বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল

আতিউর রহমান

আসছে শ্রাবণ মাস। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বর্ষার বারিধারা। শ্রাবণে এই ধারা নতুন মাত্রা পাবে। কেননা এই শ্রাবণ মাসেই আমাদের সবচেয়ে গর্বের ধন জাতির পিতার অকাল প্রয়াণ ঘটে। তাই পুরো জাতি এ মাসে থাকে মুহ্যমান। আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথেরও প্রয়াণের মাস এই শ্রাবণ। তবে বঙ্গবন্ধুর চলে যাওয়ার ঘটনাটি বড়ই হৃদয়বিদারক। স্বদেশকে গভীরভাবে ভালোবেসে যিনি সারা জীবনের প্রতিটি ক্ষণ নিবেদন করেছিলেন দেশবাসীর মুক্তির জন্যে তাঁকেই কিনা এমন নির্মমতার শিকার হয়ে চলে যেতে হলো তাঁর প্রিয় স্বদেশবাসীদের ছেড়ে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের জন্যে তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ। তাই শোকের এই মাসে তাঁরা ভাবেন এদেশটি আরো কতো আগেই না অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নের স্বাদ পেতো যদি না বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ এমন করে চলে যেতে হতো। যদিও তাঁর সুকন্যা পরবর্তী পর্বে এসে গরিব-দুঃখীর দুঃখ মোচনের নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তবুও মাঝখানে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে জাতির জীবন থেকে। আর ঐ সময়ে গরিব-বিদ্বেষী যে সব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেসব পরিবর্তন করে স্বদেশকে ফের বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ ছিল না। এখনো রয়ে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সব আবর্জনা দূর করে সমৃদ্ধির পথে স্বদেশকে এগিয়ে নেয়া মোটেও সহজ নয়। অর দ্রুত বেড়ে ওঠা অতি ধনীদের কারসাজি এড়িয়ে সাধারণের কল্যাণে নিবেদিত থাকাও বেশ কষ্টসাধ্য। এমনি এক বাস্তবতায় আমরা স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতিকৌশলকে। স্পষ্টতই বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। এ কারণে আমরা দেখতে পাই সেই ছোট্টবেলা থেকেই এবং পরবর্তীতে তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে এটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন- মানুষের উন্নয়নে কথা। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মাঝে বরাবরই প্রস্ফুটিত হয়েছে এটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার পান এদেশের সাধারণ জনগণ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে তিনি বিরাট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উন্নয়ন দর্শনে তিনি প্রথমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। একই সাথে বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক

জোরদার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান-প্রণয়ন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) পুনর্গঠন, যোগাযোগ-ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ইসলাম-বিরোধী কর্মকান্ড নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, নতুন ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ মোট ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ, দুস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী-পুনর্বাসন ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ প্রায় ৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ, কৃষকদের মাঝে দেড় লাখ গাভি ও ৪০ হাজার সেচপাম্প বিতরণ এবং ব্যাপক কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দেবার জন্যে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন। এছাড়াও বিনা/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক-বীমার ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও সেসব চালুর মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বঙ্গ শিল্প-কারখানা চালুসহ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য। স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ, পুরো দেশবাসীকে এ কাজে উজ্জীবিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেয়া পদক্ষেপসমূহ আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল-ব্যবস্থার উন্নয়ন, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন, দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ণ, উত্তর-দক্ষিণ শীতল রাজনৈতিক মেরুকরণে দেশেকে ‘জোট নিরপেক্ষ- সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয়’ নীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা, পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ণ, আদম শুমারি ইত্যাদি কর্মপ্রয়াসে বঙ্গবন্ধু উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড়ো অংশই জুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক। সারা বাংলাদেশের হৃদয়কে এক করার নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি কৃষকদের চাওয়া-পাওয়াকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। গরিবহিতৈষী বঙ্গবন্ধু সেজন্যেই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমার দেশের কৃষকেরা সবচাইতে নির্যাতিত।’ কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্যে তিনি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতী মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। পঞ্চাশের দশকে তাঁকে দেখেছি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষকের পক্ষে কথা বলতে, ষাটের দশকে দেখেছি ছয় দফার আন্দোলনে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সোচ্চার হতে। আর স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখেছি সর্বক্ষণ কৃষক-অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ তারিখের ভাষণেও এদেশের কৃষক-সমাজের অধিকার সংরক্ষণের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে কৃষকদের জন্যে অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর দশ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যে-সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুননির্মাণ, কৃষি-যন্ত্রপাতি সরবরাহ জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্যে ধানবীজ, পাটবীজ ও গমবীজ সরবরাহ করা হয়। দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লক্ষ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়া হয় ও তাঁদের সকল বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক নিম্নমূল্যের রেশন-সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য নিবারণের তাগিদে কৃষি-উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পর্যায়ে আনা হয়। ঐ সময় দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল শতকরা ৩৫ ভাগ। বিরাজমান খাসজমির সঙ্গে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির সরবরাহ বৃদ্ধির জন্যে বঙ্গবন্ধু পরিবারপিছু জমির সিলিং ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের খাদ্যঘাটতি ছিল প্রাথমিক হিসেবে ৩০ লক্ষ টন। তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে অত্যন্ত জোরদার উদ্যোগ নেন। এর ফলে ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লক্ষ একরে উন্নীত হয়। বাংলার কৃষককে সারে ভর্তুকি দিয়ে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু। গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানি প্রাপ্তি, সেচব্যবস্থার প্রসার, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাস জমি প্রাপ্তি এবং মূল্যসমর্থনমূলক সচেতন ও কৃষকদরদী নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে-ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সেই ধারাকে আরও বেগবান করেছেন।

কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, বিশেষ করে অধিক ফসল উৎপাদন, সেই সঙ্গে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারেন সেদিকে বঙ্গবন্ধুর সুদৃষ্টি ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে কৃষি-উৎপাদনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ খুব বেশি না থাকলেও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেচ, সার, বীজ ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষকদেরকে তাদের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে বলতেন। জেলা-গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষি ও কৃষকদের প্রতি নজর দেওয়ার জন্যে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষিই যেহেতু এ দেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস, সেহেতু কৃষির উন্নতিই হবে দেশের উন্নতি।

’৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্তি নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব। এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উল্লিখিত বিষয়গুলো জাতীয়করণ করেছে।

ব্যাংকসমূহ (বিদেশী ব্যাংকের শাখাগুলো বাদে), ২. সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসহ (বিদেশী বীমা কোম্পানির শাখাসমূহ বাদে), ৩. সকল পাটকল, ৪. সকল বস্ত্র সূতাকল, ৪. সকল চিনিকল, ৫. অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ-যানের বৃহদংশ, ৬. ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের তদুর্ধ্ব সকল পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি, ৭. বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসাবে স্থাপন করা হয়েছে এবং ৮. সমগ্র বহির্বাণিজ্য রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহদংশকে এই মুহূর্তে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।’

ঐ দিন তিনি আরও বলেন, সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বি বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্যে আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভোর, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা অটল, আমাদের সমস্ত নীতিÑ আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুস্তর পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতেই হবে।’

তবে শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পায়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করলেও ধীরে ধীরে তিনি ব্যক্তিখাতের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হন। তাই ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক উল্লেখ করেন যে, “পুঁজি বিনিয়োগে বেসরকারি উদ্যোক্তাদিগকে যথাযথ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য এবং বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে, সরকার চলতি অর্থবৎসরের শুরুতে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লক্ষ হইতে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করেন এবং বেসরকারী খাতে কয়েকটি নতুন শিল্প গড়িয়া তোলার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। (বাজেট বক্তৃতা, ১৯৭৫-৭৬, পৃ: ৫)। তাছাড়া ১৩৩টি পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়, ৮২টি ব্যক্তিমালিকানায় ও ৫১টি কর্মচারী সমবায়ের নিকট বিক্রি করা হয়। এভাবেই তাঁর জীবদ্দশাতেই শিল্পায়নকে ‘ডিরেগুলেট’ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়া বেগবান হয়। ধীরে ধীরে ব্যক্তিখাত শিল্পায়নের মূল চলিকাশক্তিতে আবির্ভূত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত ব্যক্তিখাত নির্ভর হলেও তাকে সহায়তার জন্যে জ্বালনীসহ মেগা অবকাঠামো খাত সরকারি বিনিয়োগেই গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ঘিরেই দেশে উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে আমরা ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮.২০ শতাংশ। শুধু প্রবৃদ্ধি নয় এদেশের বঞ্চিতজনদের জন্য ব্যাপক অংকের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। অতিদারিদ্র্যের হার আগামী কয়েক বছরেই কমিয়ে পাঁচ শতাংশের আশেপাশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সবার জন্য পেনশন কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনাও তাঁর রয়েছে। প্রবাসী কর্মীদের সবাইকে জীবণ বীমার আওতায় আনার তোড়জোড় চলছে। মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী সবাই এখন ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারছেন। ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে স্বস্তি। বড় বড় অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে জনজীবনে অরো স্বস্তির সুযোগ বাড়বে বলে আশা করা যায়। মধ্যবিত্তের জীবন চলা এখনো বেশ চাপের মুখেই রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রেখে সবার জন্য গুণমানের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ আরো বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে সেজন্যে চাই সার্বিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। রাজনৈতিক ও সামাজিক শান্তি বজায় রাখা গেলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জয়যাত্রা নিশ্চয় অব্যাহত রাখা যাবে। তাছাড়া, পুরো ২০২০ সাল জুড়ে আমরা নানা আয়োজনের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করবো। এ জন্যে গঠিত জাতীয় কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কিছুিদন আগে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভায় বসেছিলাম। সদস্যরা অনেক সৃজনশীল প্রস্তাব রেখেছেন। আমি প্রস্তাব করেছিলাম যে স্ট্যাচু অব লিবার্টির আদলে বঙ্গবন্ধুর একটি সুউচ্চ ভাস্কর্য স্থাপনের। আমাদের জাতীয় অহঙ্কার পদ্মাসেতুর আশেপাশে এই ভাস্কর্যটি স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলাম এই ভেবে যে, ঢাকার অদূরে এমন একটি স্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রেও রূপান্তর করা সম্ভব হবে। জেনে খুশি হলাম যে, এ প্রস্তাবটি মাননীয় প্রধামন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় কমিটি গ্রহণ করেছে। স্থানটি কোথায় হবে সেটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চয় ঠিক করা হবে। তবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এ জন্যে দেশের সেরা ভাস্করদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে আসন্ন ‘মুজিব বর্ষে’ নিঃসন্দেহে এটি হবে অনন্য এক মাইলফলক। আরেকটি প্রস্তাব করেছিলাম সেদিন। বলেছিলাম বঙ্গবন্ধু ছিলেন গরিবের বন্ধু। দুঃখী মানুষের বন্ধু। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার এগারো শতাংশ এখনও অতিদরিদ্র। অথচ এককালীন মাত্র পাঁচশ ডলার সম পরিমাণ বিনিয়োগ করলেই অতিদরিদ্র একটি পরিবারকে ঐ তকমা থেকে মুক্তি দেয়া যায়। আমরা যদি ধরে নেই এমন একটি পরিবারে ৫ জন সদস্য রয়েছেন তাহলে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ এমন মানুষের ৩৫ লক্ষ পরিবার রয়েছে। পাঁচশ ডলার করে এই ৩৫ লক্ষ পরিবারের জন্য বরাদ্দ করলে ১৭৬ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার লাগবে। ধরে নিলাম ২ বিলিয়ন ডলার। আরো ধরলাম অন্তত অর্ধেক মানুষকে তো অতিদারিদ্র্য রেখার ওপরে টেনে আনা সম্ভব হবে। এই পরিমাণ অর্থ কি আমাদের খরচের সাধ্য নেই? জেনে খুশি হলাম কমিটি এই প্রস্তাবটিও গ্রহণ করে বিশেষ উদ্যোগ নেবার জন্য সংশিষøষ্ট মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যাবার পক্ষে উদ্যোগ নিয়েছে। কেবিনেট সচিবালয় এ কর্মসূচির সমন্বয় করছে। আরো প্রস্তাব করেছিলাম বিদেশে যে সব বড় শহরে অধিক সংখ্যক অনাবাসী বাঙালি রয়েছেন সেখানে বঙ্গবন্ধু কেন্দ্র স্থাপনের। সেখানে আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা হবে। আরেকটি প্রস্তাব করেছিলাম আরো কিছু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু চেয়ার তৈরি করা। দেশে বিদেশে এরই মধ্যে যে সব বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন করা হয়েছে সেসবের চেয়ার অধ্যাপকদের নিয়ে দেশে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনেরও প্রস্তাব করেছিলাম। আমার ধারণা এসব নিয়ে বাস্তবায়ন কমিটি কাজ করছে। তাছাড়া, বত্রিশ নম্বর ও কুর্মিটোলায় জাতীয় যাদুঘরসহ অনেকগুলো জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা হলেও জীবনের বিরাট অংশ যে ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে তিনি কাটিয়েছেন তাকে মুজিববর্ষে দৃষ্টিনন্দন আরেকটি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব করেছিলাম। এখানে তাঁর ও তাঁর সহনেতাদে জেলের জীবন উপস্থাপন করা হবে। আশা করছি, এ প্রস্তাবটিও গৃহীত হবে। আর সবগুলো জাদুঘরকে একটি থ্রি-ডি ভার্চুয়াল জাদুঘরে রূপান্তরিত করে ডিজিটাল দর্শকদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের আহ্বানও জানিয়েছিলাম। আশা করি বাস্তবায়ন কমিটি এদিকে নজর দেবে।

আমি আরো বলেছিলাম গত বছর নিলফামারীতে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের সম্মেলন উপলক্ষে ঐ জেলার সকল স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের যুক্ত করে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। বাচ্চারা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও অবদান বিষয়ে রচনা লিখেছে, গল্প কবিতা লিখেছে। আমরা ‘মুজিব বর্ষে’ সারা দেশের শিক্ষালয়গুলোতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও তাঁর বহুমাত্রিক অবদান নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল কাজে যুক্ত করার ইচ্ছে রাখি। ইতোমধ্যেই এ নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। এমন আরো অনেক সৃজনশীল কাজের মাধ্যমেই আমরা ২০২০ সাল জুড়েই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে পারি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে তিনিই আমাদের অফুরন্ত ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। তাই তাঁকে ঘিরে এসব আয়োজন জাতি হিসেবে আমাদের আরো বেশি আশাবাদী করে তুলবে। আর বঙ্গবন্ধুর আত্মাও শান্তি পাবেন।

Email: dratiur@gmail.com

image

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড়ো অংশই জুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল

আতিউর রহমান

image

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড়ো অংশই জুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক

আসছে শ্রাবণ মাস। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে বর্ষার বারিধারা। শ্রাবণে এই ধারা নতুন মাত্রা পাবে। কেননা এই শ্রাবণ মাসেই আমাদের সবচেয়ে গর্বের ধন জাতির পিতার অকাল প্রয়াণ ঘটে। তাই পুরো জাতি এ মাসে থাকে মুহ্যমান। আরেক শ্রেষ্ঠ বাঙালি রবীন্দ্রনাথেরও প্রয়াণের মাস এই শ্রাবণ। তবে বঙ্গবন্ধুর চলে যাওয়ার ঘটনাটি বড়ই হৃদয়বিদারক। স্বদেশকে গভীরভাবে ভালোবেসে যিনি সারা জীবনের প্রতিটি ক্ষণ নিবেদন করেছিলেন দেশবাসীর মুক্তির জন্যে তাঁকেই কিনা এমন নির্মমতার শিকার হয়ে চলে যেতে হলো তাঁর প্রিয় স্বদেশবাসীদের ছেড়ে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, নিম্নমধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের জন্যে তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ। তাই শোকের এই মাসে তাঁরা ভাবেন এদেশটি আরো কতো আগেই না অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নের স্বাদ পেতো যদি না বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ এমন করে চলে যেতে হতো। যদিও তাঁর সুকন্যা পরবর্তী পর্বে এসে গরিব-দুঃখীর দুঃখ মোচনের নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তবুও মাঝখানে অনেকগুলো বছর হারিয়ে গেছে জাতির জীবন থেকে। আর ঐ সময়ে গরিব-বিদ্বেষী যে সব উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেসব পরিবর্তন করে স্বদেশকে ফের বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ ছিল না। এখনো রয়ে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সব আবর্জনা দূর করে সমৃদ্ধির পথে স্বদেশকে এগিয়ে নেয়া মোটেও সহজ নয়। অর দ্রুত বেড়ে ওঠা অতি ধনীদের কারসাজি এড়িয়ে সাধারণের কল্যাণে নিবেদিত থাকাও বেশ কষ্টসাধ্য। এমনি এক বাস্তবতায় আমরা স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতিকৌশলকে। স্পষ্টতই বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। এ কারণে আমরা দেখতে পাই সেই ছোট্টবেলা থেকেই এবং পরবর্তীতে তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে এটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন- মানুষের উন্নয়নে কথা। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মাঝে বরাবরই প্রস্ফুটিত হয়েছে এটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার পান এদেশের সাধারণ জনগণ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে তিনি বিরাট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উন্নয়ন দর্শনে তিনি প্রথমেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। একই সাথে বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক

জোরদার এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে উদ্যোগী হন। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান-প্রণয়ন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) পুনর্গঠন, যোগাযোগ-ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্যে প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড় ইত্যাদি ইসলাম-বিরোধী কর্মকান্ড নিষিদ্ধকরণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, নতুন ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ মোট ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ, দুস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী-পুনর্বাসন ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফসহ প্রায় ৩০ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ, কৃষকদের মাঝে দেড় লাখ গাভি ও ৪০ হাজার সেচপাম্প বিতরণ এবং ব্যাপক কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দেবার জন্যে ‘বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার’ প্রবর্তন করেন। এছাড়াও বিনা/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরণ বিতরণ, পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক-বীমার ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও সেসব চালুর মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপন, বঙ্গ শিল্প-কারখানা চালুসহ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সাফল্য। স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যেই দেশ পুনর্গঠনে বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ, পুরো দেশবাসীকে এ কাজে উজ্জীবিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর নেয়া পদক্ষেপসমূহ আশাতীত সাফল্য অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল-ব্যবস্থার উন্নয়ন, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার পুনর্গঠন, দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ণ, উত্তর-দক্ষিণ শীতল রাজনৈতিক মেরুকরণে দেশেকে ‘জোট নিরপেক্ষ- সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয়’ নীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা, পাঁচশালা পরিকল্পনা প্রণয়ণ, আদম শুমারি ইত্যাদি কর্মপ্রয়াসে বঙ্গবন্ধু উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বদেশকে। তাঁর শোষণহীন সমাজ গঠনের স্বপ্নের জমিনের বড়ো অংশই জুড়ে ছিল বাংলাদেশের কৃষক। সারা বাংলাদেশের হৃদয়কে এক করার নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি কৃষকদের চাওয়া-পাওয়াকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। গরিবহিতৈষী বঙ্গবন্ধু সেজন্যেই স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমার দেশের কৃষকেরা সবচাইতে নির্যাতিত।’ কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্যে তিনি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কৃষক-শ্রমিকসহ মেহনতী মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। পঞ্চাশের দশকে তাঁকে দেখেছি পাকিস্তানের পার্লামেন্টে কৃষকের পক্ষে কথা বলতে, ষাটের দশকে দেখেছি ছয় দফার আন্দোলনে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সোচ্চার হতে। আর স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখেছি সর্বক্ষণ কৃষক-অন্তপ্রাণ বঙ্গবন্ধুকে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ তারিখের ভাষণেও এদেশের কৃষক-সমাজের অধিকার সংরক্ষণের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দেন তাতে কৃষকদের জন্যে অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর দশ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না।’

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যে-সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুননির্মাণ, কৃষি-যন্ত্রপাতি সরবরাহ জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্যে ধানবীজ, পাটবীজ ও গমবীজ সরবরাহ করা হয়। দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লক্ষ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়া হয় ও তাঁদের সকল বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক নিম্নমূল্যের রেশন-সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য নিবারণের তাগিদে কৃষি-উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পর্যায়ে আনা হয়। ঐ সময় দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল শতকরা ৩৫ ভাগ। বিরাজমান খাসজমির সঙ্গে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির সরবরাহ বৃদ্ধির জন্যে বঙ্গবন্ধু পরিবারপিছু জমির সিলিং ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশের খাদ্যঘাটতি ছিল প্রাথমিক হিসেবে ৩০ লক্ষ টন। তাৎক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণে অত্যন্ত জোরদার উদ্যোগ নেন। এর ফলে ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লক্ষ একরে উন্নীত হয়। বাংলার কৃষককে সারে ভর্তুকি দিয়ে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু। গঙ্গা নদীর প্রবাহ থেকে অধিক পানি প্রাপ্তি, সেচব্যবস্থার প্রসার, উন্নত বীজ, সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত খাস জমি প্রাপ্তি এবং মূল্যসমর্থনমূলক সচেতন ও কৃষকদরদী নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে-ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা বজায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সেই ধারাকে আরও বেগবান করেছেন।

কৃষি ও কৃষকের উন্নতি, বিশেষ করে অধিক ফসল উৎপাদন, সেই সঙ্গে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারেন সেদিকে বঙ্গবন্ধুর সুদৃষ্টি ছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে কৃষি-উৎপাদনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ খুব বেশি না থাকলেও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। কৃষিকাজের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেচ, সার, বীজ ইত্যাদি ব্যবহারে কৃষকদেরকে তাদের নিজেদের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাতে বলতেন। জেলা-গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষি ও কৃষকদের প্রতি নজর দেওয়ার জন্যে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কৃষিই যেহেতু এ দেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস, সেহেতু কৃষির উন্নতিই হবে দেশের উন্নতি।

’৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে বেতার টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্তি নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব। এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উল্লিখিত বিষয়গুলো জাতীয়করণ করেছে।

ব্যাংকসমূহ (বিদেশী ব্যাংকের শাখাগুলো বাদে), ২. সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসহ (বিদেশী বীমা কোম্পানির শাখাসমূহ বাদে), ৩. সকল পাটকল, ৪. সকল বস্ত্র সূতাকল, ৪. সকল চিনিকল, ৫. অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ-যানের বৃহদংশ, ৬. ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের তদুর্ধ্ব সকল পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি, ৭. বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসাবে স্থাপন করা হয়েছে এবং ৮. সমগ্র বহির্বাণিজ্য রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহদংশকে এই মুহূর্তে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।’

ঐ দিন তিনি আরও বলেন, সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বি বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্যে আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভোর, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা অটল, আমাদের সমস্ত নীতিÑ আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুস্তর পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতেই হবে।’

তবে শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পায়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করলেও ধীরে ধীরে তিনি ব্যক্তিখাতের বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হন। তাই ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক উল্লেখ করেন যে, “পুঁজি বিনিয়োগে বেসরকারি উদ্যোক্তাদিগকে যথাযথ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য এবং বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে, সরকার চলতি অর্থবৎসরের শুরুতে বেসরকারী পুঁজি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লক্ষ হইতে ৩ কোটি টাকায় উন্নীত করেন এবং বেসরকারী খাতে কয়েকটি নতুন শিল্প গড়িয়া তোলার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। (বাজেট বক্তৃতা, ১৯৭৫-৭৬, পৃ: ৫)। তাছাড়া ১৩৩টি পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়, ৮২টি ব্যক্তিমালিকানায় ও ৫১টি কর্মচারী সমবায়ের নিকট বিক্রি করা হয়। এভাবেই তাঁর জীবদ্দশাতেই শিল্পায়নকে ‘ডিরেগুলেট’ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়া বেগবান হয়। ধীরে ধীরে ব্যক্তিখাত শিল্পায়নের মূল চলিকাশক্তিতে আবির্ভূত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত ব্যক্তিখাত নির্ভর হলেও তাকে সহায়তার জন্যে জ্বালনীসহ মেগা অবকাঠামো খাত সরকারি বিনিয়োগেই গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ঘিরেই দেশে উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। সর্বশেষ অর্থবছরে আমরা ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮.২০ শতাংশ। শুধু প্রবৃদ্ধি নয় এদেশের বঞ্চিতজনদের জন্য ব্যাপক অংকের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। অতিদারিদ্র্যের হার আগামী কয়েক বছরেই কমিয়ে পাঁচ শতাংশের আশেপাশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সবার জন্য পেনশন কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনাও তাঁর রয়েছে। প্রবাসী কর্মীদের সবাইকে জীবণ বীমার আওতায় আনার তোড়জোড় চলছে। মোবাইল ব্যাংকের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী সবাই এখন ব্যাংকিং লেনদেন করতে পারছেন। ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে স্বস্তি। বড় বড় অবকাঠামোর উন্নয়নের ফলে জনজীবনে অরো স্বস্তির সুযোগ বাড়বে বলে আশা করা যায়। মধ্যবিত্তের জীবন চলা এখনো বেশ চাপের মুখেই রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রেখে সবার জন্য গুণমানের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ আরো বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে সেজন্যে চাই সার্বিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। রাজনৈতিক ও সামাজিক শান্তি বজায় রাখা গেলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জয়যাত্রা নিশ্চয় অব্যাহত রাখা যাবে। তাছাড়া, পুরো ২০২০ সাল জুড়ে আমরা নানা আয়োজনের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করবো। এ জন্যে গঠিত জাতীয় কমিটির একজন সদস্য হিসেবে কিছুিদন আগে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভায় বসেছিলাম। সদস্যরা অনেক সৃজনশীল প্রস্তাব রেখেছেন। আমি প্রস্তাব করেছিলাম যে স্ট্যাচু অব লিবার্টির আদলে বঙ্গবন্ধুর একটি সুউচ্চ ভাস্কর্য স্থাপনের। আমাদের জাতীয় অহঙ্কার পদ্মাসেতুর আশেপাশে এই ভাস্কর্যটি স্থাপনের প্রস্তাব করেছিলাম এই ভেবে যে, ঢাকার অদূরে এমন একটি স্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রেও রূপান্তর করা সম্ভব হবে। জেনে খুশি হলাম যে, এ প্রস্তাবটি মাননীয় প্রধামন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় কমিটি গ্রহণ করেছে। স্থানটি কোথায় হবে সেটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চয় ঠিক করা হবে। তবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এ জন্যে দেশের সেরা ভাস্করদের সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে আসন্ন ‘মুজিব বর্ষে’ নিঃসন্দেহে এটি হবে অনন্য এক মাইলফলক। আরেকটি প্রস্তাব করেছিলাম সেদিন। বলেছিলাম বঙ্গবন্ধু ছিলেন গরিবের বন্ধু। দুঃখী মানুষের বন্ধু। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার এগারো শতাংশ এখনও অতিদরিদ্র। অথচ এককালীন মাত্র পাঁচশ ডলার সম পরিমাণ বিনিয়োগ করলেই অতিদরিদ্র একটি পরিবারকে ঐ তকমা থেকে মুক্তি দেয়া যায়। আমরা যদি ধরে নেই এমন একটি পরিবারে ৫ জন সদস্য রয়েছেন তাহলে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ এমন মানুষের ৩৫ লক্ষ পরিবার রয়েছে। পাঁচশ ডলার করে এই ৩৫ লক্ষ পরিবারের জন্য বরাদ্দ করলে ১৭৬ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার লাগবে। ধরে নিলাম ২ বিলিয়ন ডলার। আরো ধরলাম অন্তত অর্ধেক মানুষকে তো অতিদারিদ্র্য রেখার ওপরে টেনে আনা সম্ভব হবে। এই পরিমাণ অর্থ কি আমাদের খরচের সাধ্য নেই? জেনে খুশি হলাম কমিটি এই প্রস্তাবটিও গ্রহণ করে বিশেষ উদ্যোগ নেবার জন্য সংশিষøষ্ট মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে এগিয়ে যাবার পক্ষে উদ্যোগ নিয়েছে। কেবিনেট সচিবালয় এ কর্মসূচির সমন্বয় করছে। আরো প্রস্তাব করেছিলাম বিদেশে যে সব বড় শহরে অধিক সংখ্যক অনাবাসী বাঙালি রয়েছেন সেখানে বঙ্গবন্ধু কেন্দ্র স্থাপনের। সেখানে আমাদের শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা হবে। আরেকটি প্রস্তাব করেছিলাম আরো কিছু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু চেয়ার তৈরি করা। দেশে বিদেশে এরই মধ্যে যে সব বঙ্গবন্ধু চেয়ার স্থাপন করা হয়েছে সেসবের চেয়ার অধ্যাপকদের নিয়ে দেশে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনেরও প্রস্তাব করেছিলাম। আমার ধারণা এসব নিয়ে বাস্তবায়ন কমিটি কাজ করছে। তাছাড়া, বত্রিশ নম্বর ও কুর্মিটোলায় জাতীয় যাদুঘরসহ অনেকগুলো জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করা হলেও জীবনের বিরাট অংশ যে ঢাকা কেন্দ্রীয় করাগারে তিনি কাটিয়েছেন তাকে মুজিববর্ষে দৃষ্টিনন্দন আরেকটি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব করেছিলাম। এখানে তাঁর ও তাঁর সহনেতাদে জেলের জীবন উপস্থাপন করা হবে। আশা করছি, এ প্রস্তাবটিও গৃহীত হবে। আর সবগুলো জাদুঘরকে একটি থ্রি-ডি ভার্চুয়াল জাদুঘরে রূপান্তরিত করে ডিজিটাল দর্শকদের কাছে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপনের আহ্বানও জানিয়েছিলাম। আশা করি বাস্তবায়ন কমিটি এদিকে নজর দেবে।

আমি আরো বলেছিলাম গত বছর নিলফামারীতে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদের সম্মেলন উপলক্ষে ঐ জেলার সকল স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের যুক্ত করে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। বাচ্চারা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও অবদান বিষয়ে রচনা লিখেছে, গল্প কবিতা লিখেছে। আমরা ‘মুজিব বর্ষে’ সারা দেশের শিক্ষালয়গুলোতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও তাঁর বহুমাত্রিক অবদান নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীল কাজে যুক্ত করার ইচ্ছে রাখি। ইতোমধ্যেই এ নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে। এমন আরো অনেক সৃজনশীল কাজের মাধ্যমেই আমরা ২০২০ সাল জুড়েই বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে পারি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে তিনিই আমাদের অফুরন্ত ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। তাই তাঁকে ঘিরে এসব আয়োজন জাতি হিসেবে আমাদের আরো বেশি আশাবাদী করে তুলবে। আর বঙ্গবন্ধুর আত্মাও শান্তি পাবেন।

Email: dratiur@gmail.com