আমার সংবাদ সংবাদের আমি

বিভুরঞ্জন সরকার

দৈনিক সংবাদের পাঠক হয়েছি কবে থেকে সেটা আর এখন মনে করতে পারব না। তবে আমি একই সঙ্গে সংবাদের পাঠক এবং বিক্রেতা হয়েছিলাম। প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে সংবাদ পড়া যেমন জরুরি ছিল, তেমনি সংবাদের প্রচার বাড়ানোর কাজেও আমাদের ভূমিকা রাখতে হতো। মনে রাখতে হবে, আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেটা আমাদের জাতীয় জীবনের এক উত্থানকাল। গত শতকের ষাটের দশকের শেষ প্রান্ত। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণজাগরণের প্রস্তুতি চলছে। ছাত্ররা সংগঠিত হচ্ছে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী নিজেদের মরণ কূপ খনন করে। মুজিবের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এই সময় স্বাভাবিকভাবেই খবরের কাগজ পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে। তবে সে সময় মফস্বল এলাকায় খবরের কাগজ পাওয়া খুব সহজ ছিল না। সংবাদপত্রের সংখ্যাও কম ছিল। দিনের কাগজ অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যেত পরের দিন। প্রতিদিনের খবরের জন্য মানুষ নির্ভর করত রেডিওর ওপর। তবে রেডিও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মানুষ সব ধরনের খবরের জন্য দৈনিক পত্রিকার ওপরই বেশি নির্ভর করত। আর ছিল বিদেশি রেডিও- বিবিসি এবং ভয়েস অফ আমেরিকা।

আমরা স্কুল জীবনে নাম শুনেছি কয়েকটি পত্রিকার। আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান এবং ইংরেজি মর্নিং নিউজ ও অবজারভার। তখনও পত্রিকাগুলোর গায়ে রাজনৈতিক রঙ ছিল। কোন কাগজ কোন ধারার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক সেটা আমরা তখনই জানতাম। আজাদ ছিল মুসলিম লীগ ধারার রাজনীতির সমর্থক। ইত্তেফাক ছিল আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের পক্ষের। আর বাম-প্রগতিশীলদের কাগজ ছিল সংবাদ। দৈনিক পাকিস্তান ছিল সরকারি কাগজ। পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক পরিচয় বহন করলেও সাংবাদিকদের ছিল পেশাদারি মনোভাব। মুসলিম লীগের কাগজ আজাদে কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন সন্তোষ গুপ্তের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয়নি। আওয়ামী লীগের ইত্তেফাকে আহমেদুর রহমান এবং আলী আকসাদের মতো কমিউনিস্ট কাজ করেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তবে বামপন্থিদের মূল ঘাঁটি ছিল সংবাদ। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, বজলুর রহমানের মতো পরিচিত কমিউনিস্টরা ছিলেন সংবাদের প্রাণ। আমি ছাত্র ইউনিয়ের কর্মী হিসেবে সংবাদকেই আমার পত্রিকা হিসেবে মনে করতাম এবং আমাদের এলাকায় সংবাদের পাঠক সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করতাম। পাকিস্তানি দুঃশাসনের সময়েও গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে সংবাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং দৃঢ়।

পরে নানাভাবে সংবাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমি সংবাদের একজন হয়ে উঠেছিলাম। দুই পর্যায়ে আমি সংবাদে চাকরি করেছি। সেটা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। তবে আমি দীর্ঘদিন, কয়েক বছর টানা সংবাদে উপসম্পাদকীয় লিখেছি। সে জন্য অনেকে মনে করেন সংবাদেই বুঝি আমি বেশি দিন কাজ করেছি। ১৯৭৩ সালে ঢাকা এসে অল্প কয়েক মাস সংবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। তখন সংবাদে নগর সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন হাসান আলী ভাই। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁয়ের পীরগঞ্জে। ‘এলাকা’র মানুষ হিসেবে আমি হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। আগে থেকেই আমার একটু লেখালেখির বাতিক ছিল। আমি স্কুলছাত্র থাকতেই দৈনিক আজাদের মফঃস্বল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। সংবাদের বংশাল অফিসে গিয়ে একদিন হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আমাকে ঢাকায় থাকা-খাওয়ার টাকা নিজেকেই রোজগার করতে হবে, এটা হাসান ভাইকে জানাই। আমি দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছি, হাসান ভাইও তাই। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করি, তিনিও ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সবচেয়ে বড় কথা, আমার বাড়ি আর কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের বাড়ি এক জায়গায়। আমাকে সংবাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসাবে হাসান ভাই তাৎক্ষণিকভাবেই নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে আমি মাস তিনেকের বেশি ওই কাজটি করিনি। কারণ একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় বেশ ভালো মাইনেতে আমার একটি খন্ডকালীন চাকরি হয়েছিল। তবে সংবাদে প্রায় প্রতিদিনই যাতায়াত করতে হতো। ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির প্রেস বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

বাকশাল গঠন, মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকিগুলো বন্ধ ঘোষণা, ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেশে তৈরি হয় এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির পশ্চাৎযাত্রা শুরু হয়। খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ এবং বিদায়, জিয়াউর রহমানের উত্থানের ফলে রাজনীতিতে ফিরে আসে পাকিস্তানি ধারা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাক্সবন্দি করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা তৈরি করা হয়। প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক চরম দুঃসময়ে আমি ১৯৭৮ সালে আবার সংবাদে যোগ দেই সম্পাদনা সহকারী হিসেবে। সংবাদ তখন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির একমাত্র মুখপত্র। জহুর হোসেন চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সন্তোষ গুপ্ত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বজলুর রহমান তখন নিয়মিত কলাম লিখছেন সংবাদে। তাদের কলাম পড়ার জন্য পাঠক উন্মুখ হয়ে অপেক্ষায় থাকতেন।

রাজনীতিবিদরা যেসব বিষয়ে সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে খোলামেলা কথা বলতে পারতেন না, সেসব বিষয়ে প্রবীণ ও যশস্বী সাংবাদিকরা কলাম লিখতেন। জহুর হোসেন চৌধুরীর কলাম দরবার-ই-জহুর, আবু জাফর শামসুদ্দীনের বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সময় বহিয়া যায়, বজলুর রহমানের হালচাল কলামগুলো সে সময় অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীও তখন ছিল শিল্প-সাহিত্যানুরাগীদের কাছে বিপুল আগ্রহের বিষয়। সৈয়দ শামসুল হক, ওয়াহিদুল হকসহ অনেকে নিয়মিত সাহিত্য সাময়িকীতে লিখতেন।

এই পর্যায়েও বছরখানের মতো চাকরি করে আমি আবার সংবাদ ছাড়ি। এরপর বজলুর রহমান একাধিকবার আমাকে সংবাদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও আমি কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের ‘একতা’ ছাড়তে পারিনি। তবে আমি অনেক বছর সংবাদে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় কলাম লিখেছি। সংবাদ সম্পাদক আহমদুল কবিরও একাধিকবার আমাকে ডেকে নিয়ে আমার লেখার প্রশংসা করেছেন, আমাকে সংবাদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। সংবাদে লেখা ছাপা হলে আমি দুজন মানুষের টেলিফোন অবশ্যই পেতাম। তাদের একজন ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ এবং অন্যজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। তাঁরা ছিলেন সংবাদের গুণগ্রাহী এবং তাঁরা আমাকে সংবাদের একজন বলেই মনে করতেন। আমি মনে করি এটা আমার জীবনে একটি বিরল পাওয়া। বজলুর রহমানের মতো একজন ধীমান সম্পাদক আমার লেখা পছন্দ করতেন, নিয়মিত তাগাদা দিয়ে আমাকে দিয়ে লেখাতেন, এটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য গৌরবের বিষয়। সংবাদে দীর্ঘদিন চাকরি না করলেও আমি নিজেকে সংবাদের একজন বলেই মনে করি। সাংবাদিক হিসেবে আমার যদি সামান্য কিছু অর্জনও থেকে থাকে তাহলে তার পেছনে সংবাদের অবদান কম নয়।

সংবাদ ৬৮ বছর পূর্ণ করেছে। কম কথা নয়। সংবাদ আমাদের দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা। এই সময়কালে আমাদের দেশের সংবাদপত্র শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। পত্রিকার সংখ্যা বেড়েছে, পাঠক সংখ্যাও বেড়েছে। দেশে সংবাদকর্মীর সংখ্যাও এখন অনেক। তবে নানা কারণে সাংবাদিকতা পেশা এখনও আছে ঝুঁকির মধ্যে। আবার সংবাদপত্র শিল্পও সমস্যামুক্ত নয়। সংবাদপত্রের যে একটি আদর্শিক অবস্থান সেটি তৈরিতে সংবাদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবক্ষয়ের থাবা লেগেছে। সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে পরিবেশ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। মানুষ অনুদার হচ্ছে। কপট হচ্ছে। স্বার্থান্ধ হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দানব শক্তির আস্ফালন বাড়ছে। মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়। মানুষের শুভবুদ্ধি চাপা পড়ছে উগ্রবাদী ভাবনা-চিন্তার কাছে। এই অবস্থায় সংবাদের কাছে দেশের সুস্থ চিন্তার মানুষদের প্রত্যাশা- সংবাদ তার ঐতিহ্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগ্রত রাখুক। অপশক্তির কাছে সবাই মাথানত করলেও সংবাদ যেন তার সংকল্পে অটল থাকে। সংবাদ আমার, আমি সংবাদের- এটা যেন আমি আজীবন বলতে পারি অসংকোচে। সংবাদের পথচলা অব্যাহত থাক, নিষ্কণ্টক হোক- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটাই কামনা।

image

শিল্পী : সৈয়দ জাহাঙ্গীর

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

আমার সংবাদ সংবাদের আমি

বিভুরঞ্জন সরকার

image

শিল্পী : সৈয়দ জাহাঙ্গীর

দৈনিক সংবাদের পাঠক হয়েছি কবে থেকে সেটা আর এখন মনে করতে পারব না। তবে আমি একই সঙ্গে সংবাদের পাঠক এবং বিক্রেতা হয়েছিলাম। প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে সংবাদ পড়া যেমন জরুরি ছিল, তেমনি সংবাদের প্রচার বাড়ানোর কাজেও আমাদের ভূমিকা রাখতে হতো। মনে রাখতে হবে, আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেটা আমাদের জাতীয় জীবনের এক উত্থানকাল। গত শতকের ষাটের দশকের শেষ প্রান্ত। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণজাগরণের প্রস্তুতি চলছে। ছাত্ররা সংগঠিত হচ্ছে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী নিজেদের মরণ কূপ খনন করে। মুজিবের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এই সময় স্বাভাবিকভাবেই খবরের কাগজ পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ে। তবে সে সময় মফস্বল এলাকায় খবরের কাগজ পাওয়া খুব সহজ ছিল না। সংবাদপত্রের সংখ্যাও কম ছিল। দিনের কাগজ অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যেত পরের দিন। প্রতিদিনের খবরের জন্য মানুষ নির্ভর করত রেডিওর ওপর। তবে রেডিও সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় মানুষ সব ধরনের খবরের জন্য দৈনিক পত্রিকার ওপরই বেশি নির্ভর করত। আর ছিল বিদেশি রেডিও- বিবিসি এবং ভয়েস অফ আমেরিকা।

আমরা স্কুল জীবনে নাম শুনেছি কয়েকটি পত্রিকার। আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান এবং ইংরেজি মর্নিং নিউজ ও অবজারভার। তখনও পত্রিকাগুলোর গায়ে রাজনৈতিক রঙ ছিল। কোন কাগজ কোন ধারার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক সেটা আমরা তখনই জানতাম। আজাদ ছিল মুসলিম লীগ ধারার রাজনীতির সমর্থক। ইত্তেফাক ছিল আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের পক্ষের। আর বাম-প্রগতিশীলদের কাগজ ছিল সংবাদ। দৈনিক পাকিস্তান ছিল সরকারি কাগজ। পত্রিকাগুলো রাজনৈতিক পরিচয় বহন করলেও সাংবাদিকদের ছিল পেশাদারি মনোভাব। মুসলিম লীগের কাগজ আজাদে কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন সন্তোষ গুপ্তের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে সমস্যা হয়নি। আওয়ামী লীগের ইত্তেফাকে আহমেদুর রহমান এবং আলী আকসাদের মতো কমিউনিস্ট কাজ করেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। তবে বামপন্থিদের মূল ঘাঁটি ছিল সংবাদ। রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, শহীদুল্লা কায়সার, বজলুর রহমানের মতো পরিচিত কমিউনিস্টরা ছিলেন সংবাদের প্রাণ। আমি ছাত্র ইউনিয়ের কর্মী হিসেবে সংবাদকেই আমার পত্রিকা হিসেবে মনে করতাম এবং আমাদের এলাকায় সংবাদের পাঠক সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করতাম। পাকিস্তানি দুঃশাসনের সময়েও গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে সংবাদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং দৃঢ়।

পরে নানাভাবে সংবাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমি সংবাদের একজন হয়ে উঠেছিলাম। দুই পর্যায়ে আমি সংবাদে চাকরি করেছি। সেটা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। তবে আমি দীর্ঘদিন, কয়েক বছর টানা সংবাদে উপসম্পাদকীয় লিখেছি। সে জন্য অনেকে মনে করেন সংবাদেই বুঝি আমি বেশি দিন কাজ করেছি। ১৯৭৩ সালে ঢাকা এসে অল্প কয়েক মাস সংবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। তখন সংবাদে নগর সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন হাসান আলী ভাই। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁয়ের পীরগঞ্জে। ‘এলাকা’র মানুষ হিসেবে আমি হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। আগে থেকেই আমার একটু লেখালেখির বাতিক ছিল। আমি স্কুলছাত্র থাকতেই দৈনিক আজাদের মফঃস্বল প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি। সংবাদের বংশাল অফিসে গিয়ে একদিন হাসান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আমাকে ঢাকায় থাকা-খাওয়ার টাকা নিজেকেই রোজগার করতে হবে, এটা হাসান ভাইকে জানাই। আমি দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছি, হাসান ভাইও তাই। আমি ছাত্র ইউনিয়ন করি, তিনিও ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। সবচেয়ে বড় কথা, আমার বাড়ি আর কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের বাড়ি এক জায়গায়। আমাকে সংবাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসাবে হাসান ভাই তাৎক্ষণিকভাবেই নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে আমি মাস তিনেকের বেশি ওই কাজটি করিনি। কারণ একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় বেশ ভালো মাইনেতে আমার একটি খন্ডকালীন চাকরি হয়েছিল। তবে সংবাদে প্রায় প্রতিদিনই যাতায়াত করতে হতো। ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির প্রেস বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে দেওয়ার জন্য।

বাকশাল গঠন, মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকিগুলো বন্ধ ঘোষণা, ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেশে তৈরি হয় এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির পশ্চাৎযাত্রা শুরু হয়। খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ এবং বিদায়, জিয়াউর রহমানের উত্থানের ফলে রাজনীতিতে ফিরে আসে পাকিস্তানি ধারা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাক্সবন্দি করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জায়গা তৈরি করা হয়। প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক চরম দুঃসময়ে আমি ১৯৭৮ সালে আবার সংবাদে যোগ দেই সম্পাদনা সহকারী হিসেবে। সংবাদ তখন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তির একমাত্র মুখপত্র। জহুর হোসেন চৌধুরী, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সন্তোষ গুপ্ত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বজলুর রহমান তখন নিয়মিত কলাম লিখছেন সংবাদে। তাদের কলাম পড়ার জন্য পাঠক উন্মুখ হয়ে অপেক্ষায় থাকতেন।

রাজনীতিবিদরা যেসব বিষয়ে সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে খোলামেলা কথা বলতে পারতেন না, সেসব বিষয়ে প্রবীণ ও যশস্বী সাংবাদিকরা কলাম লিখতেন। জহুর হোসেন চৌধুরীর কলাম দরবার-ই-জহুর, আবু জাফর শামসুদ্দীনের বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সময় বহিয়া যায়, বজলুর রহমানের হালচাল কলামগুলো সে সময় অত্যন্ত পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীও তখন ছিল শিল্প-সাহিত্যানুরাগীদের কাছে বিপুল আগ্রহের বিষয়। সৈয়দ শামসুল হক, ওয়াহিদুল হকসহ অনেকে নিয়মিত সাহিত্য সাময়িকীতে লিখতেন।

এই পর্যায়েও বছরখানের মতো চাকরি করে আমি আবার সংবাদ ছাড়ি। এরপর বজলুর রহমান একাধিকবার আমাকে সংবাদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও আমি কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের ‘একতা’ ছাড়তে পারিনি। তবে আমি অনেক বছর সংবাদে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় কলাম লিখেছি। সংবাদ সম্পাদক আহমদুল কবিরও একাধিকবার আমাকে ডেকে নিয়ে আমার লেখার প্রশংসা করেছেন, আমাকে সংবাদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। সংবাদে লেখা ছাপা হলে আমি দুজন মানুষের টেলিফোন অবশ্যই পেতাম। তাদের একজন ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ এবং অন্যজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। তাঁরা ছিলেন সংবাদের গুণগ্রাহী এবং তাঁরা আমাকে সংবাদের একজন বলেই মনে করতেন। আমি মনে করি এটা আমার জীবনে একটি বিরল পাওয়া। বজলুর রহমানের মতো একজন ধীমান সম্পাদক আমার লেখা পছন্দ করতেন, নিয়মিত তাগাদা দিয়ে আমাকে দিয়ে লেখাতেন, এটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য গৌরবের বিষয়। সংবাদে দীর্ঘদিন চাকরি না করলেও আমি নিজেকে সংবাদের একজন বলেই মনে করি। সাংবাদিক হিসেবে আমার যদি সামান্য কিছু অর্জনও থেকে থাকে তাহলে তার পেছনে সংবাদের অবদান কম নয়।

সংবাদ ৬৮ বছর পূর্ণ করেছে। কম কথা নয়। সংবাদ আমাদের দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা। এই সময়কালে আমাদের দেশের সংবাদপত্র শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। পত্রিকার সংখ্যা বেড়েছে, পাঠক সংখ্যাও বেড়েছে। দেশে সংবাদকর্মীর সংখ্যাও এখন অনেক। তবে নানা কারণে সাংবাদিকতা পেশা এখনও আছে ঝুঁকির মধ্যে। আবার সংবাদপত্র শিল্পও সমস্যামুক্ত নয়। সংবাদপত্রের যে একটি আদর্শিক অবস্থান সেটি তৈরিতে সংবাদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবক্ষয়ের থাবা লেগেছে। সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যরে পরিবেশ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। মানুষ অনুদার হচ্ছে। কপট হচ্ছে। স্বার্থান্ধ হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দানব শক্তির আস্ফালন বাড়ছে। মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে মানুষের ধর্মীয় পরিচয়। মানুষের শুভবুদ্ধি চাপা পড়ছে উগ্রবাদী ভাবনা-চিন্তার কাছে। এই অবস্থায় সংবাদের কাছে দেশের সুস্থ চিন্তার মানুষদের প্রত্যাশা- সংবাদ তার ঐতিহ্য ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে জাগ্রত রাখুক। অপশক্তির কাছে সবাই মাথানত করলেও সংবাদ যেন তার সংকল্পে অটল থাকে। সংবাদ আমার, আমি সংবাদের- এটা যেন আমি আজীবন বলতে পারি অসংকোচে। সংবাদের পথচলা অব্যাহত থাক, নিষ্কণ্টক হোক- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটাই কামনা।