কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ

রবিউল হুসাইন

ঢাকা শহরের নগরায়ন শুরু হয়েছে ঢাকা নগরী বাংলা সুবার প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগের থেকে। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাইয়ে ঢাকা রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমানে এবং ইসলাম খান সুবেদার নিযুক্ত হন যদিও আরো দুই বছর লেগেছিল রাজধানীর নানান কর্মকান্ড পরিচালনা করার বিভিন্ন ভবন বা কার্যালয় নির্মাণে। তাই ১৬১০ সাল থেকেই রাজধানীর শুরু বলে ধরা হয়।

ঢাকায় প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা একটু তাড়াতাড়ি বলে মনে হলেও তা সত্যি, যেহেতু সেসময় পর্তুগিজ জলদস্যুরা জোর করে বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে অমানবিকভাবে তাদের অপহরণ করে ইউরোপ-আমেরিকায় দাস হিসেবে পাঠানোর ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করতে এই রাজনৈতিক বিবেচনার বাস্তবায়ন অতি জরুরি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তারা নিরীহ গ্রামবাসীর ধন দৌলত মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ও শস্যফসলও লুট করে নিত।

এরপর ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে প্রাদেশিক রাজধানী স্থানান্তরিত হয় এবং ঢাকা শহর তার জৌলুস ও উপযোগিতা হারাতে থাকে। কাল পরিক্রমায় ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শঠতাপূর্ণ পলাশী যুদ্ধে পরাজিত হলে ভারত ভূখ- ব্রিটিশ রাজের এক উপনিবেশে পরিণত হয় এবং সুদীর্ঘ ১৯০ বছর পর্যন্ত তা বলবৎ ছিল। এর মধ্যে ঢাকা নগরী ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং তা ১৯১১ সাল পর্যন্ত চালু থাকে।

ভারত ভূখন্ড এবার ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান হিসেবে দুই ভাগে খন্ডিত হয়ে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি পায়। যে ঘটনাকে কৌতুকপূর্ণ এক রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন বলে বিবেচনা করা হয়। ভারত ভূখন্ডকে অবিবেচনাসুলভ ক্ষুরধারী বিভাজনে বাংলা ও পাঞ্জাব- এ দুইটি প্রদেশ এত নির্মম ও নিষ্ঠুর মূল্য দিয়েছে, যার জন্যে দলে দলে মানুষ নিজের জন্মভূমি ত্যাগ, ভাগ এবং হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় ১০ লাখ নির্দোষ নিষ্পাপ প্রাণ ভারতীয় রাজনৈতিক মূষিক-নেতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক অহমিকা, তথাকথিত দেশ প্রেম, ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিত্ব ও ক্ষীণ দৃষ্টির অকারণ কারণে খামাখা উজাড় হয়ে গেছে কোনো বড় কিছুর অর্জন ছাড়া বৃটিশদের ষড়যন্ত্রী আয়োজনের কুফলে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, এর ফলে পাকিস্তান নামক একটি দেশের সৃষ্টি হলো ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে ১২০০ মাইলের দূরত্বে। পূর্ব-পশ্চিমের মাঝে, দুই-জাতিতত্ত্বে এবং ধর্মীয় চিন্তাধারায় পশ্চিম পাকিস্তান তার সেনাদল দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট ও শক্তিশালী এবং কপট-গর্বী হওয়াতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘাড়ের উপর বসে সেই প্রদেশকে নানান দিক থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৃষি ব্যবস্থা, শিল্প, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ, শোষণ ও শাসন করার অমানুষিক দুর্ব্যবস্থা পরিচালিত করতে থাকে জগদ্দল পাথর হয়ে দীর্ঘ ২৪ বছর যাবৎ সেই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। কিন্তু পূর্ববাংলার জনগণ তা মানেনি এবং সত্যিকারভাবে দেশটি ১৯৭১ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে সমর্থ হয়। হাজার হাজার বছর অন্যের দ্বারা শাসন, শোষণ, অত্যাচার এবং নিপীড়নের পর ৩০ লাখ শহীদ ও ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে- যা মানব ইতিহাসে বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অর্জন ও পিরিক বিজয় বা Pyrrhic victory হিসেবে পরিচিহ্নিত।

পাকিস্তানি বর্বর সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক নেতৃত্বে, বাঙালি কৃষক শ্রমিক ছাত্র, শিক্ষক, গ্রামবাসী, শহরবাসী আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায়, ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনে এবং বিশ্ববাসী সচেতন নাগরিকদের অকুণ্ঠ অনুপ্রেরণা ও বিবেক শাসিত কর্মকুশলতায়।

বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা পায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ এবং ঢাকা নগর বাংলাদেশের পূর্ণ এক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও ঘোষিত হয়। সেই সময় থেকে আজ ৪৮ বছর এই ২০১৯-এ এসে চলছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ঢাকা সেই আশানুযায়ী স্বাস্থ্যকর, পরিবেশবান্ধব, অগ্রসর, যানজট-দূষণ-বর্জ্যমুক্ত, নাগরিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নত, পরিপূর্ণ ও পরিশীলিত হয়ে উঠতে পারল না।

ঢাকা শহরের চতুর্দিক সাত-সাতটি নদী দ্বারা বেষ্টিত এবং ঘেরাওকৃত, যেমনÑ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বংশী, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী এবং নারাই; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইচ্ছে থাকলেও সেই নদীগুলোকে নির্দিষ্টভাবে চোখ দিয়ে দেখার উপায় নেই।

এই শহরের উপর্যুক্ত অন্যান্য উপাদান-কাঠামোর তুলনায় ফাঁকা সবুজ ময়দান, মাঠ, খেলাধুলা-বিনোদন-বেড়ানোর জায়গা একেবারে শূন্যের কোঠায়।

শহরটি গণতন্ত্রী নীতি অনুসরণে পরিচালিত অথচ রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুসারে কোন জনসভা, সমাবেশ বা প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার কোন উন্মুক্ত প্রান্তর পরিসর কোথাও নেই, অথচ কথায় আছে গণতন্ত্রের চর্চা করতে উন্মুক্ত ও ফাঁকা ময়দানের প্রয়োজন।

রাস্তা-ঘাট দখল, শাহবাগ অঞ্চল অচল কিংবা প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা জুড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনার নামে গণতান্ত্রিক অধিকার অঙ্গীকার পালনের মাধ্যমে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টির অসুবিধা ও অতি-আচার কখনো কাম্য হতে পারে না। এগুলো শহরের অন্ধকার অধ্যায়, বিষাদ-বিন্দু ও বিয়োগচিহ্ন এবং দুর্বলতা।

জলাশয় এখন মলাশয়, কোথাও ঝর্নাধারা নেই, জলবিন্দু নেই। আছে ইট আর জমাট-বাঁধা কংক্রিটের জঙ্গল, বৃক্ষহীন প্রান্তরে শুধু উঁচু-নিচু ভবন ও সৌধ।

চারিদিকে বসবাস করার জায়গা কিন্তু কোথাও খেলাধুলা করার মাঠ নেই। ফলে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ও কিশোর-কিশোরীরা রাস্তার ওপর অস্বাভাবিক উপায়ে চালিত গাড়ি, স্কুটার, রিক্সা ইত্যাদির মধ্যে থেমে থেমে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে থাকে।

আবার অসহায়ভাবে দেখা যায় আবাসিক অঞ্চল শুধু বসবাস করার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হলেও তা আর বিশেষভাবে নির্দিষ্ট হয়ে বিভাজিত হয়ে থাকতে পারছে না। একই জায়গার মধ্যে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, হাসপাতাল-ক্লিনিক-প্যাথলজি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়- একটি ভবনের মধ্যে সব কিছু, ব্যাংক, বিয়ে-শাদির জন্য কম্যুনিটি সেন্টার, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, শপিং সেন্টার ইত্যাদি সব কিছুর সমাহার দেখা যায়।

আশ্চর্যজনকভাবে নগর কর্তৃপক্ষের নিয়ম-নীতির কোন কিছু না মেনে যথেচ্ছভাবে এসব গড়ে উঠলেও এর কোন শাস্তিমূলক সংশোধন, সাবধানতা, উচ্ছেদ, নিষিদ্ধকরণ, কোনকিছুই করা হয় না অথচ এগুলো সব দেশেই ভয়ানক নাগরিক অপরাধ, শাস্তিযোগ্য চরম দুর্বৃত্তায়নের বিপরীতে সমূলে উচ্ছেদ ও চিরদিনের জন্যে নিষিদ্ধ করার কঠোর ব্যবস্থা আছে। যাতে কেউ কখনো এরকম অনিয়ম, ক্ষতিকর কার্যক্রম ও অপরাধ ভবিষ্যতে আর করতে সাহস না পায় এবং তা দৃষ্টান্তমূলক হয়ে থাকবে সবার কাছে সব সময়ে। যদি এরকম আইন করে একটি যথাযথ সুব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসা না হয়, তবে বাংলাদেশের রাজধানী প্রিয় শহর ঢাকাসহ সব শহরের কপালে একই দশা ঘটবে।

কারণ নগর গবেষণায় দেখা গেছে যে একটি নগর বা শহর সর্বমোট কমবেশি সাতটি স্তরের মধ্যে প্রসারণ, প্রবর্ধন, প্রবর্তন ও প্রবহমান হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে, (এক) Eopolis, গ্রামায়ন, (দুই) Polis নগরায়ন, (তিন) Metropolis মাতৃসমা আদর্শ নগরী, (চার) Megapolis নগরের পতন শুরুর অবস্থা যেমন বর্তমানের ঢাকা শহর, (পাঁচ) Teranapolis নাগরিক হতাশা-নির্বিণ্নতার আরম্ভ, (ছয়) Necropolis মৃতের শহর এবং (সাত) Geotrapolis পাতাল বা ভূগর্ভস্থ নগরী, মাটিচাপা পড়ে থেকে হারিয়ে যায় হয়তো একসময় প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়িতে তার ধ্বংসাবশেষ ওয়ারী-বটেশ্বরের মতো খুঁজে পাওয়া যাবে।

ঢাকা শহরকে আমরা সবাই ভালোবাসি কিন্তু শ্রদ্ধা বা সম্মান করি না। তাই বলা যায় না শহরটিকে ভালোবাসি। যেহেতু সম্মান বা শ্রদ্ধা ছাড়া ভালবাসা হয় না এবং গড়ে ওঠে না এখন ঢাকা শহরকে সম্মান শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসতে হলে নিচে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো জরুরীভিত্তিতে বাস্তবে রূপ দেয়া একান্তভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা শহরের জন্মদিন ১৬ জুলাই প্রতি বছর যৌথভাবে পালন করার কার্যক্রম সূচনা ও শুভারম্ভ করতে পারে। যে দিনে সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৪ সনে ঢাকা শহরকে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে সুবেদার ইসলাম খাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন বিরাজমান সমস্যার সমাধান ও ভবিষ্যতে উন্নত পরিকল্পনা গ্রহণ করার আলোচনা হতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশেষ করে উন্মুক্ত দুর্গন্ধ, বায়ু ও দৃষ্টি দূষণীয় পরিবেশে পরিচ্ছন্নতা, উন্নয়ন ও অবাধে রাস্তাঘাটে চলাচল নিশ্চিত করতে প্রধান সমস্যা নিরসনে সচেষ্টতা অতি জরুরি। ঢাকা শহরকে নিয়ে পৃথক একটি মেট্রোপলিটন সরকার গঠন।

ঢাকা শহরের সার্বিক কল্যাণে নাগরিকদের মধ্য থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাছাই করে একটি নাগরিক পর্ষদ বা সিটিজেনস কমিটি গঠন যারা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হবেন, ডিজাইন এ্যান্ড ক্রিয়েটিভ সেন্টার বা নক্সা ও সৃজনী কেন্দ্র গড়ে তুলে তার একজন ডিজাইন কমিশনার বা নক্সা প্রধান নির্বাচন করবেন, তরুণ স্থপতি, প্রকৌশলী ও নগরবিদদের সাহায্যে যারা ঢাকা শহরের সৌন্দর্য, পরিকল্পনা ও উন্নত-গঠনমূলক কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করে এগিয়ে যাবেন। যে কোন অবৈধ স্থাপনা দেখামাত্র তা বন্ধ করার ক্ষমতা থাকবে।

ঢাকা শহরকে ঘিরে রাখা ৭টি নদী ও ২৬টি খালের নাব্য ফিরিয়ে এনে এসবের বর্জ্য দূর করে পরিচ্ছন্ন জল-যোগাযোগের সূচনা করা; দেশের সব নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, হ্রদ-বিল, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলকে জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে, এসবের অবৈধ দখল দূষণ করা রাষ্ট্রীয় অপরাধ বলে অমার্জনীয় দেশদ্রোহিতা বিবেচনা আর বুড়িগঙ্গার বর্জ্য অপসারণ, নাব্যতা আনয়ন, দূষণমুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এনে এর ওপর আরও সেতু নির্মাণ করে ঢাকা শহরকে জিঞ্জিরার দিকে সম্প্রসারণ-প্রক্রিয়া শুরু করে বিস্তৃত পরিকল্পনায় ঢাকার নাম তখন ঢাকাঞ্জিরা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠায় সহায়তা করা।

ঐতিহ্যবাহী সংরক্ষণযোগ্য ভবনসমূহের মালিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তা সংস্কার করে জনসাধারণ ও পর্যটকদের কাছে ইতিহাস তুলে ধরা।

ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরের বিপুল পরিমাণ জৈব ও অজৈব বর্জ্য বাছাই করে তার মধ্যে থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ সংরক্ষণ এবং পচনশীল বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎশক্তি তৈরির ব্যবস্থা। এই সঙ্গে জৈব উপাদান থেকে প্রাকৃতিক সার প্রস্তুতকরণ।

ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে ভূগর্ভে ও ভূমির ওপরে রাস্তার বিস্তার, সপ্তাহের ছুটির দিন গাড়িমুক্ত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে শুধু হাঁটা বা রিক্সা বাহন ব্যবহার বাস্তবায়ন।

সরকারি মন্ত্রণালয়ে মিনিস্ট্রি অব ফিজিক্যাল প্লানিং বা ভৌত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় গঠন করে সমগ্র বাংলাদেশকে মহাপরিকল্পনায় নিয়ে এসে চাহিদানুযায়ী কৃষি, শিল্প, নগর, গ্রাম-জনপদ, সমুদ্র, নদ-নদী, জলাশয়, পাহাড়-বনাঞ্চল নির্দিষ্ট করে সে সবের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

দেশটিকে কমপক্ষে আটটি প্রদেশে বা বিভাগে ভাগ করে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াই ঢাকা শহরের এককেন্দ্রিকতা ভেঙে বাণিজ্য, বিচার ও প্রশাসন এ তিনটিকে সেইসব বিভাগে বিভাজিত করে ঢাকা শহরের ওপর দুঃসহ চাপ কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা শহরের কাছে তাই কুয়ালালামপুর থেকে পুত্রজায়ার মতো প্রশাসনিক রাজধানী নির্মাণ করতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ঢাকার অদূরে সাভার-টঙ্গীতে প্রশাসনিক রাজধানী, চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক রাজধানী, রাজশাহী বা দিনাজপুরে বিচারিক রাজধানী গড়ে তোলা।

ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়েছে তেমনি ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ এবং সেই সঙ্গে ঢাকার শেরেবাংলা নগর সংসদ ভবন ও অন্যান্য স্থাপনাসমূহ বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার যথাযথ কার্যক্রম সরকার কর্তৃক গ্রহণ করা।

যেখানে অবস্থিত মূল লুই কানকৃত পরিকল্পনাবহির্ভূত রাষ্ট্রপতি জিয়ার কবর, এর চতুর্দিকে মুক্তিযুদ্ধে সব শহীদ, সেক্টর কমান্ডারের কবর ধর্মীয় রীতির পরিপন্থী কিছু না করে পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে একটি যৌথ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা।

ঢাকা শহরে প্রস্তাবিত সংস্কৃতি বলয় বাস্তবায়নের সঙ্গে কোন উপযুক্ত স্থানে একটি ১০০০ ফুট উঁচু ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁসহ পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ।

লন্ডনের টেমস নদীর পাশে ঘূর্ণায়মান ‘লন্ডন আই’র মতো বুড়িগঙ্গার তীরে ‘ঢাকার চোখ’।

বেইজিং-হংকংয়ের মতো ঢাকা শহরের একটি ত্রিমাত্রিক দৃশ্যমান মডেল নির্মাণ। এরকম বাস্তবমুখী পরিকল্পনায় ঢাকা শহর বাংলাদেশে নতুন করে জন্ম নেবে।

এখন মুজিববর্ষ বঙ্গবন্ধুর ১০০ বছর পূর্তি স্মরণে তাঁর একটি দন্ডায়মান ভাস্কর্য ১০০০ মিটার উচ্চতায় নির্মিত করে ঢাকা শহরের সৌন্দর্য বর্ধন বা আইকন হিসেবে দাঁড়াতে পারে। এসব স্বপ্ন নিশ্চয়ই একদিন পরিপূর্ণ হবে।

স্থাপত্যশিল্প যেহেতু একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শিল্প, যারা ক্ষমতাসীন ও জনগণ-দেশবান্ধব তাদের দ্বারাই এসবের বাস্তবায়ন সম্ভব। এই প্রেক্ষিতে নগরায়নের বদলে বিপরীতে ‘গ্রামায়ণ’ শুরু হয় বা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের ধান্য সংস্কৃতির মূল শক্তি কৃষি শিল্পের বিপুল বিকাশে কৃষিভূমির বিস্তার বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

১০ তলা বা বহুতলা বিশিষ্ট আবাসগৃহ নিয়ে সারি সারি গ্রাম অর্থাৎ উল্লম্ব গ্রাম যেগুলো কৃষিজমি আর খাল-বিল-নদী-হাওরের পাড়ে নির্মিত হবে।

শিল্প-কারখানা বা আবাসিক প্রকল্প, কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নামে শত শত একর জমি অধিগ্রহণ করে করপোরেট বা যৌথ-নিগমবদ্ধ পুঁজিবাদী বাণিজ্যের অবাধ রাষ্ট্রানাকুল্যে খেলাপি ঋণ করে তার নির্লজ্জ-নির্মম বিস্তার এভাবে রোধ করা সম্ভবপর হতো।

ফলে গ্রামে-গঞ্জে খাড়া ও উঁচু বহুতলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন নিয়ে উল্লম্ব বা Vertical গ্রাম-এ সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, মৎস্য ও জীবজন্তুর বর্জ্য দিয়ে গ্যাস ও জৈব সার সৃষ্টির সুব্যবস্থাসহ নিচের সমতল আনুভূমিক জমিতে সমবায়ভিত্তিক হাঁস, মুরগি, শাক-সবজি, মাচের চাষ, গবাদিপশু পালন, দুগ্ধ খামার, ফুল-ফল, মধুর চাষ, বন ও জলাধার সৃষ্টি এবং সংরক্ষণ, শিক্ষা, সুচিকিৎসা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ, ছোট কারখানা স্থাপন, বিনোদন-মেলা-কুটিরশিল্প, সঙ্গীত, খেলাধুলা, সাঁতার, যাত্রা, নৃত্য, জারি সারি আউল-বাউল-লালন-হাসন রাজার গান চর্চা বিকাশ নিয়মিত নদী ভাঙন রোধ করাসহ সবুজ স্থাপত্য সৃষ্টিতে এমন স্বয়ংক্রিয়, টেকসই ও ডিজিটাল ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে গ্রামবাসীরা অন্যের দ্বারা সাহায্য-সহযোগিতার বদলে নিজেরাই স্বাধীনভাবে নারীকুলের আবশ্যিক অবশ্যতার অংশগ্রহণ দ্বারা পরিচালিত করতে সক্ষম হবে।

এইভাবে বাংলাদেশের নদীবাহিত পলিমাটির সবুজ গ্রামবাংলা তখন গ্রামায়ণের উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে সারা বিশ্বের মধ্যে একটি পৃথক পরিচিতি পাবে, আমরা বাঙালিরা সেই আশার বাস্তবায়ন দৃঢ়ভাবে পোষণ করি এই একবিংশ শতাব্দিতে, মনে প্রাণে মননে।

image

প্রচ্ছদ : মনিরুল ইসলাম

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ

রবিউল হুসাইন

image

প্রচ্ছদ : মনিরুল ইসলাম

ঢাকা শহরের নগরায়ন শুরু হয়েছে ঢাকা নগরী বাংলা সুবার প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার আগের থেকে। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাইয়ে ঢাকা রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমানে এবং ইসলাম খান সুবেদার নিযুক্ত হন যদিও আরো দুই বছর লেগেছিল রাজধানীর নানান কর্মকান্ড পরিচালনা করার বিভিন্ন ভবন বা কার্যালয় নির্মাণে। তাই ১৬১০ সাল থেকেই রাজধানীর শুরু বলে ধরা হয়।

ঢাকায় প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা একটু তাড়াতাড়ি বলে মনে হলেও তা সত্যি, যেহেতু সেসময় পর্তুগিজ জলদস্যুরা জোর করে বাংলার গ্রামগঞ্জ থেকে অমানবিকভাবে তাদের অপহরণ করে ইউরোপ-আমেরিকায় দাস হিসেবে পাঠানোর ব্যবসা চিরতরে বন্ধ করতে এই রাজনৈতিক বিবেচনার বাস্তবায়ন অতি জরুরি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তারা নিরীহ গ্রামবাসীর ধন দৌলত মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী ও শস্যফসলও লুট করে নিত।

এরপর ১৭০৪ সালে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে প্রাদেশিক রাজধানী স্থানান্তরিত হয় এবং ঢাকা শহর তার জৌলুস ও উপযোগিতা হারাতে থাকে। কাল পরিক্রমায় ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শঠতাপূর্ণ পলাশী যুদ্ধে পরাজিত হলে ভারত ভূখ- ব্রিটিশ রাজের এক উপনিবেশে পরিণত হয় এবং সুদীর্ঘ ১৯০ বছর পর্যন্ত তা বলবৎ ছিল। এর মধ্যে ঢাকা নগরী ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং তা ১৯১১ সাল পর্যন্ত চালু থাকে।

ভারত ভূখন্ড এবার ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান হিসেবে দুই ভাগে খন্ডিত হয়ে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তি পায়। যে ঘটনাকে কৌতুকপূর্ণ এক রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন বলে বিবেচনা করা হয়। ভারত ভূখন্ডকে অবিবেচনাসুলভ ক্ষুরধারী বিভাজনে বাংলা ও পাঞ্জাব- এ দুইটি প্রদেশ এত নির্মম ও নিষ্ঠুর মূল্য দিয়েছে, যার জন্যে দলে দলে মানুষ নিজের জন্মভূমি ত্যাগ, ভাগ এবং হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় ১০ লাখ নির্দোষ নিষ্পাপ প্রাণ ভারতীয় রাজনৈতিক মূষিক-নেতৃত্ব, সাম্প্রদায়িক অহমিকা, তথাকথিত দেশ প্রেম, ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিত্ব ও ক্ষীণ দৃষ্টির অকারণ কারণে খামাখা উজাড় হয়ে গেছে কোনো বড় কিছুর অর্জন ছাড়া বৃটিশদের ষড়যন্ত্রী আয়োজনের কুফলে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, এর ফলে পাকিস্তান নামক একটি দেশের সৃষ্টি হলো ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে ১২০০ মাইলের দূরত্বে। পূর্ব-পশ্চিমের মাঝে, দুই-জাতিতত্ত্বে এবং ধর্মীয় চিন্তাধারায় পশ্চিম পাকিস্তান তার সেনাদল দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট ও শক্তিশালী এবং কপট-গর্বী হওয়াতে পূর্ব পাকিস্তানের ঘাড়ের উপর বসে সেই প্রদেশকে নানান দিক থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৃষি ব্যবস্থা, শিল্প, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও স্থাপত্য শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ, শোষণ ও শাসন করার অমানুষিক দুর্ব্যবস্থা পরিচালিত করতে থাকে জগদ্দল পাথর হয়ে দীর্ঘ ২৪ বছর যাবৎ সেই ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। কিন্তু পূর্ববাংলার জনগণ তা মানেনি এবং সত্যিকারভাবে দেশটি ১৯৭১ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে সমর্থ হয়। হাজার হাজার বছর অন্যের দ্বারা শাসন, শোষণ, অত্যাচার এবং নিপীড়নের পর ৩০ লাখ শহীদ ও ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে- যা মানব ইতিহাসে বিশাল ত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অর্জন ও পিরিক বিজয় বা Pyrrhic victory হিসেবে পরিচিহ্নিত।

পাকিস্তানি বর্বর সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে এই বিজয় সম্ভব হয়েছিল নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক নেতৃত্বে, বাঙালি কৃষক শ্রমিক ছাত্র, শিক্ষক, গ্রামবাসী, শহরবাসী আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায়, ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থনে এবং বিশ্ববাসী সচেতন নাগরিকদের অকুণ্ঠ অনুপ্রেরণা ও বিবেক শাসিত কর্মকুশলতায়।

বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা পায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ এবং ঢাকা নগর বাংলাদেশের পূর্ণ এক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও ঘোষিত হয়। সেই সময় থেকে আজ ৪৮ বছর এই ২০১৯-এ এসে চলছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ঢাকা সেই আশানুযায়ী স্বাস্থ্যকর, পরিবেশবান্ধব, অগ্রসর, যানজট-দূষণ-বর্জ্যমুক্ত, নাগরিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নত, পরিপূর্ণ ও পরিশীলিত হয়ে উঠতে পারল না।

ঢাকা শহরের চতুর্দিক সাত-সাতটি নদী দ্বারা বেষ্টিত এবং ঘেরাওকৃত, যেমনÑ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বংশী, বালু, তুরাগ, ধলেশ্বরী এবং নারাই; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইচ্ছে থাকলেও সেই নদীগুলোকে নির্দিষ্টভাবে চোখ দিয়ে দেখার উপায় নেই।

এই শহরের উপর্যুক্ত অন্যান্য উপাদান-কাঠামোর তুলনায় ফাঁকা সবুজ ময়দান, মাঠ, খেলাধুলা-বিনোদন-বেড়ানোর জায়গা একেবারে শূন্যের কোঠায়।

শহরটি গণতন্ত্রী নীতি অনুসরণে পরিচালিত অথচ রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুসারে কোন জনসভা, সমাবেশ বা প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার কোন উন্মুক্ত প্রান্তর পরিসর কোথাও নেই, অথচ কথায় আছে গণতন্ত্রের চর্চা করতে উন্মুক্ত ও ফাঁকা ময়দানের প্রয়োজন।

রাস্তা-ঘাট দখল, শাহবাগ অঞ্চল অচল কিংবা প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা জুড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনার নামে গণতান্ত্রিক অধিকার অঙ্গীকার পালনের মাধ্যমে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টির অসুবিধা ও অতি-আচার কখনো কাম্য হতে পারে না। এগুলো শহরের অন্ধকার অধ্যায়, বিষাদ-বিন্দু ও বিয়োগচিহ্ন এবং দুর্বলতা।

জলাশয় এখন মলাশয়, কোথাও ঝর্নাধারা নেই, জলবিন্দু নেই। আছে ইট আর জমাট-বাঁধা কংক্রিটের জঙ্গল, বৃক্ষহীন প্রান্তরে শুধু উঁচু-নিচু ভবন ও সৌধ।

চারিদিকে বসবাস করার জায়গা কিন্তু কোথাও খেলাধুলা করার মাঠ নেই। ফলে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ও কিশোর-কিশোরীরা রাস্তার ওপর অস্বাভাবিক উপায়ে চালিত গাড়ি, স্কুটার, রিক্সা ইত্যাদির মধ্যে থেমে থেমে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে থাকে।

আবার অসহায়ভাবে দেখা যায় আবাসিক অঞ্চল শুধু বসবাস করার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত হলেও তা আর বিশেষভাবে নির্দিষ্ট হয়ে বিভাজিত হয়ে থাকতে পারছে না। একই জায়গার মধ্যে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুডের দোকান, হাসপাতাল-ক্লিনিক-প্যাথলজি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়- একটি ভবনের মধ্যে সব কিছু, ব্যাংক, বিয়ে-শাদির জন্য কম্যুনিটি সেন্টার, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, শপিং সেন্টার ইত্যাদি সব কিছুর সমাহার দেখা যায়।

আশ্চর্যজনকভাবে নগর কর্তৃপক্ষের নিয়ম-নীতির কোন কিছু না মেনে যথেচ্ছভাবে এসব গড়ে উঠলেও এর কোন শাস্তিমূলক সংশোধন, সাবধানতা, উচ্ছেদ, নিষিদ্ধকরণ, কোনকিছুই করা হয় না অথচ এগুলো সব দেশেই ভয়ানক নাগরিক অপরাধ, শাস্তিযোগ্য চরম দুর্বৃত্তায়নের বিপরীতে সমূলে উচ্ছেদ ও চিরদিনের জন্যে নিষিদ্ধ করার কঠোর ব্যবস্থা আছে। যাতে কেউ কখনো এরকম অনিয়ম, ক্ষতিকর কার্যক্রম ও অপরাধ ভবিষ্যতে আর করতে সাহস না পায় এবং তা দৃষ্টান্তমূলক হয়ে থাকবে সবার কাছে সব সময়ে। যদি এরকম আইন করে একটি যথাযথ সুব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে আসা না হয়, তবে বাংলাদেশের রাজধানী প্রিয় শহর ঢাকাসহ সব শহরের কপালে একই দশা ঘটবে।

কারণ নগর গবেষণায় দেখা গেছে যে একটি নগর বা শহর সর্বমোট কমবেশি সাতটি স্তরের মধ্যে প্রসারণ, প্রবর্ধন, প্রবর্তন ও প্রবহমান হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে, (এক) Eopolis, গ্রামায়ন, (দুই) Polis নগরায়ন, (তিন) Metropolis মাতৃসমা আদর্শ নগরী, (চার) Megapolis নগরের পতন শুরুর অবস্থা যেমন বর্তমানের ঢাকা শহর, (পাঁচ) Teranapolis নাগরিক হতাশা-নির্বিণ্নতার আরম্ভ, (ছয়) Necropolis মৃতের শহর এবং (সাত) Geotrapolis পাতাল বা ভূগর্ভস্থ নগরী, মাটিচাপা পড়ে থেকে হারিয়ে যায় হয়তো একসময় প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়িতে তার ধ্বংসাবশেষ ওয়ারী-বটেশ্বরের মতো খুঁজে পাওয়া যাবে।

ঢাকা শহরকে আমরা সবাই ভালোবাসি কিন্তু শ্রদ্ধা বা সম্মান করি না। তাই বলা যায় না শহরটিকে ভালোবাসি। যেহেতু সম্মান বা শ্রদ্ধা ছাড়া ভালবাসা হয় না এবং গড়ে ওঠে না এখন ঢাকা শহরকে সম্মান শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসতে হলে নিচে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো জরুরীভিত্তিতে বাস্তবে রূপ দেয়া একান্তভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।

দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা শহরের জন্মদিন ১৬ জুলাই প্রতি বছর যৌথভাবে পালন করার কার্যক্রম সূচনা ও শুভারম্ভ করতে পারে। যে দিনে সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৪ সনে ঢাকা শহরকে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে সুবেদার ইসলাম খাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন বিরাজমান সমস্যার সমাধান ও ভবিষ্যতে উন্নত পরিকল্পনা গ্রহণ করার আলোচনা হতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশেষ করে উন্মুক্ত দুর্গন্ধ, বায়ু ও দৃষ্টি দূষণীয় পরিবেশে পরিচ্ছন্নতা, উন্নয়ন ও অবাধে রাস্তাঘাটে চলাচল নিশ্চিত করতে প্রধান সমস্যা নিরসনে সচেষ্টতা অতি জরুরি। ঢাকা শহরকে নিয়ে পৃথক একটি মেট্রোপলিটন সরকার গঠন।

ঢাকা শহরের সার্বিক কল্যাণে নাগরিকদের মধ্য থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাছাই করে একটি নাগরিক পর্ষদ বা সিটিজেনস কমিটি গঠন যারা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হবেন, ডিজাইন এ্যান্ড ক্রিয়েটিভ সেন্টার বা নক্সা ও সৃজনী কেন্দ্র গড়ে তুলে তার একজন ডিজাইন কমিশনার বা নক্সা প্রধান নির্বাচন করবেন, তরুণ স্থপতি, প্রকৌশলী ও নগরবিদদের সাহায্যে যারা ঢাকা শহরের সৌন্দর্য, পরিকল্পনা ও উন্নত-গঠনমূলক কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলোচনা করে এগিয়ে যাবেন। যে কোন অবৈধ স্থাপনা দেখামাত্র তা বন্ধ করার ক্ষমতা থাকবে।

ঢাকা শহরকে ঘিরে রাখা ৭টি নদী ও ২৬টি খালের নাব্য ফিরিয়ে এনে এসবের বর্জ্য দূর করে পরিচ্ছন্ন জল-যোগাযোগের সূচনা করা; দেশের সব নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, হ্রদ-বিল, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলকে জাতীয় সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে, এসবের অবৈধ দখল দূষণ করা রাষ্ট্রীয় অপরাধ বলে অমার্জনীয় দেশদ্রোহিতা বিবেচনা আর বুড়িগঙ্গার বর্জ্য অপসারণ, নাব্যতা আনয়ন, দূষণমুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এনে এর ওপর আরও সেতু নির্মাণ করে ঢাকা শহরকে জিঞ্জিরার দিকে সম্প্রসারণ-প্রক্রিয়া শুরু করে বিস্তৃত পরিকল্পনায় ঢাকার নাম তখন ঢাকাঞ্জিরা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠায় সহায়তা করা।

ঐতিহ্যবাহী সংরক্ষণযোগ্য ভবনসমূহের মালিকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তা সংস্কার করে জনসাধারণ ও পর্যটকদের কাছে ইতিহাস তুলে ধরা।

ঢাকা শহর এবং অন্যান্য শহরের বিপুল পরিমাণ জৈব ও অজৈব বর্জ্য বাছাই করে তার মধ্যে থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ সংরক্ষণ এবং পচনশীল বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎশক্তি তৈরির ব্যবস্থা। এই সঙ্গে জৈব উপাদান থেকে প্রাকৃতিক সার প্রস্তুতকরণ।

ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে ভূগর্ভে ও ভূমির ওপরে রাস্তার বিস্তার, সপ্তাহের ছুটির দিন গাড়িমুক্ত দিবস হিসেবে ঘোষণা করে শুধু হাঁটা বা রিক্সা বাহন ব্যবহার বাস্তবায়ন।

সরকারি মন্ত্রণালয়ে মিনিস্ট্রি অব ফিজিক্যাল প্লানিং বা ভৌত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় গঠন করে সমগ্র বাংলাদেশকে মহাপরিকল্পনায় নিয়ে এসে চাহিদানুযায়ী কৃষি, শিল্প, নগর, গ্রাম-জনপদ, সমুদ্র, নদ-নদী, জলাশয়, পাহাড়-বনাঞ্চল নির্দিষ্ট করে সে সবের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

দেশটিকে কমপক্ষে আটটি প্রদেশে বা বিভাগে ভাগ করে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াই ঢাকা শহরের এককেন্দ্রিকতা ভেঙে বাণিজ্য, বিচার ও প্রশাসন এ তিনটিকে সেইসব বিভাগে বিভাজিত করে ঢাকা শহরের ওপর দুঃসহ চাপ কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা শহরের কাছে তাই কুয়ালালামপুর থেকে পুত্রজায়ার মতো প্রশাসনিক রাজধানী নির্মাণ করতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ঢাকার অদূরে সাভার-টঙ্গীতে প্রশাসনিক রাজধানী, চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক রাজধানী, রাজশাহী বা দিনাজপুরে বিচারিক রাজধানী গড়ে তোলা।

ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হয়েছে তেমনি ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ এবং সেই সঙ্গে ঢাকার শেরেবাংলা নগর সংসদ ভবন ও অন্যান্য স্থাপনাসমূহ বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার যথাযথ কার্যক্রম সরকার কর্তৃক গ্রহণ করা।

যেখানে অবস্থিত মূল লুই কানকৃত পরিকল্পনাবহির্ভূত রাষ্ট্রপতি জিয়ার কবর, এর চতুর্দিকে মুক্তিযুদ্ধে সব শহীদ, সেক্টর কমান্ডারের কবর ধর্মীয় রীতির পরিপন্থী কিছু না করে পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে একটি যৌথ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা।

ঢাকা শহরে প্রস্তাবিত সংস্কৃতি বলয় বাস্তবায়নের সঙ্গে কোন উপযুক্ত স্থানে একটি ১০০০ ফুট উঁচু ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁসহ পর্যবেক্ষণ স্তম্ভ।

লন্ডনের টেমস নদীর পাশে ঘূর্ণায়মান ‘লন্ডন আই’র মতো বুড়িগঙ্গার তীরে ‘ঢাকার চোখ’।

বেইজিং-হংকংয়ের মতো ঢাকা শহরের একটি ত্রিমাত্রিক দৃশ্যমান মডেল নির্মাণ। এরকম বাস্তবমুখী পরিকল্পনায় ঢাকা শহর বাংলাদেশে নতুন করে জন্ম নেবে।

এখন মুজিববর্ষ বঙ্গবন্ধুর ১০০ বছর পূর্তি স্মরণে তাঁর একটি দন্ডায়মান ভাস্কর্য ১০০০ মিটার উচ্চতায় নির্মিত করে ঢাকা শহরের সৌন্দর্য বর্ধন বা আইকন হিসেবে দাঁড়াতে পারে। এসব স্বপ্ন নিশ্চয়ই একদিন পরিপূর্ণ হবে।

স্থাপত্যশিল্প যেহেতু একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শিল্প, যারা ক্ষমতাসীন ও জনগণ-দেশবান্ধব তাদের দ্বারাই এসবের বাস্তবায়ন সম্ভব। এই প্রেক্ষিতে নগরায়নের বদলে বিপরীতে ‘গ্রামায়ণ’ শুরু হয় বা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের ধান্য সংস্কৃতির মূল শক্তি কৃষি শিল্পের বিপুল বিকাশে কৃষিভূমির বিস্তার বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।

১০ তলা বা বহুতলা বিশিষ্ট আবাসগৃহ নিয়ে সারি সারি গ্রাম অর্থাৎ উল্লম্ব গ্রাম যেগুলো কৃষিজমি আর খাল-বিল-নদী-হাওরের পাড়ে নির্মিত হবে।

শিল্প-কারখানা বা আবাসিক প্রকল্প, কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নামে শত শত একর জমি অধিগ্রহণ করে করপোরেট বা যৌথ-নিগমবদ্ধ পুঁজিবাদী বাণিজ্যের অবাধ রাষ্ট্রানাকুল্যে খেলাপি ঋণ করে তার নির্লজ্জ-নির্মম বিস্তার এভাবে রোধ করা সম্ভবপর হতো।

ফলে গ্রামে-গঞ্জে খাড়া ও উঁচু বহুতলা বিশিষ্ট আবাসিক ভবন নিয়ে উল্লম্ব বা Vertical গ্রাম-এ সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, মৎস্য ও জীবজন্তুর বর্জ্য দিয়ে গ্যাস ও জৈব সার সৃষ্টির সুব্যবস্থাসহ নিচের সমতল আনুভূমিক জমিতে সমবায়ভিত্তিক হাঁস, মুরগি, শাক-সবজি, মাচের চাষ, গবাদিপশু পালন, দুগ্ধ খামার, ফুল-ফল, মধুর চাষ, বন ও জলাধার সৃষ্টি এবং সংরক্ষণ, শিক্ষা, সুচিকিৎসা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ, ছোট কারখানা স্থাপন, বিনোদন-মেলা-কুটিরশিল্প, সঙ্গীত, খেলাধুলা, সাঁতার, যাত্রা, নৃত্য, জারি সারি আউল-বাউল-লালন-হাসন রাজার গান চর্চা বিকাশ নিয়মিত নদী ভাঙন রোধ করাসহ সবুজ স্থাপত্য সৃষ্টিতে এমন স্বয়ংক্রিয়, টেকসই ও ডিজিটাল ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে গ্রামবাসীরা অন্যের দ্বারা সাহায্য-সহযোগিতার বদলে নিজেরাই স্বাধীনভাবে নারীকুলের আবশ্যিক অবশ্যতার অংশগ্রহণ দ্বারা পরিচালিত করতে সক্ষম হবে।

এইভাবে বাংলাদেশের নদীবাহিত পলিমাটির সবুজ গ্রামবাংলা তখন গ্রামায়ণের উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে সারা বিশ্বের মধ্যে একটি পৃথক পরিচিতি পাবে, আমরা বাঙালিরা সেই আশার বাস্তবায়ন দৃঢ়ভাবে পোষণ করি এই একবিংশ শতাব্দিতে, মনে প্রাণে মননে।