ইজাজ আহ্মেদ মিলন
আমি পৃথিবীতে আসার তেত্রিশ বছর আগে দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমাদের নিজস্ব শব্দে অর্থাৎ বাংলা শব্দের প্রথম পত্রিকা দৈনিক সংবাদ-এর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি সেই শৈশবেই। পত্রিকার নামের মধ্য দিয়েই আধুনিক চিন্তার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। নামটাই আমাকে মূলত আকৃষ্ট করে। তবে সংবাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হওয়ার আগে আমি পরিচিত হয়েছিলাম ‘ভাইয়া’র সঙ্গে। তখনও ভাইয়া’র আসল নামটি আমার জানা হয়নি। আমার পূর্বপুরুষদের কেউই লেখক বা সাংবাদিক ছিলেন না, তারা পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তবে কেন যে শিশুকালেই আমার মস্তিষ্কের ভেতর লেখালেখির ব্যাধিটা বাসা বাধে সেটা আজও বোঝতে পারিনি। তবে এটুকু মনে আছে- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি আমাকে উস্কে দিয়েছিল- প্রভাবিত করেছিল। বলছিল ‘লেখো- তোমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না, লেখালেখিটাই হবে।’ ছোট্টবেলায় যখন প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি শুনি তখন হঠাৎ করেই হৃদয়ে ধাক্কা লাগে। প্রশ্ন জাগে এতো চমৎকার একটি গান কে লিখলেন? কীভাবে লিখলেন? ভাবলাম দেখি কিছু লিখতে পারি কি না। তখন তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আমি। খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম টেবিলে। লিখে ফেললাম একটা ছড়া। সেই যে শুরু। তারপর সমুদ্রের বহু জল গড়িয়ে গেছে। কণ্টকময় ও অমসৃণ পথের বাঁকে বাঁকে হেঁটেছি। ক্লান্ত হয়েছি কিন্তু থামিনি। দিনদিন স্বপ্ন প্রসারিত হয়েছে। নির্ভয়ে সেই স্বপ্ন দেখেছি যখন ভাইয়া’র জীবনী পাঠ করেছি। ক্রমশই অনুপ্রাণিত হয়েছি- উৎসাহিত হয়েছি।
হ্যাঁ, জনবান্ধব সাংবাদিকতার পথিকৃৎ দৈনিক সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমানই ছিলেন সেই ভাইয়া। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার আপসহীন বাতিঘর বজলুর রহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। সময়ের ব্যবধানে হয়তো সেটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ‘ভাইয়া’কে আমি চিনি-জানি। শিশু সংগঠন খেলাঘরের ভাইয়া ছিলেন বজলুর রহমান। পত্রিকা পাঠ শুরুর আগেই সংগঠনটি সম্পর্কে ধারণা হয়। ভাইয়া সম্পর্কেও। দৈনিক সংবাদে একসময় ‘খেলাঘর আসার’ নামে একটি পাতা বের হতো প্রতি বুধবার। ওই পাতার নিয়মিত পাঠক ছিলাম আমি। এরও আগে খেলাঘরের ভাইয়ার সম্পর্কে জানতাম। এই ভাইয়াই যে বজলুর রহমান সেটা জানি আরো পরে। অসংকোচ প্রকাশের সুতীব্র আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নই এই বজলুর রহমানকে গৌরবদীপ্ত করে তুলেছিল। মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা নিয়ে কাজ করার কারণেই দৈনিক সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমান সফলতার শৈলচূড়া স্পর্শ করেছিলেন।
খায়রুল কবিরের সম্পাদনায় নাসির উদ্দিন আহমদের ব্যবস্থাপনায় ১৯৫১ সালের ১৭ মে দৈনিক সংবাদ আত্মপ্রকাশ। খেলাঘরের জন্ম ১৯৫২ সালের ২ মে। এই দিন দৈনিক সংবাদ-এর সাপ্তাহিক শিশু সাহিত্যপাতা খেলাঘর নামে বের হয়। খেলাঘরকে ঘিরে একদল তরুণ লেখক ভিড় জামান। কবি হাবিবুর রহমান ছিলেন তখন খেলাঘরের ‘ভাইয়া’। ১৯৫২-৬০ সময়ে সাহিত্যচর্চা ছিল খেলাঘরের প্রধান কাজ। ১৯৬৪ সালে বজলুর রহমান খেলাঘরের ভাইয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর খেলাঘর সমাজভিত্তিক শিশু সংগঠনের রূপ রূপ নেয়। বাঙালি জাতীয়বাদ এবং শোষণমুক্ত সমাজ এই সময়ে খেলাঘরের মৌলিক চেতনা হয়ে ওঠে। ইতিহাস থেকে যতোদূর জানা যায়, এই সময়ে খেলাঘরের কান্ডারি ছিলেন বজলুর রহমান ও জিয়াউদ্দীন আহমদ। খেলাঘর শিশুর বিকাশ, শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণসহ সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ক্রীড়াক্ষেত্রে কাজ করতে থাকে। খেলাঘরের সেই ঢেউ এসে লাগে আমার ব্যক্তি জীবনেও। দৈনিক সংবাদে প্রতি বুধবার প্রকাশিত খেলাঘর আসর নামের পাতার নিয়মিত পাঠক ছিলাম আমি। এটা ২০০০ সালের দিকের ঘটনা।
১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের পতনের পর সংবাদের মালিকানা বদল হয়। পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন আহমদুল কবির এবং সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত হন জহুর হোসেন চৌধুরী। এ সময় সংবাদে যোগ দেন রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, তোয়াব খান, কামাল লোহানী, মোহাম্মদ ফরহাদ, আলী আকসাদ, বজলুর রহমানের মতো মেধাবী সাংবাদিকগণ। জন্মলগ্ন থেকে সংবাদ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দৈনিক সংবাদে জহুর হোসেন চৌধুরী লেখা শুরু করেন ‘দরবার-ই-জহুর’ শিরোনামে কলাম। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বরাবরই সংবাদ পত্রিকার প্রতি বিরূপ ছিল। দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সংবাদ একাত্ম ছিল এবং এর দপ্তরে বারবার পুলিশের আক্রমণ হয়েছে। আদর্শের জন্য সংবাদকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে ১৯৭১ সালের মার্চে। সংবাদের প্রেস, মেশিনপত্র, অফিস সবই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অগ্নিকান্ডে নিহত হন সাংবাদিক শহীদ সাবের। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সংবাদ প্রকাশিত হয় নি। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পুনরায় প্রকাশনা শুরু হয়। সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আহমদুল কবির। পরবর্তী সময়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন বজলুর রহমান। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করার পূর্ব পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর যোদ্ধা বজলুর রহমান সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে বজলুর রহমানকে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। তার মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধ সাংবাদিকতার জন্য ‘বজলুর রহমান স্মৃতিপদক’ নামে একটি পুরস্কার প্রবর্তন করে। মূল্যবান পুরস্কার। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুরস্কারটি সমাদৃত হয়। গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
বজলুর রহমানকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম একদিন। এরপর বহু সময় চলে গেছে। তার আদর্শ বুকে লালন করেছি খুব যত্ন করে। অবশেষে তাঁর নামে প্রবর্তিত ‘বজলুর রহমান স্মৃতিপদক’টাও আমার ঝুড়িতে এসে জমা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে ২০১৬ সালে এ পুরস্কার পাওয়ার পর আবার আমার কাছে প্রমাণিত হয়ছে- কেউ তার আদর্শ থেকে দূরে সরে না গেলে, সাধানায় কোনো ফাঁকিবাজি না করলে সফলতা আসবেই। ১৯৭১: বিস্মৃত সেই সব শহীদ শিরোনামে ২৩ পর্বের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য এ পুরস্কারটি দেওয়া হয় আমাকে।
জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কাটি তুলেন দেন। যাপিত জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে ওটা একটি মুহূর্ত। শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত। হল ভর্তি মানুষ। আমার স্বজনরাও আছেন। স্পিকারের হাত থেকে বর্ষসেরা সাংবাদিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বজলুর রহমান স্মৃতিপদক’ গ্রহণ করি। সেই সাথে এক লাখ টাকার চেক। পুরস্কারের চেক আমার হাতে তুলে দেওয়ার সময় মাননীয় স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বলছিলেন ‘অভিনন্দন, আরো ভালো করতে হবে।
যে আদর্শ বুকে ধারণ করে ৬৯ বছর আগে ঐতিহ্য ও অসাম্প্রদায়িক গৌরবের মুখপত্র দৈনিক সংবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, পত্রিকাটি তার আদর্শ আজো অক্ষুণ্ন রেখেছে। অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে সংবাদ আজ ৬৯-এ। অন্তহীন শুভ কামনা প্রাচীনতম দৈনিক সংবাদের জন্য।
বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯ , ২৬ আষাঢ় ১৪২৫, ৬ জ্বিলকদ ১৪৪০
ইজাজ আহ্মেদ মিলন
আমি পৃথিবীতে আসার তেত্রিশ বছর আগে দৈনিক সংবাদ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমাদের নিজস্ব শব্দে অর্থাৎ বাংলা শব্দের প্রথম পত্রিকা দৈনিক সংবাদ-এর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি সেই শৈশবেই। পত্রিকার নামের মধ্য দিয়েই আধুনিক চিন্তার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। নামটাই আমাকে মূলত আকৃষ্ট করে। তবে সংবাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হওয়ার আগে আমি পরিচিত হয়েছিলাম ‘ভাইয়া’র সঙ্গে। তখনও ভাইয়া’র আসল নামটি আমার জানা হয়নি। আমার পূর্বপুরুষদের কেউই লেখক বা সাংবাদিক ছিলেন না, তারা পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তবে কেন যে শিশুকালেই আমার মস্তিষ্কের ভেতর লেখালেখির ব্যাধিটা বাসা বাধে সেটা আজও বোঝতে পারিনি। তবে এটুকু মনে আছে- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি আমাকে উস্কে দিয়েছিল- প্রভাবিত করেছিল। বলছিল ‘লেখো- তোমাকে দিয়ে আর কিছু হবে না, লেখালেখিটাই হবে।’ ছোট্টবেলায় যখন প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি গানটি শুনি তখন হঠাৎ করেই হৃদয়ে ধাক্কা লাগে। প্রশ্ন জাগে এতো চমৎকার একটি গান কে লিখলেন? কীভাবে লিখলেন? ভাবলাম দেখি কিছু লিখতে পারি কি না। তখন তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আমি। খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম টেবিলে। লিখে ফেললাম একটা ছড়া। সেই যে শুরু। তারপর সমুদ্রের বহু জল গড়িয়ে গেছে। কণ্টকময় ও অমসৃণ পথের বাঁকে বাঁকে হেঁটেছি। ক্লান্ত হয়েছি কিন্তু থামিনি। দিনদিন স্বপ্ন প্রসারিত হয়েছে। নির্ভয়ে সেই স্বপ্ন দেখেছি যখন ভাইয়া’র জীবনী পাঠ করেছি। ক্রমশই অনুপ্রাণিত হয়েছি- উৎসাহিত হয়েছি।
হ্যাঁ, জনবান্ধব সাংবাদিকতার পথিকৃৎ দৈনিক সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমানই ছিলেন সেই ভাইয়া। অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার আপসহীন বাতিঘর বজলুর রহমানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। সময়ের ব্যবধানে হয়তো সেটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ‘ভাইয়া’কে আমি চিনি-জানি। শিশু সংগঠন খেলাঘরের ভাইয়া ছিলেন বজলুর রহমান। পত্রিকা পাঠ শুরুর আগেই সংগঠনটি সম্পর্কে ধারণা হয়। ভাইয়া সম্পর্কেও। দৈনিক সংবাদে একসময় ‘খেলাঘর আসার’ নামে একটি পাতা বের হতো প্রতি বুধবার। ওই পাতার নিয়মিত পাঠক ছিলাম আমি। এরও আগে খেলাঘরের ভাইয়ার সম্পর্কে জানতাম। এই ভাইয়াই যে বজলুর রহমান সেটা জানি আরো পরে। অসংকোচ প্রকাশের সুতীব্র আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নই এই বজলুর রহমানকে গৌরবদীপ্ত করে তুলেছিল। মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা নিয়ে কাজ করার কারণেই দৈনিক সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমান সফলতার শৈলচূড়া স্পর্শ করেছিলেন।
খায়রুল কবিরের সম্পাদনায় নাসির উদ্দিন আহমদের ব্যবস্থাপনায় ১৯৫১ সালের ১৭ মে দৈনিক সংবাদ আত্মপ্রকাশ। খেলাঘরের জন্ম ১৯৫২ সালের ২ মে। এই দিন দৈনিক সংবাদ-এর সাপ্তাহিক শিশু সাহিত্যপাতা খেলাঘর নামে বের হয়। খেলাঘরকে ঘিরে একদল তরুণ লেখক ভিড় জামান। কবি হাবিবুর রহমান ছিলেন তখন খেলাঘরের ‘ভাইয়া’। ১৯৫২-৬০ সময়ে সাহিত্যচর্চা ছিল খেলাঘরের প্রধান কাজ। ১৯৬৪ সালে বজলুর রহমান খেলাঘরের ভাইয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর খেলাঘর সমাজভিত্তিক শিশু সংগঠনের রূপ রূপ নেয়। বাঙালি জাতীয়বাদ এবং শোষণমুক্ত সমাজ এই সময়ে খেলাঘরের মৌলিক চেতনা হয়ে ওঠে। ইতিহাস থেকে যতোদূর জানা যায়, এই সময়ে খেলাঘরের কান্ডারি ছিলেন বজলুর রহমান ও জিয়াউদ্দীন আহমদ। খেলাঘর শিশুর বিকাশ, শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণসহ সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও ক্রীড়াক্ষেত্রে কাজ করতে থাকে। খেলাঘরের সেই ঢেউ এসে লাগে আমার ব্যক্তি জীবনেও। দৈনিক সংবাদে প্রতি বুধবার প্রকাশিত খেলাঘর আসর নামের পাতার নিয়মিত পাঠক ছিলাম আমি। এটা ২০০০ সালের দিকের ঘটনা।
১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের পতনের পর সংবাদের মালিকানা বদল হয়। পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন আহমদুল কবির এবং সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত হন জহুর হোসেন চৌধুরী। এ সময় সংবাদে যোগ দেন রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, তোয়াব খান, কামাল লোহানী, মোহাম্মদ ফরহাদ, আলী আকসাদ, বজলুর রহমানের মতো মেধাবী সাংবাদিকগণ। জন্মলগ্ন থেকে সংবাদ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর দৈনিক সংবাদে জহুর হোসেন চৌধুরী লেখা শুরু করেন ‘দরবার-ই-জহুর’ শিরোনামে কলাম। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বরাবরই সংবাদ পত্রিকার প্রতি বিরূপ ছিল। দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সংবাদ একাত্ম ছিল এবং এর দপ্তরে বারবার পুলিশের আক্রমণ হয়েছে। আদর্শের জন্য সংবাদকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে ১৯৭১ সালের মার্চে। সংবাদের প্রেস, মেশিনপত্র, অফিস সবই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অগ্নিকান্ডে নিহত হন সাংবাদিক শহীদ সাবের। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সংবাদ প্রকাশিত হয় নি। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পুনরায় প্রকাশনা শুরু হয়। সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আহমদুল কবির। পরবর্তী সময়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন বজলুর রহমান। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করার পূর্ব পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর যোদ্ধা বজলুর রহমান সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে বজলুর রহমানকে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়। তার মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধ সাংবাদিকতার জন্য ‘বজলুর রহমান স্মৃতিপদক’ নামে একটি পুরস্কার প্রবর্তন করে। মূল্যবান পুরস্কার। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পুরস্কারটি সমাদৃত হয়। গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
বজলুর রহমানকে পাঠ করার মধ্য দিয়ে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম একদিন। এরপর বহু সময় চলে গেছে। তার আদর্শ বুকে লালন করেছি খুব যত্ন করে। অবশেষে তাঁর নামে প্রবর্তিত ‘বজলুর রহমান স্মৃতিপদক’টাও আমার ঝুড়িতে এসে জমা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে ২০১৬ সালে এ পুরস্কার পাওয়ার পর আবার আমার কাছে প্রমাণিত হয়ছে- কেউ তার আদর্শ থেকে দূরে সরে না গেলে, সাধানায় কোনো ফাঁকিবাজি না করলে সফলতা আসবেই। ১৯৭১: বিস্মৃত সেই সব শহীদ শিরোনামে ২৩ পর্বের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য এ পুরস্কারটি দেওয়া হয় আমাকে।
জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কাটি তুলেন দেন। যাপিত জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে ওটা একটি মুহূর্ত। শ্রেষ্ঠতম মুহূর্ত। হল ভর্তি মানুষ। আমার স্বজনরাও আছেন। স্পিকারের হাত থেকে বর্ষসেরা সাংবাদিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাংবাদিকতার জন্য দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বজলুর রহমান স্মৃতিপদক’ গ্রহণ করি। সেই সাথে এক লাখ টাকার চেক। পুরস্কারের চেক আমার হাতে তুলে দেওয়ার সময় মাননীয় স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বলছিলেন ‘অভিনন্দন, আরো ভালো করতে হবে।
যে আদর্শ বুকে ধারণ করে ৬৯ বছর আগে ঐতিহ্য ও অসাম্প্রদায়িক গৌরবের মুখপত্র দৈনিক সংবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, পত্রিকাটি তার আদর্শ আজো অক্ষুণ্ন রেখেছে। অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে সংবাদ আজ ৬৯-এ। অন্তহীন শুভ কামনা প্রাচীনতম দৈনিক সংবাদের জন্য।