বিস্মৃতিকে স্মরণ

এমআর খায়রুল উমাম

১৮১৮ সালে হুগলির শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’- কে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র হিসেবে গণ্য করা। যদিও অনেক গবেষক ‘বাঙ্গাল গেজেট’কে এ সম্মান দিয়ে থাকেন। এ দুটি সংবাদপত্রই ১৮১৮ সালে কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত। দুটি পত্রিকাই ছিল সাপ্তাহিক। বাংলা ভাষায় সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত ‘প্রভাকর’ ১৮৩১ সালে প্রথম দৈনিক হিসেবে রূপান্তরিত হয়। যেমন যশোর থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকাটি ১৮৯১ সালে দৈনিক হয়ে যায়। ঊনিশ শতকে বাংলা দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা খুব বেশি না হলেও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ও মাসিক সাময়িকপত্র অনেক ছিল। এসব দেশি পত্রিকা সামাজিক দায়বদ্ধতা, জনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন অব্যাহত রেখেছিল। রাষ্ট্রশক্তির সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, দমনপীড়ন, ছাপাখানায় হানা, সাংবাদিক গ্রেফতার করার প্রবণতা সত্ত্বেও অনেক পত্রিকার পঞ্চাশ বা আরও অধিক বছর টিকে থাকার উদাহরণ আছে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আজও সংবাদপত্র এগিয়ে চলছে।

বাংলা পত্র-পত্রিকার বয়স ২০০ বছর। এই দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক কৌতূহলপ্রদ ও রোমাঞ্চকর অধ্যায় রয়েছে। যে কোন বিচারের মানদন্ডে একটা পত্রিকা ৫০ বছর বা তার অধিককাল টিকে থাকা গৌরবের। তা সংবাদপত্রই হোক বা সাময়িকপত্রই হোক। আজ ‘সংবাদ’ সেই ঐতিহ্যের অংশীদার। ইতোমধ্যে সংবাদ ৬৯-এ পা দিয়েছে। রাজনৈতিক তাগিদ বা জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি বহু বুদ্ধিজীবী ও মুক্তমনা মানুষদের সক্রিয় সহযোগিতা ও স্বহৃদয় আনুকূল্য, বৌদ্ধিক উৎকর্ষ ও উদার মানবিক মনোভাব সংবাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। ফলে সংবাদ একদেশদর্শী পত্রিকা নয়, তা সাধারণ পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সব স্তরের যে সব সংবাদপত্রকর্মী সংবাদকে সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার অবদানই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় ।

বিংশ শতাব্দীতে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বড় ঘটনা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। এই স্বাধীনতা বাঙালিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসক এদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় এই ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়ে যায়। আমাদের অংশে স্বাধীন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা-জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জণগণের শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দেয়া হয়নি ফলে সামরিক স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই বলা যায় ভারত বিভক্তি বাঙালিকে মুক্তির স্বাদ দিতে পারেনি বরং শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। এই শোষণমুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তারপর থেকে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। পদ্মা-মেঘনা-সুরমা-ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এই পানি ১৬ কোটি মানুষের দেশে কতটা কার্যকর, কতটা ফলপ্রসূ আর কতটা জনগণের জন্য হয়েছে তা বিবেচনার দাবি রাখে।

যদিও এখানে সামরিক স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরও আমরা আশান্বিত হতে পারি বিগত ৩০ বছরের গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে। এই পথচলাও মসৃণ থাকেনি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শতকরা ৫১ শতাংশ জনগণ শতকরা ৪৯ মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে। পারে যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে। এটাকে ব্রুট মেজোরিটি বলে কিনা বলতে পারব না। তবে এই ব্রুট মেজোরিটি সাধারণ মানুষকে নায্যতা দিতে পারে না। বাংলাদেশ এখনও উন্নয়নশীল দেশ নয়। এখন মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সুফল দেশের কোণায় কোণায় নাকি পৌঁছে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের জন্য ন্যূনতম যা প্রয়োজন-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সরবরাহ, পথঘাট, পরিবহন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-পানি-জ্বালানি ব্যবস্থা, মানুষের নিরাপত্তা, নারীর মর্যাদা রক্ষার প্রচেষ্টা আজ কোথায দাঁড়িয়ে আছে তা বিবেচনার দাবি রাখে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মের নামে সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর কর্তৃত্ব ও অত্যাচার, দলিত শ্রেণীর মানুষদের বঞ্চনা ও অবমাননাও কম উদ্বেগের ব্যাপার নয়।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসলেই সামাজিক মুক্তি আসে না। এজন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যার অভাবে গণতন্ত্র বা স্বাধীনতা সবই মূল্যহীন হয়ে যায়। দুবেলা দুটো অন্নের জন্য সকাল-সন্ধ্যা যাদের মাথার ঘাম পায়ে পড়ে তাদের কাছে শাসন স্বজাতির নাকি বিজাতীয় তাতে কিবা যায় আসে। মানুষের মাথা পিছু আয় বাড়ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পারঙ্গমতার ক্ষেত্রে বিশ্বের রোল মডেল হয়েছে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জিত হয়েছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে, প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষা এবং নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্জন আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ ক্রমান্বয়ে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বাড়াচ্ছে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠিত বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি যেন দিনে দিনে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় ছুটে চলেছি। এই ছুটে চলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৈষম্য আকাশ ছোঁয়া হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের এক বীভৎস প্রতিযোগিতা চলছে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, শেয়ার বাজার ধস, এমএলএম কোম্পানির নামে প্রতারণা, ঋণখেলাপিদের প্রতাপ, ব্যাংক ও বিশ্ববদ্যালয়ের লাইসেন্স নিয়ে দলবাজি, স্বজনতোষণ ইত্যাদি দেশের অর্থনীতিতে বিশঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। আর সমাজ-সময়-মানুষের এই নিয়ত চলমান জীবনের প্রতি ‘সংবাদ’-এর দৃষ্টি দৃঢ় নিবন্ধ। সাধারণ মানুষের পারিপার্শ্বিক যন্ত্রণাকে প্রচন্ড চিৎকারে ব্যক্ত না করে মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে উপস্থাপন করে চলেছে ‘সংবাদ’।

‘সংবাদ’ শুধু সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কথা ভাবেনি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপারেও পথ প্রদর্শক। চিরায়ত সাহিত্য পত্রিকা এবং লিটল ম্যাগাজিনের চাইতে ‘সংবাদ’-এর সপ্তাহান্তের সাহিত্য পাতা সৃষ্টিশীলতায় অনেক বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। গণমাধ্যমের বিপুল সাম্রাজ্যবিস্তারের ডামাডোলে উৎকর্ষ আর উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। সময়ের দাবি অনুযায়ী অপরিসীম নিষ্ঠা ধৈর্য এবং পরিশ্রমে সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলে পাঠককে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশের সামাজিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়সহ সার্বিক মূল্যবোধের পতন ইত্যাদি ইস্যুর পাশাপাশি অনেক নিরীক্ষাধর্মী বিষয় শৈল্পিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। গতানুগতিক ধারার বাইরে আসার সক্ষমতা দেখিয়ে পাঠক সমাদৃত হয়েছে।

সংবাদের বিচরণক্ষেত্রে নিয়ে আলোচনা করলে কলেবর সীমিত রাখা কঠিন। তাই যেদিন থেকে নিজের সংশ্লিষ্টতা সেদিনকার কথা স্মরণ করি। কয়েকদিন আগে সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান খুলনা বিভাগীয় সহকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে এসেছিলেন। নব্বই দশকে এমনি একটা মতবিনিময় সভায় এসেছিলেন তৎকালীন সম্পাদক বজলুর রহমান এবং সোহরাব হাসান। দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে সংবাদের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার রুকুনউদ্দৌলাহ পরিচয় করিয়ে দেন মনিরুল হক খান পিলু এবং আমাকে। পিলুর আমন্ত্রণে উনারা আমাদের পেশাগত সংগঠনের কার্যালয়ে আসেন। আলাপের এক পর্যায়ে এসে রুকুনউদ্দৌলাহ স্থানীয় দৈনিকে আমার লেখার কথা বললে সম্পাদক মহোদয় সংবাদে লেখা পাঠানোর কথা বলেন। সেই শুরু। দীর্ঘদিন রুকুনের মাধ্যমে লেখা পাঠানো চলে। পাঠকের জীবন সত্য আজও ধরতে পেরেছি বলে মনে হয় না। পাঠকের ধ্যানধারণাকে কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছি তাও জানি না। তাই গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও এখন নিজে লেখা পাঠালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামানের সহানুভূতিশীল বিবেচনা পাই যা আমাকে গর্বিত করে। সংবাদের সবচাইতে প্রিয় সম্পাদকীয় পাতার অংশ হতে পেরে ধন্য হয়েছি। সংবাদ কর্তৃপক্ষকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। সংবাদপত্র জগৎ আজ একচেটিয়া মূলধনের হাতে কুক্ষিগত। সেই মূলধনের কঠোর শাসনের মধ্যে সংবাদ সত্যের সম্মান রেখে চলায় স্বাগত জানাই।

বাংলাদেশের মতো একটা দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বর্তমানে লেখাপড়া জানা মানুষ বই বা পত্রিকার পাতা উল্টে দেখতে চায় না। তবে সবাই এটা খুব ভালো করে জানেন সমাজে পরিচিতি পেতে হলে প্রচার হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সরকারি বা সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে যারা ঘুরেফিরে সবসময় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন তারা নিজেরা কতটা দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রচার পেল, পরিচিতি লাভ করল শুধু তাই পত্রিকার পাতায় দেখতে চায় এবং দেখে থাকে। গণমাধ্যমর ব্যাপক সম্প্রসারণে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন মূল্যায়ন করার চাইতে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। দেশের এমন পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে সংবাদ নির্ভীকভাবে জণগণের ভাব ও ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে ৬৮ বছর ধরে। মহাসংগ্রামের ভরা জোয়ারে সামাজিক জীবনকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিয়ে সংবাদ দুরন্ত বেগে ছুটে চলবে এক ঐতিহাসিক ভবিষ্যতের দিকে। সমগ্র জনতার সহযোদ্ধার ভূমিকায় সংবাদ চিরজীবী হোক।

মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০১৯ , ২৫ আষাঢ় ১৪২৫, ৫ জ্বিলকদ ১৪৪০

বিস্মৃতিকে স্মরণ

এমআর খায়রুল উমাম

১৮১৮ সালে হুগলির শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’- কে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র হিসেবে গণ্য করা। যদিও অনেক গবেষক ‘বাঙ্গাল গেজেট’কে এ সম্মান দিয়ে থাকেন। এ দুটি সংবাদপত্রই ১৮১৮ সালে কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত। দুটি পত্রিকাই ছিল সাপ্তাহিক। বাংলা ভাষায় সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত ‘প্রভাকর’ ১৮৩১ সালে প্রথম দৈনিক হিসেবে রূপান্তরিত হয়। যেমন যশোর থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকাটি ১৮৯১ সালে দৈনিক হয়ে যায়। ঊনিশ শতকে বাংলা দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা খুব বেশি না হলেও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ও মাসিক সাময়িকপত্র অনেক ছিল। এসব দেশি পত্রিকা সামাজিক দায়বদ্ধতা, জনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন অব্যাহত রেখেছিল। রাষ্ট্রশক্তির সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, দমনপীড়ন, ছাপাখানায় হানা, সাংবাদিক গ্রেফতার করার প্রবণতা সত্ত্বেও অনেক পত্রিকার পঞ্চাশ বা আরও অধিক বছর টিকে থাকার উদাহরণ আছে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আজও সংবাদপত্র এগিয়ে চলছে।

বাংলা পত্র-পত্রিকার বয়স ২০০ বছর। এই দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক কৌতূহলপ্রদ ও রোমাঞ্চকর অধ্যায় রয়েছে। যে কোন বিচারের মানদন্ডে একটা পত্রিকা ৫০ বছর বা তার অধিককাল টিকে থাকা গৌরবের। তা সংবাদপত্রই হোক বা সাময়িকপত্রই হোক। আজ ‘সংবাদ’ সেই ঐতিহ্যের অংশীদার। ইতোমধ্যে সংবাদ ৬৯-এ পা দিয়েছে। রাজনৈতিক তাগিদ বা জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি বহু বুদ্ধিজীবী ও মুক্তমনা মানুষদের সক্রিয় সহযোগিতা ও স্বহৃদয় আনুকূল্য, বৌদ্ধিক উৎকর্ষ ও উদার মানবিক মনোভাব সংবাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। ফলে সংবাদ একদেশদর্শী পত্রিকা নয়, তা সাধারণ পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সব স্তরের যে সব সংবাদপত্রকর্মী সংবাদকে সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার অবদানই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় ।

বিংশ শতাব্দীতে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বড় ঘটনা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তি। এই স্বাধীনতা বাঙালিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারেনি। ব্রিটিশ শাসক এদেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় এই ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়ে যায়। আমাদের অংশে স্বাধীন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা-জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জণগণের শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দেয়া হয়নি ফলে সামরিক স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই বলা যায় ভারত বিভক্তি বাঙালিকে মুক্তির স্বাদ দিতে পারেনি বরং শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। এই শোষণমুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তারপর থেকে অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। পদ্মা-মেঘনা-সুরমা-ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এই পানি ১৬ কোটি মানুষের দেশে কতটা কার্যকর, কতটা ফলপ্রসূ আর কতটা জনগণের জন্য হয়েছে তা বিবেচনার দাবি রাখে।

যদিও এখানে সামরিক স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তারপরও আমরা আশান্বিত হতে পারি বিগত ৩০ বছরের গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে। এই পথচলাও মসৃণ থাকেনি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শতকরা ৫১ শতাংশ জনগণ শতকরা ৪৯ মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে। পারে যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করতে। এটাকে ব্রুট মেজোরিটি বলে কিনা বলতে পারব না। তবে এই ব্রুট মেজোরিটি সাধারণ মানুষকে নায্যতা দিতে পারে না। বাংলাদেশ এখনও উন্নয়নশীল দেশ নয়। এখন মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সুফল দেশের কোণায় কোণায় নাকি পৌঁছে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের জন্য ন্যূনতম যা প্রয়োজন-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য সরবরাহ, পথঘাট, পরিবহন ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-পানি-জ্বালানি ব্যবস্থা, মানুষের নিরাপত্তা, নারীর মর্যাদা রক্ষার প্রচেষ্টা আজ কোথায দাঁড়িয়ে আছে তা বিবেচনার দাবি রাখে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মের নামে সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর কর্তৃত্ব ও অত্যাচার, দলিত শ্রেণীর মানুষদের বঞ্চনা ও অবমাননাও কম উদ্বেগের ব্যাপার নয়।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা আসলেই সামাজিক মুক্তি আসে না। এজন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যার অভাবে গণতন্ত্র বা স্বাধীনতা সবই মূল্যহীন হয়ে যায়। দুবেলা দুটো অন্নের জন্য সকাল-সন্ধ্যা যাদের মাথার ঘাম পায়ে পড়ে তাদের কাছে শাসন স্বজাতির নাকি বিজাতীয় তাতে কিবা যায় আসে। মানুষের মাথা পিছু আয় বাড়ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পারঙ্গমতার ক্ষেত্রে বিশ্বের রোল মডেল হয়েছে, খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জিত হয়েছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে, প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষা এবং নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অর্জন আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত, সামাজিক নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ ক্রমান্বয়ে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বাড়াচ্ছে। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠিত বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি যেন দিনে দিনে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় ছুটে চলেছি। এই ছুটে চলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৈষম্য আকাশ ছোঁয়া হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র ব্যবস্থার দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের এক বীভৎস প্রতিযোগিতা চলছে। হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, শেয়ার বাজার ধস, এমএলএম কোম্পানির নামে প্রতারণা, ঋণখেলাপিদের প্রতাপ, ব্যাংক ও বিশ্ববদ্যালয়ের লাইসেন্স নিয়ে দলবাজি, স্বজনতোষণ ইত্যাদি দেশের অর্থনীতিতে বিশঙ্খলা ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। আর সমাজ-সময়-মানুষের এই নিয়ত চলমান জীবনের প্রতি ‘সংবাদ’-এর দৃষ্টি দৃঢ় নিবন্ধ। সাধারণ মানুষের পারিপার্শ্বিক যন্ত্রণাকে প্রচন্ড চিৎকারে ব্যক্ত না করে মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে উপস্থাপন করে চলেছে ‘সংবাদ’।

‘সংবাদ’ শুধু সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কথা ভাবেনি। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যাপারেও পথ প্রদর্শক। চিরায়ত সাহিত্য পত্রিকা এবং লিটল ম্যাগাজিনের চাইতে ‘সংবাদ’-এর সপ্তাহান্তের সাহিত্য পাতা সৃষ্টিশীলতায় অনেক বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। গণমাধ্যমের বিপুল সাম্রাজ্যবিস্তারের ডামাডোলে উৎকর্ষ আর উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। সময়ের দাবি অনুযায়ী অপরিসীম নিষ্ঠা ধৈর্য এবং পরিশ্রমে সাহিত্যের সঙ্গে সমাজের বহুমাত্রিক সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলে পাঠককে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশের সামাজিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়সহ সার্বিক মূল্যবোধের পতন ইত্যাদি ইস্যুর পাশাপাশি অনেক নিরীক্ষাধর্মী বিষয় শৈল্পিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। গতানুগতিক ধারার বাইরে আসার সক্ষমতা দেখিয়ে পাঠক সমাদৃত হয়েছে।

সংবাদের বিচরণক্ষেত্রে নিয়ে আলোচনা করলে কলেবর সীমিত রাখা কঠিন। তাই যেদিন থেকে নিজের সংশ্লিষ্টতা সেদিনকার কথা স্মরণ করি। কয়েকদিন আগে সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান খুলনা বিভাগীয় সহকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে এসেছিলেন। নব্বই দশকে এমনি একটা মতবিনিময় সভায় এসেছিলেন তৎকালীন সম্পাদক বজলুর রহমান এবং সোহরাব হাসান। দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে সংবাদের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার রুকুনউদ্দৌলাহ পরিচয় করিয়ে দেন মনিরুল হক খান পিলু এবং আমাকে। পিলুর আমন্ত্রণে উনারা আমাদের পেশাগত সংগঠনের কার্যালয়ে আসেন। আলাপের এক পর্যায়ে এসে রুকুনউদ্দৌলাহ স্থানীয় দৈনিকে আমার লেখার কথা বললে সম্পাদক মহোদয় সংবাদে লেখা পাঠানোর কথা বলেন। সেই শুরু। দীর্ঘদিন রুকুনের মাধ্যমে লেখা পাঠানো চলে। পাঠকের জীবন সত্য আজও ধরতে পেরেছি বলে মনে হয় না। পাঠকের ধ্যানধারণাকে কতটা উপলব্ধি করতে পেরেছি তাও জানি না। তাই গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলেও এখন নিজে লেখা পাঠালে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামানের সহানুভূতিশীল বিবেচনা পাই যা আমাকে গর্বিত করে। সংবাদের সবচাইতে প্রিয় সম্পাদকীয় পাতার অংশ হতে পেরে ধন্য হয়েছি। সংবাদ কর্তৃপক্ষকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। সংবাদপত্র জগৎ আজ একচেটিয়া মূলধনের হাতে কুক্ষিগত। সেই মূলধনের কঠোর শাসনের মধ্যে সংবাদ সত্যের সম্মান রেখে চলায় স্বাগত জানাই।

বাংলাদেশের মতো একটা দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে বর্তমানে লেখাপড়া জানা মানুষ বই বা পত্রিকার পাতা উল্টে দেখতে চায় না। তবে সবাই এটা খুব ভালো করে জানেন সমাজে পরিচিতি পেতে হলে প্রচার হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সরকারি বা সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতে যারা ঘুরেফিরে সবসময় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন তারা নিজেরা কতটা দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রচার পেল, পরিচিতি লাভ করল শুধু তাই পত্রিকার পাতায় দেখতে চায় এবং দেখে থাকে। গণমাধ্যমর ব্যাপক সম্প্রসারণে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন মূল্যায়ন করার চাইতে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। দেশের এমন পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে সংবাদ নির্ভীকভাবে জণগণের ভাব ও ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে ৬৮ বছর ধরে। মহাসংগ্রামের ভরা জোয়ারে সামাজিক জীবনকে কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিয়ে সংবাদ দুরন্ত বেগে ছুটে চলবে এক ঐতিহাসিক ভবিষ্যতের দিকে। সমগ্র জনতার সহযোদ্ধার ভূমিকায় সংবাদ চিরজীবী হোক।