বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন

জামিরুল শরীফ

জীবনের স্বার্থেই জীবিকার উদ্ভব হয়েছিল একদিন। জীবন মানে যেখানে সংগ্রাম সেখানে জীবনধারণের জন্যই বিচিত্র জীবিকা অবলম্বিত হয়। এই জীবিকাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। কারণ এই পেশা যেমন ব্যক্তি-মানুষের নিজের গরজে, তেমনি সমষ্টিগত মানুষেরও বিশেষ প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে। এই পেশাই সমাজের অন্তর্বর্তী বন্ধন। মানুষের সঙ্গে মানুষের অন্তরঙ্গ যোগসূত্র। এক বিশেষ সমাজ ও ভূমিখন্ডের দৈনন্দিন রূপচিত্র, তার অভিপ্রায়-অভিরুচি, নকশা বা টপোগ্রাফি একসঙ্গে। পেশাগত জীবিকা অনেক দূরবর্তী মানুষকেও একান্নবর্তী করে তোলে। আমাদের দেশে, আমাদের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে কত বিচিত্র এবং বিস্ময়কর জীবিকা যে আছে অনেকেই তার খবর রাখি না। জীবিকা-উপজীবিকা মিলিয়ে এখানে যে কত জাতের, কত শ্রেণি উপশ্রেণির বৃত্তি বা পেশায় মানুষ বাঁধা রয়েছে তার সঠিক নথিতথ্য হয়তো কোথাও নেই। আর নেই বলেই কত বিচিত্র জীবিকা যে কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে কিংবা বিরল এবং বিলুপ্ত হতে চলেছে সেটা সহজে চোখে পড়ে না। সমাজের চেহারা ও চাহিদায় জনজীবনের রূপরেখায় আজ কত বদল ঘটেছে তা বলে বিস্মিত ও দীর্ঘশ্বাসে মথিত হতে হয়।

আমরা যেন অনেকদূর চলে এসেছি, সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে। এসেছি বলতে অনেকটা ছেড়ে চলে এসেছি। বাদ দিয়েছি, বদলে নিয়েছি। ফলে ব্যবহারিক জীবনে এবং জীবিকা নির্বাহে যে জিনিসগুলো একসময় ছিল অপরিহার্য, আজ তা পরিহার করেছি আমরা সহজেই। আজ গ্রাম বাংলায় ঢেঁকির শব্দ শুনি না- সেখানে এখন যান্ত্রিক আওয়াজ। মৃৎ শিল্পের ব্যবহার ভুলতে বসেছি, মাটির হাঁড়ি-পাতিল বাসনকোসনের জায়গা দখল করেছে ভিন্ন সামগ্রী। কামারদের পাড়া খুঁজেই পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না পালকি, সেই বেহারাও নেই। নেই মেঠোপথে পালকি কাঁধে নিয়ে হুম-হুনা হুম-হুনা কোরাসে আওয়াজ। নদীগুলো শুকিয়ে বিরান প্রান্তরে সাপের খোলসের মতো পড়ে থাকে শুধু ধু ধু বালুরেখা। গুণটানা মাঝিরা কোথায় গেছে হারিয়ে। মজা খাল এখন চেহারা নিয়েছে কোন বিরহিনীর চোখের জলের শুকনো রেখায়। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়িই ছিল এককালে রাজপথের, দূরপথের প্রধান বাহন। ছিল আস্তাবল, গরুর গোয়াল। কামার, কুমার, তাঁতি, সুতার, ধুনকার, গাছি, পটুয়া, মসলিন-জামদানি শিল্পী, ঘোড়ার গাড়ির কচোয়ান, এইসব জীবিকা নির্বাহীরা একালে যেন ঐতিহ্যের স্মৃতি। সেই ঋষিপাড়া নেই, বাঁশ ও বেতের কারিগররা আজ বিরল। কাঁধে করে বাঁখে দই নিয়ে আর হাঁক ছাড়ে না দই-ওয়ালা। প্রহরে প্রহরে শহরের-গ্রামের অলিগলি বেয়ে ফেরিয়ালার যে বিচিত্র ধ্বনিতরঙ্গ মিশে যেত, বিনোদনের মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় আসতো ‘ভানুমতির খেলা’ আর ‘বায়োস্কোপের মেলা’- হাঁক ছাড়তো দুনিয়া দেখো- দু’-আনায়...। পরানপুরের হাটে হাটুরেদের ভিড়ে যে মানুষগুলো বানরের খেলা দেখাতো, রেলস্টেশনের পেছনে যে সাপুড়েরা সাপখেলা দেখাতো, কবিরাজি তাবিজের তেজারতি দেখাতো তুলারাশি হাতে... মনে করতাম তাবিজের মুষ্টি হাতের মোড়কে কী জাদু আছে, জানি না কোন বিচিত্র বিস্ময় ও মজা লুকিয়ে আছে। কৌতূহলি দৃষ্টিতে বিস্ময়ের প্রহর কাটতো। কোন গভীর উদ্দেশ্য যে ছিল তা নয়, তা ছিল খানিকটা উদ্ভটতা, রসকরা এবং মস্করার মধ্য দিয়ে বিনোদনী কৌতুকে গাছগাছড়ার ঔষধি ও তাবিজ বিক্রির কৌশল মাত্র; তা যারা কিনতেন, তাদের দৃষ্টিবিভ্রমই শুধু ঘটাতো না, মতিভ্রমও ঘটাতো। তারা অনেককাল এপেশা থেকে নিশ্চিহ্ন। কালের প্রবাহে তারা আজ অশ্রুত। তাদের উত্তর পুরুষ হয়তো কলকারখানার বৃহৎ প্রযুক্তির ঠেলায় কুটির-ঘরানার পসরা ও পেশা বদলে কোনক্রমে টিকে আছে এখনও। কিন্তু জীবনের সেই স্বাদ, সেই অন্তরঙ্গ আবেগ হারিয়ে ফেলেছে কবেই। এসব আজ গল্প। এই গল্পই এককালে ছিল সাধারণের জীবিকার যোগ, আমাদের ঐতিহ্য, গ্রামীণ ও জাতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ। আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতির অঙ্গ। সময়ের পালাবদলে তারই অঙ্গহানি ঘটেছে আজ। গ্রাম ছুটে চলেছে শহরে, মহানগরে। ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়’-নগরে আছে প্রমোদ, পল্লীতে আছে আত্মার প্রশান্তি। পল্লীর সেই মায়াবি স্নিগ্ধতা আমরা খুইয়ে বসেছি, কংক্রিটের আগ্রাসনে সে প্রায় নিঃশেষিত। হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ জীবনের দৈনন্দিন চিত্রগুলো। কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসছে তাদের মুখচ্ছবি। সেই সঙ্গে জীবনের অলিখিত ইতিহাসও হারিয়ে যেতে বসেছে সময়ের পালাবদলের হাত ধরে।

‘আমার সঙ্গে চলো মহানগরে, যে মহানগর ছড়িয়ে আছে আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো, আবার যে মহানগর উঠেছে মিনারে আর চূড়ায় আর অভ্রভেদী প্রাসাদ-শিখরে তারাদের দিকে, প্রার্থনার মতো মানবাত্মার। আমার সঙ্গে এসো মহানগরের পথে, যে পথ জটিল, দুর্বল মানুষের জীবনধারার মতো, যে পথ

অন্ধকার মানুষের মনের অরণ্যের মতো, আর যে পথ প্রশস্ত, আলোকোজ্জ্বল, মানুষের বুদ্ধি, মানুষের অদম্য উৎসাহের মতো’- কংক্রিটের শহরে ধাতু আর পাথরের ক্ষীণ প্রতিধ্বনির ভেতর ব্যক্তি হৃদয়ের স্বপ্ন-আতিশয্য, দুরন্ত ঘাত-প্রতিঘাতময় প্রায় উন্মোচিত ধ্বনি। আমাদের জীবনে পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব, পাপ আর পতনের রগরগে ঘটনাও আছে। জীবন অনেকসময় বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলেও মানুষের অনন্ত কৌতূহলই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ সেই মহামূল্য জীবনের আলেখ্য হয়ে রইলো বাংলা সাহিত্যে। গ্রামীণ ধুলোর ঘূর্ণি আর ঝরাপাতা, কচিপাতার ছন্দে জীবন দোলে। সাহিত্য যেহেতু জীবনেরই প্রতিবিম্ব, এবং আমার মতে গদ্য-পদ্যের যে সমন্বয় সাহিত্যে দ্রষ্টব্য, তার দৃষ্টান্ত জীবনেও সুলভ। সচেতন পাঠকমাত্রই একমত হবেন যে, আজকের আধুনিককালের সাহিত্য-নিসর্গকাব্যে মানব ও প্রকৃতির পরিচয় নেই। যা পাই তা কেবল কল্পনা-বর্ণনামাত্র।

সমাজের হাওয়া বদলেছে, প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে রুচির হাওয়ার বদল ঘটেছে, আমাদের জীবনের প্রাক্তন পরিচয়গুলোর প্রেক্ষাপটও বাতিল ঘটেছে। আজ আমরা স্বাধীন, সমাজ-বাঁধন ছিন্ন করেছি, কিন্তু বন্ধনমুক্ত হতে পারিনি, এবং তা সম্ভব নয়। জীবনের মর্মঘাতী তাড়না থেকে অব্যাহতি পাওয়াও অসম্ভব। অভ্রভেদী আলোকোজ্জ্বল প্রাসাদ-শিখরের তলায় মানুষ আছে কেবল বাঁচার তাগিদে, খানিক দূরত্বে দীন-হীন কুটিরে মাটির প্রদীপ জ্বলে। দারিদ্র্যপীড়িত সংসার, সারাদিন খেটে... পেটে ভাত জোটে না। নিরাবরণ জীবন দুঃস্বপ্নের উপদ্রবে ভরা।

স্বাধীন দেশ নির্বিবেক হিংস্রবাদ আর অকথ্য প্রবৃত্তির লীলাভূমি। তার মনস্তত্ত্ব অবদমিত বাসনার লোভে, ভোগে, মূঢ়তার মানুষী আত্মপ্রবঞ্চনায় রুগ্ন, মুমূর্ষু। তার ধর্ম, কর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধ, প্রেম ও প্রতিজ্ঞার মূলে নিষ্কাম আদর্শের প্রেরণা নেই। মন যদি হয় জটিল, সরলতার অভিনয়ে, বিশ্বাসের সমর্থনে সে কুটিলও বটে- এমন মানুষ আত্মবাদী স্বার্থপরতার বদভ্যাসে শিকড় গেড়ে বসে আছে। বাঙালির ইতিহাস উৎসবকে বাদ দিলে জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যা দেখা দিয়েছে- নানা স্বভাবের সংমিশ্রণে আমাদের ভেতর পশুত্বের সঙ্করতার আবির্ভাব। মানুষ বারবার যেমন আচার-আচরণের পরিচয় দেয়, তা হয়তো বুদ্ধি বিবেচনাহীন পশুর কাছেও অপ্রত্যাশিত। যেহেতু আত্ম-স্বার্থবাদী একদেশদর্শির ঝোঁক শুভবাদ বা সুবিচারের দিকে নয়, অন্যায়, বর্বরতা, ব্যভিচারের দিকেই, সেহেতু গায়ে-গতরে সে মানুষ হলেও আবেগে আচরণে কর্মে স্বভাবতই পশুত্বের আবেশে বিকৃত। অহিংসা মনুষ্যত্বের নামাঙ্কিত, হিংসা হলো জন্মগত প্রবৃত্তি। এর পেছনে সমাজ ও পরিবেশের হাত আছে কি নেই তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে, তবে জন্মের আছে, কিন্তু ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাজনীতি, অর্থ, ধর্ম বা সংগঠন বাদ দেয়া যায় না। সেখানে স্বার্থ ও নিজেদের সমর্থনে কৃত্রিমতা, ভেজাল, দুর্নীতিসহ অবিবেকী সব কর্মকা-, একদেশদর্শিতার ভূয়োদর্শন ইত্যাদি আমাদের কলুষিত, বিভ্রান্ত ও তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের ধৈর্যও সহসা বাঁধ ভাঙে না, উপায় খোঁজে- ‘হালের কাছে মাঝি আছে করবে তরী পার’- বলে আমাদের মরমী মন হাল ছেড়ে বসে আছে। ধর্মীয় রক্ষণশীল মনোভাব স্রষ্টার অনুগ্রহের আশায় সকল দায়-কর্তব্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, ইহলৌকিক অভিনিবেশ ঝেড়ে ফেলতে পারে না। আমাদের চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠে মিল নেই, সত্তায় আমরা শয়তানে-স্রষ্টায় মাখামাখি, স্বার্থের বেলায় সহৃদয়-কোমল, প্রয়োজনে স্নেহান্ধ-প্রেমান্ধ, কাজে-কর্তব্যে আত্মবাদী, নিষ্ঠুর। অর্থাৎ অহিংসা আর হিংসা অটুট ও অভিন্নহৃদয়- উভয়েই স্বার্থে অধীর, আত্মবাদী, নিষ্ঠুর ও একদেশদর্শী। ফলে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ট্র্যাজেডির শোচনীয় ঘটনার যেমন শেষ নেই- তেমনি মর্মাহত বিস্ময়ে উপলব্ধি করি, আমি মানুষ- আমি পাপী, আমি মানুষ- আমি দুঃখী, আমি মানুষ- আমি রুগ্ন, আমি মানুষ- আমি মুমূর্ষু। আধুনিক সভ্যতার শতগৌরবেও আত্মিক যন্ত্রণায় ইন্ধন যুগিয়েছে কতিপয় মানুষ। অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে স্বীকার করেও মানুষের অধিকার, কর্তৃত্ব অসাধ্যের পরাকাষ্ঠায় আটকে আছে; বিপরীতে স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, নির্দয়তা, অনাচার, অবিচার প্রভূত রীতিমতো পবিত্র ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঐতিহ্যের প্রভাব থেকে রাষ্ট্রের কোন মহলই মুক্ত নয়, ৎধফরপধষ বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত না।

আমাদের গণতন্ত্রের বংশরক্ষা করতে গিয়ে জনগণকে অবরুদ্ধ করে, নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন উপর্যুপরি পুড়িয়ে মেরে, আহত পঙ্গু করে বিশ্ববাসীকে চমকে চমকে জানান দেয়া হলো- গণতন্ত্র রক্ষায় বাঙালির আত্মাহুতি ও ত্যাগের কৃতিত্ব। ক্ষমতার রাজনীতিতে মানুষ যে কত নগ্নভাবে বিক্রি হয়, তার দৃষ্টান্ত বুঝি আমাদেরই আছে। মানুষের হুঁশ ফেরাতে ধর্মও পারে না, যখন ধর্ম হয়ে ওঠে রাজনীতির হাতিয়ার, ব্যক্তি-গোষ্ঠীর অবলম্বন-অভ্যাস। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা রুদ্ধশ্বাস-কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ নগ্ন, নিষ্ঠুরতার মর্মান্তিক সব ছবি, আরও আছে- অনুদ্ঘাটিত সমাজ ও প্রশাসনের নির্লজ্জ চেহারা। আমাদের গোটা ‘সাংস্কৃতিক জলবায়ু’ আজ দূষিত। অন্যদিকে নানা উপদ্রব সংশয়ের মধ্যেও সত্যানুসন্ধানের কাহিনি রচিত হচ্ছে। অথচ শিক্ষাই গণতন্ত্রকে সত্য এবং সার্থক করার প্রথম এবং প্রধান শর্ত, সেখানে অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামির ব্যাপক অন্ধকারেই ডুবে আছে দেশ ও জাতি। গণতন্ত্র এখানে আদর্শ নয়, গালভরা গর্বের বাণী আর মিথ্যা ভাষ্যে পরিণত।

সাহিত্য-সংস্কৃতির লোকায়ত ইতিহাসে প্রকৃতি চরাচর কি মানুষের দেহকা-ে লেগে থাকে অন্তস্তলের কাদা-মাটি, স্থানীয় গন্ধ। উপমার মতো লেগে থাকে লোকায়ত জীবনের অফুরন্ত অভিজ্ঞতা, অবলোকন, প্রহেলিকাচূর্ণ শিল্পরূপ। সময়ের ব্যবধানে মাথাখোঁড়া অন্বেষণের ফলশ্রুতিই সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রমাণ। এভাবেও বলতে পারি, জীবনের মতোই নদীর যে ধারা একদিকে তার কূল ভাঙছে, অন্য ধারা অন্যদিকে তার কূল গড়ছে। ভাঙনের কূল রক্ষা করতে আমরা পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে রাখতে চাই বটে, কিন্তু শতসহস্র বছরের এই ভাঙা-গড়ার অভ্রভেদী কীর্তি প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে চলেছে। প্রকৃতির নিয়মে জীবনের ধর্মও তাই। প্রহেলিকাচূর্ণ শিল্পরূপ বলেছি কারণ, জীবনের প্রাণচাঞ্চল্য কিংবা অসারতা, আশা-দুরাশার অনির্বচনীয় উন্মাদনা কিংবা বঞ্চনাবোধের দুঃখ আজন্ম সময়সঞ্চিত কি ধুলায়লুণ্ঠিত হয়েও অমলিন মানুষের জীবনধারা ও তার ইতিহাস। সে ইতিহাসের অংশ একটা যান্ত্রিক জাগরণের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়ে চলেছে উন্নয়ন, প্রগতি ও সভ্যতা।

জীবনের সবটাই বাস্তবকেন্দ্রিক নয়, কিন্তু বাস্তবতা ছাড়া তো জীবন হয় না, আমরা তো দাঁড়িয়ে থাকি বাস্তবতার মাটিতে। তারপরও আমাদের চিত্তবৃত্তি আকাশ-বাতাসের মতো- সেখানে কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নির্মাণ যত কঠিনই হোক- আমরা ভালোবাসি, ভালোবাসতে চাই, কারণ না ভালোবেসে আমরা থাকতে পারি না। ভালোবাসা মানে- পরত্বে হৃদয়স্পর্শিতার উপস্থিতি ও অনুভব। সেজন্য সাধারণের সহাঅনুভূতিও আমরা কামনা করি, পেয়েও থাকি। এমনকি জগৎ ও জীবনের বিশাল প্রেক্ষাপটে যে চেহারা, তাকে আমরা মানবিকবোধে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দেখি।

এক আশ্চর্য পরিহাস, এক মারাত্মক চোরাবালি এই যান্ত্রিকতা, অভ্রভেদী আধুনিকতা, যার কাছে হাত বাড়িয়ে একটুখানি পাবার আশায় অনেকখানি হারাতে হয় আমাদের। আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে আর একটি অন্তর্নিহিত জীবনও আছে। বাইরে দৃশ্যমান না হলেও আমাদের বহির্জীবন আসলে সেই অন্তর্জীবনেরই এক অমোঘ শ্রুতিলিপি।

image
আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন

জামিরুল শরীফ

image

জীবনের স্বার্থেই জীবিকার উদ্ভব হয়েছিল একদিন। জীবন মানে যেখানে সংগ্রাম সেখানে জীবনধারণের জন্যই বিচিত্র জীবিকা অবলম্বিত হয়। এই জীবিকাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। কারণ এই পেশা যেমন ব্যক্তি-মানুষের নিজের গরজে, তেমনি সমষ্টিগত মানুষেরও বিশেষ প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে। এই পেশাই সমাজের অন্তর্বর্তী বন্ধন। মানুষের সঙ্গে মানুষের অন্তরঙ্গ যোগসূত্র। এক বিশেষ সমাজ ও ভূমিখন্ডের দৈনন্দিন রূপচিত্র, তার অভিপ্রায়-অভিরুচি, নকশা বা টপোগ্রাফি একসঙ্গে। পেশাগত জীবিকা অনেক দূরবর্তী মানুষকেও একান্নবর্তী করে তোলে। আমাদের দেশে, আমাদের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে কত বিচিত্র এবং বিস্ময়কর জীবিকা যে আছে অনেকেই তার খবর রাখি না। জীবিকা-উপজীবিকা মিলিয়ে এখানে যে কত জাতের, কত শ্রেণি উপশ্রেণির বৃত্তি বা পেশায় মানুষ বাঁধা রয়েছে তার সঠিক নথিতথ্য হয়তো কোথাও নেই। আর নেই বলেই কত বিচিত্র জীবিকা যে কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে কিংবা বিরল এবং বিলুপ্ত হতে চলেছে সেটা সহজে চোখে পড়ে না। সমাজের চেহারা ও চাহিদায় জনজীবনের রূপরেখায় আজ কত বদল ঘটেছে তা বলে বিস্মিত ও দীর্ঘশ্বাসে মথিত হতে হয়।

আমরা যেন অনেকদূর চলে এসেছি, সময়ের সঙ্গে প্রয়োজনের তাগিদে। এসেছি বলতে অনেকটা ছেড়ে চলে এসেছি। বাদ দিয়েছি, বদলে নিয়েছি। ফলে ব্যবহারিক জীবনে এবং জীবিকা নির্বাহে যে জিনিসগুলো একসময় ছিল অপরিহার্য, আজ তা পরিহার করেছি আমরা সহজেই। আজ গ্রাম বাংলায় ঢেঁকির শব্দ শুনি না- সেখানে এখন যান্ত্রিক আওয়াজ। মৃৎ শিল্পের ব্যবহার ভুলতে বসেছি, মাটির হাঁড়ি-পাতিল বাসনকোসনের জায়গা দখল করেছে ভিন্ন সামগ্রী। কামারদের পাড়া খুঁজেই পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে না পালকি, সেই বেহারাও নেই। নেই মেঠোপথে পালকি কাঁধে নিয়ে হুম-হুনা হুম-হুনা কোরাসে আওয়াজ। নদীগুলো শুকিয়ে বিরান প্রান্তরে সাপের খোলসের মতো পড়ে থাকে শুধু ধু ধু বালুরেখা। গুণটানা মাঝিরা কোথায় গেছে হারিয়ে। মজা খাল এখন চেহারা নিয়েছে কোন বিরহিনীর চোখের জলের শুকনো রেখায়। ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়িই ছিল এককালে রাজপথের, দূরপথের প্রধান বাহন। ছিল আস্তাবল, গরুর গোয়াল। কামার, কুমার, তাঁতি, সুতার, ধুনকার, গাছি, পটুয়া, মসলিন-জামদানি শিল্পী, ঘোড়ার গাড়ির কচোয়ান, এইসব জীবিকা নির্বাহীরা একালে যেন ঐতিহ্যের স্মৃতি। সেই ঋষিপাড়া নেই, বাঁশ ও বেতের কারিগররা আজ বিরল। কাঁধে করে বাঁখে দই নিয়ে আর হাঁক ছাড়ে না দই-ওয়ালা। প্রহরে প্রহরে শহরের-গ্রামের অলিগলি বেয়ে ফেরিয়ালার যে বিচিত্র ধ্বনিতরঙ্গ মিশে যেত, বিনোদনের মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় আসতো ‘ভানুমতির খেলা’ আর ‘বায়োস্কোপের মেলা’- হাঁক ছাড়তো দুনিয়া দেখো- দু’-আনায়...। পরানপুরের হাটে হাটুরেদের ভিড়ে যে মানুষগুলো বানরের খেলা দেখাতো, রেলস্টেশনের পেছনে যে সাপুড়েরা সাপখেলা দেখাতো, কবিরাজি তাবিজের তেজারতি দেখাতো তুলারাশি হাতে... মনে করতাম তাবিজের মুষ্টি হাতের মোড়কে কী জাদু আছে, জানি না কোন বিচিত্র বিস্ময় ও মজা লুকিয়ে আছে। কৌতূহলি দৃষ্টিতে বিস্ময়ের প্রহর কাটতো। কোন গভীর উদ্দেশ্য যে ছিল তা নয়, তা ছিল খানিকটা উদ্ভটতা, রসকরা এবং মস্করার মধ্য দিয়ে বিনোদনী কৌতুকে গাছগাছড়ার ঔষধি ও তাবিজ বিক্রির কৌশল মাত্র; তা যারা কিনতেন, তাদের দৃষ্টিবিভ্রমই শুধু ঘটাতো না, মতিভ্রমও ঘটাতো। তারা অনেককাল এপেশা থেকে নিশ্চিহ্ন। কালের প্রবাহে তারা আজ অশ্রুত। তাদের উত্তর পুরুষ হয়তো কলকারখানার বৃহৎ প্রযুক্তির ঠেলায় কুটির-ঘরানার পসরা ও পেশা বদলে কোনক্রমে টিকে আছে এখনও। কিন্তু জীবনের সেই স্বাদ, সেই অন্তরঙ্গ আবেগ হারিয়ে ফেলেছে কবেই। এসব আজ গল্প। এই গল্পই এককালে ছিল সাধারণের জীবিকার যোগ, আমাদের ঐতিহ্য, গ্রামীণ ও জাতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ। আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতির অঙ্গ। সময়ের পালাবদলে তারই অঙ্গহানি ঘটেছে আজ। গ্রাম ছুটে চলেছে শহরে, মহানগরে। ‘ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়’-নগরে আছে প্রমোদ, পল্লীতে আছে আত্মার প্রশান্তি। পল্লীর সেই মায়াবি স্নিগ্ধতা আমরা খুইয়ে বসেছি, কংক্রিটের আগ্রাসনে সে প্রায় নিঃশেষিত। হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ জীবনের দৈনন্দিন চিত্রগুলো। কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসছে তাদের মুখচ্ছবি। সেই সঙ্গে জীবনের অলিখিত ইতিহাসও হারিয়ে যেতে বসেছে সময়ের পালাবদলের হাত ধরে।

‘আমার সঙ্গে চলো মহানগরে, যে মহানগর ছড়িয়ে আছে আকাশের তলায় পৃথিবীর ক্ষতের মতো, আবার যে মহানগর উঠেছে মিনারে আর চূড়ায় আর অভ্রভেদী প্রাসাদ-শিখরে তারাদের দিকে, প্রার্থনার মতো মানবাত্মার। আমার সঙ্গে এসো মহানগরের পথে, যে পথ জটিল, দুর্বল মানুষের জীবনধারার মতো, যে পথ

অন্ধকার মানুষের মনের অরণ্যের মতো, আর যে পথ প্রশস্ত, আলোকোজ্জ্বল, মানুষের বুদ্ধি, মানুষের অদম্য উৎসাহের মতো’- কংক্রিটের শহরে ধাতু আর পাথরের ক্ষীণ প্রতিধ্বনির ভেতর ব্যক্তি হৃদয়ের স্বপ্ন-আতিশয্য, দুরন্ত ঘাত-প্রতিঘাতময় প্রায় উন্মোচিত ধ্বনি। আমাদের জীবনে পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব, পাপ আর পতনের রগরগে ঘটনাও আছে। জীবন অনেকসময় বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলেও মানুষের অনন্ত কৌতূহলই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘মহানগর’ সেই মহামূল্য জীবনের আলেখ্য হয়ে রইলো বাংলা সাহিত্যে। গ্রামীণ ধুলোর ঘূর্ণি আর ঝরাপাতা, কচিপাতার ছন্দে জীবন দোলে। সাহিত্য যেহেতু জীবনেরই প্রতিবিম্ব, এবং আমার মতে গদ্য-পদ্যের যে সমন্বয় সাহিত্যে দ্রষ্টব্য, তার দৃষ্টান্ত জীবনেও সুলভ। সচেতন পাঠকমাত্রই একমত হবেন যে, আজকের আধুনিককালের সাহিত্য-নিসর্গকাব্যে মানব ও প্রকৃতির পরিচয় নেই। যা পাই তা কেবল কল্পনা-বর্ণনামাত্র।

সমাজের হাওয়া বদলেছে, প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে রুচির হাওয়ার বদল ঘটেছে, আমাদের জীবনের প্রাক্তন পরিচয়গুলোর প্রেক্ষাপটও বাতিল ঘটেছে। আজ আমরা স্বাধীন, সমাজ-বাঁধন ছিন্ন করেছি, কিন্তু বন্ধনমুক্ত হতে পারিনি, এবং তা সম্ভব নয়। জীবনের মর্মঘাতী তাড়না থেকে অব্যাহতি পাওয়াও অসম্ভব। অভ্রভেদী আলোকোজ্জ্বল প্রাসাদ-শিখরের তলায় মানুষ আছে কেবল বাঁচার তাগিদে, খানিক দূরত্বে দীন-হীন কুটিরে মাটির প্রদীপ জ্বলে। দারিদ্র্যপীড়িত সংসার, সারাদিন খেটে... পেটে ভাত জোটে না। নিরাবরণ জীবন দুঃস্বপ্নের উপদ্রবে ভরা।

স্বাধীন দেশ নির্বিবেক হিংস্রবাদ আর অকথ্য প্রবৃত্তির লীলাভূমি। তার মনস্তত্ত্ব অবদমিত বাসনার লোভে, ভোগে, মূঢ়তার মানুষী আত্মপ্রবঞ্চনায় রুগ্ন, মুমূর্ষু। তার ধর্ম, কর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, দেশাত্মবোধ, প্রেম ও প্রতিজ্ঞার মূলে নিষ্কাম আদর্শের প্রেরণা নেই। মন যদি হয় জটিল, সরলতার অভিনয়ে, বিশ্বাসের সমর্থনে সে কুটিলও বটে- এমন মানুষ আত্মবাদী স্বার্থপরতার বদভ্যাসে শিকড় গেড়ে বসে আছে। বাঙালির ইতিহাস উৎসবকে বাদ দিলে জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যা দেখা দিয়েছে- নানা স্বভাবের সংমিশ্রণে আমাদের ভেতর পশুত্বের সঙ্করতার আবির্ভাব। মানুষ বারবার যেমন আচার-আচরণের পরিচয় দেয়, তা হয়তো বুদ্ধি বিবেচনাহীন পশুর কাছেও অপ্রত্যাশিত। যেহেতু আত্ম-স্বার্থবাদী একদেশদর্শির ঝোঁক শুভবাদ বা সুবিচারের দিকে নয়, অন্যায়, বর্বরতা, ব্যভিচারের দিকেই, সেহেতু গায়ে-গতরে সে মানুষ হলেও আবেগে আচরণে কর্মে স্বভাবতই পশুত্বের আবেশে বিকৃত। অহিংসা মনুষ্যত্বের নামাঙ্কিত, হিংসা হলো জন্মগত প্রবৃত্তি। এর পেছনে সমাজ ও পরিবেশের হাত আছে কি নেই তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে, তবে জন্মের আছে, কিন্তু ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাজনীতি, অর্থ, ধর্ম বা সংগঠন বাদ দেয়া যায় না। সেখানে স্বার্থ ও নিজেদের সমর্থনে কৃত্রিমতা, ভেজাল, দুর্নীতিসহ অবিবেকী সব কর্মকা-, একদেশদর্শিতার ভূয়োদর্শন ইত্যাদি আমাদের কলুষিত, বিভ্রান্ত ও তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের ধৈর্যও সহসা বাঁধ ভাঙে না, উপায় খোঁজে- ‘হালের কাছে মাঝি আছে করবে তরী পার’- বলে আমাদের মরমী মন হাল ছেড়ে বসে আছে। ধর্মীয় রক্ষণশীল মনোভাব স্রষ্টার অনুগ্রহের আশায় সকল দায়-কর্তব্য থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, ইহলৌকিক অভিনিবেশ ঝেড়ে ফেলতে পারে না। আমাদের চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠে মিল নেই, সত্তায় আমরা শয়তানে-স্রষ্টায় মাখামাখি, স্বার্থের বেলায় সহৃদয়-কোমল, প্রয়োজনে স্নেহান্ধ-প্রেমান্ধ, কাজে-কর্তব্যে আত্মবাদী, নিষ্ঠুর। অর্থাৎ অহিংসা আর হিংসা অটুট ও অভিন্নহৃদয়- উভয়েই স্বার্থে অধীর, আত্মবাদী, নিষ্ঠুর ও একদেশদর্শী। ফলে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ট্র্যাজেডির শোচনীয় ঘটনার যেমন শেষ নেই- তেমনি মর্মাহত বিস্ময়ে উপলব্ধি করি, আমি মানুষ- আমি পাপী, আমি মানুষ- আমি দুঃখী, আমি মানুষ- আমি রুগ্ন, আমি মানুষ- আমি মুমূর্ষু। আধুনিক সভ্যতার শতগৌরবেও আত্মিক যন্ত্রণায় ইন্ধন যুগিয়েছে কতিপয় মানুষ। অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে স্বীকার করেও মানুষের অধিকার, কর্তৃত্ব অসাধ্যের পরাকাষ্ঠায় আটকে আছে; বিপরীতে স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, নির্দয়তা, অনাচার, অবিচার প্রভূত রীতিমতো পবিত্র ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঐতিহ্যের প্রভাব থেকে রাষ্ট্রের কোন মহলই মুক্ত নয়, ৎধফরপধষ বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত না।

আমাদের গণতন্ত্রের বংশরক্ষা করতে গিয়ে জনগণকে অবরুদ্ধ করে, নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষকে দিনের পর দিন উপর্যুপরি পুড়িয়ে মেরে, আহত পঙ্গু করে বিশ্ববাসীকে চমকে চমকে জানান দেয়া হলো- গণতন্ত্র রক্ষায় বাঙালির আত্মাহুতি ও ত্যাগের কৃতিত্ব। ক্ষমতার রাজনীতিতে মানুষ যে কত নগ্নভাবে বিক্রি হয়, তার দৃষ্টান্ত বুঝি আমাদেরই আছে। মানুষের হুঁশ ফেরাতে ধর্মও পারে না, যখন ধর্ম হয়ে ওঠে রাজনীতির হাতিয়ার, ব্যক্তি-গোষ্ঠীর অবলম্বন-অভ্যাস। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা রুদ্ধশ্বাস-কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ নগ্ন, নিষ্ঠুরতার মর্মান্তিক সব ছবি, আরও আছে- অনুদ্ঘাটিত সমাজ ও প্রশাসনের নির্লজ্জ চেহারা। আমাদের গোটা ‘সাংস্কৃতিক জলবায়ু’ আজ দূষিত। অন্যদিকে নানা উপদ্রব সংশয়ের মধ্যেও সত্যানুসন্ধানের কাহিনি রচিত হচ্ছে। অথচ শিক্ষাই গণতন্ত্রকে সত্য এবং সার্থক করার প্রথম এবং প্রধান শর্ত, সেখানে অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামির ব্যাপক অন্ধকারেই ডুবে আছে দেশ ও জাতি। গণতন্ত্র এখানে আদর্শ নয়, গালভরা গর্বের বাণী আর মিথ্যা ভাষ্যে পরিণত।

সাহিত্য-সংস্কৃতির লোকায়ত ইতিহাসে প্রকৃতি চরাচর কি মানুষের দেহকা-ে লেগে থাকে অন্তস্তলের কাদা-মাটি, স্থানীয় গন্ধ। উপমার মতো লেগে থাকে লোকায়ত জীবনের অফুরন্ত অভিজ্ঞতা, অবলোকন, প্রহেলিকাচূর্ণ শিল্পরূপ। সময়ের ব্যবধানে মাথাখোঁড়া অন্বেষণের ফলশ্রুতিই সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও তথ্যপ্রমাণ। এভাবেও বলতে পারি, জীবনের মতোই নদীর যে ধারা একদিকে তার কূল ভাঙছে, অন্য ধারা অন্যদিকে তার কূল গড়ছে। ভাঙনের কূল রক্ষা করতে আমরা পাথর দিয়ে বাঁধিয়ে রাখতে চাই বটে, কিন্তু শতসহস্র বছরের এই ভাঙা-গড়ার অভ্রভেদী কীর্তি প্রকৃতির নিয়মেই ঘটে চলেছে। প্রকৃতির নিয়মে জীবনের ধর্মও তাই। প্রহেলিকাচূর্ণ শিল্পরূপ বলেছি কারণ, জীবনের প্রাণচাঞ্চল্য কিংবা অসারতা, আশা-দুরাশার অনির্বচনীয় উন্মাদনা কিংবা বঞ্চনাবোধের দুঃখ আজন্ম সময়সঞ্চিত কি ধুলায়লুণ্ঠিত হয়েও অমলিন মানুষের জীবনধারা ও তার ইতিহাস। সে ইতিহাসের অংশ একটা যান্ত্রিক জাগরণের মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়ে চলেছে উন্নয়ন, প্রগতি ও সভ্যতা।

জীবনের সবটাই বাস্তবকেন্দ্রিক নয়, কিন্তু বাস্তবতা ছাড়া তো জীবন হয় না, আমরা তো দাঁড়িয়ে থাকি বাস্তবতার মাটিতে। তারপরও আমাদের চিত্তবৃত্তি আকাশ-বাতাসের মতো- সেখানে কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নির্মাণ যত কঠিনই হোক- আমরা ভালোবাসি, ভালোবাসতে চাই, কারণ না ভালোবেসে আমরা থাকতে পারি না। ভালোবাসা মানে- পরত্বে হৃদয়স্পর্শিতার উপস্থিতি ও অনুভব। সেজন্য সাধারণের সহাঅনুভূতিও আমরা কামনা করি, পেয়েও থাকি। এমনকি জগৎ ও জীবনের বিশাল প্রেক্ষাপটে যে চেহারা, তাকে আমরা মানবিকবোধে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দেখি।

এক আশ্চর্য পরিহাস, এক মারাত্মক চোরাবালি এই যান্ত্রিকতা, অভ্রভেদী আধুনিকতা, যার কাছে হাত বাড়িয়ে একটুখানি পাবার আশায় অনেকখানি হারাতে হয় আমাদের। আমাদের জীবনের অভ্যন্তরে আর একটি অন্তর্নিহিত জীবনও আছে। বাইরে দৃশ্যমান না হলেও আমাদের বহির্জীবন আসলে সেই অন্তর্জীবনেরই এক অমোঘ শ্রুতিলিপি।