শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান

মুহম্মদ সবুর

সবুজ মাঠ পেরিয়ে মাঠের ওপারে বৃক্ষের আড়াল থেকে ভেসে আসছে মাদলের গুরু গুরু শব্দ। সেই সাথে বসন্ত বাতাসের দোলা। অদ্ভুত হাওয়ার ঘ্রাণ। একেই বুঝি বলে মলয় সমীরণ। এই বাতাসের স্পর্শে শিহরিত শরীর মন। আকুল বাতাসে মহুয়া-মহুল ফুলের সুবাসের মাদকতা। উদ্বেলিত হয়ে ওঠে মন প্রাণ। মাদলের তালে তালে নাচের শব্দ আসে। সেই সাথে বাঁশির মনকাড়া সুর। যতো সামনে যাওয়া যায়, ততোই মাদলের ধ্বনি স্পষ্ট হতে থাকে। এক সময় মাদলের শব্দ ক্ষীণ হয়ে ভেসে আসে নারীকণ্ঠের সমবেত সুর। “গাছ ভারি, পাতা ভারি/ তুমার মন রে ভারি,/ হাতের শাঁখা ভাঙ্গিয়া দিব/ তুমার মন-বিড়িব।” মানেও বোঝা গেল। গাছ যেমন ভারি, পাতাও তেমন ভারি। তোমার মনও অভিমানে ভারি। হাতের শাঁখা ভেঙ্গে দিয়ে তোমার মন ফিরিয়ে আনবো। নারী হৃদয়ের পুরাতন আকুতি। উদ্বেলিত হৃদয় আবেদন জানায় প্রার্থিতজনের প্রতি। এই এক শাশ্বত রূপ নারীর। মাদলের তালে তালে নেচে নেচে গানে গানে হৃদয়ের দ্যোতনা ওঠে আসছে ক্রমে ক্রমে। বসন্তের আবাহনে উৎসবের আমেজ বা পরবের উল্লাস মাতোয়ারা করে তুলেছে যেন।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব বা পরবের জন্ম দিয়েছে। সমষ্টি জীবনের উত্তরণের পথেই বুঝি উৎসবের আমেজ। পাহাড় অরণ্য ঘেরা প্রকৃতির কোলে উৎসব আসে রঙে রঙে রঙিন হয়েই যেনো। সবুজের সমারোহ চারিদিকে। দেখতে দেখতে যেনো নেশা ধরে যায়। আদিম অরণ্যের ছিটেফোঁটা এখনো রয়েছে। বনজঙ্গল উজাড় হবার পরও। বাতাসে অন্য আমেজ ফাল্গুনের আবেশ মেখে। ‘বসন্তে আজ ধরার চিত্ত উতলা হলো’- সেই চিত্তে ফোটে যখন ফুল, প্রকৃতির রঙ মিলে মিশে যায়, তখন উৎসবে মাতে মন। ‘বসন্তের মাতাল সমীরণ’ এসে দোলা দিয়ে যায়। অরণ্যচারিকে ডাকে বুঝি বৃক্ষেরা। পাতায় পাতায় জাগে শিহরন। বসন্তের ছোঁয়ায় সলাজ বধূর মতো শিউরে ওঠা মনে আনে অন্যতর আবহ। মুকুলিত বৃন্তের অগ্রভাগে তার আনন্দের দোলা। হেসে ওঠে সহস্র শাখায়। কুসুম গাছের পুরো শরীর

জুড়ে জড়িয়ে ধরেছে অসংখ্য লাল কচিকাঁচা পাতা। ঢেকে দিয়েছে সমস্ত বৃক্ষকান্ড আর শাখা-প্রশাখা। শাল-মহুয়ার বনে মাতম অরণ্যচারি মানুষের। উৎসবের আয়োজনে জীবন যেন পূর্ণতা খোঁজে। বনে যখন ফাগুন, মনে তখন আগুন। নিষ্পত্র পলাশের সরু সরু ডালে কালো কালো কুঁড়ি ফুটিয়ে তাজা হৃৎপিন্ডের চেয়েও গাঢ় উজ্জ্বল লাল পাপড়ি উন্মোচিত হয়ে আছে। পাহাড়ের কোলে কোলে সহস্র পলাশের বন। ফুলেরা আবিরের রঙ ছিটানোর মতো অলংকৃত হয়ে আছে।

শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে বীরভূমের সীমান্ত ঘেঁষে ঝাড়খন্ড রাজ্য। এর বনভূমি জুড়ে বসবাস সাঁওতালি, ওরাঁও, কোল, মুন্ডা গোষ্ঠীর। সংখ্যায় সাঁওতালিদের আধিক্য। বীরভূম, মানভূম, সিংভূম, ধলভূম জুড়ে গভীর অরণ্য রয়েছে। বৃক্ষনিধন ও পাহাড় কর্তনের পরও বনের প্রসার এবং বিস্তার এখনো বিস্তর। শাল, সেগুন, মহুয়াসহ কতো শত বৃক্ষ বসন্তের স্পর্শে শিহরিত যেন। ফাগুনের এই আগুন রাঙা দিনে এই পাহাড়-অরণ্য ভুবনে মন হয়ে ওঠে বেশ উতলা। আর তার সঙ্গে এই উৎসবের আমেজ, অন্যতর আবেদন আনে। প্রকৃতিতে যেমন রঙের খেলা, মানব মনেও সেই খেলা চলে। মহুয়া গাছের নীচে ঝরা অজস্র মহুয়ার ফুলে শিশিরেরা ঘুমিয়ে থাকে ভোরে। এমন দৃশ্য অভূতপূর্ব। অপূর্ব মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে। বসন্তের এই উচ্ছলতায় উৎসব জাগে পাহাড়ে-অরণ্যে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জীবনে এই উৎসব আসে শুধু আনন্দ উল্লাস নয়, আসে জীবনাচারণের অংশ হিসেবে। ধর্মাচরণ এবং সৃজনেরও প্রক্রিয়া জড়িয়ে থাকে। সভ্যতার সেই গোড়া থেকেই বসন্ত অরণ্যচারী মানুষের জীবনে পরম সুখের, পরম ভালোলাগার আবাহনও জাগিয়ে।

শান্তিনিকেতনে দিন কয়েক কাটিয়ে ফাগুনের ভোরে এই বীরভূমের রাজদহা অরণ্য অঞ্চলে সাঁওতালি পল্লীতে আসা। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক অরুণ বাগচীর উদ্বুদ্ধকরণে এই অরণ্য ভ্রমণ। ঢাকা থেকেই সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমানের সফরসঙ্গী হিসেবে আসার এই সৌভাগ্যটুকু অনায়াসে মিলে গেলো। অরণ্য পাহাড় অঞ্চলে জন্ম বলে, চট্টগ্রামে অরণ্যের গান, পাহাড়ের ডাক শুনতে পাই। আনন্দ বাগচীর এই অঞ্চলটি পূর্ব পরিচিত। তাই সহজেই উৎসবের আয়োজন চাক্ষুষ করার সুযোগও মেলে। সাঁওতালিদের সুরধ্বনিতে প্রাণ মাতোয়ারা হয়। তাই ভোরের বেলায় শাল-মহুয়ার দেশে এসে মন উথাল-পাথাল। প্রকৃতি তার প্রকাশ ঘটিয়েছে কত শত রঙিন ফুলের মধ্য দিয়ে, এমনটা আগে চোখে পড়েনি অন্যত্র। এই ফুল আর বৃক্ষের সবুজ পাতা বুঝি সাঁওতাল পল্লীর মানুষকে আলোড়িত করে। এই ফুলকেই বসন্তোৎসবের অঙ্গ করে নিয়েছে তারা। কতো অপূর্ব পুষ্পরাজি ঋতুরাজ বসন্তে ফুটেছে। নৃ-গোষ্ঠী সে বাংলাদেশ হোক আর পশ্চিমবঙ্গ হোক, আচার আচরণ, উৎসব, ধর্মাচরণে মিল রয়েছে। তবে ভাষা ও স্থানভেদে নামায়নে রয়েছে ভিন্নতা ।

নৃ-গোষ্ঠীদের উৎসব দু’ধরনের হয়ে আসছে। একটি তার প্রথাগত রীতিনীতি বা পূজা-অর্চনার দিক। অপরটি আমোদ-প্রমোদ উল্লাসের দিক। উৎসবের সাথে তাদের প্রথাগত ধর্মাচরণও পালন করা হয়। এই অঞ্চলের সাঁওতালরা বসন্ত উৎসবকে বলে শারহুল বা শারুল। শালগাছ থেকে এই নাম। এই উৎসবটি শালগাছের সঙ্গে যুক্ত। পার্বত্য জীবনে শালগাছের ভূমিকা বহুবিদিত। আবার বাংলাদেশের সাঁওতালরা এই উৎসবকে বলে ‘বাহাপরব’। ‘বাহা’ হলো ফুলের পূজা উৎসব। শাল-মহুয়ার ফুলের পূজার মধ্য দিয়ে বাহাপরব উৎসবের সূচনা ঘটে। কোথাও আবার একে বলা হয় ‘শালুই’ উৎসব। একটি কুসুমিত প্রকৃতি পরিবেশ থেকে এই নামটির প্রচলন। ‘বাহা’ শব্দের অর্থ পুষ্প বা ফুল। আর বাহাপরব মানে ফুলের উৎসব। আর ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বয়ে যাওয়া এই উৎসবে মন উথলে ওঠে আনন্দে সাঁওতালদের। প্রকৃতির রঙের প্রকাশ তো হাজারো রঙিন ফুলের মধ্য দিয়েই ঘটে। অরণ্যবাসীরা সেই ফুলকেই বসন্তোৎসবের প্রধান অঙ্গ করে নিয়েছে। বাহ্য পরব কালে বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করা হয়। উৎসব শেষ হলেই অরণ্যবাসীরা তবেই নতুন ফুল ও ফল ব্যবহার করে। গানেই বাহার আনন্দ প্রকাশ হয়।

শারহুল বা শারুল উৎসব বৃক্ষকেন্দ্রিক। অবশ্য সাঁওতালদের এই পরব মূলত অরণ্যপূজা। বনদেবীর পূজার মতোই এই আয়োজন। এই উৎসব থেকে শুরু হয় নতুন পাতা সংগ্রহ অভিযান। পূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ গহীন বনে যায় না। অরণ্যজীবনে এই পাতা দিয়ে তৈরি হয় নানা কুটির শিল্প সামগ্রী। এই শারহুল পরবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বর্ষবিদায় ও নববর্ষ আবাহনের প্রস্তুতি। তাই শারহুল উৎসব কালে বাড়ি বাড়ি মঙ্গলঘট নিয়ে গিয়ে সেই ঘটে পানি ঢেলে নববর্ষে সুবৃষ্টির জন্য প্রার্থনা জানানো হয়। অর্থাৎ আগামীদিন ফসলে ভরে উঠুক। কৃষিকাজের প্রথম অঙ্গ বীজ বপন। এই শারহুল পরবের আগে তারা জমিতে ফসলের বীজ বপন করে না। পরব শেষ হবার পরে শুরু হয় বীজ বপনের তোড়জোড়। শারহুল পরব সাঁওতালদের শিকার পরবেরও পূর্ব প্রস্তুতি, যদিয়ো বৈশাখেই শুরু হয় শিকার পরব। তাই শারহুল পরবে বৃষবন্দনার মধ্য দিয়ে অস্ত্রপূজাও করা হয়। এরা বংশ পরম্পরায় অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে শিকার ও আত্মরক্ষা করে এসেছে। তাই শারহুল পরব সাঁওতালিদের কাছে বসন্তের জাতীয় পরব হিসেবে পরিগণিত। শারহুল ও বাহাপরবের মধ্যে তফাৎ এইটুকুই।

রাজদহা অরণ্যাঞ্চলে সাঁওতালি পল্লীর সংখ্যা অনেক। এরা অনেকটাই জোটবদ্ধ বসবাস করে। পল্লী প্রধান সুরেন কারফর্মা বেশ বিনয়ের সঙ্গেই অভ্যর্থনা জানিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে একটা কুঁড়েঘরে বসার আসন পেতে দিলেন। রুটি, গুড় আর সব্জি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সেই সঙ্গে চা। অরণ্য জীবনে চা-এর প্রবেশ বুঝি অনেককালের। সুরেন কারফর্মার সঙ্গে আরো দু’তিনজন এসে আলাপ জমালেন। এর মধ্যে একজন স্কুল শিক্ষক, সাঁওতালিরা লেখাপড়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে বোঝা গেল। শিক্ষক হরেন মাহাতো নিজে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেও অর্থাভাবে আর বিদ্যার্জন সম্ভব হয়নি। বজলুর রহমান তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। সংগে অরুণ বাগচী। তিনি অবশ্য এদের চেনাজানা-তাই অন্যদের খোঁজ খবরেই আগ্রহ বেশি। হরেন মাহাতো নিজ ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। বললেন, প্রাচীনকালে সাঁওতালরা তাদের ধর্ম নির্দিষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গাছের তলায় মিলিত হতো। কিন্তু সর্বশেষ শালগাছের (সাঁওতালি ভাষায় ‘সারি সারজম’) তলাতেই ধর্মবিষয়ক মীমাংসা ও সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। সেই থেকে শালগাছ সাঁওতালদের কাছে পবিত্র বৃক্ষ এবং ধর্মীয় প্রতীক। সকল উৎসবে ও ধর্মাচরণে শালগাছ অবশ্যই অপরিহার্য। শালগাছের নীচে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো, সেই দিনটি তাদের কাছে পবিত্র। আর তা ছিল ফাল্গুনি পূর্ণিমা। তাই মূলত ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিন অথবা ঐ দিনটিকে কেন্দ্র করেই এই উৎসবের প্রচলন। তবে স্থানবিশেষে তা চৈত্র ও বৈশাখেও চলে আসছে।

রূপান্তরের এই এক গতিপথ। সাঁওতালদের দেবতা হচ্ছেন বোঙ্গা মারাং বুরু। সাঁওতাল শব্দ বোঙ্গার বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে দেবতা। সিং অর্থাৎ সূর্য হলো সাঁওতালদের আদি দেবতা। কোথাও কোথাও সূর্যকে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করা হয়। পাঁচ বা দশ বছর পরপর সিং বোঙ্গার পূজা হয়। এতে সাদা মোরগ বা পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। সাঁওতালদের সৃষ্টিতত্ত্বে রয়েছে, শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে হংসমিথুন। নিচে শুধু পানি আর পানি। কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। অনন্তকাল ধরে এরকম ঘুরতে ঘুরতে হংস মিথুন ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তখন ‘ঠাকুর’ দয়াপরবশ হয়ে মারাং বুরুকে আদেশ দিলেন স্থলস্থান তৈরি করার। তৈরি হলো স্থলখন্ড। তৈরি হলো গাছপালা। হংসমিথুন আশ্রয় নিলো সেখানে। হংসী দু’টো ডিম প্রসব করলো। সেই ডিম থেকে জন্ম নিলো প্রথম মানব দম্পতি। পিলচু হড়ম্ আর পিলচু বুড়ি। তারা ক্রমে বড় হয়ে ওঠে। পালনকর্তা মারাং বুরু তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগাড় করে দিলেন। তিনি তাদের ঘাসের বীজ থেকে উত্তেজক পানীয় তৈরি করতে শেখালেন এবং সবার আগে পাতার ঠোঙ্গায় করে সেই পানীয় তার উদ্দেশ্যে নিবেদন করার আদেশ দিলেন। প্রথম মানব দম্পতি থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। তাই উৎসবে পানীয় পান স্বাভাবিক বলেই সাঁওতালরা আকণ্ঠ গলধাকরণ করে। সাঁওতালদের এই পরবে পুরোহিত যিনি, তাকে নানা নামে সম্বোধন করা হয়, সাঁওতালদের একটা অংশ ডাকে, ‘নায়কে’ অন্য অংশ ‘লায়া’ সম্বোধন করে। আবার মানভূম, সিংভূম অঞ্চলে লায়াকে পোহান, বাইসা পোহান এবং গোডেত নামে ডাকা হয়। লায়ার বা নায়কে শুধু মন্ত্র পুরোহিত নয়, পূজোর সব উপকরণ তাকেই সংগ্রহ করতে হয়। পল্লীবাসীর আর্থিক অনুদানে আয়োজিত হয় এই উৎসব। পূজার উপকরণের মধ্যে ফুল তো রয়েছেই, রয়েছে মাটির কলসী বা হাঁড়ি। যাকে এরা বলে সাগুন ঠিলি। কাপড়, চাল, নতুন তীর-ধনুক, আবির ইত্যাদিও রয়েছে। রয়েছে সাদা মোরগ। আর ঘরে স্বযত্নে তৈরি হাঁড়িয়া, সাঁওতালিদের উচ্চারণে তা ‘হ্যাঁড়া’। এই হ্যাঁড়া পান তাদের জীবনে ধর্মের সঙ্গে তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। এমন আকণ্ঠ পান তাদের আনন্দ উল্লাসেরই অংশ- এভাবেই তারা দেখে। এ নিয়ে কিংবদন্তিও রয়েছে। তাদের লোককাহিনীতে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে বিষয়টি। নারী-পুরুষের শারীরিক কামোন্মদনা তথা প্রণয় জাগাবার জন্যই এই হাঁড়িয়ার আবির্ভাব আদিকালেই। সাঁওতালি গ্রন্থ ‘বিস্তি’-তে এর কাহিনী রয়েছে। তাতে উল্লেখ আছে, সৃষ্টির আদিতে দুটি হাঁসের ডিম থেকে এক মানব আর এক মানবীর জন্ম হয়। ক্রমে তারা পরিণত এবং যৌবনপ্রাপ্ত হলে সৃষ্টিকর্তা মারাংবুরু তাদের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। নর-নারী যাতে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হয়ে সন্তান উৎপাদনে একাগ্র হতে পারে, সেজন্য মারাংবুরু স্বয়ং ঘাসের বীজ থেকে হাঁড়িয়া তৈরির পদ্ধতি তাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সাঁওতালদেরই অন্য এক কাহিনীতে রয়েছে যে, এক সত্যসন্ধ্যানী মর্তবাসী পূণ্যাত্মার তপস্যায় ভীত হয়ে, ভগবান তাকে পূণ্যফলচ্যূত করার জন্য এক অপদেবতাকে পাঠিয়ে দেন। অপদেবতাটি সাধু ব্যক্তির ছদ্মবেশে মর্তে এসে পূণ্যবানের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীকে হাঁড়িয়া আসক্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। বজলুর রহমান মদ্যাসক্তির যে কুফল আছে, সে বিষয়টি সম্পর্কে সাঁওতালিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে কিনা- এমনটাই জানার চেষ্টা করলেও শিক্ষক মাহাতো উদাহরণ টেনে হতাশ স্বরে বলেন, অরণ্যবাসী জীবনে মদ্যাসক্তি প্রাচীনতর। কিন্তু এই আসক্তি যে তাদের জন্য শতাব্দির পর শতাব্দি কোনো সুফল আনে নি তা এ যুগে অনেকে উপলব্ধি করছে। তাই উৎসব-পরব ছাড়া সাধারণ জীবনে হাঁড়িয়া পান হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি তিনি একথা বলতেও ভুললেন না যে, মদ যেখানে ধর্মের সঙ্গে মিশে আছে, যেখানে এটা পূজার উপকরণ, সেখানে আর ততোটা সচেতনতা তৈরির সুযোগ কোথায়! মদমুক্ত অরণ্য-পাহাড়ি জীবনে তো ভাবাই যায় না।

তবে অরুণ বাগচী এই সাত সকালেই কারফর্মার অনুরোধে এক গ্লাস হাঁড়িয়া সেবন করে, বসন্ত বাতাসে শিহরিত হতে থাকেন। আর তার জবান খুলে যায়। এই পরব এর আগে দু’বার দেখেছেন। উৎসব বর্ণনা তাই তার মুখেও। মূল উৎসব জমে উঠে দুপুরের পর। নায়েক বা লায়া পূজার উপকরণ নিয়ে সকালে পল্লীর একপ্রান্তে শালগাছের নিচে দেবস্থানে নিয়ে গেলেন। যাবার আগে পল্লী প্রধানের অনুমতি নিলেন। তার সঙ্গে আরো দু’জন সহকারি রয়েছে। তালেবে এলেম ধাঁচের। দেবস্থানেরও আলাদা নাম রয়েছে। এই পল্লীতে নাম ‘জাহের থান’। অন্য পল্লীতে ‘গরাম থান’ এবং পাহাড়ের ওপারের পল্লীতে এর নাম ‘সারণা’। এই দেবতার অধিষ্ঠান ক্ষেত্রস্বরূপ কয়েক ‘টোলা’ বা পাতার মধ্যে একটি সাধারণ জায়গা নির্দিষ্ট থাকে। এখানে আছে পাহাড়ের এক কোণে। লোকালয় থেকে একটু দূরেই। এখানে কোনো ঠাকুর বা দেবতার মূর্তি নেই। তবে একখন্ড পাথর রয়েছে। কালো গ্রানাইট। এই পল্লীর জাহের থানের শালগাছটিতে দু’টি ভাগ। ঠিক মাটির উপর থেকেই গাছটি সমান দু’ভাগ হয়ে গেছে। ‘লায়া’ এবং তার সহকারীরা আজ উপোস করবে। গতকাল নিরামিষ ভোজনের মাধ্যমে মনকে অনেকটা ‘শুচি’ করে নিয়েছে। পরবের দিন উপবাস পালন দিলেও হাঁড়িয়া পানে উপবাস বিঘ্ন হয় না। পুরোহিত ‘লায়া’ একাধিক দেবতার জন্য স্থান নির্দিষ্ট করেন সেই থানে। এরপর দুধ, তেল, সিঁদুর দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রার্থনা করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই পূজার্চনা। তারপর সহকারীসহ ফিরে যান নিজ গৃহে। লায়ার বাড়িতে পূজার প্রসাদ পাঠানো হয়। এই প্রসাদ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ শেষে মাটিতে শয্যা নিতে হয় সহকারীসহ। নৃত্যগীতবাদ্য থেকে বঞ্চিত থাকেন পুরোহিত। কিন্তু ঘুমানোর সুযোগ আর থাকে না। পল্লীর সব তরুণ-কিশোররা ‘নাগড়া’ তালে তালে রাতে হাজির হয় লায়া বা নায়কের বাড়িতে। ‘নাগড়া’ ঢোলেরই আরেক ছোট রূপ। সেই নাগড়া বাজিয়ে গাইতে থাকে গান। সে সব গানের বিষয় সাধারণত দেবতার কাছে নানারকম প্রার্থনা, নানা ভাবে ও ভাষায় দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানো। একটা গান গেয়ে শোনালেন, “কি ফুলে সেবা লায়া, কি ফুলে সেবা,/ শালই ফুল লায়া, সারুল সেবা।”

পূজার কিছু নিয়মনীতি, আচরণবিধি আছে। লায়াক পূজার আগে লালপাড়ের হলুদ রঙের কৌপীন পরে একটা ধুতিকে পাগড়ি বানিয়ে মাথায় দেয়। পরে পাগড়ির ধুতিটাকে থানের সামনে মাটির উপর নিজেই পেতে দেয়। এর উপর পল্লীর পুরুষরা চাল, ডাল, রবিশস্য, যব ইত্যাদি ঢেলে দেয়। বজলুর রহমান বর্ণনা শুনতে শুনতে বললেন, অরণ্যবাসী জীবনের প্রায় সকল আরাধনা অনুষ্ঠানই এখনো কৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। কখনো কখনো রোগ মহামারীর দুষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করে বিদায় করার দুশ্চিন্তা দেখা দিতো। সেজন্য প্রাচীনকালে নরবলি দেওয়া হতো। কিন্তু এই মাংস যেহেতু খাওয়া যেতো না তাই পশু বলি দেয়ার প্রথা চালু হয়। যা আজো প্রচল। অরণ্যবাসী অনেক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীতে পরব এমনকি হোলীর প্রধান অঙ্গ ছিল কৃষি সমাজের পূজা এবং প্রচুর খাদ্য উৎপাদন কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাময় নৃত্যগীত উৎসব পালন। উনিশ শতকে এসে নরবলির স্থানে পশুবলি চালু হয়। আনন্দ বাগচী বোঝালেন, ধর্মপালনে নারী-পুরুষদের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। পুরোহিত বা লায়ার সহকারীদের স্ত্রীরা পূজানুষ্ঠানে অংশ নিতে পারলেও অন্য নারীদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই সহকারীদের স্ত্রীদেরও আচরণ বিধি পালন করতে হয়। এরা দেবস্থানের শুদ্ধিকরণের কাজ করে গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে। পূজার আয়োজনকালেই সহকারীরা মাঝে মাঝেই সোমরস পান করে নিজেরা। আবার সমবেত প্রধান ব্যক্তিদেরও আপ্যায়ন করা হয়। ভক্তিভাবে তারা পান করে এই সোমরস। পূজাকালে দেবতা এবং পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে যেটি দেওয়া হয়, তা অবশ্যই সাদা রঙের মোরগ এবং আকারে তা বেশ বড় সড়ো। পাশাপাশি ধরিত্রীমাতা বা ‘ধত্রীমাঈ’-এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা মোরগের রঙ হচ্ছে কালো কিংবা ছাই রঙের। এটিকে কাটা হয় না। গলাটিপে শ্বাসরোধ করে মারা হয়। সব মোরগগুলোর পালক ছড়িয়ে ঝলসে নিয়ে হাঁড়িয়ার সঙ্গে পূজা চলাকালেই খাওয়া হয়। বলি হিসেবে মোরগ বেছে নেবার কারণটি বজলুর রহমান কৌতূহলের সঙ্গেই নিলেন। বললেন, হিন্দু ব্রাহ্মণদের কাছে মোরগ স্লেচ্ছদের ভক্ষ ও পোষ্য-সে মোরগ আদিবাসীদের ধর্মীয় ও উৎসব অনুষ্ঠানে ঠাঁই পেলো কেমন করে। কারফর্মা মৃদু হেসে বললেন, পশুপাখি প্রাণীদের আবার ধর্ম কিসের। আসলে মোরগ-মুরগি তো একটি পাখি মাত্র অরণ্যবাসীদের কাছে। যারা তাকে আয়ত্তে পেয়েছে, তারাই ওতপ্রোতভাবে একে দেহে মনে ধর্মে জড়িয়ে ধরেছে। আর খাদ্য হিসেবে এর সু-স্বাদকে কোন বিবেচক মানুষ অবহেলা করবে? সুপক্ব মোরগকে উপেক্ষা করা কোনো ধর্মীয় নীতি কখনোই হতে পারে না। মোরগ-মুরগি অরণ্যবাসীদের যে কোন পালাপার্বণে একটি আবশ্যিক প্রথা এখনো।

এখানকার মেয়েরা নৃত্যগীত শুরুর আগে ঘটি করে পানি নিয়ে নিজেদের ঘরে ঘরে দরজার সামনে অপেক্ষা করে। পূজার্চনা শেষে লায়া আসে, মেয়েরা তার পা ধুইয়ে দিয়ে প্রণাম করে। আশীর্বাদস্বরূপ লায়া তার হাতের কুলা থেকে তুলে দেন ‘সারজম’-শালফুলের থোকা। মেয়েরা ভক্তি ভরে আঁচলে পেতে তা গ্রহণ করে। সেই ফুল তারা গুঁজে নেয় নিজেদের খোঁপায়, কানে, বেঁধে নেয় বাহুতে। ফুলের উৎসবে স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের অঙ্গজুড়ে ফুলসাজ এনে দেয় শারহুল পরবের আনন্দ। তাদের মনে হয়, তারা পৃথিবীতে বেঁচে আছে আনন্দে, মানুষের মত। জীবন কতো বড়, কিংবা জীবন কতটুকু -সে বিচার কেউই করে না। শুধু মনে হয় এই তো জীবন। আনন্দই জীবন। তখন তাদের গলায় গান আর পায়ে নাচ। এ সময়ে পরস্পরের মধ্যে পানি ছোঁড়াছুঁড়ি খেলাও চলে। হয়তো অন্য সমাজে অর্থাৎ হোলি খেলায় এটাই প্রলম্বিত হয়ে রঙ ছোড়াছুঁড়ি হয়েছে। ছেলে মেয়েরা মুখোমুখি। নাচ আর তাল, গান আর দেহ। মেশামেশি দু’টি সারি, অথচ পৃথক। কে আগে জুড়েছে তাল বোঝা দায়। কে আগে ধরেছে নাচ বোঝা দায়। যেন এক সুরে পৃথিবী প্রাচীন। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা, তবু ক্লান্তি নেই, হাসি হাসি মুখ।

শারহুল উৎসব প্রাঙ্গণে এইসব মৃদু প্রণয়ের কাব্য গুঞ্জরণের সঙ্গে সঙ্গে হাসি, নাচ আর মাদলের বাজনা এক স্বর্গীয় পরিবেশ ও আবেশ রচনা করেছে যেন। নৃত্যগীতরতদের হাতে লায়া আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন পবিত্র পানীয় হাঁড়িয়া। ভাত থেকে তৈরি এই পানীয় সাঁওতালদের প্রায় প্রতি ঘরেই তৈরি হয়। নিয়মিত আবার বিনোদনের সঙ্গী এই পানীয়। তবুও লায়া নিজে প্রদান করেন সেই পবিত্র পানীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে। যাতে দেবতার আশীর্বাদ মিশে আছে বলে বিশ্বাস বোধ। লায়া নারী-পুরুষ সবাইকে পান করালেন। আমাদেরও আপ্যায়ন করা হলো।

ধীরে ধীরে সকলেরই রক্তে জেগে উঠছে নতুন এক তুফান। মাঝরাতে আদিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারের নিচে নীলজল যেমন উথালি-পাথালি শুরু করে তেমনি উম্মাদনা শুরু হবে বলে অরুণ বাগচী জানান। প্রত্যেকের শরীর দুলতে শুরু করবে। চোখের দৃষ্টি বদলে যাবে। রাতের আকাশে তখন গোলাকার চাঁদ সাদা দুধেল জোছনা ঢেলে দেবে। জোছনার বান ঢুকে পড়বে সাঁওতাল কুলহিতে। শাল, মহুয়া, পলাশের জঙ্গল, মাঠ প্রান্তর সব জাগিয়ে নিয়ে যাবে ধবধবে জোছনায়। অবিরাম বয়ে যাবে বাতাস। দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসা এক রকম অদ্ভূত বাতাস, মানুষের বুকের রক্ত নাচিয়ে। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসবে বাঁশির সুর। কখনো স্পষ্ট কখনো মিলিয়ে যাবে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। নেশায় আচ্ছন্ন তরুণ-তরুণীরা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সকলেই নাচে মেতে উঠবে। নাচ আর নাচ। মনের দোলা, রক্তের দোলায়, দুলতে দুলতে শরীর দোলাতে শুরু করবে। মাদলের তাল সেই দুলুনিকে ছন্দে বেঁধে রূপ দেয় নৃত্যের। সৃষ্টি হবে মানুষের আর এক আদিম শিল্প নৃত্যকলার, মাদলের তাল যতো কাছাকাছি হবে। মাদলের তালে ভাঙ্গা-ওঠা শরীরের। শরীরে শরীর জড়িয়ে নারী ও পুরুষ উদোম নৃত্যে মেতে উঠবে। হাঁড়িয়া-মউল মাতাল গন্ধে ছড়াবে বুনো শরীরী স্পর্শ। আমাদের সেসব দৃশ্য দেখার আগেই চলে যেতে হবে। সন্ধ্যা নামছে। ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছে। নৃত্য পরব চলছে। অবিরাম বয়ে চলেছে মলয় সমীরণ। সেই বাতাসের ছোঁয়ায় শিহরিত হচ্ছে শরীর মন। মহুল ফুলের মাদকতা নাসারন্ধ্র ভেদ করে রক্তে টগবগ করছে। উদ্বেলিত হৃদয়। মহুল গন্ধ নারীর শরীরের ঘ্রাণে ভাসে। শরহুল উৎসবে বসন্তের এই মাতোয়ারা সন্ধ্যায় ‘হলুই লুবুই বিটি লাগি ছাড়ি আড়িল।’ যুবতী মেয়েটির জন্য যুবকরা বুক পেতে দেবে। হৃদয় উজার করে নিবিড় জড়াবে। নারীরা শরীর-মন ঢেলে উজার করবে নিজেকে।

মাদলের ঢংকা নিনাদ শুনতে শুনতে বসন্ত সন্ধ্যায় আবার আমরা ফিরে গেলাম শান্তি নিকেতন, পেছনে ফেলে সাঁওতালি পরবের উদ্বেলিত মনকাড়া মুহূর্তগুলো। বজলুর রহমান নিমগ্নতা ছেড়ে বললেন, অন্ধকার ফুঁড়ে পাহাড়ি অরণ্য পল্লীর আলোর মশালগুলো কেমন যেন আধিভৌতিক হয়ে উঠছে। বসন্ত এসেছে বুঝি অন্যতর আবাহনে।

image

সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী দম্পতি এবং লেখক দম্পতি, ঘরোয়া পরিবেশে

আরও খবর
৬৯ বছরে সংবাদ
ভাষা থেকে ভূখন্ড
স্মৃতিময় সংবাদ-এর ৬৯ বছর
একটি রাজনৈতিক পাঠ
সংবাদ : কিছু কথা কিছু স্মৃতি
যুগে যুগে সংবাদপত্রের অগ্রযাত্রা
আলোর তৃষ্ণায় জাগো
ইতিহাস ঐতিহ্য ও আদর্শের স্মারক দৈনিক সংবাদ
কেন লিখি
সংবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আত্মার
ঐতিহ্য আর মুক্তচিন্তার সংবাদ
আমার সংবাদ সংবাদের আমি
বিচিত্র জীবিকা বিচিত্র জীবন
ঋতুপর্ণ ঘোষের এলোমেলো দেশকাল
চীন ও বাংলাদেশ : প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সম্পর্ক
সংবাদের জলসাঘর
আমরা এখন শান্ত হয়ে আছি
মাটির মাধুর্য
কষ্টের ঢাকা স্বপ্নের বাংলাদেশ
তোমারে বধিবে যে...
বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতি কৌশল
শিশুশিক্ষায় শিল্প-সাহিত্য-সংগীত
গণমাধ্যমের হাল-হকিকত
এবং বজলুর রহমান স্মৃতিপদক
দুর্নীতি, পেশাদারিত্ব ও উন্নয়ন
বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার ভবিষ্যৎ
চেতনায় নৈতিকতা মূল্যবোধ : বিরুদ্ধবাস্তবতা
সবার উপরে মানুষ সত্য
আহমদুল কবির শ্রদ্ধাঞ্জলি
কার্যকর সংসদ এবং সুশাসনের স্বপ্ন
‘সংবাদ’ আমারই ছিল আমারই আছে
আমাদের ‘সংবাদ’
নারীর অধিকার ও সচেতনতা
গণমাধ্যমে বিশ্বাস কমছে পাঠকের
নারী ও তার বিধাতা পুরুষ
বাংলাদেশের নারী
সংবাদের কাছে আমি ঋণী
বিস্মৃতিপ্রবণতা ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা
যে দীপশিখা দিয়েছে আলো

বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০

শারহুল পটবসন্ত ও বজলুর রহমান

মুহম্মদ সবুর

image

সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেত্রী মতিয়া চৌধুরী দম্পতি এবং লেখক দম্পতি, ঘরোয়া পরিবেশে

সবুজ মাঠ পেরিয়ে মাঠের ওপারে বৃক্ষের আড়াল থেকে ভেসে আসছে মাদলের গুরু গুরু শব্দ। সেই সাথে বসন্ত বাতাসের দোলা। অদ্ভুত হাওয়ার ঘ্রাণ। একেই বুঝি বলে মলয় সমীরণ। এই বাতাসের স্পর্শে শিহরিত শরীর মন। আকুল বাতাসে মহুয়া-মহুল ফুলের সুবাসের মাদকতা। উদ্বেলিত হয়ে ওঠে মন প্রাণ। মাদলের তালে তালে নাচের শব্দ আসে। সেই সাথে বাঁশির মনকাড়া সুর। যতো সামনে যাওয়া যায়, ততোই মাদলের ধ্বনি স্পষ্ট হতে থাকে। এক সময় মাদলের শব্দ ক্ষীণ হয়ে ভেসে আসে নারীকণ্ঠের সমবেত সুর। “গাছ ভারি, পাতা ভারি/ তুমার মন রে ভারি,/ হাতের শাঁখা ভাঙ্গিয়া দিব/ তুমার মন-বিড়িব।” মানেও বোঝা গেল। গাছ যেমন ভারি, পাতাও তেমন ভারি। তোমার মনও অভিমানে ভারি। হাতের শাঁখা ভেঙ্গে দিয়ে তোমার মন ফিরিয়ে আনবো। নারী হৃদয়ের পুরাতন আকুতি। উদ্বেলিত হৃদয় আবেদন জানায় প্রার্থিতজনের প্রতি। এই এক শাশ্বত রূপ নারীর। মাদলের তালে তালে নেচে নেচে গানে গানে হৃদয়ের দ্যোতনা ওঠে আসছে ক্রমে ক্রমে। বসন্তের আবাহনে উৎসবের আমেজ বা পরবের উল্লাস মাতোয়ারা করে তুলেছে যেন।

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব বা পরবের জন্ম দিয়েছে। সমষ্টি জীবনের উত্তরণের পথেই বুঝি উৎসবের আমেজ। পাহাড় অরণ্য ঘেরা প্রকৃতির কোলে উৎসব আসে রঙে রঙে রঙিন হয়েই যেনো। সবুজের সমারোহ চারিদিকে। দেখতে দেখতে যেনো নেশা ধরে যায়। আদিম অরণ্যের ছিটেফোঁটা এখনো রয়েছে। বনজঙ্গল উজাড় হবার পরও। বাতাসে অন্য আমেজ ফাল্গুনের আবেশ মেখে। ‘বসন্তে আজ ধরার চিত্ত উতলা হলো’- সেই চিত্তে ফোটে যখন ফুল, প্রকৃতির রঙ মিলে মিশে যায়, তখন উৎসবে মাতে মন। ‘বসন্তের মাতাল সমীরণ’ এসে দোলা দিয়ে যায়। অরণ্যচারিকে ডাকে বুঝি বৃক্ষেরা। পাতায় পাতায় জাগে শিহরন। বসন্তের ছোঁয়ায় সলাজ বধূর মতো শিউরে ওঠা মনে আনে অন্যতর আবহ। মুকুলিত বৃন্তের অগ্রভাগে তার আনন্দের দোলা। হেসে ওঠে সহস্র শাখায়। কুসুম গাছের পুরো শরীর

জুড়ে জড়িয়ে ধরেছে অসংখ্য লাল কচিকাঁচা পাতা। ঢেকে দিয়েছে সমস্ত বৃক্ষকান্ড আর শাখা-প্রশাখা। শাল-মহুয়ার বনে মাতম অরণ্যচারি মানুষের। উৎসবের আয়োজনে জীবন যেন পূর্ণতা খোঁজে। বনে যখন ফাগুন, মনে তখন আগুন। নিষ্পত্র পলাশের সরু সরু ডালে কালো কালো কুঁড়ি ফুটিয়ে তাজা হৃৎপিন্ডের চেয়েও গাঢ় উজ্জ্বল লাল পাপড়ি উন্মোচিত হয়ে আছে। পাহাড়ের কোলে কোলে সহস্র পলাশের বন। ফুলেরা আবিরের রঙ ছিটানোর মতো অলংকৃত হয়ে আছে।

শান্তিনিকেতন ছাড়িয়ে বীরভূমের সীমান্ত ঘেঁষে ঝাড়খন্ড রাজ্য। এর বনভূমি জুড়ে বসবাস সাঁওতালি, ওরাঁও, কোল, মুন্ডা গোষ্ঠীর। সংখ্যায় সাঁওতালিদের আধিক্য। বীরভূম, মানভূম, সিংভূম, ধলভূম জুড়ে গভীর অরণ্য রয়েছে। বৃক্ষনিধন ও পাহাড় কর্তনের পরও বনের প্রসার এবং বিস্তার এখনো বিস্তর। শাল, সেগুন, মহুয়াসহ কতো শত বৃক্ষ বসন্তের স্পর্শে শিহরিত যেন। ফাগুনের এই আগুন রাঙা দিনে এই পাহাড়-অরণ্য ভুবনে মন হয়ে ওঠে বেশ উতলা। আর তার সঙ্গে এই উৎসবের আমেজ, অন্যতর আবেদন আনে। প্রকৃতিতে যেমন রঙের খেলা, মানব মনেও সেই খেলা চলে। মহুয়া গাছের নীচে ঝরা অজস্র মহুয়ার ফুলে শিশিরেরা ঘুমিয়ে থাকে ভোরে। এমন দৃশ্য অভূতপূর্ব। অপূর্ব মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে। বসন্তের এই উচ্ছলতায় উৎসব জাগে পাহাড়ে-অরণ্যে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জীবনে এই উৎসব আসে শুধু আনন্দ উল্লাস নয়, আসে জীবনাচারণের অংশ হিসেবে। ধর্মাচরণ এবং সৃজনেরও প্রক্রিয়া জড়িয়ে থাকে। সভ্যতার সেই গোড়া থেকেই বসন্ত অরণ্যচারী মানুষের জীবনে পরম সুখের, পরম ভালোলাগার আবাহনও জাগিয়ে।

শান্তিনিকেতনে দিন কয়েক কাটিয়ে ফাগুনের ভোরে এই বীরভূমের রাজদহা অরণ্য অঞ্চলে সাঁওতালি পল্লীতে আসা। আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক অরুণ বাগচীর উদ্বুদ্ধকরণে এই অরণ্য ভ্রমণ। ঢাকা থেকেই সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমানের সফরসঙ্গী হিসেবে আসার এই সৌভাগ্যটুকু অনায়াসে মিলে গেলো। অরণ্য পাহাড় অঞ্চলে জন্ম বলে, চট্টগ্রামে অরণ্যের গান, পাহাড়ের ডাক শুনতে পাই। আনন্দ বাগচীর এই অঞ্চলটি পূর্ব পরিচিত। তাই সহজেই উৎসবের আয়োজন চাক্ষুষ করার সুযোগও মেলে। সাঁওতালিদের সুরধ্বনিতে প্রাণ মাতোয়ারা হয়। তাই ভোরের বেলায় শাল-মহুয়ার দেশে এসে মন উথাল-পাথাল। প্রকৃতি তার প্রকাশ ঘটিয়েছে কত শত রঙিন ফুলের মধ্য দিয়ে, এমনটা আগে চোখে পড়েনি অন্যত্র। এই ফুল আর বৃক্ষের সবুজ পাতা বুঝি সাঁওতাল পল্লীর মানুষকে আলোড়িত করে। এই ফুলকেই বসন্তোৎসবের অঙ্গ করে নিয়েছে তারা। কতো অপূর্ব পুষ্পরাজি ঋতুরাজ বসন্তে ফুটেছে। নৃ-গোষ্ঠী সে বাংলাদেশ হোক আর পশ্চিমবঙ্গ হোক, আচার আচরণ, উৎসব, ধর্মাচরণে মিল রয়েছে। তবে ভাষা ও স্থানভেদে নামায়নে রয়েছে ভিন্নতা ।

নৃ-গোষ্ঠীদের উৎসব দু’ধরনের হয়ে আসছে। একটি তার প্রথাগত রীতিনীতি বা পূজা-অর্চনার দিক। অপরটি আমোদ-প্রমোদ উল্লাসের দিক। উৎসবের সাথে তাদের প্রথাগত ধর্মাচরণও পালন করা হয়। এই অঞ্চলের সাঁওতালরা বসন্ত উৎসবকে বলে শারহুল বা শারুল। শালগাছ থেকে এই নাম। এই উৎসবটি শালগাছের সঙ্গে যুক্ত। পার্বত্য জীবনে শালগাছের ভূমিকা বহুবিদিত। আবার বাংলাদেশের সাঁওতালরা এই উৎসবকে বলে ‘বাহাপরব’। ‘বাহা’ হলো ফুলের পূজা উৎসব। শাল-মহুয়ার ফুলের পূজার মধ্য দিয়ে বাহাপরব উৎসবের সূচনা ঘটে। কোথাও আবার একে বলা হয় ‘শালুই’ উৎসব। একটি কুসুমিত প্রকৃতি পরিবেশ থেকে এই নামটির প্রচলন। ‘বাহা’ শব্দের অর্থ পুষ্প বা ফুল। আর বাহাপরব মানে ফুলের উৎসব। আর ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বয়ে যাওয়া এই উৎসবে মন উথলে ওঠে আনন্দে সাঁওতালদের। প্রকৃতির রঙের প্রকাশ তো হাজারো রঙিন ফুলের মধ্য দিয়েই ঘটে। অরণ্যবাসীরা সেই ফুলকেই বসন্তোৎসবের প্রধান অঙ্গ করে নিয়েছে। বাহ্য পরব কালে বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করা হয়। উৎসব শেষ হলেই অরণ্যবাসীরা তবেই নতুন ফুল ও ফল ব্যবহার করে। গানেই বাহার আনন্দ প্রকাশ হয়।

শারহুল বা শারুল উৎসব বৃক্ষকেন্দ্রিক। অবশ্য সাঁওতালদের এই পরব মূলত অরণ্যপূজা। বনদেবীর পূজার মতোই এই আয়োজন। এই উৎসব থেকে শুরু হয় নতুন পাতা সংগ্রহ অভিযান। পূজা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ গহীন বনে যায় না। অরণ্যজীবনে এই পাতা দিয়ে তৈরি হয় নানা কুটির শিল্প সামগ্রী। এই শারহুল পরবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বর্ষবিদায় ও নববর্ষ আবাহনের প্রস্তুতি। তাই শারহুল উৎসব কালে বাড়ি বাড়ি মঙ্গলঘট নিয়ে গিয়ে সেই ঘটে পানি ঢেলে নববর্ষে সুবৃষ্টির জন্য প্রার্থনা জানানো হয়। অর্থাৎ আগামীদিন ফসলে ভরে উঠুক। কৃষিকাজের প্রথম অঙ্গ বীজ বপন। এই শারহুল পরবের আগে তারা জমিতে ফসলের বীজ বপন করে না। পরব শেষ হবার পরে শুরু হয় বীজ বপনের তোড়জোড়। শারহুল পরব সাঁওতালদের শিকার পরবেরও পূর্ব প্রস্তুতি, যদিয়ো বৈশাখেই শুরু হয় শিকার পরব। তাই শারহুল পরবে বৃষবন্দনার মধ্য দিয়ে অস্ত্রপূজাও করা হয়। এরা বংশ পরম্পরায় অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে শিকার ও আত্মরক্ষা করে এসেছে। তাই শারহুল পরব সাঁওতালিদের কাছে বসন্তের জাতীয় পরব হিসেবে পরিগণিত। শারহুল ও বাহাপরবের মধ্যে তফাৎ এইটুকুই।

রাজদহা অরণ্যাঞ্চলে সাঁওতালি পল্লীর সংখ্যা অনেক। এরা অনেকটাই জোটবদ্ধ বসবাস করে। পল্লী প্রধান সুরেন কারফর্মা বেশ বিনয়ের সঙ্গেই অভ্যর্থনা জানিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে একটা কুঁড়েঘরে বসার আসন পেতে দিলেন। রুটি, গুড় আর সব্জি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সেই সঙ্গে চা। অরণ্য জীবনে চা-এর প্রবেশ বুঝি অনেককালের। সুরেন কারফর্মার সঙ্গে আরো দু’তিনজন এসে আলাপ জমালেন। এর মধ্যে একজন স্কুল শিক্ষক, সাঁওতালিরা লেখাপড়ার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে বোঝা গেল। শিক্ষক হরেন মাহাতো নিজে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হলেও অর্থাভাবে আর বিদ্যার্জন সম্ভব হয়নি। বজলুর রহমান তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। সংগে অরুণ বাগচী। তিনি অবশ্য এদের চেনাজানা-তাই অন্যদের খোঁজ খবরেই আগ্রহ বেশি। হরেন মাহাতো নিজ ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। বললেন, প্রাচীনকালে সাঁওতালরা তাদের ধর্ম নির্দিষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গাছের তলায় মিলিত হতো। কিন্তু সর্বশেষ শালগাছের (সাঁওতালি ভাষায় ‘সারি সারজম’) তলাতেই ধর্মবিষয়ক মীমাংসা ও সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। সেই থেকে শালগাছ সাঁওতালদের কাছে পবিত্র বৃক্ষ এবং ধর্মীয় প্রতীক। সকল উৎসবে ও ধর্মাচরণে শালগাছ অবশ্যই অপরিহার্য। শালগাছের নীচে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো, সেই দিনটি তাদের কাছে পবিত্র। আর তা ছিল ফাল্গুনি পূর্ণিমা। তাই মূলত ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিন অথবা ঐ দিনটিকে কেন্দ্র করেই এই উৎসবের প্রচলন। তবে স্থানবিশেষে তা চৈত্র ও বৈশাখেও চলে আসছে।

রূপান্তরের এই এক গতিপথ। সাঁওতালদের দেবতা হচ্ছেন বোঙ্গা মারাং বুরু। সাঁওতাল শব্দ বোঙ্গার বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে দেবতা। সিং অর্থাৎ সূর্য হলো সাঁওতালদের আদি দেবতা। কোথাও কোথাও সূর্যকে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করা হয়। পাঁচ বা দশ বছর পরপর সিং বোঙ্গার পূজা হয়। এতে সাদা মোরগ বা পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। সাঁওতালদের সৃষ্টিতত্ত্বে রয়েছে, শূন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে হংসমিথুন। নিচে শুধু পানি আর পানি। কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। অনন্তকাল ধরে এরকম ঘুরতে ঘুরতে হংস মিথুন ক্লান্ত হয়ে পড়লো। তখন ‘ঠাকুর’ দয়াপরবশ হয়ে মারাং বুরুকে আদেশ দিলেন স্থলস্থান তৈরি করার। তৈরি হলো স্থলখন্ড। তৈরি হলো গাছপালা। হংসমিথুন আশ্রয় নিলো সেখানে। হংসী দু’টো ডিম প্রসব করলো। সেই ডিম থেকে জন্ম নিলো প্রথম মানব দম্পতি। পিলচু হড়ম্ আর পিলচু বুড়ি। তারা ক্রমে বড় হয়ে ওঠে। পালনকর্তা মারাং বুরু তাদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগাড় করে দিলেন। তিনি তাদের ঘাসের বীজ থেকে উত্তেজক পানীয় তৈরি করতে শেখালেন এবং সবার আগে পাতার ঠোঙ্গায় করে সেই পানীয় তার উদ্দেশ্যে নিবেদন করার আদেশ দিলেন। প্রথম মানব দম্পতি থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। তাই উৎসবে পানীয় পান স্বাভাবিক বলেই সাঁওতালরা আকণ্ঠ গলধাকরণ করে। সাঁওতালদের এই পরবে পুরোহিত যিনি, তাকে নানা নামে সম্বোধন করা হয়, সাঁওতালদের একটা অংশ ডাকে, ‘নায়কে’ অন্য অংশ ‘লায়া’ সম্বোধন করে। আবার মানভূম, সিংভূম অঞ্চলে লায়াকে পোহান, বাইসা পোহান এবং গোডেত নামে ডাকা হয়। লায়ার বা নায়কে শুধু মন্ত্র পুরোহিত নয়, পূজোর সব উপকরণ তাকেই সংগ্রহ করতে হয়। পল্লীবাসীর আর্থিক অনুদানে আয়োজিত হয় এই উৎসব। পূজার উপকরণের মধ্যে ফুল তো রয়েছেই, রয়েছে মাটির কলসী বা হাঁড়ি। যাকে এরা বলে সাগুন ঠিলি। কাপড়, চাল, নতুন তীর-ধনুক, আবির ইত্যাদিও রয়েছে। রয়েছে সাদা মোরগ। আর ঘরে স্বযত্নে তৈরি হাঁড়িয়া, সাঁওতালিদের উচ্চারণে তা ‘হ্যাঁড়া’। এই হ্যাঁড়া পান তাদের জীবনে ধর্মের সঙ্গে তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। এমন আকণ্ঠ পান তাদের আনন্দ উল্লাসেরই অংশ- এভাবেই তারা দেখে। এ নিয়ে কিংবদন্তিও রয়েছে। তাদের লোককাহিনীতে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে বিষয়টি। নারী-পুরুষের শারীরিক কামোন্মদনা তথা প্রণয় জাগাবার জন্যই এই হাঁড়িয়ার আবির্ভাব আদিকালেই। সাঁওতালি গ্রন্থ ‘বিস্তি’-তে এর কাহিনী রয়েছে। তাতে উল্লেখ আছে, সৃষ্টির আদিতে দুটি হাঁসের ডিম থেকে এক মানব আর এক মানবীর জন্ম হয়। ক্রমে তারা পরিণত এবং যৌবনপ্রাপ্ত হলে সৃষ্টিকর্তা মারাংবুরু তাদের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। নর-নারী যাতে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হয়ে সন্তান উৎপাদনে একাগ্র হতে পারে, সেজন্য মারাংবুরু স্বয়ং ঘাসের বীজ থেকে হাঁড়িয়া তৈরির পদ্ধতি তাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সাঁওতালদেরই অন্য এক কাহিনীতে রয়েছে যে, এক সত্যসন্ধ্যানী মর্তবাসী পূণ্যাত্মার তপস্যায় ভীত হয়ে, ভগবান তাকে পূণ্যফলচ্যূত করার জন্য এক অপদেবতাকে পাঠিয়ে দেন। অপদেবতাটি সাধু ব্যক্তির ছদ্মবেশে মর্তে এসে পূণ্যবানের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীকে হাঁড়িয়া আসক্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। বজলুর রহমান মদ্যাসক্তির যে কুফল আছে, সে বিষয়টি সম্পর্কে সাঁওতালিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে কিনা- এমনটাই জানার চেষ্টা করলেও শিক্ষক মাহাতো উদাহরণ টেনে হতাশ স্বরে বলেন, অরণ্যবাসী জীবনে মদ্যাসক্তি প্রাচীনতর। কিন্তু এই আসক্তি যে তাদের জন্য শতাব্দির পর শতাব্দি কোনো সুফল আনে নি তা এ যুগে অনেকে উপলব্ধি করছে। তাই উৎসব-পরব ছাড়া সাধারণ জীবনে হাঁড়িয়া পান হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি তিনি একথা বলতেও ভুললেন না যে, মদ যেখানে ধর্মের সঙ্গে মিশে আছে, যেখানে এটা পূজার উপকরণ, সেখানে আর ততোটা সচেতনতা তৈরির সুযোগ কোথায়! মদমুক্ত অরণ্য-পাহাড়ি জীবনে তো ভাবাই যায় না।

তবে অরুণ বাগচী এই সাত সকালেই কারফর্মার অনুরোধে এক গ্লাস হাঁড়িয়া সেবন করে, বসন্ত বাতাসে শিহরিত হতে থাকেন। আর তার জবান খুলে যায়। এই পরব এর আগে দু’বার দেখেছেন। উৎসব বর্ণনা তাই তার মুখেও। মূল উৎসব জমে উঠে দুপুরের পর। নায়েক বা লায়া পূজার উপকরণ নিয়ে সকালে পল্লীর একপ্রান্তে শালগাছের নিচে দেবস্থানে নিয়ে গেলেন। যাবার আগে পল্লী প্রধানের অনুমতি নিলেন। তার সঙ্গে আরো দু’জন সহকারি রয়েছে। তালেবে এলেম ধাঁচের। দেবস্থানেরও আলাদা নাম রয়েছে। এই পল্লীতে নাম ‘জাহের থান’। অন্য পল্লীতে ‘গরাম থান’ এবং পাহাড়ের ওপারের পল্লীতে এর নাম ‘সারণা’। এই দেবতার অধিষ্ঠান ক্ষেত্রস্বরূপ কয়েক ‘টোলা’ বা পাতার মধ্যে একটি সাধারণ জায়গা নির্দিষ্ট থাকে। এখানে আছে পাহাড়ের এক কোণে। লোকালয় থেকে একটু দূরেই। এখানে কোনো ঠাকুর বা দেবতার মূর্তি নেই। তবে একখন্ড পাথর রয়েছে। কালো গ্রানাইট। এই পল্লীর জাহের থানের শালগাছটিতে দু’টি ভাগ। ঠিক মাটির উপর থেকেই গাছটি সমান দু’ভাগ হয়ে গেছে। ‘লায়া’ এবং তার সহকারীরা আজ উপোস করবে। গতকাল নিরামিষ ভোজনের মাধ্যমে মনকে অনেকটা ‘শুচি’ করে নিয়েছে। পরবের দিন উপবাস পালন দিলেও হাঁড়িয়া পানে উপবাস বিঘ্ন হয় না। পুরোহিত ‘লায়া’ একাধিক দেবতার জন্য স্থান নির্দিষ্ট করেন সেই থানে। এরপর দুধ, তেল, সিঁদুর দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রার্থনা করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই পূজার্চনা। তারপর সহকারীসহ ফিরে যান নিজ গৃহে। লায়ার বাড়িতে পূজার প্রসাদ পাঠানো হয়। এই প্রসাদ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ শেষে মাটিতে শয্যা নিতে হয় সহকারীসহ। নৃত্যগীতবাদ্য থেকে বঞ্চিত থাকেন পুরোহিত। কিন্তু ঘুমানোর সুযোগ আর থাকে না। পল্লীর সব তরুণ-কিশোররা ‘নাগড়া’ তালে তালে রাতে হাজির হয় লায়া বা নায়কের বাড়িতে। ‘নাগড়া’ ঢোলেরই আরেক ছোট রূপ। সেই নাগড়া বাজিয়ে গাইতে থাকে গান। সে সব গানের বিষয় সাধারণত দেবতার কাছে নানারকম প্রার্থনা, নানা ভাবে ও ভাষায় দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানো। একটা গান গেয়ে শোনালেন, “কি ফুলে সেবা লায়া, কি ফুলে সেবা,/ শালই ফুল লায়া, সারুল সেবা।”

পূজার কিছু নিয়মনীতি, আচরণবিধি আছে। লায়াক পূজার আগে লালপাড়ের হলুদ রঙের কৌপীন পরে একটা ধুতিকে পাগড়ি বানিয়ে মাথায় দেয়। পরে পাগড়ির ধুতিটাকে থানের সামনে মাটির উপর নিজেই পেতে দেয়। এর উপর পল্লীর পুরুষরা চাল, ডাল, রবিশস্য, যব ইত্যাদি ঢেলে দেয়। বজলুর রহমান বর্ণনা শুনতে শুনতে বললেন, অরণ্যবাসী জীবনের প্রায় সকল আরাধনা অনুষ্ঠানই এখনো কৃষ্টির সঙ্গে জড়িত। কখনো কখনো রোগ মহামারীর দুষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করে বিদায় করার দুশ্চিন্তা দেখা দিতো। সেজন্য প্রাচীনকালে নরবলি দেওয়া হতো। কিন্তু এই মাংস যেহেতু খাওয়া যেতো না তাই পশু বলি দেয়ার প্রথা চালু হয়। যা আজো প্রচল। অরণ্যবাসী অনেক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীতে পরব এমনকি হোলীর প্রধান অঙ্গ ছিল কৃষি সমাজের পূজা এবং প্রচুর খাদ্য উৎপাদন কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাময় নৃত্যগীত উৎসব পালন। উনিশ শতকে এসে নরবলির স্থানে পশুবলি চালু হয়। আনন্দ বাগচী বোঝালেন, ধর্মপালনে নারী-পুরুষদের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। পুরোহিত বা লায়ার সহকারীদের স্ত্রীরা পূজানুষ্ঠানে অংশ নিতে পারলেও অন্য নারীদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই সহকারীদের স্ত্রীদেরও আচরণ বিধি পালন করতে হয়। এরা দেবস্থানের শুদ্ধিকরণের কাজ করে গোবরজল দিয়ে নিকিয়ে। পূজার আয়োজনকালেই সহকারীরা মাঝে মাঝেই সোমরস পান করে নিজেরা। আবার সমবেত প্রধান ব্যক্তিদেরও আপ্যায়ন করা হয়। ভক্তিভাবে তারা পান করে এই সোমরস। পূজাকালে দেবতা এবং পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে যেটি দেওয়া হয়, তা অবশ্যই সাদা রঙের মোরগ এবং আকারে তা বেশ বড় সড়ো। পাশাপাশি ধরিত্রীমাতা বা ‘ধত্রীমাঈ’-এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা মোরগের রঙ হচ্ছে কালো কিংবা ছাই রঙের। এটিকে কাটা হয় না। গলাটিপে শ্বাসরোধ করে মারা হয়। সব মোরগগুলোর পালক ছড়িয়ে ঝলসে নিয়ে হাঁড়িয়ার সঙ্গে পূজা চলাকালেই খাওয়া হয়। বলি হিসেবে মোরগ বেছে নেবার কারণটি বজলুর রহমান কৌতূহলের সঙ্গেই নিলেন। বললেন, হিন্দু ব্রাহ্মণদের কাছে মোরগ স্লেচ্ছদের ভক্ষ ও পোষ্য-সে মোরগ আদিবাসীদের ধর্মীয় ও উৎসব অনুষ্ঠানে ঠাঁই পেলো কেমন করে। কারফর্মা মৃদু হেসে বললেন, পশুপাখি প্রাণীদের আবার ধর্ম কিসের। আসলে মোরগ-মুরগি তো একটি পাখি মাত্র অরণ্যবাসীদের কাছে। যারা তাকে আয়ত্তে পেয়েছে, তারাই ওতপ্রোতভাবে একে দেহে মনে ধর্মে জড়িয়ে ধরেছে। আর খাদ্য হিসেবে এর সু-স্বাদকে কোন বিবেচক মানুষ অবহেলা করবে? সুপক্ব মোরগকে উপেক্ষা করা কোনো ধর্মীয় নীতি কখনোই হতে পারে না। মোরগ-মুরগি অরণ্যবাসীদের যে কোন পালাপার্বণে একটি আবশ্যিক প্রথা এখনো।

এখানকার মেয়েরা নৃত্যগীত শুরুর আগে ঘটি করে পানি নিয়ে নিজেদের ঘরে ঘরে দরজার সামনে অপেক্ষা করে। পূজার্চনা শেষে লায়া আসে, মেয়েরা তার পা ধুইয়ে দিয়ে প্রণাম করে। আশীর্বাদস্বরূপ লায়া তার হাতের কুলা থেকে তুলে দেন ‘সারজম’-শালফুলের থোকা। মেয়েরা ভক্তি ভরে আঁচলে পেতে তা গ্রহণ করে। সেই ফুল তারা গুঁজে নেয় নিজেদের খোঁপায়, কানে, বেঁধে নেয় বাহুতে। ফুলের উৎসবে স্বাস্থ্যবতী মেয়েদের অঙ্গজুড়ে ফুলসাজ এনে দেয় শারহুল পরবের আনন্দ। তাদের মনে হয়, তারা পৃথিবীতে বেঁচে আছে আনন্দে, মানুষের মত। জীবন কতো বড়, কিংবা জীবন কতটুকু -সে বিচার কেউই করে না। শুধু মনে হয় এই তো জীবন। আনন্দই জীবন। তখন তাদের গলায় গান আর পায়ে নাচ। এ সময়ে পরস্পরের মধ্যে পানি ছোঁড়াছুঁড়ি খেলাও চলে। হয়তো অন্য সমাজে অর্থাৎ হোলি খেলায় এটাই প্রলম্বিত হয়ে রঙ ছোড়াছুঁড়ি হয়েছে। ছেলে মেয়েরা মুখোমুখি। নাচ আর তাল, গান আর দেহ। মেশামেশি দু’টি সারি, অথচ পৃথক। কে আগে জুড়েছে তাল বোঝা দায়। কে আগে ধরেছে নাচ বোঝা দায়। যেন এক সুরে পৃথিবী প্রাচীন। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা, তবু ক্লান্তি নেই, হাসি হাসি মুখ।

শারহুল উৎসব প্রাঙ্গণে এইসব মৃদু প্রণয়ের কাব্য গুঞ্জরণের সঙ্গে সঙ্গে হাসি, নাচ আর মাদলের বাজনা এক স্বর্গীয় পরিবেশ ও আবেশ রচনা করেছে যেন। নৃত্যগীতরতদের হাতে লায়া আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন পবিত্র পানীয় হাঁড়িয়া। ভাত থেকে তৈরি এই পানীয় সাঁওতালদের প্রায় প্রতি ঘরেই তৈরি হয়। নিয়মিত আবার বিনোদনের সঙ্গী এই পানীয়। তবুও লায়া নিজে প্রদান করেন সেই পবিত্র পানীয় অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে। যাতে দেবতার আশীর্বাদ মিশে আছে বলে বিশ্বাস বোধ। লায়া নারী-পুরুষ সবাইকে পান করালেন। আমাদেরও আপ্যায়ন করা হলো।

ধীরে ধীরে সকলেরই রক্তে জেগে উঠছে নতুন এক তুফান। মাঝরাতে আদিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারের নিচে নীলজল যেমন উথালি-পাথালি শুরু করে তেমনি উম্মাদনা শুরু হবে বলে অরুণ বাগচী জানান। প্রত্যেকের শরীর দুলতে শুরু করবে। চোখের দৃষ্টি বদলে যাবে। রাতের আকাশে তখন গোলাকার চাঁদ সাদা দুধেল জোছনা ঢেলে দেবে। জোছনার বান ঢুকে পড়বে সাঁওতাল কুলহিতে। শাল, মহুয়া, পলাশের জঙ্গল, মাঠ প্রান্তর সব জাগিয়ে নিয়ে যাবে ধবধবে জোছনায়। অবিরাম বয়ে যাবে বাতাস। দক্ষিণ দিক থেকে বয়ে আসা এক রকম অদ্ভূত বাতাস, মানুষের বুকের রক্ত নাচিয়ে। বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসবে বাঁশির সুর। কখনো স্পষ্ট কখনো মিলিয়ে যাবে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। নেশায় আচ্ছন্ন তরুণ-তরুণীরা, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সকলেই নাচে মেতে উঠবে। নাচ আর নাচ। মনের দোলা, রক্তের দোলায়, দুলতে দুলতে শরীর দোলাতে শুরু করবে। মাদলের তাল সেই দুলুনিকে ছন্দে বেঁধে রূপ দেয় নৃত্যের। সৃষ্টি হবে মানুষের আর এক আদিম শিল্প নৃত্যকলার, মাদলের তাল যতো কাছাকাছি হবে। মাদলের তালে ভাঙ্গা-ওঠা শরীরের। শরীরে শরীর জড়িয়ে নারী ও পুরুষ উদোম নৃত্যে মেতে উঠবে। হাঁড়িয়া-মউল মাতাল গন্ধে ছড়াবে বুনো শরীরী স্পর্শ। আমাদের সেসব দৃশ্য দেখার আগেই চলে যেতে হবে। সন্ধ্যা নামছে। ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছে। নৃত্য পরব চলছে। অবিরাম বয়ে চলেছে মলয় সমীরণ। সেই বাতাসের ছোঁয়ায় শিহরিত হচ্ছে শরীর মন। মহুল ফুলের মাদকতা নাসারন্ধ্র ভেদ করে রক্তে টগবগ করছে। উদ্বেলিত হৃদয়। মহুল গন্ধ নারীর শরীরের ঘ্রাণে ভাসে। শরহুল উৎসবে বসন্তের এই মাতোয়ারা সন্ধ্যায় ‘হলুই লুবুই বিটি লাগি ছাড়ি আড়িল।’ যুবতী মেয়েটির জন্য যুবকরা বুক পেতে দেবে। হৃদয় উজার করে নিবিড় জড়াবে। নারীরা শরীর-মন ঢেলে উজার করবে নিজেকে।

মাদলের ঢংকা নিনাদ শুনতে শুনতে বসন্ত সন্ধ্যায় আবার আমরা ফিরে গেলাম শান্তি নিকেতন, পেছনে ফেলে সাঁওতালি পরবের উদ্বেলিত মনকাড়া মুহূর্তগুলো। বজলুর রহমান নিমগ্নতা ছেড়ে বললেন, অন্ধকার ফুঁড়ে পাহাড়ি অরণ্য পল্লীর আলোর মশালগুলো কেমন যেন আধিভৌতিক হয়ে উঠছে। বসন্ত এসেছে বুঝি অন্যতর আবাহনে।