যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা

আবদুল লতিফ

টমাস জেফারসন্স বলেছিলেন, “যদি আমাকে কোন সংবাদপত্রবিহীন সরকার অথবা সরকারবিহীন সংবাদপত্র এর মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলা হয় তবে আমি বিনা বাক্যব্যয়ে শেষোক্তটিকেই পছন্দ করতে এক মুহূর্ত দেরি করবো না।”

জেফারসন্সের মানসপটে যে সংবাদপত্রের কথা ভেসে উঠেছিল তা নিশ্চয়ই কোন স্বাভাবিক কণ্ঠরোধ করা শেখানো বুলির রোবট সংবাদপত্র নয়। তবু মানবজাতির ইতিহাসে দেশে বিদেশে বারে বারে সেই আঘাতটাই এসেছে। সংবাদপত্র একটা জাতির আয়না। সেখানে প্রতিফলিত হয় সেই জাতির সমাজ জীবনের সঠিক চিত্র। একই সাথে ঘরে বসে বর্তমান ঘটনা, তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ ও বিভিন্ন ফিচারের মাধ্যমে আমরা সারা পৃথিবীর কাছে আসি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ যে সংবাদপত্র আমাদের হাতে এসেছে, বিভিন্ন সময়ে তার রূপবদল হয়েছে। প্রাচীন রোমে ‘অ্যাক্টা দিউরমা’ বা সরকারের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হতো। এই ঘোষণাপত্র ধাতু বা পাথরে খোদাই করে জনবহুল স্থানে টাঙিয়ে রাখা হতো। এছাড়া চীনে অষ্টম শতাব্দিতে ‘কাইয়ূয়ান ঝা আবাও’ নামে এক রাজকীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা হতো বলে জানা যায়। ১৫৬৬ সালে ভেনিসে হাতে লেখা সংবাদ প্রচার করা হতো। ১৬০৯ সালে জার্মানি থেকে প্রথম যে ছাপা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো তার নাম ‘রিলেশন’। ১৬২০ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র বের হয় আমস্টার্ডাম থেকে।

মধ্যযুগের ভারতে সংবাদপত্রের দেখা মেলে। তখনকার সংবাদপত্র ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হতো না। হাতে লেখা এই সংবাদপত্র সাধারণের জন্য লেখা হতো না। এসব সংবাদের সবটুকুই ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনে এবং দেশের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীর কাছে এসব সংবাদ পৌঁছে দেয়া হতো। এসব সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব একটি আলাদা বিভাগের ওপর ন্যস্ত ছিল। মোঘল আমলে বাবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত সব সম্রাটরা সংবাদপত্র পাঠ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবনাবসান হলে তাঁর পীড়া ও মৃত্যুর খবর দিল্লির ‘পয়গাম এ হিন্দ’ নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এসব সংবাদপত্র মুষ্টিমেয় রাজাবাদশাহ এবং রাজকর্মচারীদের জন্য প্রকাশিত হতো। অখন্ড ভারতবর্ষে প্রকৃত অর্থে সংবাদপত্রের সূচনা হয় কোলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের হাতে। বেঙ্গল গেজেট নামে দু’পাতার সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকার প্রকাশনার মাধ্যমে। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন জেমস অগাস্টাস হিকি নামক এক ইউরোপিয়ান। তাঁর হাত ধরেই এ দেশের মুদ্রিত সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা। বেঙ্গল গেজেট প্রতি শনিবারে প্রকাশিত হতো। কিন্তু এই পত্রিকায় ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর পতœী ও ইংরেজ বিচারকদের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশের দরুন অল্পদিনের মধ্যেই এই পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।

১৮১৮ সালের প্রথমার্ধে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। তাঁকে সহায়তা করেন রাজা রামমোহন রায়। আর সেই বছরেই ২৩ মে অর্থাৎ বেঙ্গল গেজেট প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীদের উদ্যোগে মার্শম্যান প্রকাশ করেন দিগদর্শন। এর এক মাস পরেই মার্শম্যান ও কেরি সাহেব আরো একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল সমাচার দর্পণ। বাংলা এবং বাঙালির কাছে প্রথম যে পত্রিকাটি সাদরে গৃহীত হয় তার নাম প্রভাকর। ১৮৩১ সালে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। প্রভাকর সম্পর্কে কবি বলেছিলেন,

‘কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত, ব্যাপ্ত চরাচর,

তাঁহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।’

চরণ দু’টির দ্ব্যর্থ অর্থ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রভাকর প্রকাশের ফলে বাংলা পত্রিকায় এক নতুন ধারার প্রবর্তন হয়। পত্রিকাটিতে সাহিত্যকর্ম প্রকাশের সাথে সাথে বাংলা গদ্যরীতিতে বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয় এবং নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

১৮৫৭ সালে এ দেশের ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহের মতো এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল। এই ঘটনা বাংলা সাময়িকপত্রে বিপুল প্রভাব ফেলে। এর আগের পত্রপত্রিকাগুলোতে বাংলা সংবাদপত্রে রাজনৈতিক বা সামাজিক নিবন্ধ প্রচারিত হতো না। ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে সোমপ্রকাশ। এই পত্রিকাই প্রথম রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করে। তখন থেকে বাঙালি সমাজে দ্রুত রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারিত হয়।

১৮৪৭ সালে পূর্ববাংলায় রঙ্গপুর বার্তাবহ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংবাদপত্রটিকে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র বলা চলে। তবে এ সময় পূর্ববঙ্গে পত্রিকার সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। কারণ পত্রিকা প্রকাশের জন্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো যেমন প্রেস, কম্পোজিটর, সংবাদ সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির অভাব ছিল। ফলে একদিকে যেমন অধিক পত্রিকার প্রকাশ ঘটেনি, অন্যদিকে প্রকাশিত পত্রিকাসমূহ স্থায়িত্ব পায়নি। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলাযন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুদ্রণালয় বা প্রেস থেকে ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসে কবি হরিশচন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ঢাকা দর্পণ। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভাতৃদ্বয় যশোরের ক্ষুদ্র গ্রাম ফুলুয়া মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ ও মহারাষ্ট্রে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের বিপ্লবাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে। এই দশকের শেষপ্রান্তে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য বৃটিশ সরকার কালাকানুন প্রবর্তন করে। পেনাল কোডের ১৫৩ (ক) ধারায় বলা হয়, ‘যে ব্যক্তি কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর সাহায্যে বা সংকেতাদি, বা দৃশ্যমান কলামূর্তির সাহায্যে, বা প্রকারান্তরে জনগণের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণার ভাব সৃষ্টি করে, বা সৃষ্টির উদ্যোগ করে, সেই ব্যক্তি কারাদন্ডে যাহার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হইবে।’

সংবাদপত্রের জন্মলগ্ন থেকে শাসকসমাজের অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। অখন্ড ভারতবাসীর মনে যখন স্বাধীনতার চেতনা উজ্জীবিত হয়ে চরম আকার ধারণ করছে সে সময় বৃটিশ বিরোধী প্রকাশনার দায়ে অনেককেই নির্যাতিত হতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদধন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ধুমকেতুতে ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় জ্বালাময়ী কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে। কবি লিখলেন:

‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল,

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।

দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’

টলে উঠলো বৃটিশ শাসকদের গদি। ৮ নভেম্বর পত্রিকাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। নজরুলকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। কবি বললেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধুমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নিমশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে।

ঔপনিবেশিক বাংলায় সংবাদপত্র তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কুষ্টিয়ার জাগরণ পত্রিকা, নোয়াখালীর দেশের বাণী পত্রিকা, বরিশালের হিতৈষী এবং চট্টগ্রামের পাঞ্চজন্য পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে শাসকদের অত্যাচারের শিকার হয়েছে।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলা সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সে সময় রুশ বিপ্লবের সাফল্যের খবর পেয়ে এ দেশের মানুষও মাথা তুলে দাঁড়ায়। শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে জনচেতনায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে সৃষ্টি হয় নতুন আবহ।

এর পর ত্রিশের দশকে যখন সারা দেশ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, সে সময় বাংলাদেশের বিপ্লবীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মহান বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংঘটিত হলো চট্টগ্রাম সশস্ত্র বিপ্লব ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবীরা দখল করে নিলেন জেলার শক্তিকেন্দ্র পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার। একই সাথে জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হলো পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালের আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলো সেই সংবাদ:

‘গতকাল রাত্রি ১১ টার সময় বিপ্লবী বলিয়া বর্ণিত একদল লোক পাহাড়তলী ইনস্টিটিউট নামক আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ইয়োরোপীয়ান ক্লাবে অতিশয় দুঃসাহসিকভাবে ইউরোপীয়ানদেও উপর আক্রমণ করে। আক্রমণকারীর দলে পুরুষের বেশে সজ্জিত একজন নারীও ছিল।’

সংবাদে বর্ণিত এই নারী ছিলেন চট্টগ্রামের বীরকন্যা কুমারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। এই বিপ্লবে তিনি শহীদ হন।

বহু জীবন আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে ভারতভূমি দ্বিখন্ডিত হয়ে বৃটিশ শাসকদের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হলো। পূর্ব বাংলার জন্য সে মুক্তি ছিল এক অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে অন্য এক অত্যাচারীর হাতে পড়া। সে সময় এই বাংলার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যে সব সংবাদপত্র সোচ্চার হয়েছে, তাকেই পশ্চিমা শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। বিরোধী দলীয় পত্রিকার ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তা আইনে সরকার অবজারভারের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অবজারভার সাহসী ভূমিকা পালন করে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেই অবজারভার পত্রিকার ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সময় পত্রিকাটি শাসকদলের তাঁবেদারিতে লিপ্ত ছিল।

১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের জন্ম। সে সময় এই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বর্ষীয়ান জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে এই পত্রিকাটি দৈনিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কালক্রমে এই পত্রিকাটি পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যেকার বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ জানায়। ইত্তেফাক ষাটের দশকে আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারি এবং মৌলিক গণতন্ত্র সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৬২, ৬৪ এবং ৬৯-এ যথাক্রমে ছাত্র আন্দোলন, দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা কর্মসূচি এবং গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে সরকারের রোষানলে পড়ে এবং এর প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়।

আইয়ুব শাসনামলে পূর্ববাংলায় যাতে রবীন্দ্রনাথের কোন সাহিত্য বা সঙ্গীত প্রচার করা না হয় সেই প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ সময় বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার প্রতিবাদে এ দেশের সংবাদপত্রসমূহ এবং সুধীমন্ডলী যথাযথ ভূমিকা পালন করে।

দেশের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামেও এ দেশের অনেক সংবাদপত্র তাদের সাহসী ভূমিকা পালন করে। এই নির্ভীক সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য ‘সংবাদ’ পত্রিকাটিকে চরম মূল্য দিতে হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদাররা সংবাদ পত্রিকা অফিস এবং প্রেস পুড়িয়ে দেয়।

সাহসী সাংবাদিকতার ধারা আজও এদেশে অব্যাহত আছে। এই ধারা এ দেশের আপামর জনগণের মধ্যে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে যাবে এই হোক আমাদের আশা।

image

শিল্পী : সমর মজুমদার

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা

আবদুল লতিফ

image

শিল্পী : সমর মজুমদার

টমাস জেফারসন্স বলেছিলেন, “যদি আমাকে কোন সংবাদপত্রবিহীন সরকার অথবা সরকারবিহীন সংবাদপত্র এর মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলা হয় তবে আমি বিনা বাক্যব্যয়ে শেষোক্তটিকেই পছন্দ করতে এক মুহূর্ত দেরি করবো না।”

জেফারসন্সের মানসপটে যে সংবাদপত্রের কথা ভেসে উঠেছিল তা নিশ্চয়ই কোন স্বাভাবিক কণ্ঠরোধ করা শেখানো বুলির রোবট সংবাদপত্র নয়। তবু মানবজাতির ইতিহাসে দেশে বিদেশে বারে বারে সেই আঘাতটাই এসেছে। সংবাদপত্র একটা জাতির আয়না। সেখানে প্রতিফলিত হয় সেই জাতির সমাজ জীবনের সঠিক চিত্র। একই সাথে ঘরে বসে বর্তমান ঘটনা, তথ্যপূর্ণ নিবন্ধ ও বিভিন্ন ফিচারের মাধ্যমে আমরা সারা পৃথিবীর কাছে আসি। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ যে সংবাদপত্র আমাদের হাতে এসেছে, বিভিন্ন সময়ে তার রূপবদল হয়েছে। প্রাচীন রোমে ‘অ্যাক্টা দিউরমা’ বা সরকারের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হতো। এই ঘোষণাপত্র ধাতু বা পাথরে খোদাই করে জনবহুল স্থানে টাঙিয়ে রাখা হতো। এছাড়া চীনে অষ্টম শতাব্দিতে ‘কাইয়ূয়ান ঝা আবাও’ নামে এক রাজকীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করা হতো বলে জানা যায়। ১৫৬৬ সালে ভেনিসে হাতে লেখা সংবাদ প্রচার করা হতো। ১৬০৯ সালে জার্মানি থেকে প্রথম যে ছাপা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো তার নাম ‘রিলেশন’। ১৬২০ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র বের হয় আমস্টার্ডাম থেকে।

মধ্যযুগের ভারতে সংবাদপত্রের দেখা মেলে। তখনকার সংবাদপত্র ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হতো না। হাতে লেখা এই সংবাদপত্র সাধারণের জন্য লেখা হতো না। এসব সংবাদের সবটুকুই ছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনে এবং দেশের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীর কাছে এসব সংবাদ পৌঁছে দেয়া হতো। এসব সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্ব একটি আলাদা বিভাগের ওপর ন্যস্ত ছিল। মোঘল আমলে বাবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত সব সম্রাটরা সংবাদপত্র পাঠ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবনাবসান হলে তাঁর পীড়া ও মৃত্যুর খবর দিল্লির ‘পয়গাম এ হিন্দ’ নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এসব সংবাদপত্র মুষ্টিমেয় রাজাবাদশাহ এবং রাজকর্মচারীদের জন্য প্রকাশিত হতো। অখন্ড ভারতবর্ষে প্রকৃত অর্থে সংবাদপত্রের সূচনা হয় কোলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের হাতে। বেঙ্গল গেজেট নামে দু’পাতার সাপ্তাহিক ইংরেজি পত্রিকার প্রকাশনার মাধ্যমে। ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন জেমস অগাস্টাস হিকি নামক এক ইউরোপিয়ান। তাঁর হাত ধরেই এ দেশের মুদ্রিত সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা। বেঙ্গল গেজেট প্রতি শনিবারে প্রকাশিত হতো। কিন্তু এই পত্রিকায় ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর পতœী ও ইংরেজ বিচারকদের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশের দরুন অল্পদিনের মধ্যেই এই পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করা হয়।

১৮১৮ সালের প্রথমার্ধে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। তাঁকে সহায়তা করেন রাজা রামমোহন রায়। আর সেই বছরেই ২৩ মে অর্থাৎ বেঙ্গল গেজেট প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীদের উদ্যোগে মার্শম্যান প্রকাশ করেন দিগদর্শন। এর এক মাস পরেই মার্শম্যান ও কেরি সাহেব আরো একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল সমাচার দর্পণ। বাংলা এবং বাঙালির কাছে প্রথম যে পত্রিকাটি সাদরে গৃহীত হয় তার নাম প্রভাকর। ১৮৩১ সালে এই পত্রিকা প্রকাশ করেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। প্রভাকর সম্পর্কে কবি বলেছিলেন,

‘কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত, ব্যাপ্ত চরাচর,

তাঁহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।’

চরণ দু’টির দ্ব্যর্থ অর্থ বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রভাকর প্রকাশের ফলে বাংলা পত্রিকায় এক নতুন ধারার প্রবর্তন হয়। পত্রিকাটিতে সাহিত্যকর্ম প্রকাশের সাথে সাথে বাংলা গদ্যরীতিতে বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয় এবং নতুন লেখকদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

১৮৫৭ সালে এ দেশের ইতিহাসে সিপাহি বিদ্রোহের মতো এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল। এই ঘটনা বাংলা সাময়িকপত্রে বিপুল প্রভাব ফেলে। এর আগের পত্রপত্রিকাগুলোতে বাংলা সংবাদপত্রে রাজনৈতিক বা সামাজিক নিবন্ধ প্রচারিত হতো না। ১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হতে থাকে সোমপ্রকাশ। এই পত্রিকাই প্রথম রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করে। তখন থেকে বাঙালি সমাজে দ্রুত রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারিত হয়।

১৮৪৭ সালে পূর্ববাংলায় রঙ্গপুর বার্তাবহ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংবাদপত্রটিকে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র বলা চলে। তবে এ সময় পূর্ববঙ্গে পত্রিকার সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। কারণ পত্রিকা প্রকাশের জন্য আনুষঙ্গিক অবকাঠামো যেমন প্রেস, কম্পোজিটর, সংবাদ সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির অভাব ছিল। ফলে একদিকে যেমন অধিক পত্রিকার প্রকাশ ঘটেনি, অন্যদিকে প্রকাশিত পত্রিকাসমূহ স্থায়িত্ব পায়নি। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলাযন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মুদ্রণালয় বা প্রেস থেকে ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসে কবি হরিশচন্দ্র মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ঢাকা দর্পণ। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভাতৃদ্বয় যশোরের ক্ষুদ্র গ্রাম ফুলুয়া মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন।

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ ও মহারাষ্ট্রে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের বিপ্লবাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে। এই দশকের শেষপ্রান্তে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য বৃটিশ সরকার কালাকানুন প্রবর্তন করে। পেনাল কোডের ১৫৩ (ক) ধারায় বলা হয়, ‘যে ব্যক্তি কথিত বা লিখিত শব্দাবলীর সাহায্যে বা সংকেতাদি, বা দৃশ্যমান কলামূর্তির সাহায্যে, বা প্রকারান্তরে জনগণের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণার ভাব সৃষ্টি করে, বা সৃষ্টির উদ্যোগ করে, সেই ব্যক্তি কারাদন্ডে যাহার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হইবে।’

সংবাদপত্রের জন্মলগ্ন থেকে শাসকসমাজের অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। অখন্ড ভারতবাসীর মনে যখন স্বাধীনতার চেতনা উজ্জীবিত হয়ে চরম আকার ধারণ করছে সে সময় বৃটিশ বিরোধী প্রকাশনার দায়ে অনেককেই নির্যাতিত হতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদধন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ধুমকেতুতে ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় জ্বালাময়ী কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে। কবি লিখলেন:

‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল,

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।

দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’

টলে উঠলো বৃটিশ শাসকদের গদি। ৮ নভেম্বর পত্রিকাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। নজরুলকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। কবি বললেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধুমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নিমশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে।

ঔপনিবেশিক বাংলায় সংবাদপত্র তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। কুষ্টিয়ার জাগরণ পত্রিকা, নোয়াখালীর দেশের বাণী পত্রিকা, বরিশালের হিতৈষী এবং চট্টগ্রামের পাঞ্চজন্য পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে শাসকদের অত্যাচারের শিকার হয়েছে।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বাংলা সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সে সময় রুশ বিপ্লবের সাফল্যের খবর পেয়ে এ দেশের মানুষও মাথা তুলে দাঁড়ায়। শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়ে জনচেতনায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে সৃষ্টি হয় নতুন আবহ।

এর পর ত্রিশের দশকে যখন সারা দেশ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, সে সময় বাংলাদেশের বিপ্লবীদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মহান বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংঘটিত হলো চট্টগ্রাম সশস্ত্র বিপ্লব ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবীরা দখল করে নিলেন জেলার শক্তিকেন্দ্র পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার। একই সাথে জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হলো পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালের আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলো সেই সংবাদ:

‘গতকাল রাত্রি ১১ টার সময় বিপ্লবী বলিয়া বর্ণিত একদল লোক পাহাড়তলী ইনস্টিটিউট নামক আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ইয়োরোপীয়ান ক্লাবে অতিশয় দুঃসাহসিকভাবে ইউরোপীয়ানদেও উপর আক্রমণ করে। আক্রমণকারীর দলে পুরুষের বেশে সজ্জিত একজন নারীও ছিল।’

সংবাদে বর্ণিত এই নারী ছিলেন চট্টগ্রামের বীরকন্যা কুমারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। এই বিপ্লবে তিনি শহীদ হন।

বহু জীবন আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালে ভারতভূমি দ্বিখন্ডিত হয়ে বৃটিশ শাসকদের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হলো। পূর্ব বাংলার জন্য সে মুক্তি ছিল এক অত্যাচারী শাসকের হাত থেকে অন্য এক অত্যাচারীর হাতে পড়া। সে সময় এই বাংলার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যে সব সংবাদপত্র সোচ্চার হয়েছে, তাকেই পশ্চিমা শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। বিরোধী দলীয় পত্রিকার ভূমিকা পালনের জন্য ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তা আইনে সরকার অবজারভারের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে অবজারভার সাহসী ভূমিকা পালন করে। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেই অবজারভার পত্রিকার ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। সে সময় পত্রিকাটি শাসকদলের তাঁবেদারিতে লিপ্ত ছিল।

১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের জন্ম। সে সময় এই পত্রিকা সম্পাদনা করতেন বর্ষীয়ান জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে এই পত্রিকাটি দৈনিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কালক্রমে এই পত্রিকাটি পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যেকার বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদ জানায়। ইত্তেফাক ষাটের দশকে আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারি এবং মৌলিক গণতন্ত্র সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৬২, ৬৪ এবং ৬৯-এ যথাক্রমে ছাত্র আন্দোলন, দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা কর্মসূচি এবং গণআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার কারণে সরকারের রোষানলে পড়ে এবং এর প্রকাশনা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়।

আইয়ুব শাসনামলে পূর্ববাংলায় যাতে রবীন্দ্রনাথের কোন সাহিত্য বা সঙ্গীত প্রচার করা না হয় সেই প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ সময় বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার প্রতিবাদে এ দেশের সংবাদপত্রসমূহ এবং সুধীমন্ডলী যথাযথ ভূমিকা পালন করে।

দেশের গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামেও এ দেশের অনেক সংবাদপত্র তাদের সাহসী ভূমিকা পালন করে। এই নির্ভীক সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য ‘সংবাদ’ পত্রিকাটিকে চরম মূল্য দিতে হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদাররা সংবাদ পত্রিকা অফিস এবং প্রেস পুড়িয়ে দেয়।

সাহসী সাংবাদিকতার ধারা আজও এদেশে অব্যাহত আছে। এই ধারা এ দেশের আপামর জনগণের মধ্যে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে যাবে এই হোক আমাদের আশা।