ভাষা থেকে ভূখন্ড

আহমদ রফিক

“ভাষার উৎপত্তি প্রয়োজন থেকে।” বহু পরিচিত এ তাত্ত্বিক সূত্র থেকে বোঝা যায়, এই প্রয়োজন ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে প্রসারিত। ব্যক্তিক পর্যায়ে এর প্রতিফলন সাদামাটা ‘কম্যুনিকেশনে’ শেষ হলেও সামাজিক পর্যায়ে এর তাৎপর্য বহুমুখী। সেখানে ভাষার হাত ধরে শিক্ষাসাহিত্য, প্রযুক্তিজ্ঞান ও সংস্কৃতির নানা শাখা একের পর এক সামাজিক তাৎপর্যে এমন অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যার ফলে এদের যে কোন বিন্দুতে অর্বাচীন আঘাত স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে। আর স্ফুলিঙ্গ যে অনুকূল পরিবেশে আগুন জ্বালাতে সক্ষম সে তথ্য আমাদের অজানা নয়।

একই সূত্র তাই ব্যবহারগত পার্থক্যের দরুন সম্পূর্ণ পৃথক তাৎপর্য সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে এসে সাদামাটা ‘কম্যুনিকেশনের’ গুণগ্রাম সংকীর্ণ ব্যক্তিক গলিপথ পার হয়ে সামাজিক তাৎপর্যে চিহ্নিত হতে পারে, প্রতিফলিত করতে পারে সামাজিক তৎপরতায় অর্থব্যঞ্জক কার্যক্রম। ভাষা চেতনা তখন সংস্কৃতি চেতনার পথে সমাজ চেতনায় উত্তীর্ণ; এবং এরা তখন পরস্পর নির্ভরতায় একে অন্যের হাত ধরে চলায় উৎসাহী হয়ে ওঠে।

এদেশে ভাষা চেতনা এমনি প্রক্রিয়ায় সংস্কৃতি চর্চার মুক্ত অধিকার অর্জনে শিক্ষিত মানসকে সচেতন করে তুলেছে, স্বাধিকার রক্ষার বোধ তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। এবং পরিশেষে সাংস্কৃতিক চেতনার গভীর তল থেকে উঠে এসেছে রাজনৈতিক স্বাধিকারের উপাদান, যা পর্যায়ক্রমে নানা বাঁক পার হয়ে ভূখন্ড ভিত্তিক জাতীয়তাবোধে রূপান্তর গ্রহণ করেছে। দেশ, কাল ও নিসর্গ জাতীয় চেতনার চরিত্রে আপন বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছে, একে লালন করেছে সবিশেষ করে।

তাই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আপাত-সরল এ প্রক্রিয়ার চরিত্র সাংস্কৃতিক হয়েও গভীরভাবে রাজনৈতিক চেতনায় সম্পৃক্ত। এবং আমাদের সংস্কৃতি চর্চার গোটা সৌধটি সামাজিক অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শিক্ষিত বাঙালির অর্থনৈতিক স্বার্থের বৃত্তটির আসন্ন আয়তনিক হ্রাস এবং তার পরিবর্ধন ও বিস্তারে ক্রমবর্ধমান বাধা ইত্যাদির পটভূমিতেই যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র ও তাৎপর্য অর্জন করেছে, সে কথা কারো অজানা নয়। তদুপরি এ সম্পর্কে শিক্ষিত শ্রেণির স্বার্থনির্ভর কার্যক্রম ঐ রাজনৈতিক তাৎপর্য ক্রমেই গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

ভাষা চেতনার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তাৎপর্য বহন করে এবং সাংস্কৃতিক চেতনার পুষ্টি আহরণ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ভাষা ও ভূখন্ডভিত্তিক সচেতনতার উদ্ভাস ঘটেছে। ঐতিহ্যের সাহায্য নিয়ে এ চেতনার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। এবং পরিশেষে তাতে ঐতিহাসিক বাস্তবতার গুণ সংযোজিত হয়েছে। এ অর্থে ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান ঘিরে সংঘটিত আন্দোলনের ভূমিকা অনেকটা। রাজনীতি ক্ষেত্রে অগ্রজের পথ বেঁধে দেবার মতো। এর অস্তিত্ব পরবর্তী কালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ‘প্রিকার্সার’ রূপে চিহ্নিত হবার যোগ্যতায় উজ্জ্বল।

ভাষা ও সংশিষ্ট সাংস্কৃতিক আন্দোলন গণতান্ত্রিক চেতনার ক্রমবিকাশ ঘটানোর প্রক্রিয়ায় ভাষা-ভূখন্ডভিত্তিক স্বাজাত্যবোধের যে আভাস পরিস্ফুট করে তুলেছে, তা বস্তুত প্রতিবাদী রাজনৈতিক চেতনারই উদ্ভাস। ধর্মীয় চেতনাধৃত স্বীয় বাসভূমে স্বধর্মী শাসকের গুলিতে চিহ্নিত রাজপথ থেকেই এদেশে প্রতিরোধ চেতনার যাত্রা শুরু এবং তা সংস্কৃতি ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই। ক্রান্তি-চেতনায় সমৃদ্ধ এমনি কয়েকটি বিন্দু প্রতি বছর বারবার ফিরে এসেছে। রেখে গেছে সাংস্কৃতিক চেতনায় পলির উর্বরতা, তুলে ধরেছে স্বাদেশিক চেতনার ক্রমবিকাশ ও গুণগত বিস্তার। এমনি করে পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে একটি বিন্দুর বহুমুখী বিস্তার।

কিন্তু তা সত্ত্বেও অস্বীকার করা চলে না যে, এই রূপান্তরের পটভূমি এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতার উদাহরণ। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে জনসমর্থন যে কোন পর্যায়ে ছিল, সরদার ফজলুল করিম, অলী আহাদ প্রমুখের প্রকাশিত ইস্তেহারে জনসাধারণের প্রতি আন্দোলন সমর্থনের আবেদনে তার প্রমাণ বিধৃত। অন্যদিকে দেশজোড়া শাসনচক্রের উগ্র রাজনৈতিক দমননীতি, দাঙ্গা এবং এ সবের পটভূমিতে জনতার অরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, সর্বোপরি জনমানসে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার নিম্নমান প্রভৃতি বিচিত্র ও বিমিশ্র জটিলতায় এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন গণতান্ত্রিক চেতনার প্রাথমিক পর্যায়ের যে বিকাশ ঘটিয়েছে, তার প্রভাব গণতান্ত্রিক রাজনীতির শূন্য অঙ্গনে সমৃদ্ধ উপকরণের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছে।

তাছাড়াও স্মর্তব্য যে, ভাষার মতো সর্বজনীন চরিত্রের বিষয়-চেতনা সাধারণত জনমানসকে আংশিকভাবে হলেও স্পর্শ করে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে বাস্তবেও তাই ঘটেছে। স্বভাবতই এ বিষয়বস্তুর অন্তরে নিহিত স্বদেশচেতনাও একই সঙ্গে জনমানসের অংশ। বিশেষে গণতান্ত্রিক প্রভাব বিস্তার করেছে। এমনি করে সংস্কৃতি-কক্ষের ক্ষণস্থায়ী সাফল্য পরবর্তী পদযাত্রার পথ কিছুটা মসৃণ করেছে, সুগম করেছে। আবার একই সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরবর্তী সম্ভাবনার বীজ সহজেই রোপণ করতে পেরেছে। এককথায় বলা যায় পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলন ও স্বদেশ অর্জনে সাফল্য প্রকৃতপক্ষে এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত রূপ। ভাষা চেতনার বিস্তার প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, এমনকি ধনী কৃষক থেকে উঠতি নয়া শিক্ষিতের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতীক। এবং এই লক্ষ্য নিয়ে আরো কয়েকটি শ্রেণি। উপশ্রেণির সমন্বয়ে রাজনৈতিক স্বার্থের পথে জাতীয়তার যাত্রাকে প্রাথমিক পর্যায়ে সংহত করেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, এবং পরবর্তী পর্যায়ে অব্যাহত শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রেই জানেন প্রতি বছর শহীদ দিবস উপলক্ষে রাজনৈতিক পদক্ষেপ বৈষয়িক বিভিন্নতা বিচার না করেই কি অবাক এক জাদুমন্ত্রে ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গতিবেগ অর্জন করেছে। সমস্ত বাধাবিপত্তি, সমস্যা বা অসহায়তার জন্য সমাধান এগিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। বাহান্ন-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর। যথাযথ চরিত্র বিচার করলে এই উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হবে।

সত্যি বলতে কি আইয়ুবী সামরিক শাসনের এক যুগ ধরে রাজনৈতিক আধো অন্ধকারে একুশের আসা-যাওয়া স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে হতাশা-নৈরাজ্য ও পশ্চাদবর্তিতার পটভূমিতে ছাত্র-যুব সমাজের চেতনায় যেন পাথর ঘষে স্ফুলিঙ্গপাত ঘটিয়েছে। ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের যে প্রবল উৎক্ষেপ, তার বিষয়আশয় তো ছিল প্রধানত ভাষা সমস্যা, সংস্কৃতি সমস্যা কিংবা শিক্ষা সমস্যাকেন্দ্রিক।

এমনি করে বাষট্টি চৌষট্টি প্রভৃতি বাঁকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খরদীপ্তি রাজনৈতিক চেতনার ওপর রক্তিম আলোর প্রতিফলন ঘটিয়েছে। উচ্চারিত হয়েছে স্বায়ত্তশাসনের ধ্বনি ও দাবি। বর্ষ ঊনসত্তর তো প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক চেতনার এক ব্যাপক বিস্তার ও গতিবেগ অর্জনের কাল, এবং সেই সঙ্গে জাতীয় চেতনা ও স্বাধিকার চেতনার সুস্পষ্ট অবয়ব গ্রহণের ক্রান্তিকাল।

এমনকি আমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা-পূর্ব সর্বশেষ আন্দোলনটির চরিত্র বিচারেও একই মৌল রূপের প্রতিভাস দেখতে পাই। আমাদের সংস্কৃতি চেতনার রাজনৈতিক রূপান্তরের সুস্পষ্ট প্রমাণ তো ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রীয় চেতনার ভূখন্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদে ক্রমশ অবয়ব গ্রহণ। তাই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তথা ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রশ্নটি ঘুরে-ফিরে বারবার রাজনৈতিক আবর্তে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছে। এই তাৎপর্য নিয়েই রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রচর্চা, পূর্ণাঙ্গ নজরুলচর্চা, মাইকেল থেকে বাংলা প্রগতি সাহিত্যের ঐতিহ্যচর্চা ইত্যাদি বিষয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল উত্তাপ ছড়িয়েছে। আর এইসব বিষয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে ইসলামবাদে অধিষ্ঠিত শাসকগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছিল সে তথ্য কমবেশি সবারই জানা। এইসব উত্তাপ সার্থকভাবে প্রতিহত করতে শাসকগোষ্ঠী বরাবরই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় উপকরণের মৌতাত ব্যবহার করেছে, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। এর অর্থ, সংস্কৃতি অঙ্গনের উল্লিখিত উপকরণগুলো আমাদের রাজনৈতিক স্বদেশ অর্জনের পথে তেজ সৃষ্টিকারী অণুর দায়িত্ব পালন করে এসেছে। শুরুতে অগ্রজ উপকরণ হিসেবে, পরে সমান্তরাল পথে সাহস, শক্তি ও প্রতিরোধ চেতনার সহমর্মিতায় এগিয়ে গেছে।

প্রতিপাদ্য বিষয়টিতে পুনর্বার ফিরে এলে সিদ্ধান্তে আসা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে যে, আমাদের সংস্কৃতি চেতনা ও তার কর্মকান্ড এ ভূখন্ডে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী, অথবা সহায়ক উপাদান। সূর্য গ্রহণের সংক্ষিপ্ত পরিসরেও সংস্কৃতি চর্চা আমাদের রাজনৈতিক চলার পথ কিছু না কিছু আলোকিত করেছে। বিপর্যয়ে এর আড়ালে আত্মরক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আটচল্লিশ থেকে সত্তর পর্যন্ত এদেশের প্রায় প্রতিটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎক্ষেপে এ বিশেষ চরিত্রই বারবার ধরা পড়ে।

এ চারিত্র্য-ধর্মেই আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চেতনার বৈশিষ্ট্য চিনে নেয়া সহজ হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সংস্কৃতি চেতনাকে সামাজিক-অর্থনৈতিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতির কল্যাণী ও সামাজিক ভূমিকার কথা মনে রেখে সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রসর হওয়া উচিত।

এই পদক্ষেপ আরো তাৎপর্য বহন করছে এই কারণে যে, আমাদের সংস্কৃতি চর্চা যে স্বদেশ ও স্বাধীনতা অর্জনের ভিত তৈরি করেছিল, তার সর্বজনীন গণতান্ত্রিক চরিত্র পরিস্ফুট করা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির সদাচার এখনো সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এমন ধারণা তাই কোনো সচেতন বুদ্ধিজীবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, অনুকূল পরিবেশে বা অনুকূল সমাজ বিন্যাসেই সংস্কৃতি চর্চার প্রগতিধর্ম সার্থকতা অর্জন করতে পারে। বরং বাস্তব সত্য এর বিপরীত সূত্রই প্রমাণ করে থাকে। অর্থাৎ বলিষ্ঠ সংস্কৃতি চর্চা আপন নিষ্ঠা ও সততায় প্রগতির অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে এবং আকাক্সিক্ষত সামাজিক পরিবর্তনের গন্তব্যে যাত্রা নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের দুই যুগব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারা ও চরিত্রে এমন উদাহরণ বিরল নয়।

সচেতন ব্যক্তিমাত্রেরই তাই সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে প্রত্যাশা, প্রগতিধর্মী সংস্কৃতিচর্চা নবলব্ধ স্বাধীনতাকে সর্বজনীন ও অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে নিশ্চিত ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এবং এই উদ্দেশ্যে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টিশীলতাকে সংস্কৃতির রূপময় ভাষ্যে তাৎপর্যময় করে তুলতে পারে। ঐতিহ্যগত বিচারে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ধারার ঐতিহাসিক বিকাশ যতটা না স্থাপত্যে কিংবা ভাস্কর্যে তার চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যময় সাহিত্যে, শিল্পে, চিত্রাঙ্কনে, লোকায়ত ধর্মে ও লোকসংস্কৃতির সবিশেষ চর্চায়। লোক সংস্কৃতির চর্চা ও লোকায়ত দর্শন বিভিন্ন যুগে নানা প্রতিকূলতার মুখেও নেহাৎ প্রাণশক্তির প্রাচুর্যে মাটির সাথে নিবিড় সম্পর্ক ও আত্মিক সখ্য বজায় রাখতে পেরেছে। অর্থাৎ জনমানসের পালল উর্বরতায় এবং অনুকূল আবহে এর পরিবর্ধন ও স্থিতি। সম্ভবত এতে বাঙালি সংস্কৃতির স্থানিক- বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট।

সূত্রটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, বাঙালি সংস্কৃতির প্রবহমানতায় যে প্রতিকূল স্রোতের টান অপকর্ষ ও অবক্ষয়ের অস্তিত্ব প্রকট করে তুলছে, তাকে প্রতিহত করতে জনমানসের নৈকট্য প্রয়োজন; প্রয়োজন জনসংস্কৃতির বিভিন্ন সুস্থ ধারাস্রোতে অবগাহন। এই সঙ্গে আরো প্রয়োজন সেই ধারার বর্তমান চরিত্র নির্ধারণ এবং পরিশেষে তাকে হাতে কাটা খালের মধ্য দিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রবাহিত করে দেয়া। নিজকে চেনার কাজে গ্রামীণ জনমানসকে উদ্বুদ্ধ করা। আর এই কাজ লোকসংস্কৃতির চর্চা অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম।

বর্তমান সময়ের পরিস্থিতি বিচারে এবং স্বাধীনতার ব্যবহারিক তাৎপর্যের পটভূমিতে। সংস্কৃতি চর্চাকে নবভাষ্যে সমৃদ্ধ করে তোলা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্য কার্যকর ও সফল করে তুলতে হলে আমাদের সংস্কৃতি চর্চাকে লোক-সংস্কৃতির প্রক্ষেপে ও শ্রম-নির্ভরতায় সজীব করে নেওয়া একটি অন্যতম পদক্ষেপ রূপে গণ্য করতে হবে। বৃহত্তর ব্যাপকতায় সংশ্লিষ্ট না হয়ে অপসংস্কৃতির টান, পশ্চাদগতির শক্তি প্রতিহত করা যাবে না, অন্ততপক্ষে সার্থকভাবে যাবে না। শুধু নাগরিক সংস্কৃতির সীমাবদ্ধ চর্চা, তা যতই প্রগতিশীল হোক না কেন, প্রতিরোধের কাজ, এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ বাস্তবায়িত করতে পারছে না, এবং পারবে না।

তাই আপাতত লোকায়ত ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির বলিষ্ঠ ও প্রগতিশীল প্রকাশ আমাদের অভিপ্রায়ে সহায়ক হতে পারে। বৃহত্তর জনমানসের সাথে যোগসূত্র স্থাপনে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। তাই সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার অনুশীলন প্রয়োজন। প্রয়োজন এদেরকে যুগোপযোগী করে তোলা, নতুন গুণগত সমৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবহার করা, যাতে প্রগতি ও জনগ্রাহ্যতার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য সমানভাবে সিদ্ধ হতে পারে। লোকগীতি, লোকনাট্য, যাত্রা, কবি বা জারি গানই নয় শুধু, মৃৎ শিল্পকলা, বেত-বাঁশের চারুকলায় সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সমন্বিত ভাষ্যে নতুন দিনের কালধর্মী সুপ্রকাশ সম্ভব হতে পারে। আমাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি চর্চায় এই সব দিকগুলোর। গুরুত্ব সংস্কৃতিবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীদের বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা ও পর্যালোচনা করে দেখা দরকার।

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

ভাষা থেকে ভূখন্ড

আহমদ রফিক

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

“ভাষার উৎপত্তি প্রয়োজন থেকে।” বহু পরিচিত এ তাত্ত্বিক সূত্র থেকে বোঝা যায়, এই প্রয়োজন ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে প্রসারিত। ব্যক্তিক পর্যায়ে এর প্রতিফলন সাদামাটা ‘কম্যুনিকেশনে’ শেষ হলেও সামাজিক পর্যায়ে এর তাৎপর্য বহুমুখী। সেখানে ভাষার হাত ধরে শিক্ষাসাহিত্য, প্রযুক্তিজ্ঞান ও সংস্কৃতির নানা শাখা একের পর এক সামাজিক তাৎপর্যে এমন অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক সৃষ্টি করে, যার ফলে এদের যে কোন বিন্দুতে অর্বাচীন আঘাত স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করতে পারে। আর স্ফুলিঙ্গ যে অনুকূল পরিবেশে আগুন জ্বালাতে সক্ষম সে তথ্য আমাদের অজানা নয়।

একই সূত্র তাই ব্যবহারগত পার্থক্যের দরুন সম্পূর্ণ পৃথক তাৎপর্য সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ ব্যষ্টি থেকে সমষ্টিতে এসে সাদামাটা ‘কম্যুনিকেশনের’ গুণগ্রাম সংকীর্ণ ব্যক্তিক গলিপথ পার হয়ে সামাজিক তাৎপর্যে চিহ্নিত হতে পারে, প্রতিফলিত করতে পারে সামাজিক তৎপরতায় অর্থব্যঞ্জক কার্যক্রম। ভাষা চেতনা তখন সংস্কৃতি চেতনার পথে সমাজ চেতনায় উত্তীর্ণ; এবং এরা তখন পরস্পর নির্ভরতায় একে অন্যের হাত ধরে চলায় উৎসাহী হয়ে ওঠে।

এদেশে ভাষা চেতনা এমনি প্রক্রিয়ায় সংস্কৃতি চর্চার মুক্ত অধিকার অর্জনে শিক্ষিত মানসকে সচেতন করে তুলেছে, স্বাধিকার রক্ষার বোধ তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। এবং পরিশেষে সাংস্কৃতিক চেতনার গভীর তল থেকে উঠে এসেছে রাজনৈতিক স্বাধিকারের উপাদান, যা পর্যায়ক্রমে নানা বাঁক পার হয়ে ভূখন্ড ভিত্তিক জাতীয়তাবোধে রূপান্তর গ্রহণ করেছে। দেশ, কাল ও নিসর্গ জাতীয় চেতনার চরিত্রে আপন বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছে, একে লালন করেছে সবিশেষ করে।

তাই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, আপাত-সরল এ প্রক্রিয়ার চরিত্র সাংস্কৃতিক হয়েও গভীরভাবে রাজনৈতিক চেতনায় সম্পৃক্ত। এবং আমাদের সংস্কৃতি চর্চার গোটা সৌধটি সামাজিক অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শিক্ষিত বাঙালির অর্থনৈতিক স্বার্থের বৃত্তটির আসন্ন আয়তনিক হ্রাস এবং তার পরিবর্ধন ও বিস্তারে ক্রমবর্ধমান বাধা ইত্যাদির পটভূমিতেই যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র ও তাৎপর্য অর্জন করেছে, সে কথা কারো অজানা নয়। তদুপরি এ সম্পর্কে শিক্ষিত শ্রেণির স্বার্থনির্ভর কার্যক্রম ঐ রাজনৈতিক তাৎপর্য ক্রমেই গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

ভাষা চেতনার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক তাৎপর্য বহন করে এবং সাংস্কৃতিক চেতনার পুষ্টি আহরণ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে ভাষা ও ভূখন্ডভিত্তিক সচেতনতার উদ্ভাস ঘটেছে। ঐতিহ্যের সাহায্য নিয়ে এ চেতনার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। এবং পরিশেষে তাতে ঐতিহাসিক বাস্তবতার গুণ সংযোজিত হয়েছে। এ অর্থে ভাষা ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান ঘিরে সংঘটিত আন্দোলনের ভূমিকা অনেকটা। রাজনীতি ক্ষেত্রে অগ্রজের পথ বেঁধে দেবার মতো। এর অস্তিত্ব পরবর্তী কালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ‘প্রিকার্সার’ রূপে চিহ্নিত হবার যোগ্যতায় উজ্জ্বল।

ভাষা ও সংশিষ্ট সাংস্কৃতিক আন্দোলন গণতান্ত্রিক চেতনার ক্রমবিকাশ ঘটানোর প্রক্রিয়ায় ভাষা-ভূখন্ডভিত্তিক স্বাজাত্যবোধের যে আভাস পরিস্ফুট করে তুলেছে, তা বস্তুত প্রতিবাদী রাজনৈতিক চেতনারই উদ্ভাস। ধর্মীয় চেতনাধৃত স্বীয় বাসভূমে স্বধর্মী শাসকের গুলিতে চিহ্নিত রাজপথ থেকেই এদেশে প্রতিরোধ চেতনার যাত্রা শুরু এবং তা সংস্কৃতি ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই। ক্রান্তি-চেতনায় সমৃদ্ধ এমনি কয়েকটি বিন্দু প্রতি বছর বারবার ফিরে এসেছে। রেখে গেছে সাংস্কৃতিক চেতনায় পলির উর্বরতা, তুলে ধরেছে স্বাদেশিক চেতনার ক্রমবিকাশ ও গুণগত বিস্তার। এমনি করে পরবর্তীকালের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে একটি বিন্দুর বহুমুখী বিস্তার।

কিন্তু তা সত্ত্বেও অস্বীকার করা চলে না যে, এই রূপান্তরের পটভূমি এক অদ্ভুত স্ববিরোধিতার উদাহরণ। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে জনসমর্থন যে কোন পর্যায়ে ছিল, সরদার ফজলুল করিম, অলী আহাদ প্রমুখের প্রকাশিত ইস্তেহারে জনসাধারণের প্রতি আন্দোলন সমর্থনের আবেদনে তার প্রমাণ বিধৃত। অন্যদিকে দেশজোড়া শাসনচক্রের উগ্র রাজনৈতিক দমননীতি, দাঙ্গা এবং এ সবের পটভূমিতে জনতার অরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, সর্বোপরি জনমানসে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার নিম্নমান প্রভৃতি বিচিত্র ও বিমিশ্র জটিলতায় এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন গণতান্ত্রিক চেতনার প্রাথমিক পর্যায়ের যে বিকাশ ঘটিয়েছে, তার প্রভাব গণতান্ত্রিক রাজনীতির শূন্য অঙ্গনে সমৃদ্ধ উপকরণের অস্তিত্ব নিশ্চিত করেছে।

তাছাড়াও স্মর্তব্য যে, ভাষার মতো সর্বজনীন চরিত্রের বিষয়-চেতনা সাধারণত জনমানসকে আংশিকভাবে হলেও স্পর্শ করে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে বাস্তবেও তাই ঘটেছে। স্বভাবতই এ বিষয়বস্তুর অন্তরে নিহিত স্বদেশচেতনাও একই সঙ্গে জনমানসের অংশ। বিশেষে গণতান্ত্রিক প্রভাব বিস্তার করেছে। এমনি করে সংস্কৃতি-কক্ষের ক্ষণস্থায়ী সাফল্য পরবর্তী পদযাত্রার পথ কিছুটা মসৃণ করেছে, সুগম করেছে। আবার একই সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরবর্তী সম্ভাবনার বীজ সহজেই রোপণ করতে পেরেছে। এককথায় বলা যায় পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলন ও স্বদেশ অর্জনে সাফল্য প্রকৃতপক্ষে এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত রূপ। ভাষা চেতনার বিস্তার প্রকৃতপক্ষে বাঙালি মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, এমনকি ধনী কৃষক থেকে উঠতি নয়া শিক্ষিতের অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রতীক। এবং এই লক্ষ্য নিয়ে আরো কয়েকটি শ্রেণি। উপশ্রেণির সমন্বয়ে রাজনৈতিক স্বার্থের পথে জাতীয়তার যাত্রাকে প্রাথমিক পর্যায়ে সংহত করেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, এবং পরবর্তী পর্যায়ে অব্যাহত শক্তির সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিমাত্রেই জানেন প্রতি বছর শহীদ দিবস উপলক্ষে রাজনৈতিক পদক্ষেপ বৈষয়িক বিভিন্নতা বিচার না করেই কি অবাক এক জাদুমন্ত্রে ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গতিবেগ অর্জন করেছে। সমস্ত বাধাবিপত্তি, সমস্যা বা অসহায়তার জন্য সমাধান এগিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। বাহান্ন-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর। যথাযথ চরিত্র বিচার করলে এই উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হবে।

সত্যি বলতে কি আইয়ুবী সামরিক শাসনের এক যুগ ধরে রাজনৈতিক আধো অন্ধকারে একুশের আসা-যাওয়া স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে হতাশা-নৈরাজ্য ও পশ্চাদবর্তিতার পটভূমিতে ছাত্র-যুব সমাজের চেতনায় যেন পাথর ঘষে স্ফুলিঙ্গপাত ঘটিয়েছে। ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের যে প্রবল উৎক্ষেপ, তার বিষয়আশয় তো ছিল প্রধানত ভাষা সমস্যা, সংস্কৃতি সমস্যা কিংবা শিক্ষা সমস্যাকেন্দ্রিক।

এমনি করে বাষট্টি চৌষট্টি প্রভৃতি বাঁকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের খরদীপ্তি রাজনৈতিক চেতনার ওপর রক্তিম আলোর প্রতিফলন ঘটিয়েছে। উচ্চারিত হয়েছে স্বায়ত্তশাসনের ধ্বনি ও দাবি। বর্ষ ঊনসত্তর তো প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক চেতনার এক ব্যাপক বিস্তার ও গতিবেগ অর্জনের কাল, এবং সেই সঙ্গে জাতীয় চেতনা ও স্বাধিকার চেতনার সুস্পষ্ট অবয়ব গ্রহণের ক্রান্তিকাল।

এমনকি আমাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা-পূর্ব সর্বশেষ আন্দোলনটির চরিত্র বিচারেও একই মৌল রূপের প্রতিভাস দেখতে পাই। আমাদের সংস্কৃতি চেতনার রাজনৈতিক রূপান্তরের সুস্পষ্ট প্রমাণ তো ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্রীয় চেতনার ভূখন্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদে ক্রমশ অবয়ব গ্রহণ। তাই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তথা ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রশ্নটি ঘুরে-ফিরে বারবার রাজনৈতিক আবর্তে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছে। এই তাৎপর্য নিয়েই রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রচর্চা, পূর্ণাঙ্গ নজরুলচর্চা, মাইকেল থেকে বাংলা প্রগতি সাহিত্যের ঐতিহ্যচর্চা ইত্যাদি বিষয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল উত্তাপ ছড়িয়েছে। আর এইসব বিষয়ের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য যে ইসলামবাদে অধিষ্ঠিত শাসকগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছিল সে তথ্য কমবেশি সবারই জানা। এইসব উত্তাপ সার্থকভাবে প্রতিহত করতে শাসকগোষ্ঠী বরাবরই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় উপকরণের মৌতাত ব্যবহার করেছে, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। এর অর্থ, সংস্কৃতি অঙ্গনের উল্লিখিত উপকরণগুলো আমাদের রাজনৈতিক স্বদেশ অর্জনের পথে তেজ সৃষ্টিকারী অণুর দায়িত্ব পালন করে এসেছে। শুরুতে অগ্রজ উপকরণ হিসেবে, পরে সমান্তরাল পথে সাহস, শক্তি ও প্রতিরোধ চেতনার সহমর্মিতায় এগিয়ে গেছে।

প্রতিপাদ্য বিষয়টিতে পুনর্বার ফিরে এলে সিদ্ধান্তে আসা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে যে, আমাদের সংস্কৃতি চেতনা ও তার কর্মকান্ড এ ভূখন্ডে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী, অথবা সহায়ক উপাদান। সূর্য গ্রহণের সংক্ষিপ্ত পরিসরেও সংস্কৃতি চর্চা আমাদের রাজনৈতিক চলার পথ কিছু না কিছু আলোকিত করেছে। বিপর্যয়ে এর আড়ালে আত্মরক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। আটচল্লিশ থেকে সত্তর পর্যন্ত এদেশের প্রায় প্রতিটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎক্ষেপে এ বিশেষ চরিত্রই বারবার ধরা পড়ে।

এ চারিত্র্য-ধর্মেই আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চেতনার বৈশিষ্ট্য চিনে নেয়া সহজ হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সংস্কৃতি চেতনাকে সামাজিক-অর্থনৈতিক চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতির কল্যাণী ও সামাজিক ভূমিকার কথা মনে রেখে সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রসর হওয়া উচিত।

এই পদক্ষেপ আরো তাৎপর্য বহন করছে এই কারণে যে, আমাদের সংস্কৃতি চর্চা যে স্বদেশ ও স্বাধীনতা অর্জনের ভিত তৈরি করেছিল, তার সর্বজনীন গণতান্ত্রিক চরিত্র পরিস্ফুট করা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্কৃতির সদাচার এখনো সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এমন ধারণা তাই কোনো সচেতন বুদ্ধিজীবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, অনুকূল পরিবেশে বা অনুকূল সমাজ বিন্যাসেই সংস্কৃতি চর্চার প্রগতিধর্ম সার্থকতা অর্জন করতে পারে। বরং বাস্তব সত্য এর বিপরীত সূত্রই প্রমাণ করে থাকে। অর্থাৎ বলিষ্ঠ সংস্কৃতি চর্চা আপন নিষ্ঠা ও সততায় প্রগতির অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারে এবং আকাক্সিক্ষত সামাজিক পরিবর্তনের গন্তব্যে যাত্রা নিশ্চিত করতে পারে। আমাদের দুই যুগব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারা ও চরিত্রে এমন উদাহরণ বিরল নয়।

সচেতন ব্যক্তিমাত্রেরই তাই সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে প্রত্যাশা, প্রগতিধর্মী সংস্কৃতিচর্চা নবলব্ধ স্বাধীনতাকে সর্বজনীন ও অর্থবহ করে তোলার ক্ষেত্রে নিশ্চিত ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। এবং এই উদ্দেশ্যে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টিশীলতাকে সংস্কৃতির রূপময় ভাষ্যে তাৎপর্যময় করে তুলতে পারে। ঐতিহ্যগত বিচারে বাঙালি সংস্কৃতির প্রাচীন ধারার ঐতিহাসিক বিকাশ যতটা না স্থাপত্যে কিংবা ভাস্কর্যে তার চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যময় সাহিত্যে, শিল্পে, চিত্রাঙ্কনে, লোকায়ত ধর্মে ও লোকসংস্কৃতির সবিশেষ চর্চায়। লোক সংস্কৃতির চর্চা ও লোকায়ত দর্শন বিভিন্ন যুগে নানা প্রতিকূলতার মুখেও নেহাৎ প্রাণশক্তির প্রাচুর্যে মাটির সাথে নিবিড় সম্পর্ক ও আত্মিক সখ্য বজায় রাখতে পেরেছে। অর্থাৎ জনমানসের পালল উর্বরতায় এবং অনুকূল আবহে এর পরিবর্ধন ও স্থিতি। সম্ভবত এতে বাঙালি সংস্কৃতির স্থানিক- বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট।

সূত্রটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, বাঙালি সংস্কৃতির প্রবহমানতায় যে প্রতিকূল স্রোতের টান অপকর্ষ ও অবক্ষয়ের অস্তিত্ব প্রকট করে তুলছে, তাকে প্রতিহত করতে জনমানসের নৈকট্য প্রয়োজন; প্রয়োজন জনসংস্কৃতির বিভিন্ন সুস্থ ধারাস্রোতে অবগাহন। এই সঙ্গে আরো প্রয়োজন সেই ধারার বর্তমান চরিত্র নির্ধারণ এবং পরিশেষে তাকে হাতে কাটা খালের মধ্য দিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রবাহিত করে দেয়া। নিজকে চেনার কাজে গ্রামীণ জনমানসকে উদ্বুদ্ধ করা। আর এই কাজ লোকসংস্কৃতির চর্চা অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম।

বর্তমান সময়ের পরিস্থিতি বিচারে এবং স্বাধীনতার ব্যবহারিক তাৎপর্যের পটভূমিতে। সংস্কৃতি চর্চাকে নবভাষ্যে সমৃদ্ধ করে তোলা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্য কার্যকর ও সফল করে তুলতে হলে আমাদের সংস্কৃতি চর্চাকে লোক-সংস্কৃতির প্রক্ষেপে ও শ্রম-নির্ভরতায় সজীব করে নেওয়া একটি অন্যতম পদক্ষেপ রূপে গণ্য করতে হবে। বৃহত্তর ব্যাপকতায় সংশ্লিষ্ট না হয়ে অপসংস্কৃতির টান, পশ্চাদগতির শক্তি প্রতিহত করা যাবে না, অন্ততপক্ষে সার্থকভাবে যাবে না। শুধু নাগরিক সংস্কৃতির সীমাবদ্ধ চর্চা, তা যতই প্রগতিশীল হোক না কেন, প্রতিরোধের কাজ, এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ বাস্তবায়িত করতে পারছে না, এবং পারবে না।

তাই আপাতত লোকায়ত ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির বলিষ্ঠ ও প্রগতিশীল প্রকাশ আমাদের অভিপ্রায়ে সহায়ক হতে পারে। বৃহত্তর জনমানসের সাথে যোগসূত্র স্থাপনে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। তাই সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখার অনুশীলন প্রয়োজন। প্রয়োজন এদেরকে যুগোপযোগী করে তোলা, নতুন গুণগত সমৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যবহার করা, যাতে প্রগতি ও জনগ্রাহ্যতার দ্বিবিধ উদ্দেশ্য সমানভাবে সিদ্ধ হতে পারে। লোকগীতি, লোকনাট্য, যাত্রা, কবি বা জারি গানই নয় শুধু, মৃৎ শিল্পকলা, বেত-বাঁশের চারুকলায় সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সমন্বিত ভাষ্যে নতুন দিনের কালধর্মী সুপ্রকাশ সম্ভব হতে পারে। আমাদের বিশ্বাস, সংস্কৃতি চর্চায় এই সব দিকগুলোর। গুরুত্ব সংস্কৃতিবিদ ও সংস্কৃতিকর্মীদের বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা ও পর্যালোচনা করে দেখা দরকার।