ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ

কাশেম হুমায়ূন

ছোটবেলা থেকে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার জের ধরে লেখালেখির জগতে হাঁটাচলা। সেটিও হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার কমিটমেন্ট থেকে। এর রেশ ধরেই সাংবাদিকতায় এবং সংবাদ-এ অভিষেক। স্বাধীনতার পর নতুন মেরুকরণে পুনঃপ্রকাশের পর বাহাত্তর থেকে সম্পৃক্ত হই সংবাদ-এ।

এখন টানা ৬৮ বছর শেষে ৬৯তে পদার্পণের স্মারকে এসে দাঁড়িয়েছে আদর্শবাদী সাংবাদিকতার মুখপত্র দৈনিক সংবাদ। ১৯৫৪’র ১৭মে প্রকাশিত এ দৈনিকটি এখনও তার আদর্শে বলীয়ান। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝায় পড়েছে সংবাদ। কিন্তু কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। আদর্শচ্যুত হয়ে চাকচিক্যনির্ভর হয়ে পাঠকদের সঙ্গে প্রতারণাও করেনি। এমনকি ঝুঁকে পড়েনি আজকের কর্পোরেট হাউসের ধারায়। সংবাদ বরাবরই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে সত্যতা, সততা এবং ন্যায়-নীতি প্রগতির বৈশিষ্ট্যটিকে।

ব্যতিক্রমী ইতিহাস হলো সংবাদের জন্ম হয়েছিল মুসলিম লীগ ঘরানায়; কিন্তু এতে কাজ করতেন প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাচেতনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংবাদকর্মীরা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভূমিধস ভরাডুবির জেরে পরিবর্তন আসে সংবাদের মালিকানায়ও। অর্থনৈতিকভাবেও পেরে উঠছিলেন না তখনকার সম্পাদক খায়রুল কবির। অর্থনৈতিক সংকটে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। এতে পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে তিনি এর দায়িত্ব দেন তার অনুজ আহমদুল কবিরকে।

আহমদুল কবির দায়িত্ব নেয়ার পর সংবাদ পায় নতুন স্পন্দন। সংবাদ এ সময় প্রকাশ্য সমর্থন জোগায় বাম ও প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিকে। এতে একদিকে সংবাদ হয় আরো গণমুখী, অন্যদিকে প্রতিকূলতা আরো বাড়ে। এতে কাবু না হয়ে আহমদুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সৈয়দ নুরুদ্দীন, শহীদুল্লা কায়সার, বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, মকবুলার রহমান অবতীর্ণ হন আরও সাহসী ভূমিকায়। স্বৈরাচারী সেনা শাসক আইয়ুব খানের রক্তচক্ষুতে পড়েন তারা। এর জেরে কারাভোগও করতে হয়েছে আহমদুল কবিরসহ তাদের অনেকেরই।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বেও পাক হানাদাদের টার্গেটে পড়ে সংবাদ। ২৬৩ বংশাল রোডের সংবাদ অফিসটি পুড়িয়ে দেয় তারা। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান সংবাদকর্মী শহীদ সাবের। সংবাদের সাংবাদিকদের অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর রাজাকারদের হাতে শহীদ হন সংবাদের বার্তা সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মোশতাক-জিয়ার পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে সংবাদ ইস্পাত কঠিন শক্ত অবস্থান নেয়। তোলপাড় সৃষ্টি করে জহুর হোসেন চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, সন্তোষ গুপ্ত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তোয়াব খান, এবিএম মূসা, বজলুর রহমানের তেজস্বী লেখনী। বিরাশিতে সামরিক শাসন জারি করে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধেও সংবাদ তার অঙ্গীকার অনুযায়ী ভূমিকা রাখে। এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলেও বেশ কবার আঘাত আসে সংবাদের ওপর।

সংবাদ অফিস তখন ২৬৩ বংশালে। পত্রিকাটির নয়া অভিযাত্রার ঊষালগ্নে ১৯৭২ সালের পহেলা জুন আমার সাংবাদিকতায় অভিষেক। সেই অভিষেকটা ঘটে তখনকার চিফ রিপোর্টার মজিবুর রহমান বাদলের হাত ধরে। আমি তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ৩ মাস ট্রায়ালের পর বেতন ধরা হয় ১৭৫ টাকা। আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন সম্পাদক আহমদুল কবির। তাঁর সামনে ও আশপাশে বসা ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত, রণেশ দাশগুপ্ত, হাসান আলী ও বাদল ভাই। আহমদুল কবির সমসাময়িক বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। তিনিসহ সবাই আমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়। শুরু থেকেই সিনিয়ররা আমাকে বেশ উৎসাহ জোগাতে থাকেন। তখন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, চিফ রিপোর্টার বাদল ভাই ছাড়াও হাসান আলী, তোজাম্মেল আলী তোজা ভাই, শহীদুল ইসলাম, আবু আল সাঈদ, বেবী মওদুদ, মহসীন খায়রুল আনাম, রশিদ তালুকদার, মোজাম্মেল হোসেন মন্টু প্রমুখের কথা বেশ মনে পড়ে। একদিকে তাদের স্নেহ, আরেক দিকে উৎসাহ-অভিভাবকত্ব।

শিক্ষা ও মেধা, রাজনীতি, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়েই তাঁরা ছিলেন দক্ষ-অভিজ্ঞ। আহমদুল কবির আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ২০০১ সালে হন প্রধান সম্পাদক এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংবাদিকতা অঙ্গনের এ মানুষটিকে সম্পাদক হিসেবে পাওয়া আমাদের সৌভাগ্য। তাঁর বড় ছেলে আলতামাশ কবির বর্তমান সম্পাদক।

অভিভাবকত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পুরোধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলু ভাইয়ের নাম। তাঁর মতো একজন অভিভাবক পাওয়া আমার জীবনে আরেকটি পাওয়া। একজন মানুষের একসঙ্গে কত গুণ থাকতে পারে ভাবতে অবাক লাগে। আমি তাঁকে শুরুতে পেয়েছি সংবাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে। তিনি ১৯৬১ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে সংবাদ-এ যোগদান করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। আমৃত্যু তিনি সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বজলুর রহমান সাবেক সফল কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর স্বামী।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এসে সংবাদ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও স্মরণ করতে হয়। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘জিন্দেগী’ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৫০ সালে শুরু হয় ‘সংবাদ’-এর জন্ম প্রক্রিয়া। পরের বছর ২৬৩, বংশাল রোডের একটি পুরনো দ্বিতল বাড়ি থেকে পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে ১৭ মে ১৯৫১ সালে। বংশাল রোডের ছোট্ট পরিসরই তখন এ অঞ্চলে বৈশ্বিক চিন্তা-চেতনায় উৎসবমুখর আস্তানা। এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন খায়রুল কবির। আর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নাসির উদ্দিন আহমেদ। খায়রুল কবির তখন যুক্ত ছিলেন বার্তা সংস্থা এপিপির সাথে। পরে দীর্ঘদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন জহুর হোসেন চৌধুরী, আহমদুল কবির, বজলুর রহমান প্রমুখ।

ঢাকা ও কলকাতার বাংলা সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে সংবাদই সম্ভবত সর্বপ্রথম একজন নারী সাংবাদিক নিয়োগ করে। তিনি লায়লা সামাদ। নারী ছাড়াও শিশু-কিশোরদের জন্য আয়োজনের দিক থেকেও সংবাদই পথদ্রষ্টা। এছাড়া, খেলাঘর নামক শিশুদের বিখ্যাত আসর আজও সংবাদ থেকে প্রকাশিত হয়। সংবাদের সাহিত্য পাতাও দেশের সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় প্রশংসিত। আজকের নামকরা কবি ও সাহিত্যিক এবং সাংবাদিকদের অনেকেই সংবাদ-এর সৃষ্টি। সাংবাদিক হিসেবে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠাও এই সংবাদেই। দেশ স্বাধীনের পর সংবাদের নয়া অভিযাত্রার ঊষালগ্নে ১৯৭২ সালের পহেলা জুন আমার সাংবাদিকতায় অভিষেক। রয়েছি এখনো।

সংবাদ আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হয়নি। সংবাদ-এর আছে ঐতিহ্য ও কমিটমেন্ট। যে ঐতিহ্য ও কমিটমেন্ট থেকে সংবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা আজো সংবাদকর্মীরা ধরে রেখেছেন। সংবাদ-এর আধুনিক চাকচিক্য না থাকলেও পাঠকের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে।

সংবাদকে ঐতিহ্য, যশ, খ্যাতির শিখরে নিয়ে যাওয়া অগ্রজদের অন্যতম একজন ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী। বিভিন্ন সময়ে সংবাদ-এ গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ’৭৭ থেকে ’৭৯ পর্যন্ত তার দরবার-এ-জহুর কলামটি পাঠকদের বেশ আলোড়িত করে। সাংবাদিকতায় আসার আগে-পরে তার নাম ও খ্যাতি বহু শুনেছি। এ কারণে তিনি সংবাদ-এ এলে তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতাম। বাংলাকে সহজ ও সাবলীল করার এক অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল জহুর হোসেন চৌধুরীর। সহকর্মী এবং জুনিয়রদের শেখানোর মানসিকতাও ছিল। এমন আরেকজন প্রথিতযশা সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সংবাদ-এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সহকর্মীদের যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত খুব কম। ’৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংবাদ-এ পেয়েছি কেজি মুস্তাফা, আউয়াল খান, এবিএম মূসা, তোহা খান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, জীবন চৌধুরী, মোজাম্মেল হোসেন মন্টু, আতাউর রহমান, সৈয়দ নুরুদ্দীন, মতিউর রহমান চৌধুরী, আশরাফ খান, আবুল হাসনাত, জাফর ওয়াজেদ, বশির আহমদ, প্রফুল্ল কুমার ভক্ত, রেজোয়ানুল হক রাজা, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, আমির খসরু, জগলুল আহমদ, খন্দকার মুনীরুজ্জামান, সালাম জুবায়ের, সাইফুল আমীন, মোতাহের হোসেন মাসুম, শওকত মাহমুদ, সোহরাব হাসান, মনজুরুল আহসান বুলবুল, হারুনুর রশীদসহ অনেককে। সংবাদ-এ অগ্রজরা যেভাবে অনুজদের সহযোগিতা দিয়েছেন তা বিরল।

প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা, দেশপ্রেম ও প্রবহমান রাজনীতির ভাষ্যচিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সংবাদ শুধু একটি সত্যনিষ্ঠ পত্রিকা ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার বাহন নয়, এ দেশের শ্রেষ্ঠ লেখক, সৎ সাংবাদিক, চিৎপ্রকর্ষবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তৈরিরও পাদপীঠ এই সংবাদ। সেইসাথে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, ধর্মান্ধতা, অপসংস্কৃতি এবং অগণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে জ্বলন্ত মশাল।

আশা করি সংবাদ ১০০ বছর পার করতে পারবে।

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ

কাশেম হুমায়ূন

image

ছোটবেলা থেকে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার জের ধরে লেখালেখির জগতে হাঁটাচলা। সেটিও হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার কমিটমেন্ট থেকে। এর রেশ ধরেই সাংবাদিকতায় এবং সংবাদ-এ অভিষেক। স্বাধীনতার পর নতুন মেরুকরণে পুনঃপ্রকাশের পর বাহাত্তর থেকে সম্পৃক্ত হই সংবাদ-এ।

এখন টানা ৬৮ বছর শেষে ৬৯তে পদার্পণের স্মারকে এসে দাঁড়িয়েছে আদর্শবাদী সাংবাদিকতার মুখপত্র দৈনিক সংবাদ। ১৯৫৪’র ১৭মে প্রকাশিত এ দৈনিকটি এখনও তার আদর্শে বলীয়ান। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝায় পড়েছে সংবাদ। কিন্তু কখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। আদর্শচ্যুত হয়ে চাকচিক্যনির্ভর হয়ে পাঠকদের সঙ্গে প্রতারণাও করেনি। এমনকি ঝুঁকে পড়েনি আজকের কর্পোরেট হাউসের ধারায়। সংবাদ বরাবরই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে সত্যতা, সততা এবং ন্যায়-নীতি প্রগতির বৈশিষ্ট্যটিকে।

ব্যতিক্রমী ইতিহাস হলো সংবাদের জন্ম হয়েছিল মুসলিম লীগ ঘরানায়; কিন্তু এতে কাজ করতেন প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাচেতনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংবাদকর্মীরা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভূমিধস ভরাডুবির জেরে পরিবর্তন আসে সংবাদের মালিকানায়ও। অর্থনৈতিকভাবেও পেরে উঠছিলেন না তখনকার সম্পাদক খায়রুল কবির। অর্থনৈতিক সংকটে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। এতে পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে তিনি এর দায়িত্ব দেন তার অনুজ আহমদুল কবিরকে।

আহমদুল কবির দায়িত্ব নেয়ার পর সংবাদ পায় নতুন স্পন্দন। সংবাদ এ সময় প্রকাশ্য সমর্থন জোগায় বাম ও প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিকে। এতে একদিকে সংবাদ হয় আরো গণমুখী, অন্যদিকে প্রতিকূলতা আরো বাড়ে। এতে কাবু না হয়ে আহমদুল কবির, জহুর হোসেন চৌধুরী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সৈয়দ নুরুদ্দীন, শহীদুল্লা কায়সার, বজলুর রহমান, সন্তোষ গুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, মকবুলার রহমান অবতীর্ণ হন আরও সাহসী ভূমিকায়। স্বৈরাচারী সেনা শাসক আইয়ুব খানের রক্তচক্ষুতে পড়েন তারা। এর জেরে কারাভোগও করতে হয়েছে আহমদুল কবিরসহ তাদের অনেকেরই।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বেও পাক হানাদাদের টার্গেটে পড়ে সংবাদ। ২৬৩ বংশাল রোডের সংবাদ অফিসটি পুড়িয়ে দেয় তারা। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান সংবাদকর্মী শহীদ সাবের। সংবাদের সাংবাদিকদের অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর রাজাকারদের হাতে শহীদ হন সংবাদের বার্তা সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর মোশতাক-জিয়ার পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে সংবাদ ইস্পাত কঠিন শক্ত অবস্থান নেয়। তোলপাড় সৃষ্টি করে জহুর হোসেন চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, সন্তোষ গুপ্ত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, তোয়াব খান, এবিএম মূসা, বজলুর রহমানের তেজস্বী লেখনী। বিরাশিতে সামরিক শাসন জারি করে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধেও সংবাদ তার অঙ্গীকার অনুযায়ী ভূমিকা রাখে। এরশাদের ৯ বছরের শাসনামলেও বেশ কবার আঘাত আসে সংবাদের ওপর।

সংবাদ অফিস তখন ২৬৩ বংশালে। পত্রিকাটির নয়া অভিযাত্রার ঊষালগ্নে ১৯৭২ সালের পহেলা জুন আমার সাংবাদিকতায় অভিষেক। সেই অভিষেকটা ঘটে তখনকার চিফ রিপোর্টার মজিবুর রহমান বাদলের হাত ধরে। আমি তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ৩ মাস ট্রায়ালের পর বেতন ধরা হয় ১৭৫ টাকা। আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন সম্পাদক আহমদুল কবির। তাঁর সামনে ও আশপাশে বসা ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত, রণেশ দাশগুপ্ত, হাসান আলী ও বাদল ভাই। আহমদুল কবির সমসাময়িক বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করেন। তিনিসহ সবাই আমার জবাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়। শুরু থেকেই সিনিয়ররা আমাকে বেশ উৎসাহ জোগাতে থাকেন। তখন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, চিফ রিপোর্টার বাদল ভাই ছাড়াও হাসান আলী, তোজাম্মেল আলী তোজা ভাই, শহীদুল ইসলাম, আবু আল সাঈদ, বেবী মওদুদ, মহসীন খায়রুল আনাম, রশিদ তালুকদার, মোজাম্মেল হোসেন মন্টু প্রমুখের কথা বেশ মনে পড়ে। একদিকে তাদের স্নেহ, আরেক দিকে উৎসাহ-অভিভাবকত্ব।

শিক্ষা ও মেধা, রাজনীতি, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়েই তাঁরা ছিলেন দক্ষ-অভিজ্ঞ। আহমদুল কবির আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ২০০১ সালে হন প্রধান সম্পাদক এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংবাদিকতা অঙ্গনের এ মানুষটিকে সম্পাদক হিসেবে পাওয়া আমাদের সৌভাগ্য। তাঁর বড় ছেলে আলতামাশ কবির বর্তমান সম্পাদক।

অভিভাবকত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম পুরোধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলু ভাইয়ের নাম। তাঁর মতো একজন অভিভাবক পাওয়া আমার জীবনে আরেকটি পাওয়া। একজন মানুষের একসঙ্গে কত গুণ থাকতে পারে ভাবতে অবাক লাগে। আমি তাঁকে শুরুতে পেয়েছি সংবাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে। তিনি ১৯৬১ সালে সহকারী সম্পাদক হিসেবে সংবাদ-এ যোগদান করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। আমৃত্যু তিনি সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বজলুর রহমান সাবেক সফল কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর স্বামী।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এসে সংবাদ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও স্মরণ করতে হয়। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘জিন্দেগী’ পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৫০ সালে শুরু হয় ‘সংবাদ’-এর জন্ম প্রক্রিয়া। পরের বছর ২৬৩, বংশাল রোডের একটি পুরনো দ্বিতল বাড়ি থেকে পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে ১৭ মে ১৯৫১ সালে। বংশাল রোডের ছোট্ট পরিসরই তখন এ অঞ্চলে বৈশ্বিক চিন্তা-চেতনায় উৎসবমুখর আস্তানা। এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন খায়রুল কবির। আর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নাসির উদ্দিন আহমেদ। খায়রুল কবির তখন যুক্ত ছিলেন বার্তা সংস্থা এপিপির সাথে। পরে দীর্ঘদিন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন জহুর হোসেন চৌধুরী, আহমদুল কবির, বজলুর রহমান প্রমুখ।

ঢাকা ও কলকাতার বাংলা সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে সংবাদই সম্ভবত সর্বপ্রথম একজন নারী সাংবাদিক নিয়োগ করে। তিনি লায়লা সামাদ। নারী ছাড়াও শিশু-কিশোরদের জন্য আয়োজনের দিক থেকেও সংবাদই পথদ্রষ্টা। এছাড়া, খেলাঘর নামক শিশুদের বিখ্যাত আসর আজও সংবাদ থেকে প্রকাশিত হয়। সংবাদের সাহিত্য পাতাও দেশের সাহিত্যচর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় প্রশংসিত। আজকের নামকরা কবি ও সাহিত্যিক এবং সাংবাদিকদের অনেকেই সংবাদ-এর সৃষ্টি। সাংবাদিক হিসেবে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠাও এই সংবাদেই। দেশ স্বাধীনের পর সংবাদের নয়া অভিযাত্রার ঊষালগ্নে ১৯৭২ সালের পহেলা জুন আমার সাংবাদিকতায় অভিষেক। রয়েছি এখনো।

সংবাদ আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হয়নি। সংবাদ-এর আছে ঐতিহ্য ও কমিটমেন্ট। যে ঐতিহ্য ও কমিটমেন্ট থেকে সংবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা আজো সংবাদকর্মীরা ধরে রেখেছেন। সংবাদ-এর আধুনিক চাকচিক্য না থাকলেও পাঠকের চাহিদা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে।

সংবাদকে ঐতিহ্য, যশ, খ্যাতির শিখরে নিয়ে যাওয়া অগ্রজদের অন্যতম একজন ছিলেন জহুর হোসেন চৌধুরী। বিভিন্ন সময়ে সংবাদ-এ গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ’৭৭ থেকে ’৭৯ পর্যন্ত তার দরবার-এ-জহুর কলামটি পাঠকদের বেশ আলোড়িত করে। সাংবাদিকতায় আসার আগে-পরে তার নাম ও খ্যাতি বহু শুনেছি। এ কারণে তিনি সংবাদ-এ এলে তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতাম। বাংলাকে সহজ ও সাবলীল করার এক অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল জহুর হোসেন চৌধুরীর। সহকর্মী এবং জুনিয়রদের শেখানোর মানসিকতাও ছিল। এমন আরেকজন প্রথিতযশা সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সংবাদ-এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সহকর্মীদের যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তিনি অর্জন করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত খুব কম। ’৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সংবাদ-এ পেয়েছি কেজি মুস্তাফা, আউয়াল খান, এবিএম মূসা, তোহা খান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, জীবন চৌধুরী, মোজাম্মেল হোসেন মন্টু, আতাউর রহমান, সৈয়দ নুরুদ্দীন, মতিউর রহমান চৌধুরী, আশরাফ খান, আবুল হাসনাত, জাফর ওয়াজেদ, বশির আহমদ, প্রফুল্ল কুমার ভক্ত, রেজোয়ানুল হক রাজা, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, আমির খসরু, জগলুল আহমদ, খন্দকার মুনীরুজ্জামান, সালাম জুবায়ের, সাইফুল আমীন, মোতাহের হোসেন মাসুম, শওকত মাহমুদ, সোহরাব হাসান, মনজুরুল আহসান বুলবুল, হারুনুর রশীদসহ অনেককে। সংবাদ-এ অগ্রজরা যেভাবে অনুজদের সহযোগিতা দিয়েছেন তা বিরল।

প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা, দেশপ্রেম ও প্রবহমান রাজনীতির ভাষ্যচিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সংবাদ শুধু একটি সত্যনিষ্ঠ পত্রিকা ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার বাহন নয়, এ দেশের শ্রেষ্ঠ লেখক, সৎ সাংবাদিক, চিৎপ্রকর্ষবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তৈরিরও পাদপীঠ এই সংবাদ। সেইসাথে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, ধর্মান্ধতা, অপসংস্কৃতি এবং অগণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে জ্বলন্ত মশাল।

আশা করি সংবাদ ১০০ বছর পার করতে পারবে।