেসবুকে সবাই সন্ত্রাসী নয়ন বন্ডের মৃত্যু কামনা করছিল। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষÑ সেই মানুষই আরেকজন মানুষের ক্রসফায়ারে মৃত্যু কামনা করে। খালেদা জিয়ার আমলে র‌্যাবের সৃষ্টি না হলে এ দেশটি এতদিনে নরকে পরিণত হতো। তার আমলে ক্রসফায়ারে বিএনপি নামধারী মস্তান মরেছে বেশি। এ ব্যাপারে খালেদা জিয়া দলীয় কর্মী বলে সন্ত্রাসীদের রক্ষা করার চেষ্টা করেননি। সন্ত্রাসীরা সর্বদা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। বিএনপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিনের মতো এমন মেরুদন্ডহীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেন বাংলাদেশে আর না জন্মায়; তার আমলে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীর ব্যাপকতায় সমাজে একটা অরাজকতা বিরাজ করছিল। ক্রসফায়ারে মৃত্যু নিয়ে প্রচুর সমালোচনা রয়েছে, বিচারবহির্ভূত এমন হত্যাকান্ড কোন সচেতন লোক সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা মানুষকে মারাত্মকভাবে হতাশ করছে। ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসী নয়ন বন্ডের মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষ নিজের পয়সা দিয়ে মিষ্টি কিনে তা বিতরণ করেছে। মানুষ প্রশাসনে আবেদন করে কাক্সিক্ষত প্রতিকার পায় না, মানুষ বিচার প্রার্থনা করে আইনজীবীদের কারসাজিতে জমিজমা সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়।এমন দুর্বিষহ অবস্থায় মানুষ মনে মনে দগ্ধ হতে থাকে; মানসিক যন্ত্রণায় কাতর থাকা অবস্থায় যখন শুনতে পায় তাকে নির্যাতনকারী সন্ত্রাসীর মতো একজন সন্ত্রাসীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তখন তার লুকায়িত ব্যথা-বেদনা আনন্দে রূপান্তরিত হয়ে সুনামির সৃষ্টি করে, মিষ্টি কিনে এবং তা বিতরণ করে। জনগণের এ মানসিক স্বস্তি সরকার ও সরকারের ব্যবস্থাপনার প্রতি তাদের অনাস্থারই বহির্প্রকাশ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী রিফাত হত্যাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। এ কথাটি তিনিই প্রথম বলেননি, যুগ যুগ ধরে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এমন কথা শুনে আসছি। ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ শব্দ দুইটি ব্যবহার করে রাজনীতিবিদেরা জনগণকে কী ম্যাসেজ দিতে চান তা কখনো আমার বোধগম্য হয়নি। অবশ্য সব শব্দের অর্থ যে আমি বুঝি তা কিন্তু নয়। কতগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা পরপর হলে অবিচ্ছিন্ন হিসেবে বিবেচিত হবে তার ব্যাখ্যা আমি কোথাও পাইনি। পৃথিবীতে সংঘটিত বেশিরভাগ ঘটনাই পারষ্পরিক সম্পর্কহীন, এতদিন আমাদের দেশে যত হত্যাকান্ড হয়েছে তার অর্ধেক হয়েছে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, কলহে। রিফাতের হত্যার পেছনেও রয়েছে ব্যক্তিগত কলহ। তাই বলে এই সকল হত্যাকান্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে হাল্কা করার প্রয়াসকে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করে না। বাসের হেলপার কর্তৃক ধাক্কা মেরে যাত্রীকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে তার উপর দিয়ে বাসের চাকা তুলে দেয়া, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে গণধর্ষণ, অভাবের তাড়ায় সন্তানদের হত্যা করে মা-বাবার আত্মহত্যা, মাদকাসক্ত মেয়ের হাতে পিতার খুন, মুক্তিপণের জন্য শিশু অপহরণ, চোর সন্দেহে সিলেটের শিশু রাজন, খুলনার রাকিব, ময়মনসিংহের কিশোর সাগরকে খুঁটিতে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা, নির্যাতন করা, ভ্যান চুরির জন্য যাত্রীবেশী দুর্বৃত্ত দ্বারা সাতক্ষীরার কিশোর শাহীনকে কোপানো, যৌতুকের মামলা করায় জামালপুরের গৃহবধূকে গাছে বেঁধে স্বামী কর্তৃক নির্যাতন, উটপাখির ডিম চুরির অভিযোগে নরসিংদীর তেরো বছরের কিশোর রিয়াদের হাত-পা ভেঙে দেয়া, নাস্তিকের অভিযোগে হুমায়ুন আজাদ, রাজীব হায়দার, অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাশকে কোপানোও তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ব্যক্তিগত কারণে সংঘটিত হত্যাকা-ের ঘাতক নয়ন বন্ড বহুদিন পূর্ব থেকেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল; পুলিশ দুয়েকবার তাকে ধরেছেও, কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে আবার সন্ত্রাস করেছে, ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ইংলিশ মুভি জেমসবন্ডের মতো সন্ত্রাসী দল তৈরি করে সে বিএনপির কর্মী হয়েও কুকর্মের আশ্রয় লাভের সুবিধার্থে বিএনপির আদর্শ ত্যাগ করে এক লহমায় আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়ে গিয়েছিল।

রিফাতের এই হত্যাকান্ডের ভিডিও ক্লিপ ও কিছু স্থির চিত্র ফেসবুকে দেয়াতে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়; কিন্তু ঘাতকদের প্রতিহত না করে যারা শুধু ভিডিও করেছেন বা ছবি তুলেছেন তাদের প্রচুর ভর্ৎসনাও করা হয়েছে। কারো বিপদে নীরব দর্শক হয়ে থাকা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ১৯৮৫ সনে ফ্রান্সের একটি হোটেলে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ছেলে শাহনেওয়াজ ভুট্টোর অত্যধিক মদ পানে মৃত্যুকালীন তার বউ রেহানার নির্লিপ্ত ও নির্বিকার থাকার জন্য তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো।এমন একটি ঘটনা ঘটেছিলো চিত্র সাংবাদিক কেভিন কার্টারের তোলা হৃদয়বিদারক ও সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি ছবির ক্ষেত্রে, যে ছবিটির জন্য কেভিন কার্টার পুলিৎজার পুরস্কার পান। ১৯৯৪ সনে সুদানে দুর্ভিক্ষপীড়িত এক অনাহারি কঙ্কালসার শিশু খাবারের প্রত্যাশায় জাতিসংঘের লঙ্গরখানার দিকে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছিল, দীর্ঘদিন খাবার না পেয়ে শিশুটি এত দুর্বল ছিল যে, হামাগুড়ি দিতে গিয়েও বারবার কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। একটি শকুন শিশুটির পেছনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছিল কখন শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে এবং তার দেহটি ছিন্নভিন্ন করে খাওয়া যাবে। কেভিন কার্টার শিশুটিকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা না করে স্থান ত্যাগ করে চলে যান; শিশুটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা পরে আর জানা যায়নি। পরবর্তীতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি কেভিন কার্টারের মনে এত গভীর রেখাপাত করে যে, শিশুটিকে বাঁচানোর কোন চেষ্টা না করে তাকে পরিত্যাগ করে চলে আসার অনুশোচনা থেকে নিষ্কৃতি নিতে তিনি আত্মহত্যা করেন। তাই বলে তার তোলা ছবিটির গুরুত্ব কম বলা যাবে না, সুদানে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র অনুধাবনে এই একটি ছবিই যথেষ্ট ছিলো। ঠিক তেমনি রিফাতের খুনের দৃশ্যের ছবি তোলারও প্রয়োজন ছিল। রিফাতের হত্যাকান্ডের ভিডিও ক্লিপ ও ছবি ফেসবুকে আলোড়ন সৃষ্টি না করলে সরকার ও পুলিশ প্রশাসন এমন ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিতো কী না সন্দেহ।

বিগত কিছুদিন যাবত প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে ছুরি-রামদা দিয়ে কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিগত কয়েক দিনে ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক কোন্দল, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, চুরি, ডাকাতি, মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণে অনেক নৃশংস হত্যাকান্ডের কাহিনী বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসেবে অভিহিত করে এসব হত্যাকান্ড আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারেনি বলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উল্লেখ করেছেন। এসব হত্যাকান্ডের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়নিÑ এমন ধারণা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বর্তমান সরকারের স্বার্থে পরিত্যাগ করতে হবে। তাকে বুঝতে হবে যে, দেশের আনাচে-কানাচে আগে যেসব ঘটনা ঘটতো তা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যেত, এখন ফেসবুক সাংবাদিকতায় মুহূর্তে সবাই জেনে যায়। জনগণ সব অপরাধ জানতে পারছে বলেই এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়বদ্ধতা বেড়ে গেছে। সমাজে মানুষের জীবনের অস্থিরতাজনিত এই অনিশ্চয়তা রোধে সরকারকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে, সরকারের ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট লোকগুলোকে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণে তৎপর হতে হবে। সাগর-রুনী এবং নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যাকান্ডের রহস্য কেন উদ্ঘাটন করা সম্ভব হচ্ছে না তা, পরিষ্কারভাবে জনগণকে না জানালে এ ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন জাগবেই। এসব হত্যাকান্ড রাজনৈতিক না হলেও সরকারের ভূমিকার অস্পষ্টতা সরকারের ইমেজ ক্ষুণ্ন করছে। এত বছর ক্ষমতায় থাকার পর গুণগত পরিবর্তনে কোন ঝামেলার জন্য এখনও বিএনপিকে দায়ী করে আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মতুষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকতে পারবেন, জনগণ কিন্তু তা বিশ্বাস করবে না। প্রধানমন্ত্রীকে উপলব্ধি করতে হবে যে, রাজনৈতিক কর্মী নামের এই বীরবল সন্ত্রাসীরা ক্ষমতার প্রশ্রয় না থাকায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কারও গায়ে একটু থুতু মারার সাহসও করেনি। তাই মস্তাননির্ভর রাজনীতির পরিবর্তন না হলে আমাদের মতো নিরীহ সাধারণ দর্শকরা কখনও চাপাতির নিচে প্রাণ দিতে যাবে না; আধুনিক মানুষের মনোবৃত্তি হচ্ছে এড়িয়ে চলা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ত্যাগ করে কেউ সামাজিক দায় কাঁধে নেবে না। সব কিছু নষ্টদের দখলে যাওয়ার আগেই দেশ, সরকার ও জনগণকে সতর্ক হতে হবে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

zeauddinahmed@gmail.com