সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার

অসীম সাহা

কবে থেকে ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকা পড়তে শুরু করেছিলাম ঠিক মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে, তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। কিন্তু অন্য কোনও পত্রিকা তেমনভাবে নয়, যেমনভাবে সংবাদ ছিলো আমাদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। এর কারণ দুটি। এক. সংবাদ ছিল তখনকার বামঘরানা ও প্রগতিশীল মানুষদের মুখপত্র। দুই. ঐ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘খেলাঘর’ ছিল আমাদের জন্য নিশ্বাস নেবার ঘর। তখন দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক আজাদ ছিল প্রধানতম পত্রিকা! তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ছিল গণতান্ত্রিক ধারার মানুষদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পত্রিকা; আর যারা ইসলামধর্মের অনুসারী, তাদের কাছে মৌলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত ‘দৈনিক আজাদ’ই ছিল আদর্শ পত্রিকা। অন্যদিকে জহুর হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক সংবাদ ছিল বামপন্থি রাজনীতিক নেতা, কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রাণের পত্রিকা।

এখনকার মতো তখন অনেক দৈনিক পত্রিকা ছিল না। তাই পত্রিকা বাছাই করতে কারোরই বেগ পেতে হয়নি। সংবাদের মালিক ছিলেন শিল্পপতি আহমদুল কবির। তিনি নিজে রাজনৈতিক দল ন্যাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে পত্রিকাটিতে এমন সব মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন, যারা সরাসরি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখ তো সংবাদে চাকরি করতেন। পরবর্তী সময়ে সন্তোষ গুপ্ত এসে সংবাদে যোগদান করেন। সঙ্গে ছিলেন বজলুর রহমান, যিনি ‘খেলাঘর’ পাতাটি দেখতেন। তিনি সকলের কাছে ‘ভাইয়া’ নামে পরিচিত ছিলেন। এদের চিনত না, এমন শিক্ষিত মানুষ সে-সময়ে ছিল বিরল। সে-কারণে কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা সংবাদকে নিজেদের পত্রিকা বলে মনে করতেন।

সেই অল্প বয়সেই বড়দের প্রভাবে কিনা জানি না, আমরাও সংবাদের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম। পরবর্তীকালে সংবাদ তো আমার সহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আমি সরাসরি ‘খেলাঘর আসরের’ সদস্য হিসেবে কাজ করতে থাকি। আমার শহর মাদারীপুরে গড়ে তুলি ‘রংমশাল খেলাঘর আসর’।

১৯৬৭ সালে ‘খেলাঘর’-এর আয়োজনে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তাতে আমি তৃতীয় স্থান অধিকার করি। কিন্তু অনিবার্য কারণে আমি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আসতে পারিনি। কিন্তু সে-পুরস্কারটি আমি আর কখনও পাইনি!

এরপরই ১৯৬৭ সালে আমি একা একা ঢাকায় বেড়াতে আসি। তখন ‘দৈনিক পয়গাম’ নামে পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের ছেলে একটি পত্রিকা বের করতো। সেখানে ‘নওনেহালের আসর’ নামে ছোটদের একটি পাতা বের হতো, যার দায়িত্বে ছিলেন দেশবরেণ্য ছড়াকার রফিকুল হক দাদাভাই। তিনি তখন ‘মিতা ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর হাত দিয়েই আমার প্রথম গল্প ‘ভুলিতে পারিনি আজও’ ‘নওনেহালের আসরে’ ছাপা হয়। সেখানে লেখেননি, এখনকার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের খুব কম সংখ্যককেই পাওয়া যাবে। এরপর শুরু হয় ‘সংবাদ’-এ আমার লেখালেখির দুরন্ত অভিযান। বজলু ভাই যে আমার কতো লেখা ‘খেলাঘরে’ ছেপেছেন, আমি তা মনেও করতে পারি না! আমি যখন চূড়ান্তভাবে ঢাকায় চলে আসি, ১৯৬৯ সালে, তখন নিয়মিত ২৬৩ বংশাল রোডের দোতলা বাড়িটিতে প্রতিদিন যাই। ওর দোতলা দালানের উত্তরদিকের ঘরটি খেলাঘর আসরের জন্য বরাদ্দ ছিল। আমরা খেলাঘরের লিখিয়ে এবং সদস্যরা প্রতিদিন বিকেলে সেখানে জড়ো হতাম। সুকুমার বড়ুয়া, আখতার হুসেন, রশীদ সিনহা, আবু সালেহ, কবি বেলাল চৌধুরীর ছোট ভাই জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ আরও কতোজন যে আসতেন, তাদের সকলের নাম এখন আর মনে নেই।

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই হাতের ডানের একটি রুমে বসতেন সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত এবং শহীদুল্লা কায়সার। তিনজনই এমন গম্ভীর ও ভারিক্কি ছিলেন যে, তাঁদের সঙ্গে যেচে কথা বলার কখনও সাহস হয়নি। বরং ওদিক দিয়ে হাঁটার সময় খুব পা টিপে টিপে হাঁটতাম, যাতে তাঁদের কোনও ডিসটার্ব না হয়।

পরবর্তী সময় সত্যেনদা ও রণেশদার সঙ্গে আমার গভীরতর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে অন্য ইতিহাস।

আগেই বলেছি সংবাদ অফিসটি ছিল দোতলা। নিচতলায় ছাপার মেশিন। নবাবপুর রোড ধরে এগুলোই ডানদিকে ছিল বংশাল রোড। সংবাদ অফিসের ডানদিকে ছিল ‘মুন সিনেমা হল’।

উপরতলায় সম্পাদকীয় বিভাগ, নিচে নিউজ রুম। সেখানে যারা চাকরি করতেন, তাদের অধিকাংশই বামঘরানার মানুষ। নিয়মিত যেতে যেতে তাঁদের সঙ্গেও আমার এক নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছিল। সেখানে আমার যাতায়াত এত বেশি ছিল যে, অনেকে মনে করতেন, আমি সংবাদে চাকরি করি। এই সম্পর্ক অটুট ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর আর সংবাদ অফিসে যাওয়া হয়নি। তবে বংশাল রোড থেকে পুরানা পল্টনে সংবাদ অফিস শিফট করার পর অনেকবার গিয়েছি। তখন সংবাদের সাহিত্যসাময়িকীর দায়িত্বে ছিলেন আবুল হাসানাত, যিনি মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা লেখেন। তখন তিনি আমার অনেক গদ্য ও পদ্য তার পাতায় ছেপেছেন। তার রুমে অনেক আড্ডা দিয়েছি। এ-ছাড়াও সম্পাদকীয় বিভাগে সন্তোষ গুপ্ত থাকাতে তাঁর রুমেও অনেকবার গিয়েছি। বার্তা বিভাগে যারা ছিলেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার জানাশোনা ছিল। কবি জাহিদুল হকও কিছুদিন সেখানে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তার রুমে গিয়েও আড্ডা দিয়েছি। পরবর্তীকালে আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন কবি মিনার মনসুর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিলে সেখানেও আড্ডা দিয়েছি। বর্তমান সাহিত্যসম্পাদক প্রীতিভাজন কবি ওবায়েদ আকাশের সঙ্গে তার একেবারে ছোট্ট একটি রুমেও দুএকবার আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়েছে। কিছুদিন কবি রফিক আজাদের সাবেক স্ত্রী আদিলা বকুল সংবাদের লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন। ভাবীর সঙ্গে সেখানে দেখা হলে অনেক আলাপ করেছি। যতদিন সংবাদ অফিসে গেছি সম্পাদক বজলু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসিনি, এমন দিন কমই আছে। বজলু ভাই ছিলেন মিতভাষী। কাছে পেলে খুব মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করতেন “অসীম কেমন আছো? লেখালেখি কেমন চলছে?” বজলু ভাই কখনও কখনও আমাকে ‘কবি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমি বিব্রত ও লজ্জিত হতাম। কিন্তু তিনি এমনি নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন যে, তাকে বারণ করলে তিনি মৃদু হাসতেন। সেই বজলু ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছিল!

সংবাদের মালিক আহমদুল কবিরকে আমি খুব বেশি দেখিনি। যেটুকু দেখেছি, সেটা বংশাল রোডের অফিসে। তাও দুএকবার। দীর্ঘ এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা। কথা হয়নি কোনদিন। কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন সংবাদে চাকরি করতেন, তখন তারা দোতলা ছেড়ে নিচতলায় নতুন অবয়বের ঘরে বসতেন। রুমে রণেশদা, মোহাম্মদ তোহা খানসহ আর দুএকজনকে দেখেছি। নির্মলেন্দু গুণ সেখানে ময়মনসিংহ থেকে এসে চাকরি করতেন এবং ঐ রুমেই বসতেন। আমি থাকা অবস্থায় আহমদুল কবির একবার ঐ রুমে ঢুকেছিলেন। সেই দেখা; আর একবার নিচ থেকে দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় তাঁকে দেখেছিলাম।

যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর খবর দেখেছিলাম সংবাদপত্রের পাতায়!

আসলে সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আত্মার। পরবর্তীকালে ঘুরে-ফিরে অনেক পত্রিকায় চাকরি করেছি। জীবনের ৫০ বছর অতিক্রম করেছি পত্রিকায় পত্রিকায় ঘুরে ঘুরে। কিন্তু ‘সংবাদ’ আমার জীবনের পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে গাঁথা হয়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল সংবাদের সাংবাদিক হবো; কিন্তু সে-সৌভাগ্য আমার হয়নি। মুখ ফুটে কোনদিন কাউকে নিজের ইচ্ছের কথা জানাতেও পারিনি। পারলে হয়তো চাকরি হতেও পারতো। কিন্তু হয়নি, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু তা হলেও সংবাদ আমার প্রাণের কাগজ, মনের কাগজ এবং আত্মার কাগজ। যে ‘সংবাদ’কে আমরা দেখেছি, গুণগত মানের দিক থেকে হয়তো সেটি আর তেমন অবস্থায় নেই। তবু সংবাদের যে কোনো দুঃসংবাদে আমরা ব্যথিত হই, সংবাদের ক্ষতিকে নিজেদের ক্ষতি বলে মনে করি। কারণ সংবাদ এত বছর পরে এসেও তার যে প্রগতিশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা, তা থেকে এখনও সরে যায়নি। যে কোনো প্রগতিশীল অন্দোলন-সংগ্রামে সংবাদের ভূমিকা আমাদের প্রাণিত করে। সংবাদপত্রজগৎ এখন আনেক আগাছায় ভরে গেছে। নীতি, আদর্শ ও সততার বদলে দুঃশাসন জায়গা করে নিয়েছে; কিন্তু সংবাদ এখনও একলব্য হয়ে তার লক্ষ্যে অবিচল আছে, এটা সংবাদের জন্য যেমন, তেমনি আমাদের জন্যও অনেক শ্লাঘার বিষয়। আমি সংবাদের নবজন্মে তার দীর্ঘায়ু এবং আদর্শের ক্ষেত্রে নিরাপোষ ভূমিকা আশা করি। জয়তুঃ সংবাদ।

image

শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার

অসীম সাহা

image

শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী

কবে থেকে ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকা পড়তে শুরু করেছিলাম ঠিক মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে, তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। কিন্তু অন্য কোনও পত্রিকা তেমনভাবে নয়, যেমনভাবে সংবাদ ছিলো আমাদের কাছে প্রধান আকর্ষণ। এর কারণ দুটি। এক. সংবাদ ছিল তখনকার বামঘরানা ও প্রগতিশীল মানুষদের মুখপত্র। দুই. ঐ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘খেলাঘর’ ছিল আমাদের জন্য নিশ্বাস নেবার ঘর। তখন দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক আজাদ ছিল প্রধানতম পত্রিকা! তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ছিল গণতান্ত্রিক ধারার মানুষদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পত্রিকা; আর যারা ইসলামধর্মের অনুসারী, তাদের কাছে মৌলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত ‘দৈনিক আজাদ’ই ছিল আদর্শ পত্রিকা। অন্যদিকে জহুর হোসেন চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক সংবাদ ছিল বামপন্থি রাজনীতিক নেতা, কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রাণের পত্রিকা।

এখনকার মতো তখন অনেক দৈনিক পত্রিকা ছিল না। তাই পত্রিকা বাছাই করতে কারোরই বেগ পেতে হয়নি। সংবাদের মালিক ছিলেন শিল্পপতি আহমদুল কবির। তিনি নিজে রাজনৈতিক দল ন্যাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে পত্রিকাটিতে এমন সব মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন, যারা সরাসরি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার প্রমুখ তো সংবাদে চাকরি করতেন। পরবর্তী সময়ে সন্তোষ গুপ্ত এসে সংবাদে যোগদান করেন। সঙ্গে ছিলেন বজলুর রহমান, যিনি ‘খেলাঘর’ পাতাটি দেখতেন। তিনি সকলের কাছে ‘ভাইয়া’ নামে পরিচিত ছিলেন। এদের চিনত না, এমন শিক্ষিত মানুষ সে-সময়ে ছিল বিরল। সে-কারণে কম্যুনিস্ট পার্টি, ন্যাপ এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা সংবাদকে নিজেদের পত্রিকা বলে মনে করতেন।

সেই অল্প বয়সেই বড়দের প্রভাবে কিনা জানি না, আমরাও সংবাদের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলাম। পরবর্তীকালে সংবাদ তো আমার সহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। আমি সরাসরি ‘খেলাঘর আসরের’ সদস্য হিসেবে কাজ করতে থাকি। আমার শহর মাদারীপুরে গড়ে তুলি ‘রংমশাল খেলাঘর আসর’।

১৯৬৭ সালে ‘খেলাঘর’-এর আয়োজনে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তাতে আমি তৃতীয় স্থান অধিকার করি। কিন্তু অনিবার্য কারণে আমি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আসতে পারিনি। কিন্তু সে-পুরস্কারটি আমি আর কখনও পাইনি!

এরপরই ১৯৬৭ সালে আমি একা একা ঢাকায় বেড়াতে আসি। তখন ‘দৈনিক পয়গাম’ নামে পূর্ব-পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের ছেলে একটি পত্রিকা বের করতো। সেখানে ‘নওনেহালের আসর’ নামে ছোটদের একটি পাতা বের হতো, যার দায়িত্বে ছিলেন দেশবরেণ্য ছড়াকার রফিকুল হক দাদাভাই। তিনি তখন ‘মিতা ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর হাত দিয়েই আমার প্রথম গল্প ‘ভুলিতে পারিনি আজও’ ‘নওনেহালের আসরে’ ছাপা হয়। সেখানে লেখেননি, এখনকার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের খুব কম সংখ্যককেই পাওয়া যাবে। এরপর শুরু হয় ‘সংবাদ’-এ আমার লেখালেখির দুরন্ত অভিযান। বজলু ভাই যে আমার কতো লেখা ‘খেলাঘরে’ ছেপেছেন, আমি তা মনেও করতে পারি না! আমি যখন চূড়ান্তভাবে ঢাকায় চলে আসি, ১৯৬৯ সালে, তখন নিয়মিত ২৬৩ বংশাল রোডের দোতলা বাড়িটিতে প্রতিদিন যাই। ওর দোতলা দালানের উত্তরদিকের ঘরটি খেলাঘর আসরের জন্য বরাদ্দ ছিল। আমরা খেলাঘরের লিখিয়ে এবং সদস্যরা প্রতিদিন বিকেলে সেখানে জড়ো হতাম। সুকুমার বড়ুয়া, আখতার হুসেন, রশীদ সিনহা, আবু সালেহ, কবি বেলাল চৌধুরীর ছোট ভাই জিয়াউদ্দিন আহমেদসহ আরও কতোজন যে আসতেন, তাদের সকলের নাম এখন আর মনে নেই।

দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই হাতের ডানের একটি রুমে বসতেন সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত এবং শহীদুল্লা কায়সার। তিনজনই এমন গম্ভীর ও ভারিক্কি ছিলেন যে, তাঁদের সঙ্গে যেচে কথা বলার কখনও সাহস হয়নি। বরং ওদিক দিয়ে হাঁটার সময় খুব পা টিপে টিপে হাঁটতাম, যাতে তাঁদের কোনও ডিসটার্ব না হয়।

পরবর্তী সময় সত্যেনদা ও রণেশদার সঙ্গে আমার গভীরতর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে অন্য ইতিহাস।

আগেই বলেছি সংবাদ অফিসটি ছিল দোতলা। নিচতলায় ছাপার মেশিন। নবাবপুর রোড ধরে এগুলোই ডানদিকে ছিল বংশাল রোড। সংবাদ অফিসের ডানদিকে ছিল ‘মুন সিনেমা হল’।

উপরতলায় সম্পাদকীয় বিভাগ, নিচে নিউজ রুম। সেখানে যারা চাকরি করতেন, তাদের অধিকাংশই বামঘরানার মানুষ। নিয়মিত যেতে যেতে তাঁদের সঙ্গেও আমার এক নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছিল। সেখানে আমার যাতায়াত এত বেশি ছিল যে, অনেকে মনে করতেন, আমি সংবাদে চাকরি করি। এই সম্পর্ক অটুট ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর আর সংবাদ অফিসে যাওয়া হয়নি। তবে বংশাল রোড থেকে পুরানা পল্টনে সংবাদ অফিস শিফট করার পর অনেকবার গিয়েছি। তখন সংবাদের সাহিত্যসাময়িকীর দায়িত্বে ছিলেন আবুল হাসানাত, যিনি মাহমুদ আল জামান নামে কবিতা লেখেন। তখন তিনি আমার অনেক গদ্য ও পদ্য তার পাতায় ছেপেছেন। তার রুমে অনেক আড্ডা দিয়েছি। এ-ছাড়াও সম্পাদকীয় বিভাগে সন্তোষ গুপ্ত থাকাতে তাঁর রুমেও অনেকবার গিয়েছি। বার্তা বিভাগে যারা ছিলেন, তাদের অনেকের সঙ্গেই আমার জানাশোনা ছিল। কবি জাহিদুল হকও কিছুদিন সেখানে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। তার রুমে গিয়েও আড্ডা দিয়েছি। পরবর্তীকালে আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন কবি মিনার মনসুর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিলে সেখানেও আড্ডা দিয়েছি। বর্তমান সাহিত্যসম্পাদক প্রীতিভাজন কবি ওবায়েদ আকাশের সঙ্গে তার একেবারে ছোট্ট একটি রুমেও দুএকবার আড্ডা দেয়ার সুযোগ হয়েছে। কিছুদিন কবি রফিক আজাদের সাবেক স্ত্রী আদিলা বকুল সংবাদের লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন। ভাবীর সঙ্গে সেখানে দেখা হলে অনেক আলাপ করেছি। যতদিন সংবাদ অফিসে গেছি সম্পাদক বজলু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসিনি, এমন দিন কমই আছে। বজলু ভাই ছিলেন মিতভাষী। কাছে পেলে খুব মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করতেন “অসীম কেমন আছো? লেখালেখি কেমন চলছে?” বজলু ভাই কখনও কখনও আমাকে ‘কবি’ বলে সম্বোধন করতেন। আমি বিব্রত ও লজ্জিত হতাম। কিন্তু তিনি এমনি নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন যে, তাকে বারণ করলে তিনি মৃদু হাসতেন। সেই বজলু ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করেছিল!

সংবাদের মালিক আহমদুল কবিরকে আমি খুব বেশি দেখিনি। যেটুকু দেখেছি, সেটা বংশাল রোডের অফিসে। তাও দুএকবার। দীর্ঘ এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা। কথা হয়নি কোনদিন। কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন সংবাদে চাকরি করতেন, তখন তারা দোতলা ছেড়ে নিচতলায় নতুন অবয়বের ঘরে বসতেন। রুমে রণেশদা, মোহাম্মদ তোহা খানসহ আর দুএকজনকে দেখেছি। নির্মলেন্দু গুণ সেখানে ময়মনসিংহ থেকে এসে চাকরি করতেন এবং ঐ রুমেই বসতেন। আমি থাকা অবস্থায় আহমদুল কবির একবার ঐ রুমে ঢুকেছিলেন। সেই দেখা; আর একবার নিচ থেকে দোতলার বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় তাঁকে দেখেছিলাম।

যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর খবর দেখেছিলাম সংবাদপত্রের পাতায়!

আসলে সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আত্মার। পরবর্তীকালে ঘুরে-ফিরে অনেক পত্রিকায় চাকরি করেছি। জীবনের ৫০ বছর অতিক্রম করেছি পত্রিকায় পত্রিকায় ঘুরে ঘুরে। কিন্তু ‘সংবাদ’ আমার জীবনের পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে গাঁথা হয়ে গেছে। ইচ্ছে ছিল সংবাদের সাংবাদিক হবো; কিন্তু সে-সৌভাগ্য আমার হয়নি। মুখ ফুটে কোনদিন কাউকে নিজের ইচ্ছের কথা জানাতেও পারিনি। পারলে হয়তো চাকরি হতেও পারতো। কিন্তু হয়নি, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু তা হলেও সংবাদ আমার প্রাণের কাগজ, মনের কাগজ এবং আত্মার কাগজ। যে ‘সংবাদ’কে আমরা দেখেছি, গুণগত মানের দিক থেকে হয়তো সেটি আর তেমন অবস্থায় নেই। তবু সংবাদের যে কোনো দুঃসংবাদে আমরা ব্যথিত হই, সংবাদের ক্ষতিকে নিজেদের ক্ষতি বলে মনে করি। কারণ সংবাদ এত বছর পরে এসেও তার যে প্রগতিশীলতা ও অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা, তা থেকে এখনও সরে যায়নি। যে কোনো প্রগতিশীল অন্দোলন-সংগ্রামে সংবাদের ভূমিকা আমাদের প্রাণিত করে। সংবাদপত্রজগৎ এখন আনেক আগাছায় ভরে গেছে। নীতি, আদর্শ ও সততার বদলে দুঃশাসন জায়গা করে নিয়েছে; কিন্তু সংবাদ এখনও একলব্য হয়ে তার লক্ষ্যে অবিচল আছে, এটা সংবাদের জন্য যেমন, তেমনি আমাদের জন্যও অনেক শ্লাঘার বিষয়। আমি সংবাদের নবজন্মে তার দীর্ঘায়ু এবং আদর্শের ক্ষেত্রে নিরাপোষ ভূমিকা আশা করি। জয়তুঃ সংবাদ।