স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর

কামাল লোহানী

দেখতে দেখতে ‘সংবাদ’ ৬৯ বছরে পদার্পণ করল। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের এই সাহসী ‘সংবাদ’ আমার স্মৃতিতে এখনো অমলিন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ‘সংবাদের’ মালিক-সাংবাদিকদের অকুতোভয় ভূমিকা, এখনো আন্দোলিত করে।

১৯৬২ সাল। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার তেজোদৃপ্ত ছাত্রসমাজের প্রবল আন্দোলন সমরনায়কের তখত্-ই-তাউস কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ছাত্রদের ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ, পুলিশি-সেনা নির্যাতন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মমত্ববোধ সন্তানদের প্রতি, দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলেছিল। ফলে আন্দোলন জনগণের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল। অবাধ্যতার ঢেউ লেগেছিল দেশ এবং দেশের ভেতরেও। অসংখ্য ছাত্র নেতাকর্মী এবং রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে জেলখানায় পুরে দেয়া হয়েছিল। আমি তখন দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকায় চাকরি করতাম। রাতের শিফট ছেড়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম এমনি সময় পলাশী ব্যারাকের কোণে ঢাকেশ্বরী মন্দির যাওয়ার পথের মোড়ে কয়েকটি সাইকেল করে ক’জন আইজি ও পুলিশ বাজপাখির মতন হামলে পড়ল আমার রিকশাটার ওপর। গ্রেফতার হলাম। লালবাগ থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ ও আইবিগুলোর কথোপকথনে জানতে পারলাম আমার নামে হুলিয়া হয়েছে।

পরদিন অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানার ইন্টারোগেশন সেন্টারে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল সারা রাত, হাজার হাজার ওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে। রাত কেটেছে মানসিক নিপীড়নে। সকালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা হচ্ছিল, এমন সময় দেখলাম আমার শিক্ষিকা স্ত্রী তেরো দিনের বাচ্চাকে নিয়ে হাজির সেলের সামনে। এ আমাদের প্রথম সন্তান। জন্মেছে ৩০ জানুয়ারি, সেদিন আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীও জীবনের প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন।

খানিকক্ষণ কথা বলার পর পুলিশ এল নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেতে হবে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। গেটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোজাপথ ধরে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর বাঁ হাতে ঘুরেই ডানদিকে ২৬ সেল। সেখানে আমাকে ‘জমা’ করা হলো। এইখানেই পেয়েছিলাম পাকিস্তানের এক সময় অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ, পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পূর্তমন্ত্রী কফিল উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক রণেশ দাশগুপ্ত, আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, শহর আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, পেয়েছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)-কে। বরিশাল থেকে এসেছিলেন ন্যাপের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ঢাকার শ্রমিক নেতা বন্ধু নাসিম আলী, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হায়দার আকবর খান রণো, ছাত্রলীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম ও শেখ ফজলুল হক মণি। দৈনিক সংবাদ-এর বিজ্ঞাপন বিভাগের সদস্য এবং ভাসানী ন্যাপের একনিষ্ঠ কর্মী মন্টু খান।

২৬ সেলে থাকতে ‘রাজবন্দি’ হিসেবে আমরা ক’টি দৈনিক সংবাদপত্র পেতাম। তার মধ্যে দৈনিক সংবাদও ছিল। প্রতিদিন প্রাথমিক পাঠ-কর্মটি আমাকে দিয়েই সম্পন্ন করা হতো, যেহেতু আমি সংবাদিক এবং মাত্র ২৮ বছর বয়সী টগবগে তরুণ। প্রতিদিন নিউজ হেডলাইন পড়ি এবং যেসব মুরব্বির নাম করলাম, ওরা শুনতেন। যে সংবাদ বিস্তারিত পড়ার প্রয়োজন হতো সেটা অবশ্য পড়া হতো। একদিন হলো মজা, সেদিন আলজেরীয় মুক্তি সংগ্রামীদের ফরাসি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের বিজয় হয়েছে। আলজেরিয়া মুক্ত। দৈনিক সংবাদ-এ প্রথম পাতায় ‘তাহিয়া আল জেজাইর’ শিরোনামে একটি ডবল কলাম সম্পাদকীয় লিখেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী। কী অসাধারণ একটি ফ্রন্টপেজ এডিটোরিয়াল! যাকে আমার কাছে একমাত্র তুলনীয় বলে মনে হয়েছে ১৯৫৩ সালে কমরেড স্তালিনের মৃত্যুতে দৈনিক ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের লেখা প্রথম পাতার দু’কলামে ছাপা সম্পাদকীয়র সঙ্গে।

মানিক ভাই আমাকে পড়তে বললেন। আমি পড়ছি। সম্পাদকীয়র মাঝখানটা পেরিয়ে কিছুদূর এগুতেই একটা জায়গায় লেখা- ‘...হারামজাদা সালান, কুত্তার বাচ্চা... শুয়োরের বাচ্চা...’ এমনি করে আলজেরীয় মুক্তি সংগ্রামবিরোধী ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির চার প্রধান সেনা জেনারেলের নাম। কী প্রচন্ড ঘৃণাই উদ্গিরণ হয়েছিল সেদিন জহুর ভাইয়ের ওই অসাধারণ এবং ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে। তিনি তো ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, তাই মুক্তিসংগ্রাম ও ফরাসিদের দীর্ঘ নিপীড়ন ফুটে উঠেছিল তার প্রবল ক্ষোভে, ঘৃণায়। ...কিন্তু বিপদ হলো মানিক ভাইকে নিয়ে। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে, জহুর ভাই ওই গালমন্দ সম্পাদকীয়তে লিখেছেন। নিশ্চয়ই আমি বানিয়ে বলছি। মানিক ভাই আমায় বললেন, আবার পড় তো। পড়লাম। বিশ্বাস করলেন না, আবার ভালভাবে পড়তে বললেন। কিন্তু মানিক ভাই কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে জহুর ভাই সম্পাদকীয়তে এমন লিখতে পারেন। এবার তিনি সন্দিগ্ধ মনে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দৈনিক সংবাদটাই চাইলেন। আমিও এগিয়ে দিলাম। চোখ যখন ওই লাইনের ওপর পড়ল, মানিক ভাই বললেন, জহুর তাহলে চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ট্রাডিশনটা বজায় রেখেছে।

কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা ইত্যাদি শব্দাবলি যে কোন সম্পাদকীয়, বিশেষ করে এমন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে কেউ লিখতে পারেন- এমন বিশেষ শব্দ একমাত্র মানিক ভাই-ই তাঁর মুসাফির কলামেই ব্যবহার করতেন। আর কেউ কখনও করেননি, অথচ ‘তাহিয়া আল জেজাইর’ সম্পাদকীয়টি পড়তে গিয়ে, ওই শব্দগুলো একেবারেই বেমানান মনে হয়নি। জহুর হোসেন চৌধুরীর লেখায় কী অভিনব মুন্সিয়ানাই না ছিল!

২.

দৈনিক সংবাদ ৬৯ বছরে পদার্পণ করেছে প্রকাশনার। এ কী কম কথা! তবে সংবাদকে কত যে বাধা-বিঘ্ন, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এ পত্রিকা তো জন্ম নিয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন এবং মুসলিম লীগেরই মালিকানায়। তবে খায়রুল কবির আমাদের অতীব শ্রদ্ধেয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ছিলেন সম্পাদক ওই পত্রিকার। আর কবির ভাই গুণী, মেধাবী, প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখক ও ছাত্রদের অথবা সাহিত্যমনাদের সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর সম্পাদকীয়, বার্তা এবং সংশোধনী বিভাগে। যেমন ধরুন, সৈয়দ নূরুদ্দিন ছিলেন প্রথম বার্তা সম্পাদক, যার মিষ্টি হাতের লেখা দারুণ জনপ্রিয় ছিল এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রাজ্ঞ ছিলেন।

সংবাদ মুসলিম লীগের মুখপত্র হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য অঙ্গনের উজ্জ্বল জোতিষ্কদেরই সংযোজন হয়েছিল এইখানে। যেমন সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী, আনিস চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদও সম্ভবত এই সময়ই কাজ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেও এঁদের কেউ কেউ সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি দিয়েছিলেন এখানেই। সাহিত্য মেধাও এইখানেই বিকশিত হয়েছে- কেউ কবি, কেউ গল্পকার, নাট্যকার অথবা প্রাবন্ধিক হিসেবে। পরে এই সংবাদ-এই শ্রদ্ধেয় রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেনের মতন মার্কসবাদী লেখকও যুক্ত হয়েছিলেন সম্পাদকীয় বিভাগে। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা কমরেড শহীদুল্লা কায়সার একসময় দীর্ঘ সময় সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল তাতে মুসলিম লীগ গো-হারা হেরেছিল। পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে তিন শতাধিক যুক্তফ্রন্টদলীয় প্রার্থীর জয় হয়েছিল এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু মাসও পার হতে পারেনি, কেন্দ্রের মুসলিম লীগ সরকার বাঙালির হাতে যেন ‘ক্ষমতা’ না যায় সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে হিংসাত্মক মনোভঙ্গি নিয়ে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে জনপ্রিয় এবং মুসলিম লীগবিরোধী নতুন রাজনৈতিক মোর্চা যুক্তফ্রন্টকে সহ্য করতে চাইলো না বলেই প্রেসিডেন্ট শাসন জারি হয়েছিল। এ সত্ত্বেও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভেবে নূরুল আমিন দৈনিক সংবাদের মালিকানা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিনে নিয়েছিলেন কবির ভাইরা। উল্লেখ্য, ওই নির্বাচনে নূরুল আমিন সাহেব মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে তার সম্ভবত জামানত পর্যন্ত হারিয়েছিলেন। তখনকার নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা খালেক নেওয়াজ তাকে পরাজিত করেছিলেন।

যা হোক, নতুন মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর খায়রুল কবির ভাই গণমাধ্যমের ভিন্ন পথ জনসংযোগ সেখান থেকে ব্যাংকিং-নেতৃত্বে পর্যন্ত দক্ষতার ছাপ রেখে এবং দারুণ সফলতা দেখিয়েছিলেন। তিনি আদতে প্রগতিমনা মানুষ ছিলেন। যার কারণে সাংবাদিকতায় ওই বুদ্ধিদীপ্ত এবং সাহসী তরুণদের অভিষেক হতে পেরেছিল। এই সময়ে ছাত্রনেতা ও মার্কসবাদী চিন্তা-চৈতন্যে আদর্শিক কর্মী কেজি মুস্তাফা দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক হয়েছিলেন। কারণ নূরুদ্দিন ভাইও তখন সংবাদ ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যান, প্রধানত খায়রুল কবির ভাইয়ের প্রভাবে।

এ সময় বার্তা বিভাগে বহু সচেতন প্রগতিশীল তরুণ এই সাহসী পেশায় এসেছিলেন। উল্লেখ প্রয়োজন, এ সময়ই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ‘দৈনিক জনতা’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের প্রয়াস নিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার রক্তচক্ষু অঙ্কুরেই তাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সরকার নিষিদ্ধ করে দেয় ‘দৈনিক জনতা’, সেখানে থেকে কেজি মুস্তাফা, তোয়াব খান, ফজলুল করিম (তারা) এঁরা যুক্ত হন সংবাদের সঙ্গে। মাহবুবুর রহমান খান ছিলেন জেনারেল ম্যানেজার, প্রগতি চিন্তার মানুষ। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনের হাল ধরে বসেছিলেন নীরবে। ‘দাদু’ ছিলেন বিজ্ঞাপনের দায়িত্বে, সঙ্গে মন্টু খান। দাদু খেলার পোকা ছিলেন। ক্রিকেট হলে তো কথাই নেই। একবার শুনেছি, পাকিস্তান আর কোন বিদেশী দলের টেস্ট ম্যাচ ঢাকা স্টেডিয়ামে। দাদুকে আর পায় কে! পাঁচদিন ওই বয়সী ভদ্রলোক ময়দানেই কাটিয়ে দিতেন। সেবার মাহবুবুর রহমান খান বললেন, বিজ্ঞাপনের মানুষ এতদিন একসঙ্গে ছুটি দেয়া কি যায়? দাদু বললেন অকপটে, ছুটি না দিলে আমার পদত্যাগ গ্রহণ করুন। ক্রীড়ামোদী দাদু কেবল ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্রমনা এক অসাধারণ মানুষ, যিনি নীরবেই কাজ করে যেতেন, কেউ জানতেও পারত না।

প্রখ্যাত সাংবাদিক হিসেবে যাঁরা নমস্য ছিলেন, তাঁদের মধ্যে খোন্দকার আবু তালেব (একাত্তরে শহীদ), তোহা খান, সাইয়ীদ আতিকুল্লা, হাবিবুর রহমান (শিশু সাহিত্যিক), আরও পরে বজলুর রহমান, আনোয়ার জাহিদ, সলিমুল্লা আরও অনেকে। এত বছর পরে সবার নাম মনে পড়ছে না। তবে একটি নাম অমর হয়ে চিরভাস্বর আমাদের হৃদয়ে, তিনি হলেন ছোটগল্পকার এবং সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার শহীদ সাবের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম পর্যায়েই দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, কারণ এই পত্রিকা ছিল সব বামপন্থি ছাত্র, লেখক-সাংবাদিক এমনকি রাজবন্দিদের আশ্রয়স্থল- অভয়ারণ্য। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশনে সার্চলাইট’-এ বাংলার নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছিল, তারই নির্মম শিকার, আমাদের প্রিয় গল্পকার-লেখক-সাংবাদিক শহীদ সাবেব। এ সময় তিনি অপ্রকৃতিস্থও ছিলেন। রাতে মাঝে মধ্যেই তার ডেরা সংবাদ অফিসেই আশ্রয় নিতেন আর চিরচেনা নিউজ টেবিলই ছিল তাঁর ‘বিছানা’। অগ্নিদগ্ধ করে পাকিস্তানিরা তাঁকে পুড়িয়ে মেরেছিল। জানি না, কোন ধর্মবিশ্বাস থেকে একজন অপ্রকৃতিস্থ এবং প্রতিষ্ঠিত সচেতন লেখককে হত্যা করেছিল। আমার মনে পড়ে, পঞ্চাশের দশকেই জেলখানা থেকে তাঁর অসাধারণ রচনা ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালের প্রথিতযশা সাময়িকী ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেদিন শহীদ সাবের রাজবন্দি ছিলেন পাকিস্তানি কারাগারে, তা সত্ত্বেও ‘পাচার’ হয়ে গিয়েছিল তার এই অনন্য লেখাটি কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকার সীমান্ত প্রহরীরও সতর্ক চোখ উপেক্ষা করে।

এই দৈনিক সংবাদ পঞ্চাশের দশকে বামপন্থিদের আশ্রয় ছিল তেমনি ছিল প্রসূতিগৃহ নবীন সাংবাদিকদের এবং শিশু-কিশোরদের নবনবীনের গাহিয়া গান সংঘবদ্ধতার সংগঠন গড়ে উঠল ‘খেলাঘর’ নামে। বজলুর রহমান তখন ভাইয়া অর্থাৎ খেলাঘর প্রধান। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শুভ রহমান, গোলাম সারওয়ার, নিয়ামত হোসেন, ইমরুল চৌধুরী, ইউসুফ পাশা, আখতার হুসেন, মোজাম্মেল হোসেন, আবেদ খান এমন আরও অনেকে। ‘খেলাঘর’ ছিল ছোটদের সাপ্তাহিক পাতা। একে নির্ভর করে ‘খেলাঘর’কে একটি শিশু-কিশোর সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বজলুর রহমান ভাইয়া। প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষস্থল হয়ে উঠেছিল এই সংগঠনটি। কত যে লেখক, সাংবাদিক, সংগঠন বিকশিত হয়েছিল এইখান থেকেই তার হিসাব নেই। আজও দেশময় ভিন্ন সত্তা নিয়ে ছড়িয়ে আছে কিন্তু বিভক্ত হয়ে।

দৈনিক সংবাদ একসময় জেল খেটে মুক্তি পাওয়া প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক বাম কর্মী-নেতাদের ঠিকানা ছিল। সেটি ষাটের দশক। যারাই জেল থেকে বেরুতেন তারা প্রথমেই উঠতেন দৈনিক সংবাদের বংশাল অফিসে। তারপর তাদের আস্তানা ঠিক করে দেয়া হতো। কোথায় থাকবেন, কোথায় খাবেন, এগুলো সংবাদই তখন দেখভাল করত।

দৈনিক সংবাদ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছে। আবার ষাটের দশকে আইয়ুবী নির্বাচন, মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচন প্রথা চালু হয়েছিল, তখন ‘কপ’ অর্থাৎ কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজ, সম্মিলিত বিরোধী দল গঠনে দারুণ গণতান্ত্রিক ও উদার মানসিকতা নিয়ে এক সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল। অথচ সামরিক শাসকচক্রের কারচুপির কারণে কপ প্রার্থী মিস ফাতিমা জিন্না আইয়ুব খানের কাছে হেরে গেলেন। এর পরপরই সামরিক শাসকচক্র পূর্ববঙ্গবাসীদের শায়েস্তা করার জন্য আদমজী শিল্পাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফেঁদে বসল। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সংবাদ এবং ইত্তেফাকের উদ্যোগে সব সংবাদপত্রের ঐক্য গড়ে উঠল। লেখা হলো একটি সম্পাদকীয়- ‘পূর্ববঙ্গ রুখিয়া দাঁড়াও’। সেই সম্পাদকীয় আজাদ, অবজারভারেও ছাপা হয়েছিল। দাঙ্গা প্রতিরোধে তোপখানা রোডে সংবাদের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা আহমদুল কবির-এর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির দপ্তর বসেছিল। সত্যি কথা বলতে কি ৫০, ৬০, ৭০-এর দশকের রাজনৈতিক পরিক্রমায় সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, সামন্তবাদবিরোধী গণআন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার কাতারে এক সাহসী সৈনিক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছে দৈনিক সংবাদ।

৩.

তখন মালিকানা স্বত্ব আহমদুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী এবং নাসির উদ্দিন আহমদের। এঁরা যখন হাল ধরেছেন তখন আমিও সংবাদে। জহুর ভাই সম্পাদক, শহীদ ভাই যুগ্ম সম্পাদক, রণেশ দা ও সত্যেন দা এবং বজলু সম্পাদকীয় বিভাগে। তোয়াব খান নিউজ এডিটর। সন্তোষ দা (সন্তোষ গুপ্ত), তারা ভাই (ফজজুল করিম), গোলাম রহমান শিফট ইনচার্জ নিউজের। এ সময়টা আর্থিকভাবে খুব একটা ভাল ছিল না। সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীরা সংবাদ-এ ধর্মঘটও পালন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্থকরী দুর্বলতার কথা আমরা জানতাম কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়নের গোপন ব্যালটে ওই ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ দাবি খানিকটা মেনে নিয়েছিলেন। এ সত্ত্বেও মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের কোন হেরফের হয়নি সেদিন।

পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগ নিলে তোয়াব খান চলে গিয়েছিলেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায়। তাতে অবশ্যই সংবাদ নিউজ ডেস্কের বেশ খানিকটা ক্ষতিই হয়েছিল। কারণ তাঁর সঙ্গে আরও দু-চারজন সংবাদ ছেড়ে গিয়েছিলেন। এইখানে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করা যায়, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল বলে নিজেদের যারা জাহির করতেন, তাদের মধ্যে এক উর্দুভাষী সাংবাদিক তখন ইউনিয়নগতভাবে এবং তার মাতৃভাষা উর্দু হওয়ার সুবাদে পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন। বস্তুত সেই উর্দুভাষী সাংবাদিকই তখন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সাংবাদিক সংগ্রহে সবচেয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে আসেন। ফলে সব বামমনা সাংবাদিক-লেখক তাকে আস্থায় নিয়েছিলেন। দৈনিক সংবাদ-এর মতন প্রগতিশীল, জনগণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক একটি প্রতিষ্ঠানকে পরোক্ষভাবে আঘাত করা হয়েছিল- যা কমিউনিস্ট পার্টি চাইত না। পরে অবশ্যই প্রমাণিত হয়েছিল, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে এই উর্দুভাষী সাংবাদিক- যাকে প্রগতিবান্ধব ও পার্টি সুহৃদ ভাবা হতো, সেই ব্যক্তিই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক বলে প্রতিভাত হয়েছিলেন এবং তিনি- সালাউদ্দিন মোহাম্মদ এবং আনোয়ার জাহিদ দু’জনে মিলে মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য পণ্য সরবরাহ করতেন।

এমনি একটি প্রতিষ্ঠান সংবাদ- যার প্রবল ভূমিকা জনকল্যাণে, প্রগতিশীলতার পক্ষে, আমরা তাবৎকাল ধরে লক্ষ্য করে এসেছি। আর এ কারণেই মূলত দৈনিক সংবাদ এবং তার মেহনতি শ্রমিক-সাংবাদিকদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, অর্থকরী দিক দিয়ে বিশেষ করে। তবুও যত সামান্যই হোক, দৈনিক সংবাদ তার ভূমিকা আজও রেখে চলেছে। না হলে দৈনিক সংবাদ দীর্ঘ চড়াইউতরাই পেরিয়ে আজও চলমান সেই দায়িত্ব নিয়ে নবীন নেতৃত্বের হাত ধরে রয়েছে কী করে? যত সঙ্কটই আসুক না কেন, মেহনতি মানুষগুলো রাজনৈতিক অঙ্গীকার থেকে সংবাদপত্রকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেনি। কায়েমি স্বার্থবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। আর সে কারণেই যত সমস্যা দেখা দিক না কেন, মালিকও টেনেহিঁচড়ে চলেছেন আজও। আজ সংবাদ-এর ৬৯ বছরে পদার্পণকে স্বাগত জানাই।

দৈনিক সংবাদ দীর্ঘজীবী হোক, এই কামনায়।

***

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর

কামাল লোহানী

image

দেখতে দেখতে ‘সংবাদ’ ৬৯ বছরে পদার্পণ করল। গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের এই সাহসী ‘সংবাদ’ আমার স্মৃতিতে এখনো অমলিন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে ‘সংবাদের’ মালিক-সাংবাদিকদের অকুতোভয় ভূমিকা, এখনো আন্দোলিত করে।

১৯৬২ সাল। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার তেজোদৃপ্ত ছাত্রসমাজের প্রবল আন্দোলন সমরনায়কের তখত্-ই-তাউস কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ছাত্রদের ওপর হামলা, গুলিবর্ষণ, পুলিশি-সেনা নির্যাতন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মমত্ববোধ সন্তানদের প্রতি, দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলেছিল। ফলে আন্দোলন জনগণের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল। অবাধ্যতার ঢেউ লেগেছিল দেশ এবং দেশের ভেতরেও। অসংখ্য ছাত্র নেতাকর্মী এবং রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে জেলখানায় পুরে দেয়া হয়েছিল। আমি তখন দৈনিক ‘আজাদ’ পত্রিকায় চাকরি করতাম। রাতের শিফট ছেড়ে যখন বাড়ি ফিরছিলাম এমনি সময় পলাশী ব্যারাকের কোণে ঢাকেশ্বরী মন্দির যাওয়ার পথের মোড়ে কয়েকটি সাইকেল করে ক’জন আইজি ও পুলিশ বাজপাখির মতন হামলে পড়ল আমার রিকশাটার ওপর। গ্রেফতার হলাম। লালবাগ থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ ও আইবিগুলোর কথোপকথনে জানতে পারলাম আমার নামে হুলিয়া হয়েছে।

পরদিন অর্থাৎ ১২ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানার ইন্টারোগেশন সেন্টারে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছিল সারা রাত, হাজার হাজার ওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে। রাত কেটেছে মানসিক নিপীড়নে। সকালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা হচ্ছিল, এমন সময় দেখলাম আমার শিক্ষিকা স্ত্রী তেরো দিনের বাচ্চাকে নিয়ে হাজির সেলের সামনে। এ আমাদের প্রথম সন্তান। জন্মেছে ৩০ জানুয়ারি, সেদিন আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীও জীবনের প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলেন।

খানিকক্ষণ কথা বলার পর পুলিশ এল নিয়ে যাওয়ার জন্য, যেতে হবে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। গেটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোজাপথ ধরে বেশ খানিকটা যাওয়ার পর বাঁ হাতে ঘুরেই ডানদিকে ২৬ সেল। সেখানে আমাকে ‘জমা’ করা হলো। এইখানেই পেয়েছিলাম পাকিস্তানের এক সময় অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ, পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পূর্তমন্ত্রী কফিল উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান, প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক রণেশ দাশগুপ্ত, আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, শহর আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা, পেয়েছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)-কে। বরিশাল থেকে এসেছিলেন ন্যাপের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, ঢাকার শ্রমিক নেতা বন্ধু নাসিম আলী, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হায়দার আকবর খান রণো, ছাত্রলীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম ও শেখ ফজলুল হক মণি। দৈনিক সংবাদ-এর বিজ্ঞাপন বিভাগের সদস্য এবং ভাসানী ন্যাপের একনিষ্ঠ কর্মী মন্টু খান।

২৬ সেলে থাকতে ‘রাজবন্দি’ হিসেবে আমরা ক’টি দৈনিক সংবাদপত্র পেতাম। তার মধ্যে দৈনিক সংবাদও ছিল। প্রতিদিন প্রাথমিক পাঠ-কর্মটি আমাকে দিয়েই সম্পন্ন করা হতো, যেহেতু আমি সংবাদিক এবং মাত্র ২৮ বছর বয়সী টগবগে তরুণ। প্রতিদিন নিউজ হেডলাইন পড়ি এবং যেসব মুরব্বির নাম করলাম, ওরা শুনতেন। যে সংবাদ বিস্তারিত পড়ার প্রয়োজন হতো সেটা অবশ্য পড়া হতো। একদিন হলো মজা, সেদিন আলজেরীয় মুক্তি সংগ্রামীদের ফরাসি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের বিজয় হয়েছে। আলজেরিয়া মুক্ত। দৈনিক সংবাদ-এ প্রথম পাতায় ‘তাহিয়া আল জেজাইর’ শিরোনামে একটি ডবল কলাম সম্পাদকীয় লিখেছেন পত্রিকাটির সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী। কী অসাধারণ একটি ফ্রন্টপেজ এডিটোরিয়াল! যাকে আমার কাছে একমাত্র তুলনীয় বলে মনে হয়েছে ১৯৫৩ সালে কমরেড স্তালিনের মৃত্যুতে দৈনিক ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারের লেখা প্রথম পাতার দু’কলামে ছাপা সম্পাদকীয়র সঙ্গে।

মানিক ভাই আমাকে পড়তে বললেন। আমি পড়ছি। সম্পাদকীয়র মাঝখানটা পেরিয়ে কিছুদূর এগুতেই একটা জায়গায় লেখা- ‘...হারামজাদা সালান, কুত্তার বাচ্চা... শুয়োরের বাচ্চা...’ এমনি করে আলজেরীয় মুক্তি সংগ্রামবিরোধী ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির চার প্রধান সেনা জেনারেলের নাম। কী প্রচন্ড ঘৃণাই উদ্গিরণ হয়েছিল সেদিন জহুর ভাইয়ের ওই অসাধারণ এবং ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে। তিনি তো ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন, তাই মুক্তিসংগ্রাম ও ফরাসিদের দীর্ঘ নিপীড়ন ফুটে উঠেছিল তার প্রবল ক্ষোভে, ঘৃণায়। ...কিন্তু বিপদ হলো মানিক ভাইকে নিয়ে। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে, জহুর ভাই ওই গালমন্দ সম্পাদকীয়তে লিখেছেন। নিশ্চয়ই আমি বানিয়ে বলছি। মানিক ভাই আমায় বললেন, আবার পড় তো। পড়লাম। বিশ্বাস করলেন না, আবার ভালভাবে পড়তে বললেন। কিন্তু মানিক ভাই কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে জহুর ভাই সম্পাদকীয়তে এমন লিখতে পারেন। এবার তিনি সন্দিগ্ধ মনে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দৈনিক সংবাদটাই চাইলেন। আমিও এগিয়ে দিলাম। চোখ যখন ওই লাইনের ওপর পড়ল, মানিক ভাই বললেন, জহুর তাহলে চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ট্রাডিশনটা বজায় রেখেছে।

কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা ইত্যাদি শব্দাবলি যে কোন সম্পাদকীয়, বিশেষ করে এমন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক সম্পাদকীয়তে কেউ লিখতে পারেন- এমন বিশেষ শব্দ একমাত্র মানিক ভাই-ই তাঁর মুসাফির কলামেই ব্যবহার করতেন। আর কেউ কখনও করেননি, অথচ ‘তাহিয়া আল জেজাইর’ সম্পাদকীয়টি পড়তে গিয়ে, ওই শব্দগুলো একেবারেই বেমানান মনে হয়নি। জহুর হোসেন চৌধুরীর লেখায় কী অভিনব মুন্সিয়ানাই না ছিল!

২.

দৈনিক সংবাদ ৬৯ বছরে পদার্পণ করেছে প্রকাশনার। এ কী কম কথা! তবে সংবাদকে কত যে বাধা-বিঘ্ন, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এ পত্রিকা তো জন্ম নিয়েছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন এবং মুসলিম লীগেরই মালিকানায়। তবে খায়রুল কবির আমাদের অতীব শ্রদ্ধেয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ছিলেন সম্পাদক ওই পত্রিকার। আর কবির ভাই গুণী, মেধাবী, প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখক ও ছাত্রদের অথবা সাহিত্যমনাদের সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর সম্পাদকীয়, বার্তা এবং সংশোধনী বিভাগে। যেমন ধরুন, সৈয়দ নূরুদ্দিন ছিলেন প্রথম বার্তা সম্পাদক, যার মিষ্টি হাতের লেখা দারুণ জনপ্রিয় ছিল এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রাজ্ঞ ছিলেন।

সংবাদ মুসলিম লীগের মুখপত্র হওয়া সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য অঙ্গনের উজ্জ্বল জোতিষ্কদেরই সংযোজন হয়েছিল এইখানে। যেমন সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ফজলে লোহানী, আনিস চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান ও আলাউদ্দিন আল আজাদও সম্ভবত এই সময়ই কাজ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেও এঁদের কেউ কেউ সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি দিয়েছিলেন এখানেই। সাহিত্য মেধাও এইখানেই বিকশিত হয়েছে- কেউ কবি, কেউ গল্পকার, নাট্যকার অথবা প্রাবন্ধিক হিসেবে। পরে এই সংবাদ-এই শ্রদ্ধেয় রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেনের মতন মার্কসবাদী লেখকও যুক্ত হয়েছিলেন সম্পাদকীয় বিভাগে। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা কমরেড শহীদুল্লা কায়সার একসময় দীর্ঘ সময় সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গে যে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল তাতে মুসলিম লীগ গো-হারা হেরেছিল। পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে তিন শতাধিক যুক্তফ্রন্টদলীয় প্রার্থীর জয় হয়েছিল এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু মাসও পার হতে পারেনি, কেন্দ্রের মুসলিম লীগ সরকার বাঙালির হাতে যেন ‘ক্ষমতা’ না যায় সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে হিংসাত্মক মনোভঙ্গি নিয়ে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে জনপ্রিয় এবং মুসলিম লীগবিরোধী নতুন রাজনৈতিক মোর্চা যুক্তফ্রন্টকে সহ্য করতে চাইলো না বলেই প্রেসিডেন্ট শাসন জারি হয়েছিল। এ সত্ত্বেও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ভেবে নূরুল আমিন দৈনিক সংবাদের মালিকানা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিনে নিয়েছিলেন কবির ভাইরা। উল্লেখ্য, ওই নির্বাচনে নূরুল আমিন সাহেব মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে তার সম্ভবত জামানত পর্যন্ত হারিয়েছিলেন। তখনকার নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা খালেক নেওয়াজ তাকে পরাজিত করেছিলেন।

যা হোক, নতুন মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর খায়রুল কবির ভাই গণমাধ্যমের ভিন্ন পথ জনসংযোগ সেখান থেকে ব্যাংকিং-নেতৃত্বে পর্যন্ত দক্ষতার ছাপ রেখে এবং দারুণ সফলতা দেখিয়েছিলেন। তিনি আদতে প্রগতিমনা মানুষ ছিলেন। যার কারণে সাংবাদিকতায় ওই বুদ্ধিদীপ্ত এবং সাহসী তরুণদের অভিষেক হতে পেরেছিল। এই সময়ে ছাত্রনেতা ও মার্কসবাদী চিন্তা-চৈতন্যে আদর্শিক কর্মী কেজি মুস্তাফা দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক হয়েছিলেন। কারণ নূরুদ্দিন ভাইও তখন সংবাদ ছেড়ে ভিন্ন পেশায় চলে যান, প্রধানত খায়রুল কবির ভাইয়ের প্রভাবে।

এ সময় বার্তা বিভাগে বহু সচেতন প্রগতিশীল তরুণ এই সাহসী পেশায় এসেছিলেন। উল্লেখ প্রয়োজন, এ সময়ই পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ‘দৈনিক জনতা’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশের প্রয়াস নিয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার রক্তচক্ষু অঙ্কুরেই তাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। সরকার নিষিদ্ধ করে দেয় ‘দৈনিক জনতা’, সেখানে থেকে কেজি মুস্তাফা, তোয়াব খান, ফজলুল করিম (তারা) এঁরা যুক্ত হন সংবাদের সঙ্গে। মাহবুবুর রহমান খান ছিলেন জেনারেল ম্যানেজার, প্রগতি চিন্তার মানুষ। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনের হাল ধরে বসেছিলেন নীরবে। ‘দাদু’ ছিলেন বিজ্ঞাপনের দায়িত্বে, সঙ্গে মন্টু খান। দাদু খেলার পোকা ছিলেন। ক্রিকেট হলে তো কথাই নেই। একবার শুনেছি, পাকিস্তান আর কোন বিদেশী দলের টেস্ট ম্যাচ ঢাকা স্টেডিয়ামে। দাদুকে আর পায় কে! পাঁচদিন ওই বয়সী ভদ্রলোক ময়দানেই কাটিয়ে দিতেন। সেবার মাহবুবুর রহমান খান বললেন, বিজ্ঞাপনের মানুষ এতদিন একসঙ্গে ছুটি দেয়া কি যায়? দাদু বললেন অকপটে, ছুটি না দিলে আমার পদত্যাগ গ্রহণ করুন। ক্রীড়ামোদী দাদু কেবল ক্রিকেটপ্রেমী ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও গণতন্ত্রমনা এক অসাধারণ মানুষ, যিনি নীরবেই কাজ করে যেতেন, কেউ জানতেও পারত না।

প্রখ্যাত সাংবাদিক হিসেবে যাঁরা নমস্য ছিলেন, তাঁদের মধ্যে খোন্দকার আবু তালেব (একাত্তরে শহীদ), তোহা খান, সাইয়ীদ আতিকুল্লা, হাবিবুর রহমান (শিশু সাহিত্যিক), আরও পরে বজলুর রহমান, আনোয়ার জাহিদ, সলিমুল্লা আরও অনেকে। এত বছর পরে সবার নাম মনে পড়ছে না। তবে একটি নাম অমর হয়ে চিরভাস্বর আমাদের হৃদয়ে, তিনি হলেন ছোটগল্পকার এবং সংবাদের স্টাফ রিপোর্টার শহীদ সাবের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম পর্যায়েই দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল, কারণ এই পত্রিকা ছিল সব বামপন্থি ছাত্র, লেখক-সাংবাদিক এমনকি রাজবন্দিদের আশ্রয়স্থল- অভয়ারণ্য। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশনে সার্চলাইট’-এ বাংলার নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর যে গণহত্যা চাপিয়ে দিয়েছিল, তারই নির্মম শিকার, আমাদের প্রিয় গল্পকার-লেখক-সাংবাদিক শহীদ সাবেব। এ সময় তিনি অপ্রকৃতিস্থও ছিলেন। রাতে মাঝে মধ্যেই তার ডেরা সংবাদ অফিসেই আশ্রয় নিতেন আর চিরচেনা নিউজ টেবিলই ছিল তাঁর ‘বিছানা’। অগ্নিদগ্ধ করে পাকিস্তানিরা তাঁকে পুড়িয়ে মেরেছিল। জানি না, কোন ধর্মবিশ্বাস থেকে একজন অপ্রকৃতিস্থ এবং প্রতিষ্ঠিত সচেতন লেখককে হত্যা করেছিল। আমার মনে পড়ে, পঞ্চাশের দশকেই জেলখানা থেকে তাঁর অসাধারণ রচনা ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালের প্রথিতযশা সাময়িকী ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেদিন শহীদ সাবের রাজবন্দি ছিলেন পাকিস্তানি কারাগারে, তা সত্ত্বেও ‘পাচার’ হয়ে গিয়েছিল তার এই অনন্য লেখাটি কলকাতার ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকার সীমান্ত প্রহরীরও সতর্ক চোখ উপেক্ষা করে।

এই দৈনিক সংবাদ পঞ্চাশের দশকে বামপন্থিদের আশ্রয় ছিল তেমনি ছিল প্রসূতিগৃহ নবীন সাংবাদিকদের এবং শিশু-কিশোরদের নবনবীনের গাহিয়া গান সংঘবদ্ধতার সংগঠন গড়ে উঠল ‘খেলাঘর’ নামে। বজলুর রহমান তখন ভাইয়া অর্থাৎ খেলাঘর প্রধান। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শুভ রহমান, গোলাম সারওয়ার, নিয়ামত হোসেন, ইমরুল চৌধুরী, ইউসুফ পাশা, আখতার হুসেন, মোজাম্মেল হোসেন, আবেদ খান এমন আরও অনেকে। ‘খেলাঘর’ ছিল ছোটদের সাপ্তাহিক পাতা। একে নির্ভর করে ‘খেলাঘর’কে একটি শিশু-কিশোর সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বজলুর রহমান ভাইয়া। প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষস্থল হয়ে উঠেছিল এই সংগঠনটি। কত যে লেখক, সাংবাদিক, সংগঠন বিকশিত হয়েছিল এইখান থেকেই তার হিসাব নেই। আজও দেশময় ভিন্ন সত্তা নিয়ে ছড়িয়ে আছে কিন্তু বিভক্ত হয়ে।

দৈনিক সংবাদ একসময় জেল খেটে মুক্তি পাওয়া প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক বাম কর্মী-নেতাদের ঠিকানা ছিল। সেটি ষাটের দশক। যারাই জেল থেকে বেরুতেন তারা প্রথমেই উঠতেন দৈনিক সংবাদের বংশাল অফিসে। তারপর তাদের আস্তানা ঠিক করে দেয়া হতো। কোথায় থাকবেন, কোথায় খাবেন, এগুলো সংবাদই তখন দেখভাল করত।

দৈনিক সংবাদ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছে। আবার ষাটের দশকে আইয়ুবী নির্বাচন, মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচন প্রথা চালু হয়েছিল, তখন ‘কপ’ অর্থাৎ কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টিজ, সম্মিলিত বিরোধী দল গঠনে দারুণ গণতান্ত্রিক ও উদার মানসিকতা নিয়ে এক সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল। অথচ সামরিক শাসকচক্রের কারচুপির কারণে কপ প্রার্থী মিস ফাতিমা জিন্না আইয়ুব খানের কাছে হেরে গেলেন। এর পরপরই সামরিক শাসকচক্র পূর্ববঙ্গবাসীদের শায়েস্তা করার জন্য আদমজী শিল্পাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ফেঁদে বসল। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য সংবাদ এবং ইত্তেফাকের উদ্যোগে সব সংবাদপত্রের ঐক্য গড়ে উঠল। লেখা হলো একটি সম্পাদকীয়- ‘পূর্ববঙ্গ রুখিয়া দাঁড়াও’। সেই সম্পাদকীয় আজাদ, অবজারভারেও ছাপা হয়েছিল। দাঙ্গা প্রতিরোধে তোপখানা রোডে সংবাদের অন্যতম স্বত্বাধিকারী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা আহমদুল কবির-এর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির দপ্তর বসেছিল। সত্যি কথা বলতে কি ৫০, ৬০, ৭০-এর দশকের রাজনৈতিক পরিক্রমায় সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ, সামন্তবাদবিরোধী গণআন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার কাতারে এক সাহসী সৈনিক ও সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছে দৈনিক সংবাদ।

৩.

তখন মালিকানা স্বত্ব আহমদুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী এবং নাসির উদ্দিন আহমদের। এঁরা যখন হাল ধরেছেন তখন আমিও সংবাদে। জহুর ভাই সম্পাদক, শহীদ ভাই যুগ্ম সম্পাদক, রণেশ দা ও সত্যেন দা এবং বজলু সম্পাদকীয় বিভাগে। তোয়াব খান নিউজ এডিটর। সন্তোষ দা (সন্তোষ গুপ্ত), তারা ভাই (ফজজুল করিম), গোলাম রহমান শিফট ইনচার্জ নিউজের। এ সময়টা আর্থিকভাবে খুব একটা ভাল ছিল না। সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীরা সংবাদ-এ ধর্মঘটও পালন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অর্থকরী দুর্বলতার কথা আমরা জানতাম কিন্তু সাংবাদিক ইউনিয়নের গোপন ব্যালটে ওই ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কর্তৃপক্ষ দাবি খানিকটা মেনে নিয়েছিলেন। এ সত্ত্বেও মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের কোন হেরফের হয়নি সেদিন।

পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট ইংরেজি ও বাংলা দৈনিক প্রকাশের উদ্যোগ নিলে তোয়াব খান চলে গিয়েছিলেন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায়। তাতে অবশ্যই সংবাদ নিউজ ডেস্কের বেশ খানিকটা ক্ষতিই হয়েছিল। কারণ তাঁর সঙ্গে আরও দু-চারজন সংবাদ ছেড়ে গিয়েছিলেন। এইখানে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করা যায়, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল বলে নিজেদের যারা জাহির করতেন, তাদের মধ্যে এক উর্দুভাষী সাংবাদিক তখন ইউনিয়নগতভাবে এবং তার মাতৃভাষা উর্দু হওয়ার সুবাদে পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন। বস্তুত সেই উর্দুভাষী সাংবাদিকই তখন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সাংবাদিক সংগ্রহে সবচেয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে আসেন। ফলে সব বামমনা সাংবাদিক-লেখক তাকে আস্থায় নিয়েছিলেন। দৈনিক সংবাদ-এর মতন প্রগতিশীল, জনগণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক একটি প্রতিষ্ঠানকে পরোক্ষভাবে আঘাত করা হয়েছিল- যা কমিউনিস্ট পার্টি চাইত না। পরে অবশ্যই প্রমাণিত হয়েছিল, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে এই উর্দুভাষী সাংবাদিক- যাকে প্রগতিবান্ধব ও পার্টি সুহৃদ ভাবা হতো, সেই ব্যক্তিই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক বলে প্রতিভাত হয়েছিলেন এবং তিনি- সালাউদ্দিন মোহাম্মদ এবং আনোয়ার জাহিদ দু’জনে মিলে মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য পণ্য সরবরাহ করতেন।

এমনি একটি প্রতিষ্ঠান সংবাদ- যার প্রবল ভূমিকা জনকল্যাণে, প্রগতিশীলতার পক্ষে, আমরা তাবৎকাল ধরে লক্ষ্য করে এসেছি। আর এ কারণেই মূলত দৈনিক সংবাদ এবং তার মেহনতি শ্রমিক-সাংবাদিকদেরও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, অর্থকরী দিক দিয়ে বিশেষ করে। তবুও যত সামান্যই হোক, দৈনিক সংবাদ তার ভূমিকা আজও রেখে চলেছে। না হলে দৈনিক সংবাদ দীর্ঘ চড়াইউতরাই পেরিয়ে আজও চলমান সেই দায়িত্ব নিয়ে নবীন নেতৃত্বের হাত ধরে রয়েছে কী করে? যত সঙ্কটই আসুক না কেন, মেহনতি মানুষগুলো রাজনৈতিক অঙ্গীকার থেকে সংবাদপত্রকে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেনি। কায়েমি স্বার্থবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। আর সে কারণেই যত সমস্যা দেখা দিক না কেন, মালিকও টেনেহিঁচড়ে চলেছেন আজও। আজ সংবাদ-এর ৬৯ বছরে পদার্পণকে স্বাগত জানাই।

দৈনিক সংবাদ দীর্ঘজীবী হোক, এই কামনায়।

***