সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি

চপল বাশার

আমার সাংবাদিকতা জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে আগামী বছর ২০২০ সালে। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার আগেই ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেই। এই পঞ্চাশ বছরে বিভিন্ন গণমাধ্যম, যেমন বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক ও সাপ্তাহিক, বার্তা সংস্থা, টেলিভিশন ও রেডিওতে কাজ করেছি। বিদেশী সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার সঙ্গেও কাজ করেছি। কিন্তু একথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে আমার প্রথম প্রেম ‘সংবাদ’-এর সঙ্গেই। ১৯৭০-এর শুরুতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি বার্তা সংস্থা ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি (এনা)-তে স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করি। সেখানে মাসতিনেক কাজ করার পর ২৬৩, বংশাল রোডে ‘সংবাদ’ অফিসে চলে আসি। সেখানে যোগ দেই শিক্ষানবীশ স্টাফ রিপোর্টার/ সাব-এডিটর হিসাবে। পত্রিকার তৎকালীন চীফ রিপোর্টার প্রয়াত হাসান আলি আমাকে ‘সংবাদ’-এ আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ‘সংবাদ’-এর বার্তাকক্ষে তখন প্রয়োজনের তুলনায় কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। সে কারণেই আমাকে নিয়ে আসা। সেখানে যোগ দেয়ার পর প্রায় এক বছর অর্থাৎ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত একটানা কাজ করেছি। প্রয়োজনে রিপোর্টিং করতে হতো, এসাইনমেন্ট নিয়ে বাইরে যেতাম, ফিরে এসে রিপোর্ট লিখতাম, মাঝে মাঝে ফিচারও লিখতাম। অন্য সময় ডেস্কে বসে সাব-এডিটরের কাজ করতাম, নিউজ এজেন্সি থেকে আসা ইংরেজি রিপোর্ট বাংলায় অনুবাদ করতাম, সম্পাদনা করতাম। কখনও বা ডেস্কে বসেই দেশী বা বিদেশী খবর নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতাম, ছবির ক্যাপসন লিখতাম, এক কথায় বলতে গেলে বার্তা কক্ষের সব ধরনের কাজেই আমি দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। ‘সংবাদ’-এ এক বছরের কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে পরিপূর্ণ সাংবাদিক হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে, যে অভিজ্ঞতা আমাকে পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকে সামনের দিকেই এগিয়ে নিয়েছে। তাই আমি শুরুতেই বলেছি সাংবাদিকতার জীবনে ‘সংবাদ’ আমার প্রথম প্রেম। প্রথম প্রেম কি কখনও ভোলা যায়? তাই তো আজ ‘সংবাদ’-এর স্মৃতিকথা নিয়ে লিখতে বসেছি, মাঝে মাঝেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি।

ষাটের দশকের প্রায় গোড়ার দিক থেকেই ‘সংবাদ’-এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। ১৯৬২তে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পরি। এরপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়ে সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকি। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮, এই দুই বছর আমি ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সংগঠন সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর ও প্রেস রিলিজ নিয়ে আমি নিজেই যেতাম বংশাল রোডের সংবাদ অফিসে। সে সময় চীফ রিপোর্টার ছিলেন মোহাম্মদ আফজল। তিনি পরবর্তীকালে ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন এবং ছিলেন বাম রাজনীতির একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদে এখনও আছেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ, রংপুরে নিজের বাড়িতে থাকেন। আমি প্রেস রিলিজ নিয়ে আফজল ভাইর হাতে দিতাম। তিনি তখন চীফ রিপোর্টার হলেও আর কোন রিপোর্টার ছিল না। তিনি একাই একশ! আফজল ভাই প্রেস রিলিজ নিয়ে আমাকে তার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসতে বলতেন। তারপর পিয়নকে বলতেন আমাকে এক কাপ চা দেয়ার জন্য। এরপর নিউজপ্রিন্টের প্যাড এগিয়ে দিয়ে বলতেন, “কলম আছে তো? প্রেস রিলিজ থেকে তুমি নিজেই রিপোর্টটা লিখে দাও। প্রেস রিলিজের একদম শেষে যে বক্তব্য বা দাবিটা আছে, সেটা সামনে নিয়ে এসে ‘ইন্ট্রো’ করো, তারপর রিপোর্টটা লিখে ফেল। চিন্তা করো না, আমি দেখে দেব।” আমি খুব উৎসাহ নিয়ে রিপোর্ট লিখে ফেলতাম। আফজল ভাই সেটা দেখে দু-একটা বানান সংশোধন বা সামান্য পরিবর্তন করে বলতেন, “ভালোই হয়েছে।” এই বলে তিনি পাঠিয়ে দিতেন ডেস্কে। পরদিন ‘সংবাদ’-এর প্রথম বা শেষ পাতায় যখন দেখতাম আমার লেখা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, বড়ই আনন্দিত হতাম। আমার লেখা প্রেস রিলিজ থেকে আমারই তৈরি করা রিপোর্ট! এভাবেই আমার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। এজন্য আমি আফজল ভাইর কাছে চিরঋণী।

‘সংবাদ’ অফিসে আমার যাতায়ত চলতেই থাকলো, সেই সঙ্গে চললো রিপোর্ট লেখা। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও অনেকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তাদের সান্নিধ্য আমাকে সমৃদ্ধ করলো। কাজ না থাকলেও মাঝে মাঝেই ‘সংবাদ’ অফিসে গিয়ে হাজির হতাম, আড্ডা দিতাম। ওটা ছিল তখন বাম ঘরানার লেখক ও রাজনতিবিদদের মিলনকেন্দ্র। সেটাও ছিল আমার বড় আকর্ষণ।

১৯৭০ সালের মার্চ অথবা এপ্রিল, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র, ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সে সময়ে সংবাদ-এ যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলাম। বার্তা সংস্থা ‘এনা’র চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘সংবাদ’-এ চলে এলাম। এখানে আসার পেছনে মনের টানও ছিল। নতুন এসেছি। তাই বেতনও কম। মাসে ১৫০ টাকা। এই টাকার পরিমাণ তখন কিন্তু কম নয়। আমার গোপীবাগের বাসা থেকে বংশাল রোডে যেতে রিকশা ভাড়া লাগতো আট আনা অর্থাৎ ৫০ পয়সা। বংশালের রেস্তোরাঁয় এক কাপ চা দুই আনা, একটা সিঙ্গারাও দুই আনা। এক টাকা বা দেড় টাকার ভাত খাওয়া যেতো। অতএব ১৫০ টাকা আমার জন্য ছিলো অনেক টাকা। তবে অন্যন্য সংবাদপত্রের তুলনায় সংবাদ-এর সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন ছিলো অনেক কম। বেতনের অর্ধেক দেয়া হতো মাসের ৭ তারিখে, অবিশিষ্ট অর্ধেক বেতন দেয়া হতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে, অনিয়মিতভাবে। তবে মাস শেষ হওয়ার আগেই পুরো বেতন শোধ করা হতো, বাকি বা বকেয়া থাকতো না। বেতন নিয়ে সাংবাদিক কর্মচারীদের মধ্যে কোনও ক্ষোভ আমি দেখিনি, কারণ পুরো বেতনটাই তারা মাস শেষ হওয়ার আগেই পেয়ে যেতেন। ক্ষোভ না থাকার আরও কারণ ছিলো। সাংবাদিকদের সবাই, এমনকি কর্মচারীরাও চিন্তায় ছিলেন প্রগতিশীল, ‘সংবাদ’কে নিজেদের প্রতিষ্ঠান মনে করতেন, পত্রিকার প্রতি ছিল একাত্মতাবোধ। এছাড়াও পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক শ্রদ্ধেয় জহুর হাসেন চৌধুরী ও যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সারকে সবাই ভালোবাসতেন। এরা দু’জনই ‘সংবাদ’-এর সাংবাদিক-কর্মচারীদের অভিভাবকের মতো ছিলেন।

আমি আগেই বলেছি ১৯৭০ সালের মার্চ-এপ্রিল থেকে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংবাদ-এ একটানা কাজ করেছি এবং এরই মধ্যে কিছুদিন ছুটি নিয়ে এম.এ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। ১৯৭০ সালে ক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া, তখনও সামরিক আইন চলছে, তবে আগের তুলনায় একটু ঢিলেঢালা। রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে কাজ করতে পারছে, সংবাদপত্রের ওপর কড়াকড়ি নেই। সেই বছরের দু’টি বড় ঘটনা ছিলো ১২ নভেম্বরে উপকূলীয় জেলাগুলিতে ঘূর্ণিঝড় এবং ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দশ লাখ মানুষ মারা যায়। সংবাদ-এর ফটো সাংবাদিক ছিলেন রশীদ তালুকদার। তিনি নিজে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির অনেক ছবি তুলেছিলেন এবং জেলা সংবাদদাতারাও ছবি ও খবর পাঠাতেন। প্রতিদিন সংবাদ-এর প্রথম পাতা, শেষ পাতা ও অন্যান্য পাতায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি ও লাশের ছবি ও খবর দিয়ে ভরা থাকতো। সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্য দিয়ে আমি ঘূর্ণিঝড়ের খবর লিখতাম। অসহায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও জীবিত মানুষদের কষ্ট নিয়ে লিখতে গিয়ে সে সময় আমি খুবই মানসিক যন্ত্রণা পেয়েছি। ঘূর্ণিদুর্গতদের সাহায্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার বলতে গেলে কিছুই করেনি। বেসরকারি সাহায্য নিয়েই দুর্গত মানুষরা বেঁচে ছিল। তখনই প্রমাণ হয়ে গেছে যে পাকিস্তানের সরকার পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। এই অবহেলা ও বঞ্চনার বিষয়টি ‘সংবাদ’ তার প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় নিবন্ধে জোরালোভাবে তুলে ধরেছিলো। বাংলার বিক্ষুব্ধ মানুষ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিলো, যার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো ঘূর্ণিদূর্গত মানুষের প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা।

১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র বঙ্গবন্ধুর কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এর পরের ঘটনা সবাই জানেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি রূপ নিলো স্বাধীনতার আন্দোলনে। শুরু হলো পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরুর দিক নির্দেশনা দিলো। সে সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের খবর, বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত বাঙালির ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলি এবং এ সংক্রান্ত সব খবর সংবাদ-এর প্রথম পাতায় বড় করে ছবিসহ ছাপা হতো, লেখা হতো সম্পাদকীয় নিবন্ধ ও প্রবন্ধ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আর একটি কথা বলতেই হয়। আমি আগেই বলেছি সে সময় আমি সংবাদ-এর ডেস্ক ওয়ার্ক-এর পাশাপাশি রিপোর্টিং টিমের সঙ্গেও কাজ করতাম, এ কাজ আমার বেশি ভালো লাগতো। ৭ মার্চ চীফ রিপোর্টার হাসান আলি, স্টাফ রিপোর্টার মুজিবুর রহমান বাদলের সঙ্গে আমিও রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে ও কভার করতে। বিকেলে অফিসে ফিরে বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের ভাষণ পুরোটা লিখলেন হাসান আলি। আমি ও বাদল বক্তৃতার বিভিন্ন পয়েন্ট ও উক্তি দিয়ে তাকে সহায়তা করলাম। সে সময় রেসকোর্স ময়দানের বিপুল জনসমাগম, জনতার স্লোগান এবং মাথার ওপর উড়তে থাকা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারÑ এসব নিয়েও আমরা বিস্তারিত বিবরণ লিখলাম। রাতে তখনকার বার্তা সম্পাদক আলী আকসাদ রিপোর্টটি দেখলেন এবং সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে টেলিফোনে পরামর্শ করে হেডলাইন লিখলেন নিজের হাতে। প্রথম পাতার ওপরে ৮ কলাম হেডলাইনটি ছিলোÑ ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কেউ কেউ বললেন, এই হেডলাইন ‘সংবাদ’-এর জন্য কোন বিপদ ডেকে আনবে না তো? আকসাদ ভাই বললেন, “যা হয় হবে। হেডলাইন এটাই থাকবে। আমরা পাঠককে সঠিক তথ্য দেব।” পরদিন দেখা গেল ‘সংবাদ’-ই একমাত্র দৈনিক যাতে বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে হেডলাইন করা হয়েছে। একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না। সেই রাতে বার্তা কক্ষে শিফট-ইন-চার্জ ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার। তিনি মৃত্যুর কিছুকাল আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে দাবি করেছিলেন যে, কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করে তিনি নিজেই হেডলাইনটি দিয়েছিলেন। তার দাবিটি সঠিক নয়, একথা আমি মনে কোনও দ্বিধা না রেখে বলতে পারি, কারণ সেই রাতে আমি বার্তাকক্ষে উপস্থিত ছিলাম। আমাদের সামনেই নিউজ ডেস্কে বসে বার্তা সম্পাদক আকসাদ ভাই হেডলাইনটি লিখেছিলেন। সত্যকে অস্বীকার করা ঠিক নয়।

যাই হোক, ‘সংবাদ’ যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো, তার মূল্যও দিতে হয়েছে। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু হলো। সেদিন রাতে ১১টা নাগাদ আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে গোপীবাগের বাসায় ফিরে এসেছি। রাত ১২টার দিকে শুরু হলো হানাদার বাহিনীর তান্ডব। গোলাগুলির শব্দে কান পাতা দায়। আমার বাসার টেলিফোন তখনও সচল ছিলো। আমি ‘সংবাদ’ অফিসে ফোন করলাম। সে রাতেও শিফট-ইন-চার্জ ছিলেন গোলাম সারওয়ার। তিনি তখন ভয়ে কাঁপছেন। বললেন সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে, আমি কী করবো বুঝতে পারছি না।’ আমি বললাম, “আপনিও বের হয়ে যান, যেখানেই হোক, আশ্রয় নিন। ‘সংবাদ’ অফিসে হামলা হবেই।” এর পরেই টেলিফোন ডেড্ হয়ে গেল। সারওয়ার ভাই বের হতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু একজন পারেন নি। তিনি কবি শহীদ সাবের, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। ‘সংবাদ’ অফিসেই তিনি থাকতেন। পরদিন পাকবাহিনী ২৬৩, বংশাল রোডে ‘সংবাদ’ অফিসে হামলা করে, দোতলা পুরানো ভবন, পেছনের প্রেস এবং সবকিছুতে আগুন দেয়। সে আগুনে পুড়ে মরেন কবি শহীদ সাবের।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘সংবাদ’ আর প্রকাশিত হয়নি। যুদ্ধশেষে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি ‘সংবাদ’ আবার প্রকাশিত হতে থাকে বংশাল রোডের অফিস থেকেই। পুরনো দোতলা ভবনের নিচতলার একটি ঘর ব্যবহারযোগ্য ছিলো। সেখানে অফিস ঘর, নতুন একটি টিনশেডে কয়েকটি ঘরে বার্তা কক্ষ ও সম্পাদকীয় বিভাগ স্থাপন করা হলো। যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে শহীদুল্লা কায়সার দীর্ঘকাল ‘সংবাদ’কে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, ‘সংবাদ’-এর কর্মীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেন নি, তার লাশটিও পাওয়া যায়নি।

‘সংবাদ’ যখন নতুনভাবে প্রকাশিত হলো, তখন এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন প্রকাশক আহমদুল কবির। সাবেক সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী পত্রিকার পরিচালনা পরিষদে পরিচালক হিসেবে থাকলেন এবং সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে থাকলেন। আলী আকসাদ বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন, হাসান আলিও সিটি এডিটর পদে প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্বে থাকলেন। ২৫ মার্চের আগে যারা ‘সংবাদ’-এ ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনীতে। যুদ্ধশেষে আমি ১৯৭২-এর প্রথম দিকেই ‘দৈনিক বাংলা’য় স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে স্থায়ী পদে কাজ করার অফার পেলাম। তখনকার বেতন স্কেল অনুযায়ী মাসিক বেতন ৫০০ টাকা। আমার বন্ধু ও রাজনৈতিক শুভানুধ্যায়ীরা ওখানেই যোগ দেয়ার পরামর্শ দিলেন। তারা বললেন, “এটা তো আর দৈনিক পাকিস্তান নয়। এখন দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন কাগজ। প্রচার সংখ্যায় সর্বোচ্চ। তুমি ওখানেই যোগ দাও- ওখানেও আমাদের লোক থাকা দরকার,” আমি তাই করলাম। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে থাকলাম। রিপোর্টারদের মধ্যে সম্ভবত আমিই ছিলাম বয়সে সবচেয়ে ছোট। অথচ আমার ওপরেই কাজের চাপ থাকতো সবচেয়ে বেশি। ১৯৭২-এর ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) আওয়ামী লীগ জনসভা করেছিল, তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান বক্তা। দৈনিক বাংলার সিনিয়র রিপোর্টাররা প্রায় সকলেই সেখানে ছিলেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ লেখার দায়িত্ব পড়লো আমার মতো সর্বকনিষ্ঠ রিপোর্টারের ওপর। আমার কাছে টেপ রেকর্ডার ছিলো না, শুধুমাত্র আমার নোটের ওপর নির্ভর করেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ আমি লিখেছিলাম। এটা ছিলো আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। আমি সফলভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি, সফল হয়েছি। আমার সে বিশাল রিপোর্ট দুই কিস্তিতে পরপর দুই দিন ধরে ছাপা হয়েছিলো। অথচ সিনিয়র রিপোর্টাররা বঙ্গবন্ধুর জনসভার ওপর দু-চার প্যারার সাইড স্টোরি লিখে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ওপর ইচ্ছা করেই চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে- কারণ রিপোর্টিং টিমের অধিকাংশই ছিলেন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তাদের আস্থা কতটুকু তা নিয়ে আমার সন্দেহ ছিলো। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি সেখানে আর থাকবো না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলাম।

১৯৭৩-এর শুরুতেই আমি আবার ‘সংবাদ’-এ যোগ দিলাম। এবারও উদ্যোগ নিলেন ও সহযোগিতা করলেন তৎকালীন সিটি এডিটর প্রয়াত হাসান আলি। তখন বার্তা সম্পাদক পদে আলী আকসাদ আর ছিলেন না, তিনি বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন বার্তা সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন সন্তোষ গুপ্ত। সন্তোষদা ছিলেন কবি, নরম মনের মানুষ। কিন্তু বার্তা সম্পাদক হিসাবে খুব কঠোর ছিলেন, এজন্য আড়ালে তাকে আমরা বলতাম ‘সন্ত্রাস গুপ্ত’। আমি রিপোর্টার হিসাবেই কাজ করতে চেয়েছিলাম, হাসান আলিও তাই চাচ্ছিলেন, কারণ রিপোর্টারের সংখ্যা তখনও কম। কিন্তু সন্তোষদা রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ডেস্কে লোক অনেক কম। একজন শিফট-ইন-চার্জ দরকার। চপল বাশার আপাতত শিফট ই-চার্জ পদে কাজ করুক, পরে না হয় আবার রিপোর্টিং বিভাগে যাবে। তিনি পরে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন, “বার্তা বিভাগে শিফট-ইন-চার্জ খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই পদে দায়িত্বশীল সাংবাদিক দরকার। আপনার ওপর আস্থা আছে বলেই ওখানে বসাচ্ছি- পরে আবার রিপোর্টার হতে পারবেন।” সেই যে শিফট-ইন-চার্জের চেয়ারে বসলাম, সেখান থেকে উঠতে ৫/৬ বছর লেগেছিল। ডেস্কে থাকলেও মাঝে মাঝে বিশেষ রিপোর্ট ও ফিচার লিখেছি, তাতে কোনও বাধা ছিলো না।

আশির দশকের শুরুতেই ঢাকা থেকে দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পুনর্প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হলো। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বেশি বেতন দিয়ে অন্যান্য কাগজে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিকদের নিয়োগ করতে শুরু করলেন। প্রথমেই তাদের নজর পড়লো ‘সংবাদ’-এর দিকে। তারা জানতেন ‘সংবাদ’-এর সাংবাদিকদের বেতন অন্যান্য পত্রিকার চেয়ে কম। তারা বেশি বেতন অফার করায় রিপোর্টারদের প্রায় সবাই বাংলার বাণীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ডেস্ক থেকেও দু-একজন গেলেন। আমিও বাংলার বাণীতে যাবো এমন গুজব আমিও শুনেছি। তবে সেখানে যাওয়ার আগ্রহ আমার ছিল না। ‘সংবাদ’-এর তৎকালীন চীফ রিপোর্টার তোজাম্মল আলিসহ সম্ভবত সাতজন দক্ষ রিপোর্টার চলে গেলেন। সে সময়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান তাদের ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন, সম্পাদক/প্রকাশক আহমদুল কবিরকে অনুরোধ করেছিলেন “ওদের বেতন বাড়িয়ে দিন, তাহলে ওরা যাবে না।” প্রস্তাবটি কবির সাহেব নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, “বেতন এক পয়সাও বাড়াবো না। যারা যেতে চায়, যেতে দাও। ওদের ছাড়াও ‘সংবাদ’ চলবে। তুমি বরং যারা আছে তাদের নিয়ে নতুন করে রিপোর্টিং টিম দাঁড় করাও।”

এতজন রিপোর্টার একসঙ্গে চলে যাওয়ায় রিপোর্টিং বিভাগে শূন্যতা দেখা দিলো। সে সময়ে আমি রিপোর্টিং বিভাগে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখালাম। সন্তোষদা আমাকে আগেই কথা দিয়েছিলেন যে, প্রয়োজন হলে এবং সুযোগ হলে আমি আবার রিপোর্টার হতে পরবো। আমার আগ্রহের কথা কবির সাহেবের কানে গেল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানতে চাইলেন আমি পারবো কিনা, আমার অভিজ্ঞতা কতটুকু। আমি দৃঢ় আস্থার সঙ্গে বললাম, “অবশ্যই পারবো। আমি তো আগে রিপোর্টারই ছিলাম। এতদিন আমি সিনিয়র রিপোর্টারদের লেখা এডিট করেছি, প্রয়োজনে নতুন করে লিখে দিয়েছি। তাছাড়া আমি বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষাতেই লিখতে জানি।” কবির সাহেব মৃদু হেসে বললেন, “তাই নাকি? তাহলে কাজ করে দেখাও। আজ থেকেই কাজে লেগে যাও।” তাই হলো। পরদিনই আমি ইংরেজিতে লেখা নিয়োগপত্র পেলাম, দেখলাম আমাকে চীফ রিপোর্টার হিসেবে অবিলম্বে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। আমার বেতন-ভাতাও বাড়িয়ে দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমিও আনন্দের সঙ্গে দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। ইতোমধ্যে ‘সংবাদ’ কার্যালয় বংশাল রোড থেকে পুরানা পল্টনে স্থানান্তর করা হয়েছে।

আমি যখন চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব নিলাম, তখন সংবাদে রিপোর্টার অবশিষ্ট আছেন মাত্র দু’জন- প্রফুল্ল কুমার ভক্ত ও বশীর আহমদ। দু’জনই এখন প্রয়াত। সংবাদ-এর বর্তমান ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ূন তখন নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা, তবে সে প্রতিদিনই ঢাকায় ‘সংবাদ’ অফিসে এসে রিপোর্ট জমা দিতো। তার সঙ্গে আমার এবং আমাদের ব্যক্তিগত সখ্যও গড়ে উঠেছিলো, সেই সুসম্পর্ক তার সঙ্গে এখনও আছে। কাশেম হুমায়ূনকে আমরা আমাদের রিপোর্টিং টিমে ‘স্টাফ রিপোর্টার’ হিসাবে নিয়ে নিলাম। তাকে নিয়ে আমাদের রিপোর্টিং টিমে মোট লোকসংখ্যা দাঁড়ালো চারজনে, আর এই নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু।

একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। ঢাকায় তখন অন্যান্য দৈনিক পত্রিকায় অনেক দক্ষ, অভিজ্ঞ সিনিয়র রিপোর্টাররা কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কাজ করতে হয়েছে। বাইরে একটা ধারণা ও প্রচারণা ছিল যে ‘সংবাদ’ এবার ডুবে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ‘সংবাদ’-এর রিপোর্টিং এবং সামগ্রিকভাবে ‘সংবাদ’ আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। বশীর আহমদ ছিলেন ক্রাইম রিপোর্টার, তিনি অপরাধ বিষয়ক খবর নিয়েই থাকতেন। প্রফুল্ল ভক্ত কৃষি, খাদ্য বিষয়ক রিপোর্টে পারদর্শী ছিলেন, অন্যান্য রিপোর্টও প্রয়োজনে করতেন। কাশেম হুমায়ূন মূলত সচিবালয় ভিত্তিক সরকারি কার্যক্রমের উপর রিপোর্ট লিখতেন। রাজনৈতিক রিপোর্ট দৈনিক সংবাদপত্রের মূল আকর্ষণ। সেটার দায়িত্ব আমি নিজেই নিলাম। তখন এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন চলছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ৬ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন এবং এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে এসেছেন। এদিকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিও আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও বিরোধী শিবিরের আন্দোলন গতিশীল হয়েছে। পাঠক তখন সংবাদপত্রে রাজনীতির খবরই আগে পড়তো। আমি একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামপন্থী রাজনৈতিক দল, সবার সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতাম। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এজন্য খবর সংগ্রহ করতে আমার অসুবিধা হতো না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোটের খবর ‘সংবাদ’-এ যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো। আমি নিজে সে সময়ের দুই বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকার একাধিকবার নিয়েছি এবং তা পত্রিকার প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হতো। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকারও আমি নিতাম। এ কারণে ‘সংবাদ’- এর রাজনৈতিক প্রতিবেদন পাঠক ও রাজনৈতিক মহলের প্রশংসা পেয়েছে, পত্রিকার প্রচার সংখ্যাও বেড়েছে। সংবাদ-এর সম্পাদক ও কর্তৃপক্ষ আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন। রাজনৈতিক সংবাদের পাশাপাশি কূটনৈতিক রিপোর্ট ও অর্থনৈতিক খবর, যেমন জাতীয় বাজেটের খবরও আমাকেই লিখতে হতো। আমার ওপর প্রচন্ড চাপ পড়তো, এমনও হয়েছে যে, দিনে আমাকে ১৮ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়েছে। উপায় ছিলো না, লোকবল কম। কর্তৃপক্ষ একসময় সমস্যাটা বুঝলেন এবং একজন দু’জন করে আরও কয়েকজন রিপোর্টার নিলেন। ১৯৮৩ সালের দিকে এলেক শওকত মাহমুদ, ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে যোগ দিলেন মনোজ রায়। মনোজ সহকারী জজ্-এর চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতার আকর্ষণে সংবাদ-এ এসে স্টাফ রিপোর্টার হলেন। এরপর একে একে কামরুল ইসলাম চৌধুরী, বদিউল আলম, আমীর খসরু এসে যোগ দিলেন। ক্রীড়া প্রতিবেদক পদে অজয় বড়ুয়া আগে থেকেই ছিলেন। এভাবেই ‘সংবাদ’-এর রিপোর্টিং টিম আগের চেয়ে শক্তিশালী হলো, কিন্তু লোকবল অন্যান্য পত্রিকার তুলনায় তখনও কম।

সংবাদ এর চীফ রিপোর্টার পদে আমি ‘অফিসিয়ালি’ ছিলাম তিন বছরের মতো। একসময় আমি অনুভব করলাম চীফ রিপোর্টার হিসেবে রিপোর্টিং টিমের তত্বাবধান করতে গিয়ে আমার নিজের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কাজের চাপে শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়ছি। একসময় আমি কর্তৃপক্ষকে জানালাম যে এ দায়িত্ব পালন আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়, আমি নিজের রিপোর্টিং ও লেখালিখিতেই মনোনিবেশ করতে চাই। আমি পদত্যাগপত্র পেশ করলাম এবং মৌখিকভাবে জানালাম আর কাউকে চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দিন। কর্তৃপক্ষ আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন, কিন্তু নতুন কোন চীফ রিপোর্টার নিয়োগ করলেন না। তারা বার্তা সম্পাদক সন্তোষ গুপ্তকে বললেন, আপনিই এই দায়িত্ব পালন করুন, রিপোর্টারদের এ্যাসাইনমেন্ট দিন। সন্তোষদা কিছুদিন রিপোর্টারদের এ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। আমি রেহাই পেলাম, নিজের কাজে মন দিলাম, আমার নিজের রিপোর্ট লেখার পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। কিন্তু বেশিদিন শান্তিতে থাকতে পারলাম না। সন্তোষদা একদিন এ্যাসাইনমেন্ট খাতা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, “আপনি লিখে দিন কে কী করবে। আমি পারবো না, আমার আরও কাজ আছে।” অর্থাৎ আমাকে আবার অনানুষ্ঠানিকভাবে চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করতে হলো। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে আমি ‘সংবাদ’ থেকে পদত্যাগ করে নতুন ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’-এ যোগ দেই। সে পর্যন্ত আমাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও সংবাদ-এর প্রধান প্রতিবেদক তথা চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। অন্য কাউকে চীফ রিপোর্টার পদে নিয়োগের অনুরোধ করা হলেও সম্পাদক আহমদুল কবির তা করেন নি।

image

শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি

চপল বাশার

image

শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী

আমার সাংবাদিকতা জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হবে আগামী বছর ২০২০ সালে। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার আগেই ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেই। এই পঞ্চাশ বছরে বিভিন্ন গণমাধ্যম, যেমন বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক ও সাপ্তাহিক, বার্তা সংস্থা, টেলিভিশন ও রেডিওতে কাজ করেছি। বিদেশী সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার সঙ্গেও কাজ করেছি। কিন্তু একথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, সংবাদপত্র জগতের সঙ্গে আমার প্রথম প্রেম ‘সংবাদ’-এর সঙ্গেই। ১৯৭০-এর শুরুতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি বার্তা সংস্থা ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি (এনা)-তে স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করি। সেখানে মাসতিনেক কাজ করার পর ২৬৩, বংশাল রোডে ‘সংবাদ’ অফিসে চলে আসি। সেখানে যোগ দেই শিক্ষানবীশ স্টাফ রিপোর্টার/ সাব-এডিটর হিসাবে। পত্রিকার তৎকালীন চীফ রিপোর্টার প্রয়াত হাসান আলি আমাকে ‘সংবাদ’-এ আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ‘সংবাদ’-এর বার্তাকক্ষে তখন প্রয়োজনের তুলনায় কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। সে কারণেই আমাকে নিয়ে আসা। সেখানে যোগ দেয়ার পর প্রায় এক বছর অর্থাৎ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত একটানা কাজ করেছি। প্রয়োজনে রিপোর্টিং করতে হতো, এসাইনমেন্ট নিয়ে বাইরে যেতাম, ফিরে এসে রিপোর্ট লিখতাম, মাঝে মাঝে ফিচারও লিখতাম। অন্য সময় ডেস্কে বসে সাব-এডিটরের কাজ করতাম, নিউজ এজেন্সি থেকে আসা ইংরেজি রিপোর্ট বাংলায় অনুবাদ করতাম, সম্পাদনা করতাম। কখনও বা ডেস্কে বসেই দেশী বা বিদেশী খবর নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতাম, ছবির ক্যাপসন লিখতাম, এক কথায় বলতে গেলে বার্তা কক্ষের সব ধরনের কাজেই আমি দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। ‘সংবাদ’-এ এক বছরের কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে পরিপূর্ণ সাংবাদিক হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে, যে অভিজ্ঞতা আমাকে পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকে সামনের দিকেই এগিয়ে নিয়েছে। তাই আমি শুরুতেই বলেছি সাংবাদিকতার জীবনে ‘সংবাদ’ আমার প্রথম প্রেম। প্রথম প্রেম কি কখনও ভোলা যায়? তাই তো আজ ‘সংবাদ’-এর স্মৃতিকথা নিয়ে লিখতে বসেছি, মাঝে মাঝেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ছি।

ষাটের দশকের প্রায় গোড়ার দিক থেকেই ‘সংবাদ’-এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। ১৯৬২তে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পরি। এরপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হয়ে সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকি। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮, এই দুই বছর আমি ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। সংগঠন সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর ও প্রেস রিলিজ নিয়ে আমি নিজেই যেতাম বংশাল রোডের সংবাদ অফিসে। সে সময় চীফ রিপোর্টার ছিলেন মোহাম্মদ আফজল। তিনি পরবর্তীকালে ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন এবং ছিলেন বাম রাজনীতির একজন নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক। গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদে এখনও আছেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ, রংপুরে নিজের বাড়িতে থাকেন। আমি প্রেস রিলিজ নিয়ে আফজল ভাইর হাতে দিতাম। তিনি তখন চীফ রিপোর্টার হলেও আর কোন রিপোর্টার ছিল না। তিনি একাই একশ! আফজল ভাই প্রেস রিলিজ নিয়ে আমাকে তার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসতে বলতেন। তারপর পিয়নকে বলতেন আমাকে এক কাপ চা দেয়ার জন্য। এরপর নিউজপ্রিন্টের প্যাড এগিয়ে দিয়ে বলতেন, “কলম আছে তো? প্রেস রিলিজ থেকে তুমি নিজেই রিপোর্টটা লিখে দাও। প্রেস রিলিজের একদম শেষে যে বক্তব্য বা দাবিটা আছে, সেটা সামনে নিয়ে এসে ‘ইন্ট্রো’ করো, তারপর রিপোর্টটা লিখে ফেল। চিন্তা করো না, আমি দেখে দেব।” আমি খুব উৎসাহ নিয়ে রিপোর্ট লিখে ফেলতাম। আফজল ভাই সেটা দেখে দু-একটা বানান সংশোধন বা সামান্য পরিবর্তন করে বলতেন, “ভালোই হয়েছে।” এই বলে তিনি পাঠিয়ে দিতেন ডেস্কে। পরদিন ‘সংবাদ’-এর প্রথম বা শেষ পাতায় যখন দেখতাম আমার লেখা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, বড়ই আনন্দিত হতাম। আমার লেখা প্রেস রিলিজ থেকে আমারই তৈরি করা রিপোর্ট! এভাবেই আমার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। এজন্য আমি আফজল ভাইর কাছে চিরঋণী।

‘সংবাদ’ অফিসে আমার যাতায়ত চলতেই থাকলো, সেই সঙ্গে চললো রিপোর্ট লেখা। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সারসহ আরও অনেকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তাদের সান্নিধ্য আমাকে সমৃদ্ধ করলো। কাজ না থাকলেও মাঝে মাঝেই ‘সংবাদ’ অফিসে গিয়ে হাজির হতাম, আড্ডা দিতাম। ওটা ছিল তখন বাম ঘরানার লেখক ও রাজনতিবিদদের মিলনকেন্দ্র। সেটাও ছিল আমার বড় আকর্ষণ।

১৯৭০ সালের মার্চ অথবা এপ্রিল, তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র, ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সে সময়ে সংবাদ-এ যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলাম। বার্তা সংস্থা ‘এনা’র চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘সংবাদ’-এ চলে এলাম। এখানে আসার পেছনে মনের টানও ছিল। নতুন এসেছি। তাই বেতনও কম। মাসে ১৫০ টাকা। এই টাকার পরিমাণ তখন কিন্তু কম নয়। আমার গোপীবাগের বাসা থেকে বংশাল রোডে যেতে রিকশা ভাড়া লাগতো আট আনা অর্থাৎ ৫০ পয়সা। বংশালের রেস্তোরাঁয় এক কাপ চা দুই আনা, একটা সিঙ্গারাও দুই আনা। এক টাকা বা দেড় টাকার ভাত খাওয়া যেতো। অতএব ১৫০ টাকা আমার জন্য ছিলো অনেক টাকা। তবে অন্যন্য সংবাদপত্রের তুলনায় সংবাদ-এর সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন ছিলো অনেক কম। বেতনের অর্ধেক দেয়া হতো মাসের ৭ তারিখে, অবিশিষ্ট অর্ধেক বেতন দেয়া হতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে, অনিয়মিতভাবে। তবে মাস শেষ হওয়ার আগেই পুরো বেতন শোধ করা হতো, বাকি বা বকেয়া থাকতো না। বেতন নিয়ে সাংবাদিক কর্মচারীদের মধ্যে কোনও ক্ষোভ আমি দেখিনি, কারণ পুরো বেতনটাই তারা মাস শেষ হওয়ার আগেই পেয়ে যেতেন। ক্ষোভ না থাকার আরও কারণ ছিলো। সাংবাদিকদের সবাই, এমনকি কর্মচারীরাও চিন্তায় ছিলেন প্রগতিশীল, ‘সংবাদ’কে নিজেদের প্রতিষ্ঠান মনে করতেন, পত্রিকার প্রতি ছিল একাত্মতাবোধ। এছাড়াও পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক শ্রদ্ধেয় জহুর হাসেন চৌধুরী ও যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সারকে সবাই ভালোবাসতেন। এরা দু’জনই ‘সংবাদ’-এর সাংবাদিক-কর্মচারীদের অভিভাবকের মতো ছিলেন।

আমি আগেই বলেছি ১৯৭০ সালের মার্চ-এপ্রিল থেকে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংবাদ-এ একটানা কাজ করেছি এবং এরই মধ্যে কিছুদিন ছুটি নিয়ে এম.এ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। ১৯৭০ সালে ক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া, তখনও সামরিক আইন চলছে, তবে আগের তুলনায় একটু ঢিলেঢালা। রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে কাজ করতে পারছে, সংবাদপত্রের ওপর কড়াকড়ি নেই। সেই বছরের দু’টি বড় ঘটনা ছিলো ১২ নভেম্বরে উপকূলীয় জেলাগুলিতে ঘূর্ণিঝড় এবং ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন। ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দশ লাখ মানুষ মারা যায়। সংবাদ-এর ফটো সাংবাদিক ছিলেন রশীদ তালুকদার। তিনি নিজে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির অনেক ছবি তুলেছিলেন এবং জেলা সংবাদদাতারাও ছবি ও খবর পাঠাতেন। প্রতিদিন সংবাদ-এর প্রথম পাতা, শেষ পাতা ও অন্যান্য পাতায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি ও লাশের ছবি ও খবর দিয়ে ভরা থাকতো। সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্য দিয়ে আমি ঘূর্ণিঝড়ের খবর লিখতাম। অসহায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও জীবিত মানুষদের কষ্ট নিয়ে লিখতে গিয়ে সে সময় আমি খুবই মানসিক যন্ত্রণা পেয়েছি। ঘূর্ণিদুর্গতদের সাহায্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার বলতে গেলে কিছুই করেনি। বেসরকারি সাহায্য নিয়েই দুর্গত মানুষরা বেঁচে ছিল। তখনই প্রমাণ হয়ে গেছে যে পাকিস্তানের সরকার পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। এই অবহেলা ও বঞ্চনার বিষয়টি ‘সংবাদ’ তার প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয় নিবন্ধে জোরালোভাবে তুলে ধরেছিলো। বাংলার বিক্ষুব্ধ মানুষ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিলো, যার অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো ঘূর্ণিদূর্গত মানুষের প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা।

১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র বঙ্গবন্ধুর কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। এর পরের ঘটনা সবাই জানেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি রূপ নিলো স্বাধীনতার আন্দোলনে। শুরু হলো পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরুর দিক নির্দেশনা দিলো। সে সময়ে অসহযোগ আন্দোলনের খবর, বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত বাঙালির ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলি এবং এ সংক্রান্ত সব খবর সংবাদ-এর প্রথম পাতায় বড় করে ছবিসহ ছাপা হতো, লেখা হতো সম্পাদকীয় নিবন্ধ ও প্রবন্ধ।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আর একটি কথা বলতেই হয়। আমি আগেই বলেছি সে সময় আমি সংবাদ-এর ডেস্ক ওয়ার্ক-এর পাশাপাশি রিপোর্টিং টিমের সঙ্গেও কাজ করতাম, এ কাজ আমার বেশি ভালো লাগতো। ৭ মার্চ চীফ রিপোর্টার হাসান আলি, স্টাফ রিপোর্টার মুজিবুর রহমান বাদলের সঙ্গে আমিও রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে ও কভার করতে। বিকেলে অফিসে ফিরে বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের ভাষণ পুরোটা লিখলেন হাসান আলি। আমি ও বাদল বক্তৃতার বিভিন্ন পয়েন্ট ও উক্তি দিয়ে তাকে সহায়তা করলাম। সে সময় রেসকোর্স ময়দানের বিপুল জনসমাগম, জনতার স্লোগান এবং মাথার ওপর উড়তে থাকা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারÑ এসব নিয়েও আমরা বিস্তারিত বিবরণ লিখলাম। রাতে তখনকার বার্তা সম্পাদক আলী আকসাদ রিপোর্টটি দেখলেন এবং সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী ও যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে টেলিফোনে পরামর্শ করে হেডলাইন লিখলেন নিজের হাতে। প্রথম পাতার ওপরে ৮ কলাম হেডলাইনটি ছিলোÑ ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কেউ কেউ বললেন, এই হেডলাইন ‘সংবাদ’-এর জন্য কোন বিপদ ডেকে আনবে না তো? আকসাদ ভাই বললেন, “যা হয় হবে। হেডলাইন এটাই থাকবে। আমরা পাঠককে সঠিক তথ্য দেব।” পরদিন দেখা গেল ‘সংবাদ’-ই একমাত্র দৈনিক যাতে বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে হেডলাইন করা হয়েছে। একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না। সেই রাতে বার্তা কক্ষে শিফট-ইন-চার্জ ছিলেন প্রয়াত সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার। তিনি মৃত্যুর কিছুকাল আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে দাবি করেছিলেন যে, কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করে তিনি নিজেই হেডলাইনটি দিয়েছিলেন। তার দাবিটি সঠিক নয়, একথা আমি মনে কোনও দ্বিধা না রেখে বলতে পারি, কারণ সেই রাতে আমি বার্তাকক্ষে উপস্থিত ছিলাম। আমাদের সামনেই নিউজ ডেস্কে বসে বার্তা সম্পাদক আকসাদ ভাই হেডলাইনটি লিখেছিলেন। সত্যকে অস্বীকার করা ঠিক নয়।

যাই হোক, ‘সংবাদ’ যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো, তার মূল্যও দিতে হয়েছে। ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু হলো। সেদিন রাতে ১১টা নাগাদ আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে গোপীবাগের বাসায় ফিরে এসেছি। রাত ১২টার দিকে শুরু হলো হানাদার বাহিনীর তান্ডব। গোলাগুলির শব্দে কান পাতা দায়। আমার বাসার টেলিফোন তখনও সচল ছিলো। আমি ‘সংবাদ’ অফিসে ফোন করলাম। সে রাতেও শিফট-ইন-চার্জ ছিলেন গোলাম সারওয়ার। তিনি তখন ভয়ে কাঁপছেন। বললেন সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে, আমি কী করবো বুঝতে পারছি না।’ আমি বললাম, “আপনিও বের হয়ে যান, যেখানেই হোক, আশ্রয় নিন। ‘সংবাদ’ অফিসে হামলা হবেই।” এর পরেই টেলিফোন ডেড্ হয়ে গেল। সারওয়ার ভাই বের হতে পেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু একজন পারেন নি। তিনি কবি শহীদ সাবের, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। ‘সংবাদ’ অফিসেই তিনি থাকতেন। পরদিন পাকবাহিনী ২৬৩, বংশাল রোডে ‘সংবাদ’ অফিসে হামলা করে, দোতলা পুরানো ভবন, পেছনের প্রেস এবং সবকিছুতে আগুন দেয়। সে আগুনে পুড়ে মরেন কবি শহীদ সাবের।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘সংবাদ’ আর প্রকাশিত হয়নি। যুদ্ধশেষে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি ‘সংবাদ’ আবার প্রকাশিত হতে থাকে বংশাল রোডের অফিস থেকেই। পুরনো দোতলা ভবনের নিচতলার একটি ঘর ব্যবহারযোগ্য ছিলো। সেখানে অফিস ঘর, নতুন একটি টিনশেডে কয়েকটি ঘরে বার্তা কক্ষ ও সম্পাদকীয় বিভাগ স্থাপন করা হলো। যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে শহীদুল্লা কায়সার দীর্ঘকাল ‘সংবাদ’কে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, ‘সংবাদ’-এর কর্মীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর সহযোগী আলবদর বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেন নি, তার লাশটিও পাওয়া যায়নি।

‘সংবাদ’ যখন নতুনভাবে প্রকাশিত হলো, তখন এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলেন প্রকাশক আহমদুল কবির। সাবেক সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী পত্রিকার পরিচালনা পরিষদে পরিচালক হিসেবে থাকলেন এবং সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখতে থাকলেন। আলী আকসাদ বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন, হাসান আলিও সিটি এডিটর পদে প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্বে থাকলেন। ২৫ মার্চের আগে যারা ‘সংবাদ’-এ ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনীতে। যুদ্ধশেষে আমি ১৯৭২-এর প্রথম দিকেই ‘দৈনিক বাংলা’য় স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে স্থায়ী পদে কাজ করার অফার পেলাম। তখনকার বেতন স্কেল অনুযায়ী মাসিক বেতন ৫০০ টাকা। আমার বন্ধু ও রাজনৈতিক শুভানুধ্যায়ীরা ওখানেই যোগ দেয়ার পরামর্শ দিলেন। তারা বললেন, “এটা তো আর দৈনিক পাকিস্তান নয়। এখন দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন কাগজ। প্রচার সংখ্যায় সর্বোচ্চ। তুমি ওখানেই যোগ দাও- ওখানেও আমাদের লোক থাকা দরকার,” আমি তাই করলাম। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে থাকলাম। রিপোর্টারদের মধ্যে সম্ভবত আমিই ছিলাম বয়সে সবচেয়ে ছোট। অথচ আমার ওপরেই কাজের চাপ থাকতো সবচেয়ে বেশি। ১৯৭২-এর ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) আওয়ামী লীগ জনসভা করেছিল, তখনকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান বক্তা। দৈনিক বাংলার সিনিয়র রিপোর্টাররা প্রায় সকলেই সেখানে ছিলেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ লেখার দায়িত্ব পড়লো আমার মতো সর্বকনিষ্ঠ রিপোর্টারের ওপর। আমার কাছে টেপ রেকর্ডার ছিলো না, শুধুমাত্র আমার নোটের ওপর নির্ভর করেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ আমি লিখেছিলাম। এটা ছিলো আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। আমি সফলভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি, সফল হয়েছি। আমার সে বিশাল রিপোর্ট দুই কিস্তিতে পরপর দুই দিন ধরে ছাপা হয়েছিলো। অথচ সিনিয়র রিপোর্টাররা বঙ্গবন্ধুর জনসভার ওপর দু-চার প্যারার সাইড স্টোরি লিখে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ওপর ইচ্ছা করেই চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে- কারণ রিপোর্টিং টিমের অধিকাংশই ছিলেন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তাদের আস্থা কতটুকু তা নিয়ে আমার সন্দেহ ছিলো। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমি সেখানে আর থাকবো না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম এবং ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে গেলাম।

১৯৭৩-এর শুরুতেই আমি আবার ‘সংবাদ’-এ যোগ দিলাম। এবারও উদ্যোগ নিলেন ও সহযোগিতা করলেন তৎকালীন সিটি এডিটর প্রয়াত হাসান আলি। তখন বার্তা সম্পাদক পদে আলী আকসাদ আর ছিলেন না, তিনি বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছিলেন। তখন বার্তা সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন সন্তোষ গুপ্ত। সন্তোষদা ছিলেন কবি, নরম মনের মানুষ। কিন্তু বার্তা সম্পাদক হিসাবে খুব কঠোর ছিলেন, এজন্য আড়ালে তাকে আমরা বলতাম ‘সন্ত্রাস গুপ্ত’। আমি রিপোর্টার হিসাবেই কাজ করতে চেয়েছিলাম, হাসান আলিও তাই চাচ্ছিলেন, কারণ রিপোর্টারের সংখ্যা তখনও কম। কিন্তু সন্তোষদা রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ডেস্কে লোক অনেক কম। একজন শিফট-ইন-চার্জ দরকার। চপল বাশার আপাতত শিফট ই-চার্জ পদে কাজ করুক, পরে না হয় আবার রিপোর্টিং বিভাগে যাবে। তিনি পরে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন, “বার্তা বিভাগে শিফট-ইন-চার্জ খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই পদে দায়িত্বশীল সাংবাদিক দরকার। আপনার ওপর আস্থা আছে বলেই ওখানে বসাচ্ছি- পরে আবার রিপোর্টার হতে পারবেন।” সেই যে শিফট-ইন-চার্জের চেয়ারে বসলাম, সেখান থেকে উঠতে ৫/৬ বছর লেগেছিল। ডেস্কে থাকলেও মাঝে মাঝে বিশেষ রিপোর্ট ও ফিচার লিখেছি, তাতে কোনও বাধা ছিলো না।

আশির দশকের শুরুতেই ঢাকা থেকে দৈনিক ‘বাংলার বাণী’ পুনর্প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হলো। পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বেশি বেতন দিয়ে অন্যান্য কাগজে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিকদের নিয়োগ করতে শুরু করলেন। প্রথমেই তাদের নজর পড়লো ‘সংবাদ’-এর দিকে। তারা জানতেন ‘সংবাদ’-এর সাংবাদিকদের বেতন অন্যান্য পত্রিকার চেয়ে কম। তারা বেশি বেতন অফার করায় রিপোর্টারদের প্রায় সবাই বাংলার বাণীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ডেস্ক থেকেও দু-একজন গেলেন। আমিও বাংলার বাণীতে যাবো এমন গুজব আমিও শুনেছি। তবে সেখানে যাওয়ার আগ্রহ আমার ছিল না। ‘সংবাদ’-এর তৎকালীন চীফ রিপোর্টার তোজাম্মল আলিসহ সম্ভবত সাতজন দক্ষ রিপোর্টার চলে গেলেন। সে সময়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান তাদের ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন, সম্পাদক/প্রকাশক আহমদুল কবিরকে অনুরোধ করেছিলেন “ওদের বেতন বাড়িয়ে দিন, তাহলে ওরা যাবে না।” প্রস্তাবটি কবির সাহেব নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, “বেতন এক পয়সাও বাড়াবো না। যারা যেতে চায়, যেতে দাও। ওদের ছাড়াও ‘সংবাদ’ চলবে। তুমি বরং যারা আছে তাদের নিয়ে নতুন করে রিপোর্টিং টিম দাঁড় করাও।”

এতজন রিপোর্টার একসঙ্গে চলে যাওয়ায় রিপোর্টিং বিভাগে শূন্যতা দেখা দিলো। সে সময়ে আমি রিপোর্টিং বিভাগে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখালাম। সন্তোষদা আমাকে আগেই কথা দিয়েছিলেন যে, প্রয়োজন হলে এবং সুযোগ হলে আমি আবার রিপোর্টার হতে পরবো। আমার আগ্রহের কথা কবির সাহেবের কানে গেল। তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি জানতে চাইলেন আমি পারবো কিনা, আমার অভিজ্ঞতা কতটুকু। আমি দৃঢ় আস্থার সঙ্গে বললাম, “অবশ্যই পারবো। আমি তো আগে রিপোর্টারই ছিলাম। এতদিন আমি সিনিয়র রিপোর্টারদের লেখা এডিট করেছি, প্রয়োজনে নতুন করে লিখে দিয়েছি। তাছাড়া আমি বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষাতেই লিখতে জানি।” কবির সাহেব মৃদু হেসে বললেন, “তাই নাকি? তাহলে কাজ করে দেখাও। আজ থেকেই কাজে লেগে যাও।” তাই হলো। পরদিনই আমি ইংরেজিতে লেখা নিয়োগপত্র পেলাম, দেখলাম আমাকে চীফ রিপোর্টার হিসেবে অবিলম্বে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। আমার বেতন-ভাতাও বাড়িয়ে দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আমিও আনন্দের সঙ্গে দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। ইতোমধ্যে ‘সংবাদ’ কার্যালয় বংশাল রোড থেকে পুরানা পল্টনে স্থানান্তর করা হয়েছে।

আমি যখন চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব নিলাম, তখন সংবাদে রিপোর্টার অবশিষ্ট আছেন মাত্র দু’জন- প্রফুল্ল কুমার ভক্ত ও বশীর আহমদ। দু’জনই এখন প্রয়াত। সংবাদ-এর বর্তমান ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ূন তখন নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা, তবে সে প্রতিদিনই ঢাকায় ‘সংবাদ’ অফিসে এসে রিপোর্ট জমা দিতো। তার সঙ্গে আমার এবং আমাদের ব্যক্তিগত সখ্যও গড়ে উঠেছিলো, সেই সুসম্পর্ক তার সঙ্গে এখনও আছে। কাশেম হুমায়ূনকে আমরা আমাদের রিপোর্টিং টিমে ‘স্টাফ রিপোর্টার’ হিসাবে নিয়ে নিলাম। তাকে নিয়ে আমাদের রিপোর্টিং টিমে মোট লোকসংখ্যা দাঁড়ালো চারজনে, আর এই নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু।

একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম। ঢাকায় তখন অন্যান্য দৈনিক পত্রিকায় অনেক দক্ষ, অভিজ্ঞ সিনিয়র রিপোর্টাররা কাজ করছেন। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কাজ করতে হয়েছে। বাইরে একটা ধারণা ও প্রচারণা ছিল যে ‘সংবাদ’ এবার ডুবে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ‘সংবাদ’-এর রিপোর্টিং এবং সামগ্রিকভাবে ‘সংবাদ’ আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। বশীর আহমদ ছিলেন ক্রাইম রিপোর্টার, তিনি অপরাধ বিষয়ক খবর নিয়েই থাকতেন। প্রফুল্ল ভক্ত কৃষি, খাদ্য বিষয়ক রিপোর্টে পারদর্শী ছিলেন, অন্যান্য রিপোর্টও প্রয়োজনে করতেন। কাশেম হুমায়ূন মূলত সচিবালয় ভিত্তিক সরকারি কার্যক্রমের উপর রিপোর্ট লিখতেন। রাজনৈতিক রিপোর্ট দৈনিক সংবাদপত্রের মূল আকর্ষণ। সেটার দায়িত্ব আমি নিজেই নিলাম। তখন এরশাদের সামরিক স্বৈরশাসন চলছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ৬ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন এবং এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে এসেছেন। এদিকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিও আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও বিরোধী শিবিরের আন্দোলন গতিশীল হয়েছে। পাঠক তখন সংবাদপত্রে রাজনীতির খবরই আগে পড়তো। আমি একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বামপন্থী রাজনৈতিক দল, সবার সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতাম। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এজন্য খবর সংগ্রহ করতে আমার অসুবিধা হতো না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোটের খবর ‘সংবাদ’-এ যথাযথভাবে গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হতো। আমি নিজে সে সময়ের দুই বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎকার একাধিকবার নিয়েছি এবং তা পত্রিকার প্রথম পাতায় ফলাও করে ছাপা হতো। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকারও আমি নিতাম। এ কারণে ‘সংবাদ’- এর রাজনৈতিক প্রতিবেদন পাঠক ও রাজনৈতিক মহলের প্রশংসা পেয়েছে, পত্রিকার প্রচার সংখ্যাও বেড়েছে। সংবাদ-এর সম্পাদক ও কর্তৃপক্ষ আমার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন। রাজনৈতিক সংবাদের পাশাপাশি কূটনৈতিক রিপোর্ট ও অর্থনৈতিক খবর, যেমন জাতীয় বাজেটের খবরও আমাকেই লিখতে হতো। আমার ওপর প্রচন্ড চাপ পড়তো, এমনও হয়েছে যে, দিনে আমাকে ১৮ ঘণ্টাও কাজ করতে হয়েছে। উপায় ছিলো না, লোকবল কম। কর্তৃপক্ষ একসময় সমস্যাটা বুঝলেন এবং একজন দু’জন করে আরও কয়েকজন রিপোর্টার নিলেন। ১৯৮৩ সালের দিকে এলেক শওকত মাহমুদ, ১৯৮৪ সালের এপ্রিলে যোগ দিলেন মনোজ রায়। মনোজ সহকারী জজ্-এর চাকরি ছেড়ে সাংবাদিকতার আকর্ষণে সংবাদ-এ এসে স্টাফ রিপোর্টার হলেন। এরপর একে একে কামরুল ইসলাম চৌধুরী, বদিউল আলম, আমীর খসরু এসে যোগ দিলেন। ক্রীড়া প্রতিবেদক পদে অজয় বড়ুয়া আগে থেকেই ছিলেন। এভাবেই ‘সংবাদ’-এর রিপোর্টিং টিম আগের চেয়ে শক্তিশালী হলো, কিন্তু লোকবল অন্যান্য পত্রিকার তুলনায় তখনও কম।

সংবাদ এর চীফ রিপোর্টার পদে আমি ‘অফিসিয়ালি’ ছিলাম তিন বছরের মতো। একসময় আমি অনুভব করলাম চীফ রিপোর্টার হিসেবে রিপোর্টিং টিমের তত্বাবধান করতে গিয়ে আমার নিজের ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কাজের চাপে শারীরিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়ছি। একসময় আমি কর্তৃপক্ষকে জানালাম যে এ দায়িত্ব পালন আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়, আমি নিজের রিপোর্টিং ও লেখালিখিতেই মনোনিবেশ করতে চাই। আমি পদত্যাগপত্র পেশ করলাম এবং মৌখিকভাবে জানালাম আর কাউকে চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দিন। কর্তৃপক্ষ আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন, কিন্তু নতুন কোন চীফ রিপোর্টার নিয়োগ করলেন না। তারা বার্তা সম্পাদক সন্তোষ গুপ্তকে বললেন, আপনিই এই দায়িত্ব পালন করুন, রিপোর্টারদের এ্যাসাইনমেন্ট দিন। সন্তোষদা কিছুদিন রিপোর্টারদের এ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। আমি রেহাই পেলাম, নিজের কাজে মন দিলাম, আমার নিজের রিপোর্ট লেখার পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। কিন্তু বেশিদিন শান্তিতে থাকতে পারলাম না। সন্তোষদা একদিন এ্যাসাইনমেন্ট খাতা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, “আপনি লিখে দিন কে কী করবে। আমি পারবো না, আমার আরও কাজ আছে।” অর্থাৎ আমাকে আবার অনানুষ্ঠানিকভাবে চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করতে হলো। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে আমি ‘সংবাদ’ থেকে পদত্যাগ করে নতুন ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’-এ যোগ দেই। সে পর্যন্ত আমাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও সংবাদ-এর প্রধান প্রতিবেদক তথা চীফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। অন্য কাউকে চীফ রিপোর্টার পদে নিয়োগের অনুরোধ করা হলেও সম্পাদক আহমদুল কবির তা করেন নি।