নজরদারিতে থাকবে শত কোটি টাকার উপরের ঋণ খেলাপিরা

নীতিমালা চূড়ান্ত করতে বৈঠক আজ

বছরের পর বছর আটকে থাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকে আলাদা সেল গঠন করার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)। এই সেল খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি কঠোর ও গভীর অনুসন্ধান করবে। মূলত ১০০ কোটি টাকার উপরে শীর্ষ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর তদারকিতে আনতেই এ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঋণ আদায়ে চলমান প্রক্রিয়াগুলোও সক্রিয় রাখবে।

এই সেল নির্দিষ্ট সময় পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হালনাগাদ পরিস্থিতি জানাবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে করণীয় ঠিক করতে ব্যাংকগুলোর কাছে চাওয়া পরামর্শের ভিত্তিতে এসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সিন্ধান্তের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পর কাজ শুরু করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এছাড়া বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে সামাজিক চাপ তৈরি করার পরামর্শও দিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, প্রতিটি ব্যাংকেরই ঋণ আদায়ে একটি বিভাগ রয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। অতীতেও এমন অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাতেও কাজ হয়নি। এর মূল কারণ রাজনৈতিকভাবে খেলাপিদের সুবিধা দেয়া হয়। তবে নতুন সেলগুলো যদি ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে আদায় বাড়তে পারে বলেও মনে করছেন তারা। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও কঠোর তদারকি দরকার বলে মনে করছেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ১০০ কোটি টাকার উপরে দেশের শীর্ষ ১৭৭ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ১০০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজারকোটি টাকার ঋণখেলাপি। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর পরিমাণ ৪১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানকে কঠোর তদারকিতে আনতে একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কঠোর তদারকির মূল উদ্দেশ্য হলো দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ের মাধ্যমে এই ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা। বছরের পর বছর আটকে থাকা খেলাপি ঋণ আদায়সহ প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি কঠোর ও গভীর অনুসন্ধানের জন্য ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকে আলাদা সেল গঠন করার নির্দেশনা দেয়া হবে। আবার খেলাপি ঋণ তদারকিতে বিদ্যমান ব্যবস্থাও অব্যাহত থাকবে।

জানা গেছে, শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদাভাবে তদারকির জন্য গত মার্চে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে একশ’ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেগুলোর তদারকিতে আরও কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া যায়Ñ এ বিষয়ে মতামত চেয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ। ব্যাংকগুলো থেকে মতামত পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা শেষে একটি নীতিমালা করা হয়। নীতিমালাটি চূড়ান্ত করতে আজ সোমবার একটি বৈঠক ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শীঘ্রই এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা প্রজ্ঞাপন আকারে ব্যাংকগুলোয় পাঠাবে। নির্দেশনা অনুসারে ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরা শীর্ষ খেলাপি প্রতিষ্ঠান তদারকিতে নামবে এবং নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিবেদন পাঠাবে।

সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোয় গঠিত আলাদা সেল থেকে শীর্ষ এসব ঋণখেলাপির বর্তমান ব্যবসায়িক অবস্থা, ঋণ আদায়ের আদৌ সম্ভাবনা রয়েছে কি নাÑ এসব যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রকৃত সমস্যার কারণে খেলাপি হলে প্রয়োজনে ওই গ্রাহককে নতুন সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায়ে কোন সম্ভাবনা না থাকলে খেলাপির সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সব আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিয়মিত তদারকির ত্রৈমাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

ব্যাংক কর্মকর্তরা বলছেন, প্রতিটি ব্যাংকের ঋণ আদায়ে আলাদা বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তদারকির জন্য আলাদা সেল রয়েছে। তবে এসব খেলাপির থেকে টাকা আদায় করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এখন দেখা যাক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে কী নির্দেশনা দেয়। বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে বলেও মনে করছেন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এটি ভালো উদ্যোগ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকরা। খেলাপি ঋণ কমানোর এ উদ্যোগকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। কেননা খেলাপি ঋণের বড় অংশই আটকে আছে শীর্ষ খেলাপিদের কাছে। আবার টাকা-পয়সা বেশি হওয়ার কারণে নানা উপায়ে তারা পার পেয়ে যান। তাদের থেকে আংশিক টাকা আদায় করতে পারলেও খেলাপি ঋণ অনেক কমে যাবে। তবে শুধু সেল গঠন করলে হবে না। এসব সেল ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তা কঠোরভাবে দেখতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিশেষ তদারকিতে আনার বিষয়টি খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে, তা দেখার বিষয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা দেয়া হয়। অনেক সময় ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা দেন। এর মাধ্যমে আইনি দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করা হয়। ফলে এসব সমস্যা দূর না করে শুধু তদারকি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে লাভ হবে বলে মনে হয় না।

নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে সরব আ হ ম মুস্তফা কামাল। শুরুর দিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আগামীতে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না, বরং কমবে। তবে গত ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে খেলাপি ঋণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি বেড়ে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা হয়। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধার ঘোষণা দেন তিনি। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী গত ১৬ মে খেলাপি ঋণ পুনর্তফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি হওয়া ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনর্তফসিলের সুযোগ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ধার্য করা হয় ৯ শতাংশ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনার ওপর স্থগিতাদেশ দেন আদালত। পরে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের বিষয়টি আপিল বিভাগে গড়িয়েছে। আপিল বিভাগ থেকে স্থগিতাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কার্যকর হয়ে যায়।

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে নানামুখী আলোচনার মধ্যে গত ২২ জুন জাতীয় সংসদে শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। গত এপ্রিলভিত্তিক সিআইবির (ঋণ তথ্য ব্যুরো) প্রতিবেদনের আলোকে প্রকাশিত তালিকায় দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে একশ’ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠান ১৭৭টি। এ তালিকায় রয়েছে দেশের বহুল সমালোচিত হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট, এননটেক্স, এসএ গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত সাব-স্ট্যান্ডার্ড ১০ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা বাদে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৬৮ কোটি টাকা। অবলোপন করা খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। এসব খেলাপি ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে শীর্ষ ১৭৭ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে।

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০১৯ , ২৪ আষাঢ় ১৪২৫, ৪ জ্বিলকদ ১৪৪০

নজরদারিতে থাকবে শত কোটি টাকার উপরের ঋণ খেলাপিরা

নীতিমালা চূড়ান্ত করতে বৈঠক আজ

রোকন মাহমুদ

বছরের পর বছর আটকে থাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকে আলাদা সেল গঠন করার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি)। এই সেল খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি কঠোর ও গভীর অনুসন্ধান করবে। মূলত ১০০ কোটি টাকার উপরে শীর্ষ খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর তদারকিতে আনতেই এ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঋণ আদায়ে চলমান প্রক্রিয়াগুলোও সক্রিয় রাখবে।

এই সেল নির্দিষ্ট সময় পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হালনাগাদ পরিস্থিতি জানাবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে করণীয় ঠিক করতে ব্যাংকগুলোর কাছে চাওয়া পরামর্শের ভিত্তিতে এসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সিন্ধান্তের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার পর কাজ শুরু করবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এছাড়া বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে সামাজিক চাপ তৈরি করার পরামর্শও দিয়েছেন তারা। তারা বলছেন, প্রতিটি ব্যাংকেরই ঋণ আদায়ে একটি বিভাগ রয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না। অতীতেও এমন অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাতেও কাজ হয়নি। এর মূল কারণ রাজনৈতিকভাবে খেলাপিদের সুবিধা দেয়া হয়। তবে নতুন সেলগুলো যদি ঠিকমতো কাজ করে, তাহলে আদায় বাড়তে পারে বলেও মনে করছেন তারা। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও কঠোর তদারকি দরকার বলে মনে করছেন তারা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ১০০ কোটি টাকার উপরে দেশের শীর্ষ ১৭৭ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ১০০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজারকোটি টাকার ঋণখেলাপি। ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর পরিমাণ ৪১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানকে কঠোর তদারকিতে আনতে একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগত এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কঠোর তদারকির মূল উদ্দেশ্য হলো দ্রুত খেলাপি ঋণ আদায়ের মাধ্যমে এই ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা। বছরের পর বছর আটকে থাকা খেলাপি ঋণ আদায়সহ প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক পরিস্থিতি কঠোর ও গভীর অনুসন্ধানের জন্য ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকে আলাদা সেল গঠন করার নির্দেশনা দেয়া হবে। আবার খেলাপি ঋণ তদারকিতে বিদ্যমান ব্যবস্থাও অব্যাহত থাকবে।

জানা গেছে, শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলাদাভাবে তদারকির জন্য গত মার্চে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে একশ’ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেগুলোর তদারকিতে আরও কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া যায়Ñ এ বিষয়ে মতামত চেয়ে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ। ব্যাংকগুলো থেকে মতামত পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা শেষে একটি নীতিমালা করা হয়। নীতিমালাটি চূড়ান্ত করতে আজ সোমবার একটি বৈঠক ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত অনুসারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শীঘ্রই এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা প্রজ্ঞাপন আকারে ব্যাংকগুলোয় পাঠাবে। নির্দেশনা অনুসারে ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরা শীর্ষ খেলাপি প্রতিষ্ঠান তদারকিতে নামবে এবং নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিবেদন পাঠাবে।

সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোয় গঠিত আলাদা সেল থেকে শীর্ষ এসব ঋণখেলাপির বর্তমান ব্যবসায়িক অবস্থা, ঋণ আদায়ের আদৌ সম্ভাবনা রয়েছে কি নাÑ এসব যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রকৃত সমস্যার কারণে খেলাপি হলে প্রয়োজনে ওই গ্রাহককে নতুন সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায়ে কোন সম্ভাবনা না থাকলে খেলাপির সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে আদায়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সব আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। ঋণ আদায়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও নিয়মিত তদারকির ত্রৈমাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

ব্যাংক কর্মকর্তরা বলছেন, প্রতিটি ব্যাংকের ঋণ আদায়ে আলাদা বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তদারকির জন্য আলাদা সেল রয়েছে। তবে এসব খেলাপির থেকে টাকা আদায় করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এখন দেখা যাক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে কী নির্দেশনা দেয়। বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে বলেও মনে করছেন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

এটি ভালো উদ্যোগ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকরা। খেলাপি ঋণ কমানোর এ উদ্যোগকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। কেননা খেলাপি ঋণের বড় অংশই আটকে আছে শীর্ষ খেলাপিদের কাছে। আবার টাকা-পয়সা বেশি হওয়ার কারণে নানা উপায়ে তারা পার পেয়ে যান। তাদের থেকে আংশিক টাকা আদায় করতে পারলেও খেলাপি ঋণ অনেক কমে যাবে। তবে শুধু সেল গঠন করলে হবে না। এসব সেল ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তা কঠোরভাবে দেখতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের বিশেষ তদারকিতে আনার বিষয়টি খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া কী হবে, তা দেখার বিষয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা দেয়া হয়। অনেক সময় ঋণখেলাপিরা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা দেন। এর মাধ্যমে আইনি দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করা হয়। ফলে এসব সমস্যা দূর না করে শুধু তদারকি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে লাভ হবে বলে মনে হয় না।

নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে সরব আ হ ম মুস্তফা কামাল। শুরুর দিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আগামীতে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না, বরং কমবে। তবে গত ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে খেলাপি ঋণ প্রায় ১৭ হাজার কোটি বেড়ে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা হয়। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে ঋণখেলাপিদের জন্য বিশেষ সুবিধার ঘোষণা দেন তিনি। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী গত ১৬ মে খেলাপি ঋণ পুনর্তফসিলের বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি হওয়া ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনর্তফসিলের সুযোগ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার ধার্য করা হয় ৯ শতাংশ। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনার ওপর স্থগিতাদেশ দেন আদালত। পরে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের বিষয়টি আপিল বিভাগে গড়িয়েছে। আপিল বিভাগ থেকে স্থগিতাদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কার্যকর হয়ে যায়।

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ নিয়ে নানামুখী আলোচনার মধ্যে গত ২২ জুন জাতীয় সংসদে শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। গত এপ্রিলভিত্তিক সিআইবির (ঋণ তথ্য ব্যুরো) প্রতিবেদনের আলোকে প্রকাশিত তালিকায় দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে একশ’ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠান ১৭৭টি। এ তালিকায় রয়েছে দেশের বহুল সমালোচিত হলমার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট, এননটেক্স, এসএ গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত সাব-স্ট্যান্ডার্ড ১০ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা বাদে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৬৮ কোটি টাকা। অবলোপন করা খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। এসব খেলাপি ঋণের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রয়েছে শীর্ষ ১৭৭ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে।